Monday 4 May 2020

আমূল পরিবর্তনের দোরগোড়ায়


বদলে যাচ্ছে সব কিছু
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

কোভিড১৯ আমাদের এক আমূল পরিবর্তনের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আগামী ছ’ মাস থেকে এক বছরে এই পরিবর্তনগুলি আরও স্পষ্টতর হবে। তার আগে, চোখের সামনে এখন ছায়া ছায়া রূপ ধরে সে সব ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।

প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল, কোভিড১৯ প্রকৃতির তরফে মানুষের ওপর এক অপ্রত্যাশিত ও দুর্মর আঘাত। এরজন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। উপরন্তু, এ বিষয়ে তেমন কোনও আগাম জোরালো আভাসও পাওয়া যায়নি। তবে এই সতর্কতাগুলো ছিল, যে লোভী একদল মানুষের দাপটে জল-জঙ্গল-জমি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে ও সকল প্রজাতির জন্য প্রকৃতির যে ব্যবস্থাপনা তা তুমুল ভাবে ধ্বস্ত হচ্ছে। সেই সুবাদে খুব স্বাভাবিক ছিল প্রকৃতি একদিন প্রত্যাঘাত করবে। কিন্তু তা যে এমন বিশ্বব্যাপী ও সর্বত্রগামী এক আপাত স্থায়ী মহামারি রূপে আসবে তা কেউ বিন্দুমাত্র আন্দাজ করতে পারেনি। কথায় আছে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে।

অসহায় মানুষের আপাতত কিছু করার নেই। ‘বাঘের ভয়ে সন্ধ্যা’ এখন ২৪-ঘন্টা। ঘরবন্দী মানুষ পড়েছেন উভয় সংকটে। ঘর থেকে বেরলে কোভিড১৯’এর ত্রাস, ঘরে থাকলে পেটে টান। নীতিকারেরা, রাজনৈতিক নেতারা, বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসকেরা এবং নানাবিধ পণ্ডিতেরা সকলেই এখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ও সন্ত্রস্ত। ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা যখন তুঙ্গে তখনই আবার শোনা যাচ্ছে কোভিড১৯ তার রূপ বদলাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, ‘আবার সে আসিবে ফিরিয়া’। ওদিকে ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে মানুষের মৃত্যু মিছিল। তাদের উন্নত ও আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। আইএলও ঘোষণা দিয়েছে, বিশ্বের অর্ধেক লোকের হাতে আর কাজ থাকবে না। এই কর্মহীনতার রাহুকে আগামী বিশ্ব কীভাবে মোকাবিলা করে তাই এখন দেখার ও বোঝার। ইতিমধ্যেই মানুষের যাপনরীতি বদলে গেছে অনেকটাই।

এই উভয় সংকট থেকে পরিত্রাণ কীভাবে? আমেরিকায় এক শ্রেণির মানুষ পথে নেমে বলছেন, লকডাউন তুলে নাও, আমরা কাজে যাব। অপরপক্ষ জোর সওয়াল করছে, লকডাউন তুলে নিলে মহামারি আরও মারাত্মক আকার নেবে। তথ্যগুলিও সব আঁকাবাঁকা, ভুলভুলাইয়া। একটি তথ্যে পাচ্ছি, ভারতে প্রতি বছর ২.৫ কোটি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন যার মধ্যে ৪,৪০,০০০ জন মারা যান। হু জানাচ্ছে, ভারতে প্রতি বছর ম্যালেরিয়া আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১.৫ কোটি যার মধ্যে মারা যান ২০,০০০। এদিকে ৩ মে ২০২০ অবধি প্রকাশিত তথ্যে, এ দেশে কোভিড১৯ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪২,৫৪৬ যার মধ্যে মারা গেছেন ১৩৯১ জন (৩.২৬ শতাংশ)। গোটা বছরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কোটিতে পৌঁছবে কিনা বলা দুষ্কর কিন্তু মৃত্যুহার যদি ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যেও থাকে তাহলে তা কিন্তু যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুকে ছাপিয়ে যেতে পারে।

এরই মধ্যে কিছুটা আশ্চর্যের হলেও বাস্তব হল, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনে মোট কোভিড১৯ আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যুর শতকরা হার কিন্তু যথাক্রমে ১৫.৭, ১৫.৪, ১৪.৭, ১৩.৬ ও ১১.৫ (জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, ২ মে ২০২০)। এই অধিক মৃত্যুহার অবশ্যই দুশ্চিন্তার, তদুপরি, গবেষণারও বিষয়। এমতাবস্থায় লকডাউন তুলে দিলে (সীমিত পরিসরে হলেও) তা মৃত্যুর হারকে বাড়িয়ে তুলবে কিনা এ কথা কেউ হলফ করে বলতে পারছে না। অন্যদিকে ভারতের মতো দেশগুলির ক্ষেত্রে যেখানে তুলনামূলক ভাবে মৃত্যুহার কম সেখানে লকডাউন তুলে নিলে তা আখেরে সার্বিক অর্থে কাজে দেবে কিনা (নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়াবে কিনা) সেও নিশ্চিত করে বলার মতো নয়।

