Tuesday 19 May 2020

খোয়াব দেখি অন্তরে

মানুষের ন্যূনতম চাহিদা তো মেটাতে হবে!
অরিন্দম সিংহ
করোনার আবহে  সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য গণ মাধ্যমে অনবরত একটা কথাই বলা হয়ে চলেছে। করোনা অতিক্রান্ত সময়ে পৃথিবীটা এমন থাকবে না, বদলে যাবে আমাদের যাপিত জীবনের দিনলিপি। সামাজিক দূরত্বের স্থায়ী চিহ্ন গেঁথে যাবে আমাদের প্রাত্যহিকতায়। লকডাউনের পরবর্তী সময়ে সমাজ-অর্থনীতির আমূল বদলের সঙ্গে সমঝোতা করে এগোতে হবে আমাদের।

এ বিশ্ব অনেক মহামারী দেখেছে। কিন্তু এমন ত্রস্ত আতঙ্কের সময় বোধহয় দেখেনি। এক অতি ক্ষুদ্র জীবের এমন সর্বাত্মক, সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক মারণলীলার কাছে দাম্ভিক মানুষ এমনভাবে কখনও বোধহয় অসহায় আত্মসমর্পণ করেনি। এখানেই এই প্যানডেমিক ইউনিক।

কিন্তু, বদলে যাওয়া জীবনের ছবিটা কীভাবে কল্পনা করা যাবে? অর্থনীতিবিদ থেকে সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই আন্দাজ দেবার চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু এই পুঁজিবাদের চেহারায় তা কেমন বদল হবে তার স্থির চিত্র আঁকা যেমন অসাধ্যপ্রায়, তেমনি কেউ কেউ অত্যন্ত সঠিকভাবেই হয়তো বলার চেষ্টা করছেন ইতিউতি যে, পুঁজির ক্রম সঞ্চারমানতা আর নির্বাধ লাভ আর সীমাহীন লোভ পুঁজিবাদেরই ক্রিয়াশীলতার ধরন-ধারণকেই বদলে নেবে। ডিজিটাল পেপারলেস ইকনমির দিকে আরও বেশি বেশি করে ঝুঁকবে তার আপন অস্তিত্ব ও সঙ্কটকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে।

হয়তো ঠিক। হয়তো কেন, ঠিকই। কিন্তু, বদল কি আসবে সেই ক্ষুৎকাতর, অস্বাস্থ্যে অশিক্ষায় দিন কাটানো হতভাগ্য মানুষদের জীবনে, যেখানে গণতন্ত্র, সাম্য, স্বাধীনতা ইত্যাকার শব্দ দূরতম নক্ষত্রের মতোই অচেনা ও অধরা? প্রতিবেশে গড়ে ওঠা সামাজিক দূরত্বের ধারণা অন্তত তাঁদের জীবনে কোনও নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হবে না।

গ্রাম ভারতে, এমনকি এই ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গেও, জাত ব্যবস্থার মধ্যবর্তিতায় সামাজিক দূরত্বের রকমফের এখনও গেঁড়ে বসে আছে। এখনও জাতের নামে বজ্জাতি করে চলা কায়েমী স্বার্থের মানুষরা, যারা বদলে যাওয়া অর্থনীতির ধারক ও বাহক এবং নিশ্চিতরূপেই এর দোসর হবে, তারা জাতব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে নবায়িত পুঁজিবাদের অস্তিত্বের যাথার্থ্য প্রমাণে সচেষ্ট থাকবে। আদিবাসী জনগণের অরণ্যের অধিকার, আর যা ন্যূনতম অধিকার জীবন ধারণের, তা পরিবর্তিত আর্থ- সামাজিক পরিস্থিতিতে বদলে যাবে- এমন ভাবনা অতি বড় স্বপ্নের সওদাগরও ভাবতে পারবেন না। হ্যাঁ, পরিবেশের অপরিবর্তনযোগ্য ক্ষতি সাধনের পরও। বদলে যাওয়া অর্থনীতির যারা চালক তারাও একদিকে হাই-টেক রোবটিক্স ইকনমিক্সের জয়ডঙ্কা বাজাবেন তুমুল চিৎকারে আর অন্যদিকে হয়তো দলিত মানুষজন প্রান্তিকতা থেকে আরও প্রান্তিকতায় সরে যাবেন। মিলিয়ে যেতে থাকবে তাঁদের কণ্ঠস্বর, যদি বা কখনও ক্কচিৎ ওঠে তা। ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের বাস্তবায়নের পথে তাঁরা হাঁটবেন কি না তা যেমন দেখার তেমনই দেখার প্রাথমিক স্বাস্থ্যে, শিক্ষায় সার্বজনীন অধিকারের প্রতি মনোযোগী হবেন কী না। করোনার আক্রমণ দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের বিব্রতকর অপরিণামদর্শী অপ্রস্তুত ভাব।

