'সাহিত্য এখনও সেই পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে একটি...'
আবু সঈদ আহমেদ
কন্নড় লেখিকা, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী বানু মুশতাক তাঁর ছোটগল্প সংকলন 'হার্ট ল্যাম্প'এর জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার (২০২৫) জিতে কন্নড় ভাষায় এই প্রথম ইতিহাস তৈরি করেছেন। বিচারকরা তাঁর গল্পের চরিত্রদের প্রশংসা করেছেন এই ভাষায়, 'astonishing portraits of survival and resilience.'। তাঁর এই সম্মাননার আগে আমরা বাঙালিরা কজন তাঁকে চিনতাম বা তাঁর কাজ সম্পর্কে জানতাম? সত্যিই কি আমরা এই বৈচিত্র্যময় দেশে পরস্পরকে এখনও চিনি?
তাঁর নিজের কাজ সম্পর্কে এই বিরল সম্মাননার অধিকারী মুশতাক বলেন, 'এই বইটির জন্ম এই বিশ্বাস থেকে যে, কোনও গল্পই কখনও ছোট হয় না; মানুষের অভিজ্ঞতার ছন্দে প্রতিটি সূত্রই সমগ্রের ওজন ধারণ করে। ... যে বিশ্ব প্রায়শই আমাদের বিভক্ত করার চেষ্টা করে, সাহিত্য এখনও সেই শেষ পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে একটি যেখানে আমরা একে অপরের মনের ভিতরে বাস করতে পারি, এমনকি কয়েক পৃষ্ঠার জন্যও।'
বানু মুশতাক ১৯৪৮ সালের ৩ এপ্রিল কর্নাটকের হাসানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বেড়ে ওঠা কর্নাটকের পাহাড়ি মালনাড় অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রামে। পরে তিনি ব্যবসায়ী মহিয়উদ্দিন মুশতাকের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তাঁর লেখালেখির শুরু ১৯৭০-এর দশকে এবং ১৯৭৪ সালে 'প্রজামাথা' নামে একটি সাময়িকীতে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে তিনি কবি ও লেখক পি লঙ্কেশ (নিহত সমাজকর্মী ও সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের পিতা) সম্পাদিত ট্যাবলয়েড 'লঙ্কেশ' পত্রিকায় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০-এর দশকে তিনি কন্নড় সাহিত্যের বান্দায়া আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য এই আন্দোলন প্রতিবাদের ঐতিহ্যে চিহ্নিত হয়েছিল, যা মুসলমান ও দলিত সহ প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে সে আন্দোলনে স্থান দেয়। ১৯৮৩ সালে তিনি হাসান সিটি মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন; দুটি মেয়াদে এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে মুশতাক সাংবাদিকতা ছেড়ে তাঁর পরিবারকে সাহায্য করার জন্য আইনজীবী হিসেবে জীবিকা শুরু করেন।
বছরের পর বছর ধরে মুশতাকের লেখা অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ স্থানীয় ও জাতীয় পুরস্কার জিতেছে, যার মধ্যে রয়েছে কর্নাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার এবং দানা চিন্তামণি আত্তিমব্বে পুরস্কার। ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রকাশিত মুশতাকের পাঁচটি ছোটগল্প সংকলনের অনূদিত ইংরেজি সংকলন - 'হাসিনা এবং অন্যান্য গল্প' - ২০২৪ সালে PEN অনুবাদ পুরস্কার জিতেছে। ২০০০ সালে 'মুসলমান মহিলাদের মসজিদে প্রবেশের অধিকারের পক্ষে' তাঁর প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় মুশতাক এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে তিন মাসের 'সামাজিক বয়কট' ঘোষণা করা হয়। সেই সময় তিনি ভয়ঙ্কর সব টেলিফোন কল পান এবং একদিন এক ব্যক্তি তাঁকে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা করে কিন্তু তাঁর স্বামীর সাহায্যে সেদিন তিনি বেঁচে ফেরেন। