মধ্যবিত্ত কি প্রায়-বিলোপের পথে?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
সারা বিশ্বে যেমন, তেমন আমাদের দেশেও দেখা যাচ্ছে, কাজ অনেক মিলছে বটে,
যদিও অধিকাংশ কাজগুলিই অস্থায়ী চরিত্রের, কিন্তু আয় নামছে নিচের দিকে। একমাত্র ব্যতিক্রম
ঠিকা মজদুর ও সরকারি চাকরির কর্মক্ষেত্র। ঠিকা মজুরদের দৈনিক আয় বাড়ছে, কারণ, সেখানে
চাকরির অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার বালাই নেই, বরং, তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারলে মজুরি
বাবদ খরচ সর্বমোটে কমই পড়ে। আর অন্যদিকে সরকারি কর্মক্ষেত্রে ডিএ বাড়ে, না বাড়লে মামলা
করে আদায়ও করা যায়, নতুন বেতন কমিশন বসে; লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন যখন সরকারি কোষাগার
ঋণ করেও টানা যায়।
আসলে, মধ্যবিত্ত সমাজই পড়ে গেছে এক মহা ফ্যাসাদে। এই যে ফুরফুরে আইটি সেক্টর,
যাদের কর্মীদের ঠাটবাটে এক সময়ে সরকারি কর্মচারীরাও লজ্জা পেতেন, দেখা যাচ্ছে, গত ২০১১
সালে আইটি সেক্টরে নতুন কর্মীর বার্ষিক আয় যেখানে শুরু হত ৩.২ লক্ষ টাকা থেকে, ২০২৪’এ
এসে তা শুরু হচ্ছে ৩.৫ থেকে ৩.৭ লক্ষ টাকায়। ১৩ বছরে আয় বৃদ্ধি মাত্র ৯ শতাংশ, বছরে ১ শতাংশেরও
কম। অথচ, মুদ্রাস্ফীতির বার্ষিক বৃদ্ধির হার অন্তত ৪ থেকে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১১ সালে
আইটি সেক্টরে কাজ করতে ঢোকা কর্মীটি যতটুকু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতেন, আজ যিনি কাজে
ঢুকছেন তাঁর সে স্বাচ্ছন্দ্য অনেক অনেক কম।
এক সময়ে মধ্যবিত্ত সমাজের এক বৃহৎ অংশ ছিল সরকারি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের
কর্মচারীরা, যেমন বড় বড় রাষ্ট্রীয় ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, ব্যাঙ্ক, বীমা ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রের
শ্রমিক, বাবু ও আমলারা। গত তিন দশকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের বিদায় হয়েছে, সরকারও
কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে, ফলে, এক বড় অংশের জনতা মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে ছিটকে বেরিয়ে
গেছে বা যাচ্ছে। আর বেসরকারি ক্ষেত্রেও কর্মী নিয়োগ বেশ সংকুচিত, যারা আছে তাদের আয়
পড়তির দিকে, অতএব, এই অংশের মধ্যবিত্তরাও এখন বিলোপের পথে। হিসেব নিয়ে দেখুন, আইআইটি’এর
মতো প্রিমিয়ার প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২৪ সালে পাশ করা ছাত্রদের ৩৮ শতাংশ কোনও চাকরিই পায়নি।
তাহলে বাকী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কী অবস্থা তা তো বোঝাই যাচ্ছে! আর যারা চাকরি পায়,
তাদের একটা বড় অংশের মাইনেপত্রের অবস্থা কিন্তু যথেষ্ট করুণ। রইল বাকী কিছু পেশাদারি
কাজ, যেমন, ডাক্তারি, ওকালতি, শিল্পকর্ম, পরামর্শ-প্রদান প্রভৃতি সহ শিক্ষকতা, স্বাস্থ্যকর্ম,
মাঝারি দোকানদারি বা ব্যবসা, গবেষণা, যেখানে রীতিমতো লড়ে জায়গা তৈরি করতে হয়, সকলের
নিশ্চিত ভালো রোজগার যে হয় তাও নয় এবং জনসংখ্যার অনুপাতেও এরা নগণ্য।
কেন এই পরিণতি? আর আমরা যাচ্ছিই বা কোন পানে?
