Wednesday 6 May 2020

যুদ্ধ চলছে

এক প্রকাণ্ড ভয়ের সামনে নতজানু
প্রবুদ্ধ বাগচী
গত প্রায় দেড় মাস এমন একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমাদের সবাইকে চলতে হচ্ছে যা আমরা কখনও ভাবিনি বা আমাদের ফেলে আসা ইতিহাসের ভিতর খুঁজে পাইনি। একেবারে আনকোরা এক অবস্থা। আমাদের মন ও মনন ক্রমশ অসাড় হয়ে ওঠার পক্ষে এ এক বাধ্যতামূলক অবরোধ। শোনা যায়, আমরা নাকি একটা যুদ্ধ লড়ছি; কেমন সে যুদ্ধ আমাদের সে বিষয়ে কোনও সামান্যতম ধারণা নেই। আমরা প্রায় সকলেই যেন একরকম দৃষ্টিহীন ধৃতরাষ্ট্র- মিডিয়া ও নানা সমাজমাধ্যম সঞ্জয়ের ভূমিকায় থেকে আমাদের একটা আবছা ধারাবিবরণী শুনিয়ে চলেছে নিজেদের মতো করে, সেই বিবরণীর ওপর আমাদের যেমন কোনও হাত নেই তেমনি কোনও উপায় নেই যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সরেজমিনে তা যাচাই করে দেখার। কারণ, নিজেদের গৃহের ঘেরাটোপে বসে থাকাই আমাদের যুদ্ধকে অতিক্রম ও পরাজিত করবার একমাত্র উপায় বলে বিবেচিত হচ্ছে আজ, সাধারণভাবে এর ব্যত্যয় হওয়ার কারণ নেই।

কিন্তু যুদ্ধ আর তার অস্পষ্ট বিবরণী আসলে যেটা তৈরি করে তা হল সংশয়, সংশয় এবং সংশয়। বলতে অসুবিধে নেই, আমরা আজ প্রত্যেকেই কমবেশি তার শিকার। তাই আমাদের মনের ভিতর যে অসংখ্য প্রশ্নের অবিরত স্ফুরণ, তার নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা যত কমে আসছে আমরা চক্রবৎ আরও প্রশ্নের সংক্রমণে পড়ে যাচ্ছি। এই সংক্রমণ রোগের প্রকোপের থেকে কিছুমাত্র কম নয়। কারণ, কোনও নিভৃতবাস এই আক্রমণের ধারকে ভোঁতা করতে পারে না বরং বিপরীতে ক্রমশ আমাদের মন আতঙ্কে নীল হয়ে আসে, অবসাদে শ্রান্ত হয়ে পড়ে- যে কোনও সৃজনের প্রয়াসকে তা গোড়াতেই গলা টিপে মেরে ফেলে। গভীর অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে যদি একটুও আলোর ইশারা না মেলে, প্রতিদিন চারদিক থেকে কেবলই মৃত্যুর সঙ্কেত স্ফীত করে তোলে পরিসংখ্যান, তখন আস্তে আস্তে বিবশ হয়ে আসে মন, শ্লথ হয়ে আসে হাতের কলম, জট পাকিয়ে পাকিয়ে  থেমে যায় ভাবনার সূত্র। তাই, কীই বা লিখতে পারি আমি? আদৌ পারব কী?