রাজনীতিশাস্ত্রে একটা কথা আছে, রাষ্ট্র যতক্ষণ না বৈধতার সঙ্কটের সম্মুখীন হয় ততক্ষণ সে তার বিচিত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দৃশ্য বা অদৃশ্য কার্যাবলী দিয়ে নিজের টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে এবং রেজিলিয়েন্স বাড়াতে সচেষ্ট থাকে। কিন্তু, সত্যিই যদি অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের মধ্যে সংক্ষোভের সৃষ্টি হয় ক্রমাগত বঞ্চিত হতে হতে, তখন কোন বটিকার উদ্ভাবন করবে এই রাষ্ট্র, সেই দেখার। না, বিপ্লব বা বিদ্রোহ অত্যাসন্ন এমন ভাবালুতার অবকাশ রাখছি না। কিন্তু এই যে পরিবর্তিত অর্থনীতিতে কোটি কোটি মানুষের কাজ হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে তাতে এই বিপুল সংখ্যক নতুন করে কর্মহীন মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই বা কোন পথে সামাল দেবে রাষ্ট্র? আকিল বিল্গ্রামীর মতো দার্শনিক করোনা-পূর্ব ভারতের ধর্ম-দ্বন্দ্ব দীর্ণ জীর্ণ শীর্ণ কাপুরুষ সমাজ-দেহ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, আন্দোলন শূন্যতাই (ওঁর ভাষায়, movement vacuum) এখনকার সমস্যা।

এই ফাঁক পূরণে কারা এগিয়ে আসবে ? সিভিল সোসাইটির কমিটেড মানুষ না মার্কসবাদী বিপ্লবীরা? তরল পরিস্থিতিতে কোনও অনুমানই চলে না। তবুও, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকেদের, যাঁদের অধিকাংশই  অদক্ষ কিন্তু অপরিহার্য দেশের বিবিধ কর্ম-পরিকল্পনায়, রাষ্ট্রের সীমাহীন ঔদাসীন্য আর অসংবেদনশীলতা কী প্রমাণ করে না যে রাষ্ট্রের কাছে এক গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ বাতিলের তালিকায়? এ ব্যাপারে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকা বেশ হতাশাব্যঞ্জক। এমন আশঙ্কা কী খুব অমূলক যে, বদলে যাওয়া সময়ে সমাজ-অর্থনীতিতে এঁদের দুর্দশাই ঘনিয়ে তুলবে না মহা সংকট যা হতে পারে সার্বিক এবং সার্বত্রিক? পরিতাপ এই যে, এই ঘনীভূত সংকটের থেকে জন্ম নেওয়া  অমানবিক সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের শতধা বিভক্ত হতশ্রী চেহারা পূর্বকথিত আন্দোলন শূন্যতা পুরণে তেমন সক্রিয় ভুমিকা নিতে পারবে বলে আদৌ মনে হয় না। নয়া উদারবাদী ভাবনায়  বেসরকারিকরনের সর্বরোগহর বটিকার কেরামতি স্পষ্টতই বড় প্রশ্নের মুখে। বিশেষ করে, করোনার মোকাবিলা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়েছে। জনস্বাস্থ্যকে অবহেলা করে, তার পরিকাঠামো তৈরি না করে, কেবল আয়েসি জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই বেসরকারি হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনার মস্ত গলদ আজ দ্গদগে ক্ষতচিহ্নের মতো সকলকে ব্যঙ্গ করছে না? আয়ুষ্মান ভারতের মতো ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্টও যে আদতে বেসরকারি কর্পোরেট স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের পকেট ভর্তি করার সুনিপুণ কৌশল, তা আর গোপন নেই। গরিবগুর্বোদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যের প্রতি দৃকপাত পর্যন্ত করার প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার বাহাদুর।

