বৃহৎ পুঁজির একবগগা স্বার্থে সরকার?
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
এইবার মুদ্রাস্ফীতির গণনায় ব্যাপক ফাঁক রাখতে খাদ্যপণ্যকে মুদ্রাস্ফীতির সূচক তালিকা থেকে বাদ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার; অথচ খাদ্যপণ্যেই দাম বাড়ে গড়ে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ! দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ভালোমন্দ যে সমস্ত জিনিসের দামের ওঠানামার সঙ্গে যুক্ত, তাকেই এরা উপেক্ষা করতে চাইছে। অর্থাৎ, দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি কম করে দেখাতে চাইছে। সেই মর্মে প্রস্তাব এসেছে এবারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে অর্থমন্ত্রক থেকে আবেদন করা হয়েছে, এভাবেই ভেবে দেখার জন্য। কিন্তু তাতে লাভ কার? কীভাবে? পুঁজির স্বার্থ ছাড়া এই সরকার আর কিছু কি ভাবে?
মুদ্রাস্ফীতি গণনার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সেই নিয়মে এ দেশের প্রায় ২০০টি পণ্যের দাম নিয়ে প্রতি সপ্তাহে তা নিরূপণ করা হয়। খাদ্যপণ্য ছাড়াও ভাড়া এবং নানা পরিষেবা ও উপযোগিতামূলক খরচ, আবাসন খরচ, পেট্রোলের মতো পরিবহন খরচ, স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদিকে ধরা হয়। খোলা বাজারে পাইকারি ও খুচরো বিক্রির দাম উভয়কেই ধরে দু'রকম দামের ভিত্তিতে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির হার গোনা হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেশে মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নগদের জোগান কমিয়ে-বাড়িয়ে, তার জন্য ব্যাঙ্কের রেপো রেট কমে-বাড়ে। সেই সূত্রে সুদের হার কমানো বাড়ানো হয়। বাণিজ্যের স্বার্থে শিল্প মহল সর্বদাই চায় এই সুদ কমিয়ে রাখা হোক। তাতে তাদের ঋণের উপর সুদের খরচ কমে। কিন্তু সেই খরচ কমলেই যে জিনিসের দাম কমে তা নয়, ফলে পুঁজির মুনাফা বাড়ে। কম্পাউন্ডিং হিসেবে এই মুনাফা বেশ অনেকখানি হয়। ঠিক ততখানিই চাপে পড়ে সাধারণ মানুষ এবং আমজনতার পকেট থেকে গুনাগারও যায় ঠিক ততটাই, যদি না মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে ঠিক ঠিক অঙ্ক কষে সুদ বাড়ানো বা কমানো হয়। ভারতের মতো অর্থ ব্যবস্থায় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দায়িত্ব আমজনতার কথা ভেবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রয়োজনে সুদের হার বাড়িয়ে নগদের জোগান কমিয়ে নেওয়া। তাতে বড়লোকদের উপর চাপ পড়লেও সাধারণ মানুষ বাঁচে। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই রীতি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।
এই নিয়েই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সঙ্গে সরকারের গোলমাল শুরু। পরবর্তীকালে অন্য গভর্নরদেরও ভূমিকা মেনে নিতে পারেনি মোদি সরকার। তারা চায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্ষমতা খর্ব করে তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে বেশি বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করানোর জন্য সুদের হার কমিয়ে দিতে। এটা চাইলেই হয় না, অত সোজা কথাও নয়। তা অর্থনীতির জটিল হিসেবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নগদের জোগান বেড়ে গেলে জিনিসের দাম বাড়বে তখন দেশের উৎপাদন খরচ বাড়বে, কর্মসংস্থান কমবে, মানুষের সঞ্চয় কমবে এবং দেশের রফতানি বাণিজ্যেও তার প্রভাব পড়বে। তাই শিল্পপতিদের বিনিয়োগ খরচ কমাতে সুদের হার কমিয়ে রাখলেই দেশের উন্নয়ন হবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয় বরং উল্টোটাই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাতে সর্বনাশ। মোদি সরকার এই ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করে অর্থনীতির ভারসাম্যটা নষ্ট করতে চাইছে শুধুমাত্র পুঁজির স্বার্থে। তাদের বক্তব্য, তা না হলে বিনিয়োগ আসবে না, আর পুঁজির উন্নয়ন না হলে দেশের সর্বনাশ।