যেহেতু অখণ্ড অবসর তাই প্রচুর প্রচুর মানুষ তাঁদের ভাবনা লিপিবদ্ধ করে চলেছেন নিয়ত। সংবাদপত্র তো আছেই, সেই সঙ্গে নানা সামাজিক মাধ্যম, আন্তর্জালের নানা পত্রিকা, ব্লগ- সকলেই কিছু কিছু করে বলছেন নিজের মতো, আন্তরিকভাবে। এই বিপুল তথ্যের কিছু তো অংশত চোখে পড়ছে আমারও, নানা তথ্যে সমৃদ্ধ হচ্ছি, ভয় পাচ্ছি, দুশ্চিন্তার আবর্তে পাক খাচ্ছি। এত এত পড়ে জেনে আবারও থমকে আসছে সব কিছু- তবে কি এই লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত ফ্রন্টে? একদিন কি এই যুদ্ধ এসে দাঁড়াবে আমারই এই ছোট ফ্ল্যাটবাড়ির চৌকাঠে? সেদিন আমি তবে কী নিয়ে প্রতিহত করব তাকে? এইসব ভাবনা অণুভাবনায় আচ্ছন্ন আর গ্রস্ত হয়ে থাকছে মনের উঠোন।

তাহলে কি গৃহবন্দিত্ব মানে এমন একটা ব্যবস্থার কথাই ভাবব যেখানে শুধু ন্যূনতম প্রয়োজনের পরিধিটুকু বাদ দিয়ে আর কোথাও তাকাব না আমরা? খাওয়ার পরে শোওয়া আবার শোওয়ার পরে খাওয়ার এক অলাতচক্র- এক নির্জীব বেঁচে থাকার পরিপাটি আয়োজন- আলোহীন, মননহীন, স্যাঁতস্যাতে- প্রায় অনেকটা জীবাণু বৃদ্ধির অনুকূল প্রতিবেশের মতো ফলবান। কিন্তু যুদ্ধটা চলবেই। আমরা তার হয়তো কিছুটা টের পাব, অনেকটাই পাব না। ওই না-পাওয়াটুকুর আড়াল দিয়ে এমন সব ঘটনা ঘটে যেতে থাকবে যা ইতিহাসের অনেক বাঁক বদলে দেবে হয়তো- মানুষকে তার সমাজ, পরিবেশ, বহমান জীবনযাপন থেকে এইভাবে টেনে-হিঁচড়ে ঘরের অন্ধকারে লেপটে ফেলে যে সব নতুন ইতিহাস লেখা হবে তার সঙ্গে কি সত্যি কোনও যোগ থাকবে মানুষের? একটি জীবাণু যে মানব সভ্যতার একরকম বিভাজিকা হয়ে উঠতে পারে, মাত্র চার-পাঁচ মাস আগেও যখন নতুন বছরের আগমন নিয়ে প্রথাগত হুল্লোড়ে মেতেছিলাম, তখন কি একবারের জন্যও এমন ভাবতে পেরেছিলাম আমরা? কী আশ্চর্য, আজ সেই উচ্ছলতাকে প্রকাণ্ড নির্বুদ্ধিতা বলে মনে হয় আমাদের! মনে হয় নিপুণ পরিহাস!

তবু যুদ্ধ চলছে। গোটা পৃথিবী জুড়েই যুদ্ধ। আমরা সবাই মিত্রপক্ষে, শত্রু এক অজানা অস্তিত্ব- জীব ও জড়ের মাঝখানে বলে তাকে আমরা বইয়ের পাতায় লিখে রেখেছি। আমাদের চোখের ওপর যে মানচিত্র বিছিয়ে ধরা হয়েছে তাতে যুদ্ধের এই অংশটা খুব স্পষ্ট। গোটা যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে লাল-নীল-সবুজের ওঠাপড়া যা নাকি কেবলই পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে আর তৈরি হয়ে উঠছে নানা নতুন নতুন অনুশাসন, রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান। আমরা যুদ্ধ মাখছি, যুদ্ধ খাচ্ছি, যুদ্ধ নিয়ে শুতে যাচ্ছি, আবার যুদ্ধের মধ্যেই জেগে উঠছি, চোখ কচলিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছি অপার শূন্যতা- আপাতত এই শূন্যতাই আমাদের আইন, আমাদের অভীষ্ট- দূরত্বই আমাদের শক্তি, বিচ্ছিন্নতা আমাদের আয়ুধ।