গত পাঁচ দিনে ভারতের কোভিড১৯ পরিসংখ্যান যদি নজর করা যায় তবে তা কিন্তু বেশ দুশ্চিন্তার কারণ। গত ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে- এই পাঁচ দিনে দেখা যাচ্ছে, এ দেশে দৈনন্দিন কোভিড১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে: ১৭০৫, ১৮০১, ২৩৯৬, ২৫৬৭ ও ২৭১৭। পাশাপাশি দৈনন্দিন মৃত্যুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে (যদিও মৃত্যুহার গড়ে ৩.২৬ শতাংশের আশেপাশেই আছে) যথাক্রমে: ৭১, ৭৫, ৭৭, ৯২ ও ৬৮। (সূত্র: www.covid19india.org)। অর্থাৎ, দেশ–বিদেশ মিলিয়ে সমস্ত ঘটনাবলীই এক বিভ্রান্তিকর, পরস্পর-বিরোধী ও নানাবিধ সম্ভাবনার জাঁতাকলে বিদ্ধ। অসহায়ত্ব ও কতকটা নিয়তির কাছে বাঁধা পড়ে যাওয়া এই পরিস্থিতি পোক্ত করছে আগামী দিনে পরিবর্তনের বনিয়াদ। যে পরিবর্তন হয়ে উঠছে অবধারিত।

সে পরিবর্তনের রূপগুলি কেমন ও কীভাবে তা প্রভাবিত করবে আগামী চলার পথ?  

প্রথমত, এটা স্বীকার করে নেওয়া ভাল, সামাজিক দূরত্বের যে বিধি চালু হয়েছে তা আগামী কয়েক বছরে হয়তো সাধারণ নিয়ম ও কার্যপ্রণালীতে পরিণতি পাবে। কারণ, এই বিশ্বাস দৃঢ়তর হচ্ছে যে কোভিড১৯ নির্মূল হওয়ার নয়, একে নিয়েই ভবিষ্যতের মনুষ্য-যাপন কতকটা অবধারিত। ফলত, ঘর থেকে কাজ করার রীতিই ক্রমশ কাজের প্রধান আঙ্গিক হয়ে উঠবে যা বহুল পরিমাণে চালু কাজের রীতিগুলিকে অকেজো করে দেবে। যেমন, দোকানে গিয়ে জিনিসপত্র কেনা, বাসে-ট্রেনে নিত্য চলাচল, রেস্তোরাঁয় খাওয়া, ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক জমায়েত, মাঠে বা হলে গিয়ে খেলা বা চলচ্চিত্র দেখা ইত্যাকার বহু কিছুতে মানুষ ধীরে ধীরে অনভ্যস্ত হয়ে উঠবে যার ফলে এইসব ক্ষেত্রগুলি হয়তো কমবেশি শুকিয়ে আসবে।

দ্বিতীয়ত, ভোগ্যবস্তুর চাহিদা বহুল পরিমাণে কমে যাবে। এর কারণ দুটি। এক, বহু লোকের চাকরি চলে যাওয়া ও মাইনে বন্ধ হওয়ায় সাধারণ ভাবে চাহিদার স্তর অনেক নিচে নেমে আসবে। দুই, বেশি বেশি পরিমাণে ও অধিক সময় জুড়ে ঘরবন্দী মানুষের চিরাচরিত ভোগ্যবস্তুগুলির প্রতি মায়ামোহও কমবে। যেমন, জামাকাপড়, জুতো, সাজগোজের সরঞ্জাম, গাড়ি, পেট্রোল এইসবের চাহিদা বহুল পরিমাণে কমে যাওয়ার কথা। ভারতীয় ক্রেতাদের ওপর ম্যাকেনজি কৃত সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের ফলে ৫৪ শতাংশ মানুষ আয় খুইয়েছেন ও ৬৭ শতাংশ মানুষ তাঁদের নিত্য খরচাদি কমিয়েছেন। মুদি, গৃহস্থালী সরঞ্জাম ও হোম এনটারটেনমেন্ট- এ বাদে অন্যান্য ক্ষেত্রে খরচ বহুল পরিমাণে কমে এসেছে।  