স্বার্থ ও ভাবনাচিন্তার এই মেরুকরণের ফলে বিরক্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নররা। প্রত্যেকেই তাঁদের মতো করে এর বিরোধিতা করেছেন। বস্তুত, সারা বিশ্বেই মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, জিনিসের দাম ওঠা নামা, অর্থনীতিতে নগদের জোগান এবং সুদের হার ঠিক রাখার দায়িত্বটা সেই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হাতেই থাকে। এখানে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে দেশের অর্থনীতি ও আমজনতা ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব কিছু জেনেও মোদি চাইছেন তাঁর মতো করে চলতে। ঠিক যে ভাবে নোট বাতিলের সময় তিনি একরোখা অবস্থান নেন, এই ব্যাপারেও তাঁর মনোভাব তেমনি।
তাই, সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না-- এমন একটি ফর্মুলা তৈরি করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের বক্তব্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে রেপো রেট ঠিক করে তা নির্ধারণের সময় যেন খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে আর বিচার না করা হয়। রঘুরাম রাজন এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর থাকাকালীন তিনি নিজেই রেপো রেট নির্ধারণের সময় উৎপাদকের মূল্য, যাকে বলে প্রোডিউসার প্রাইস ইনডেক্স (বা পিপিআই), তা দেখে এগোতেন। পরবর্তীকালে সরকারের তরফে কেন্দ্রের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরন গত ২৩-২৪ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ফের একই কথা বলেন। এবারে সরকারের বক্তব্য একটু অন্যরকম: মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির ফলে সুদের ওঠানামা নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যা খুশি করছে করুক, তাতে সরকার আর কোনও হস্তক্ষেপ করবে না, তবে মুদ্রাস্ফীতি গণনার ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যের দামটা বাদ রাখা হোক। কারণ, দেশে সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ে খাদ্যপণ্যের। আর দাম বৃদ্ধি হলে সুদ কমানোর জায়গা থাকে না। তাই মুদ্রাস্ফীতির হার নিরূপণের ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যকে সরিয়ে অন্য কিছু রাখা হোক যার দাম কমে কিংবা খুব বেশি বাড়ে না। তাহলে মুদ্রাস্ফীতি কম দেখানো যাবে, ফলে, সুদের হার আরও কম হবে। পুঁজি মহল সন্তুষ্ট হবে।
কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে নগদের জোগানের নিয়ন্ত্রণ হবে না। আরও বেশি অসাম্য বাড়বে। যে মুষ্টিমেয় শ্রেণির মানুষ যথেষ্ট নগদ ও ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী, কেবলমাত্র তারাই ভালো থাকবে। আর যারা সীমিত আয়ের মধ্যে দিন গুজরান করেন, তাদের জন্য জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারের টনক নড়ানোর মতো কেউ থাকবে না। এখন যেরকম ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার ফলে মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেলে আলোচনা শুরু হয়ে যায় অর্থনীতির শীর্ষ মহলে, কারণ, বর্তমানে পণ্যের খুচরো দরে মূল্যবৃদ্ধি নির্ধারণে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অংশ ৪৬ শতাংশ! স্বাভাবিকভাবেই মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে সুদের হার বাড়ানো বা কমানোর নীতি। খাদ্যপণ্যকে বাদ দিলে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির হার কম দেখাবে। কিন্তু তাতে প্রকৃত দাম বাড়তে থাকবে। রাজনের কথায়, 'খাদ্যপণ্যের দর যদি দীর্ঘ সময় বেশি থাকে তাহলে চাহিদার তুলনায় জোগান কম ধরে নিতে হবে। এর অর্থ ভারসাম্য বজায় রাখতে অন্য ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি কমাতে হবে। যা শীর্ষ ব্যাঙ্ক করতে পারে'; আর সেটাই যদি শীর্ষ ব্যাঙ্ক না করে তাহলে আমজনতাকে পুড়তে হবে দাম বৃদ্ধির আগুনে, অন্যদিকে সরকার ঘোষণা করবে দাম বৃদ্ধি হচ্ছে না, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। তাতে শীর্ষ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাতে পথ পাবে।
উদ্যোগপতিদের কথা ভেবে সরকার এই পথেই এগোতে চায়। কিন্তু আমজনতা, যাঁরা সীমিত অর্থে সংসার চালান, তাদের কথা কে ভাববে?
No comments:
Post a Comment