গ্রিক নাটকে কোরাসের একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকত। পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধেই দুটো পক্ষ থাকতে হয়, নইলে যুদ্ধ পাকিয়ে তোলা যায় না। এই দুই যুধ্যমান বিপরীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই কোরাস দল আলো ফেলত অন্যদিকে, যেদিকে সচরাচর আলোর ভাগ অল্প। মহাভারতের মহাযুদ্ধ শুরুর আগে এমন এক কোরাসের কথা বুদ্ধদেব বসু ফুটিয়েছিলেন তার ‘প্রথম পার্থ’ কাব্যনাট্যে। কী বলছিলেন তাঁরা? সেই বৃদ্ধ দল? বলছিলেন, এই ক্ষত্রিয়-বিরোধে কী কতটুকু যায় আসে সাধারণের! প্রবল একটা ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়ে এই উচ্চারণ ছিল হয়তো বা এক ব্যর্থ পরিতাপ, তখন আর কী করতে পারেন তাঁরা- কী শোনাতে পারেন বিপুল ক্ষয়ের আয়োজকদের?

আমরাও আজ সেই নিরুপায় অস্তিত্বের বল্কল গায়ে জড়িয়ে নিয়েছি। যুদ্ধ চলছে। কিন্তু সেই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান যে বড় একপেশে। শুধু রোগে মৃত্যুর সংখ্যায়ন নিয়ে আমাদের দায় শেষ হয়ে যায়। যে যুদ্ধ চলছে বিপন্ন ত্রাণশিবিরে, পরিযায়ী শ্রমিকদের অস্থায়ী ক্যাম্পে, সাধারণ, একেবারে প্রান্তীয় মানুষের প্রতিদিনের সংসারে, ব্যক্তি মানুষের বিষাদে অবসন্ন হয়ে আসা মনে, আটপৌরে আমাদের চেতনায়– তা কি আদৌ কোনও সংখ্যায় মেপে ফেলা যায়? এক প্রকাণ্ড ভয়ের সামনে যেভাবে আজ নতজানু হয়ে আছে আমাদের সমাজ-অর্থনীতি-জীবন- যেভাবে ‘প্রতি মুহূর্তের কণ্ঠ ছিঁড়ে নেয় অন্ধকারে পর্বতকন্দরে মহাকাল’, যেভাবে ‘কারণবিহীন এক মহাপরিণাম ভেসে চলে যায় গভীর সাগরে’- এর মধ্যে, এই সব কিছুর মধ্যে দাঁড়িয়ে কি আদৌ কোনও লেখনীকে শাণিত করা যায়? জানি না। জানি না, আজ নয় কাল, নয় পরশু, যেদিন সত্যিই অতিমারি থেমে যাবে নিজের নিয়মে, যেমন গিয়েছে এতকাল- কিন্তু এক ভিন্নতর যুদ্ধ পায়ে পায়ে এগিয়ে আসবে আমাদের সকলের দোরগোড়ায়, সজোরে কড়া নাড়বে দরজায়- সেদিন কি আমরা গৃহবন্দিত্বের ফিকিরে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারব পরাজয়ের প্রান্তে?

এইসব প্রশ্নেই আতুর হয়ে আছি।

2 comments:

  1. Khub mononshil ebong porinoto lekha.bhalo laglo.

    ReplyDelete
  2. অনেকদিন এত ভালো লেখা পড়ি নি । প্রথমত আপনার বাংলা । অনবদ্য । দ্বিতীয়ত আশঙ্কা আর সংশয় নিয়ে এই অসম যুদ্ধে আমাদের সাধারণ মানুষের অবস্থান । এবং অবস্থা ।
    তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে মনোগ্রাহী পাঠ হল গ্রিক নাটকের কোরাস এবং 'প্রথম পার্থ' নাটক থেকে উদ্ধৃতি আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন অনায়াসে উচ্চারণ ।
    অসাধারণ একটি লেখা ।
    আইভি চট্টোপাধ্যায়

    ReplyDelete