তৃতীয়ত, সামাজিক দূরত্বের বিধি ও ঘরবন্দীত্ব খুব স্বভাবিক ভাবেই মানুষকে অনেক বেশি ডিজিটাল ও ভার্চুয়াল করে তুলবে। এই প্রবণতা তাকে হয়তো ক্রিপ্টোকারেন্সিতেও অভ্যস্ত করে তুলবে যেখানে ডিজিটাল লেনদেন ও মুদ্রা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের মুখ্য কাণ্ডারী।

চতুর্থত, কোভিড১৯ সর্বপরিসরে মানুষের মধ্যে এক ভয় ও আশঙ্কার পরিবেশ তৈরি করেছে। এই ভয় নানাবিধ, নানা মাত্রিক। এই ভয় থেকে মানুষ নিজেকে আরও গুটিয়ে নিচ্ছে, নিজের রোগবিরোগকেও গোপন করতে চাইছে, খুব বেশি বিপদে না পড়লে এড়াতে চাইছে হাসপাতাল ও ডাক্তারের চেম্বার। এর ফলে আখেরে কী হবে, যেমন iatrogenic disease (চিকিৎসা জনিত কারণে রোগ) কমে আসবে কিনা, তা এই মুহূর্তে বলা অসম্ভব। তবে এ তো দেখাই যাচ্ছে, কোভিড১৯-এর আতঙ্কে মানুষের অন্যান্য রোগব্যাধির প্রকোপ যেন কতকটা স্তিমিত। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মৌলিক উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা নিয়ে জীব বিজ্ঞানী ব্রুস লিপটন, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ মনু কোঠারী ও কার্ডিওলজিস্ট বি এম হেগড়ে বহুদিন ধরে নানাবিধ সংশয় প্রকাশ করেছেন। আজকের এই দুঃসময় বোধহয় সেদিক পানে মানুষের দৃষ্টিকে প্রসারিত করবে।

পঞ্চমত, জমায়েতের বিপদ অথবা বহুজনের একসঙ্গে থাকার রীতি সেনাবাহিনীর ব্যারাককেও করে তুলছে বিপদগ্রস্ত। ইতিমধ্যেই দিল্লিতে সিআরপি’র একটি ব্যারাকে শতাধিক জওয়ানের কোভিড১৯ পজিটিভ এসেছে। এই প্রবণতা খুব স্বাভাবিক। তাহলে কি সেনাবাহিনীর একসঙ্গে থাকার রেওয়াজেও বদল আসবে? যুদ্ধবিগ্রহের প্রাথমিক শর্তও কি তবে অস্বীকার হতে চলেছে? যুদ্ধ কি তাহলে ক্রমেই অবাস্তব এক রূপকল্প হয়ে দাঁড়াবে? এর থেকে সুখকর প্রস্তাব আর কী হতে পারে! যদি তাই হয়, তবে মনুষ্য ভবিষ্যতের এক যুগান্তকারী অধ্যায়ে আমরা প্রবেশ করব।

ষষ্ঠত, কৃষি, খনি উত্তোলন, পরিবহন, নির্মাণ, ম্যানুফ্যাকচারিং ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলিতে, ক্ষুদ্র-বৃহৎ শিল্প মিলিয়ে, কাজ চলবে তো বটেই কিন্তু তার ব্যাপ্তি ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসবে। এই ক্ষেত্রগুলির অপরিহার্যতা আরও বেশি যান্ত্রিকীকরণের দিকে তাদের ঠেলবে কিন্তু পুঁজি এখান থেকে অনেকটাই সরে যেতে থাকবে ভার্চুয়াল জগতে। কারণ, কাজের রীতি, মুনাফার হার ও চাহিদার আতিশয্যে ডিজিটাল ও ভার্চুয়াল জগতেরই যে এখন রমরমা। আর তাকে আরও শাণিত করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপ্রতিরোধ্য মেধা ও কারুকৌশল।

সবটা মিলিয়ে আমরা এক আমূল পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে চলেছি। এই নতুন পরিসরে চিরাচরিত রাজনীতিবিদ, অর্থনীতির পণ্ডিত বা সমাজতাত্ত্বিকেরা খুব ভ্যাবাচ্যাকা খাবেন কিন্তু তার কন্দরেই এক নতুন প্রাসঙ্গিকতা, দর্শন ও তার ক্রিটিক ঘাপটি মেরে বসে আছে। সেইটেকে অবলোকন করাই এখন প্রধান কর্তব্যকর্ম। আর তার ওপরেই নির্মিত হবে নতুন রাজনৈতিক দর্শন বা রাজনৈতিক-অর্থনীতির নতুন ভাবনা-অনুশীলন।   

1 comment:

  1. Khub logical analysis. Manuser porer lorai hoyto multinational companies gulor sathe hote choleche. There will may be huge deformations in many sectors of our social, political, economic life.

    ReplyDelete