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে চিকমাগালুর জেলার বাবা বুদানগিরিতে মুসলমানদের একটি সমকামী মাজারে যেতে বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টার প্রতিবাদে মুশতাক নাগরিক সমাজের দল 'কোমু সৌহার্দ বেদিক'এ যোগ দেন। মুশতাক স্কুলে মুসলমান শিক্ষার্থীদের হিজাব পরার অধিকারকে সমর্থন করেছেন, যা কর্নাটকের আদালতে এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
তাঁর একটি গল্প 'কারি নাগরাগালু' (কালো গোখরো) যা 'হার্ট ল্যাম্প'-এ অন্তর্ভুক্ত, গিরিশ কাসারাবল্লির পুরস্কারপ্রাপ্ত কন্নড় ছবি 'হাসিনা'-তে (২০০৪) চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল। প্রধান অভিনেত্রী তারা হাসিনা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন। এই গল্পের কাহিনি এক ভারতীয় মুসলমান মহিলাকে নিয়ে যে তার স্বামী দ্বারা পরিত্যক্ত হয়। গল্পে হাসিনা তার মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অটোচালক ইয়াকুবকে বিয়ে করে। এই দম্পতির তিন মেয়ে: দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মুন্নি, শুব্বি ও হাবিবা। তাদের চতুর্থ সন্তান যখন গর্ভে, তারা সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য গর্ভাবস্থা স্ক্যান করে। যখন ইয়াকুব জানতে পারে যে সেটি আরও একটি মেয়ে, তখন সে পালাক্রমে নির্যাতনকারী ও অবহেলাকারী হয়ে ওঠে। অবশেষে হাসিনাকে পরিত্যাগ করে।
বানু মুশতাক তাঁর ছয় দশকের দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে ৬০টিরও বেশি গল্প লিখেছেন। তাঁর গল্পগুলি ইতিমধ্যেই ছয়টি সংকলনে প্রকাশিত। ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মুশতাকের লেখা ১২টি ছোটগল্প সম্বলিত 'হার্ট ল্যাম্প' দক্ষিণ ভারতে বসবাসকারী মুসলমান নারীদের কষ্টের কথা মর্মস্পর্শী ভাবে তুলে ধরেছে। তাঁর এইসব অসাধারণ গল্পগুলির মধ্যে সেরা কয়েকটি হল: হেজ্জে মুদিদা হাদি (১৯৯০), বেঙ্কি মালে (১৯৯৯), এদেয়া হানাতে (২০০৪), সাফিরা (২০০৬), হাসিনা মাত্তু ইতারা কাঠেগালু (২০১৫) ও হেন্নু হাদিনা স্বয়ম্বরা (২০২২)। গল্পগুলি কর্নাটকে কথিত কন্নড় থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি। আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জেতা প্রথম ভারতীয় অনুবাদক ভাস্তি বলেন, তিনি আশা করেন যে এই পুরস্কার কন্নড় ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ভাষার সাহিত্য এবং অনুবাদের কাজকে বিপুল ভাবে উৎসাহিত করবে।
ভারতে বইটির প্রকাশক পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া'র প্রধান সম্পাদক মানসী সুব্রহ্মণ্যম বিবিসিকে বলেন যে এই পুরস্কার আঞ্চলিক সাহিত্যের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য জয়। তাঁর ভাষায়, '২০২২ সালে 'টম্ব অফ স্যান্ড'এর ঐতিহাসিক জয়ের পর (গীতাঞ্জলি শ্রী'র বইটি হিন্দি থেকে ডেইজি রকওয়েল অনুবাদ করেছিলেন) এই বছর 'হার্ট ল্যাম্প'এর সম্মান এমন একটি শক্তিশালী স্মারক যে তা ভারতের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের প্রতি আমাদের পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে।'
অবশ্যই পড়ব।
ReplyDeleteআলোচনাটি তথ্যবহুল ও প্রয়োজনীয়।
শ্রেয়া ঘোষ।