করোনার আক্রমণ যে শিক্ষা দিয়ে গেল বা আগামী বছর কয়েক মাঝে মধ্যেই সর্ববিশারদ রাজনীতি কারবারী তথা বেত্তাদের সবক শেখাবে তাতে এখন অন্তত বিশেষজ্ঞরাও নিঃসন্দেহ। এই শিক্ষা কী বদল আনবে স্বাস্থ্যনীতিতে? যে 'বাদ দেওয়া'র খেলা অহরহ চলছে, তাতে রাতারাতি ভোলবদলের কোনও সম্ভাবনা নেই। জনবাদী রাজনীতির ইডিয়মে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন যদি বা আসে, পুঁজির লক্ষ্য কিন্তু মুনাফা বাড়ানোর মধ্যেই স্থির থাকার কথা। এর অন্যথা হলে বুঝতে হবে, পুঁজিবাদ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই একটু আধটু কল্যাণমুখী প্রকল্পের দিকে ঝুঁকছে। সাম্প্রতিকে কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হল তা দেশের জিডিপি-র ১০ শতাংশ বলে দাবি করা হয়েছে। কম কথা নয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল যে এই করোনা আবহেও, যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৈন্য নগ্ন হয়ে পড়েছে সেখানেও এই ক্ষেত্রে এক পয়সাও বরাদ্দ নেই। যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পিপিই কেনা হল তার সামান্যতম সদিচ্ছাও এখানে প্রকাশিত হলে সরকারের আন্তরিকতার প্রমাণ আমরা পেতে পারতাম। কিন্তু তা বোধহয় হবারই নয়। জনস্বাস্থ্য সরকারের কাছে কখনই অগ্রাধিকার পায়নি, আগামীতেও পাবে এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। অথচ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বেসরকারি অংশগ্রহণ যথেষ্টই বেশি। কিন্তু কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনও হাসপাতালই কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হয়নি। সরকার বা রাষ্ট্রও তেমন জোরাজুরি করেনি ওদের যুদ্ধে সামিল হতে।

তাই, বদল যদি সত্যিই দেখতে হয় আমাদের জীবনযাপনের ধরন-ধারণে বা আমাদের প্রাত্যহিকতায়, তবে রাষ্ট্রকে কেবল পুঁজির লালন পালনেই ব্যস্ত থাকলে চলবে না বা কর্পোরেটদের অগ্রাধিকারকেই রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার হিসেবে দেখলে চলবে না, অগণিত মানুষের  ন্যূনতম চাহিদার কথাও মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান আর্থিক বিপর্যয় সামাল দিতেও চাই এক নীরোগ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কর্মঠ মানব সম্পদ। কেবল দক্ষ ও অতি দক্ষ শ্রমিক আমাদের মতো অর্থনীতির একমাত্র চালিকাশক্তি হতে পারে না, বিপুল সংখ্যক তথাকথিত অদক্ষ শ্রমিকরাই কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রাণশক্তি। এই সরল সত্য বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হবার কোনও প্রয়োজন নেই।

3 comments:

  1. It is an excellent write up & very much didactic in nature.The write up is very much relevant in the corona stricken world .It has pointed out the immediate tasks of the govt to be be taken up on warfooting to save the world economy & the marginalized people in the world.It has a special concern for poor & developing nations in the world.

    ReplyDelete
  2. ভারতের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি যে দেশের শ্রমিক ও মেহনতী মানুষ, এই সত্যকে যতদিন অস্বীকার করা হবে ততদিন কোন পরিবর্তন আসবেনা। এর আগেও অনেকবার দেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে, তখনও সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গরিব মানুষই, কিন্তু সেই স্মৃতি দেশের নীতি নির্ধারকগণ বেশিদিন মনে রাখেনি। বলা ভাল মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি। এখন যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষিত হয়েছে তার কত শতাংশ গেইব মানুষের কল্যাণে ব্যবহার হয় আর কত শতাংশ রাজনীতির কারবারিদের পকেটে যায় সেটি দেখার। হিসাব তো আমরা চাই, কিন্তু পাবো কি?

    ReplyDelete
  3. গেইব এর পরিবর্তে গরীব হবে

    ReplyDelete