এর পিছনে সর্বপ্রধান কারণ দুটি: এক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে বহু কাজের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, যা যন্ত্রসমাজ আরও নিপুণ ভাবে করে দিতে সক্ষম। তাই, মনুষ্যশ্রমেরও নিয়োগ পূর্ণ ও আংশিক উভয় মাপেই ক্রমশ কমছে। যারা এখনও কাজে থাকছেন তাদেরও বিদায় যেহেতু নিকটবর্তী তাই মজুরি বা মাইনে বাড়ার প্রশ্নও আর নেই; দুই, খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে লাগামছাড়া খরচ, অতি-উচ্চ বাড়ি ভাড়া, তার ওপর ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ-সুবিধা প্রশস্ত হওয়ায় গাড়ি-বাড়ি-পণ্য ক্রয়ে ঋণের চাপ— এইসব বিবিধ জাঁতাকলে মধ্যবিত্ত সমাজ আরও বিপদগ্রস্ত। ২০২৪ সালের তথ্য বলছে, আমাদের দেশে গৃহস্থালী ঋণ বেড়ে এখন জিডিপি’র ৪২.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একদিকে আয়ের পতন অন্যদিকে খরচের ভার, তারপর যদি তা লাগামছাড়া ঋণের জালে আটকে পড়ে, তাহলে আত্মহনন। দেখা যাবে, গত কয়েক বছরে বিপর্যস্ত মধ্যবিত্তের আত্মহত্যার সংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে।
যদিও তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ মধ্যবিত্ত, যাদের বার্ষিক
আয় ৫ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা, এবং কারও কারও অনুমান, ২০৩১ সালে গিয়ে তা পৌঁছবে ৩৮ শতাংশে। কিন্তু তা কি সত্যি পৌঁছবে? প্রথমত, পড়তি আয়ের নিরিখে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ যে নিম্নবিত্ত
হয়ে পড়ছে ও দ্বিতীয়ত, সর্বত্র স্থায়ী চাকরির সংকোচন ও যেটুকু বা নিয়োজন তাও খুব কম
মাইনেতে, ফলে, মধ্যবিত্ত সমাজে নতুন জনসংযোজন কিন্তু অপ্রতুল।
তাই, সমাজটা ক্রমেই অতি ধনী ও নিম্নবিত্ত— এই দুই বর্গেই ভাগ হয়ে পড়ছে,
যেখানে মধ্যবর্তী এক বিশাল মধ্যবিত্ত সমাজের যে অস্তিত্ব গত কয়েক দশকে গড়ে উঠেছিল তার
বাস্তবতা আর থাকছে না। যেটুকু যতটা এখনও আছে, তা রেশ মাত্র, কতকটা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে আগের প্রজন্মের গচ্ছিত
অর্থ ও সম্পদের জেরে আরও কিছুকাল বয়ে চলা। অথচ নতুন বাস্তবতা হল, অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও
কমছে— নিম্নবিত্ত মানুষ কিন্তু দরিদ্র নয়, আবার মধ্যবিত্তও নয়, কারণ, তাদের বার্ষিক
আয় আমাদের দেশের নিরিখে ৫ লক্ষ টাকার নিচেই।
দাঁড়াচ্ছে এই, গড়ে উঠতে থাকা বিশাল এই নিম্নবিত্ত সমাজের মানুষেরা বেঁচে থাকবে নানাবিধ
খুচরো ও অস্থায়ী কাজে যুক্ত থেকে এবং সরকারি জনকল্যাণ প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে। এই
জনকল্যাণের প্রকল্পই তাদের দরিদ্র হয়ে পড়া থেকে রক্ষা করে। তাই আজ অর্থনৈতিক ভাবে জনকল্যাণের রাজনীতির এতটাই গুরুত্ব। নিম্নবিত্তদের মধ্যে থেকে বিশেষ কেউ কেউ
পেশাদারি সাফল্যে মধ্যবিত্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে পারে, কেউ বা অতি ধনীও হতে পারে,
কিন্তু দুই বর্গের আয়ের তুমুল বৈষম্যই হবে সাধারণ ভাবে কঠিন বাস্তবতা। এটাই পুঁজিবাদের
আজকের নতুন ধরন। কারণ, সমাজটাই পরিচালিত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত এমন এক যন্ত্রসমাজের
দ্বারা যারা একদিকে সামাজিক উদ্বৃত্ত উৎপন্ন করতে ও অতি মুনাফার পাহাড় জমাতে সক্ষম,
অন্যদিকে সেই উদ্বৃত্তের কিছুটা ভাগ দিয়ে সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র্য মোচনেও
ওস্তাদ।
তাই, পুঁজিবাদের আজ আর বহু মানুষ সম্বলিত মধ্যবিত্ত সমাজের দরকার নেই, কারণ, ‘white-collar job’ বলে যে মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক কাজগুলি এতদিন তারা করে এসেছে, তা আজ যন্ত্রসমাজ আরও নিপুণ, নিখুঁত ও ত্বরিৎ গতিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম।
ফলস্বরূপ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যে কোষ বিদ্রোহ দানা বাঁধছে না।
ReplyDeleteরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুলি নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ বিশেষ করে প্রতিন্ঠান বিরোধী দল গুলি।
অসিত রায়
স্পষ্ট বিশ্লেষণ! আজকের মধ্যবিত্ত সমাজের টালমাটাল অবস্থাকে এত নির্মোহভাবে তুলে ধরার জন্য লেখাটি বিশেষভাবে প্রশংসার দাবিদার।
ReplyDelete