Monday, 26 May 2025

'নিস্তার নাহি কাহারও সটকে'

কারা যুদ্ধ চায়?

তরুণ লালা



গত ৭ মে ভারতীয় সময় রাত ১:০৫ থেকে ১:৩০-এর মধ্যে, ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে নয়টি স্থানে বিমান হামলা চালায়। এই অভিযানটি 'অপারেশন সিন্দুর' বলে প্রচারিত হয়, যা পহেলগাঁও'এ সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার সরাসরি প্রতিক্রিয়া। সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়, 'এই হামলাগুলোর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী, যেমন জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তইবা'র সঙ্গে জড়িত অবকাঠামোগুলি। এই অভিযান শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে এবং পাকিস্তানি সামরিক বা বেসামরিক স্থানগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।'

তবে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, এতে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এবং অসামরিক স্থাপনা, যেমন মসজিদের, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খুব স্বাভাবিক, একে অপরকে আড়াল করতে এই ধরনের কিছু বিতর্ক থাকবেই।

ভারতের এই বিমান হামলার পর পাকিস্তান জম্মু অঞ্চলে মর্টার শেল ছুঁড়ে প্রতিশোধ নেয়। কথিত, তাতে ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন এবং গুরুতর সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। পরবর্তী কয়েক দিনে এই দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যার ফলে ১০ মে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি 'যুদ্ধ'বিরতির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের দেশে বেশ কিছু মানুষ এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং দেশের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি ও সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সোফিয়া কুরেশি'র ওপর ভয়ঙ্কর ট্রোল শুরু করে দেয় (অথচ যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছেন, সেই সরকার-প্রধানদের বিরুদ্ধে কিন্তু টুঁ শব্দটিও নেই)। এতে সামিল হয়ে পড়ে শাসক দলের কিছু নেতা-মন্ত্রীরাও, যাদের বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থা সরব হলেও শাসক দল বা প্রশাসনের তেমন কোনও হেলদোল দেখা যায় না। ফলে, কোন অংশের মানুষ এই যুদ্ধ উন্মাদনার সমর্থক ও প্রচারক তা বেশ স্পষ্ট বোঝাও যায়! 

যদিও এই 'সিন্দুর অভিযান' ভারতের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করে— এটি ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তানি ভূখণ্ডে ভারতের সবচেয়ে গভীর অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে আমার সাদা মনে কয়েকটা প্রশ্ন ছিল। এই যে এত রক্তপাত, বিপুল খরচ (যার বোঝা পড়ছে আপনার, আমার এবং সকল করদাতাদের উপর) এবং অসংখ্য প্রাণহানি (আমাদের দিকের)— ওদের দিকের কয়েকজন নিরীহ মানুষকে যদি ছেড়েও দিই— এর আসল ও শেষ উদ্দেশ্যটা আপনার মতে ঠিক কী? তা কি

১) পাকিস্তানকে পুরো দখল করা? 

২) নাকি বালুচিস্তানকে মুক্ত করা? 

৩) নাকি পাক-অধিকৃত কাশ্মীর (POK) অধিগ্রহণ?

৪) নাকি শুধু জঙ্গি/সন্ত্রাসবাদীদের নির্মূল করা (তাও কীভাবে? সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে?) 

৫) নাকি পাকিস্তানকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা?

৬) না অন্য কিছু? (দুই দেশেরই কর্ণধারের উদ্দেশ্য হতে পারে এই সুযোগে গদি আঁকড়ে থাকা বা দখল করা। From power (which corrupts) to absolute power (which corrodes)??!)

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, কেবল প্রতিবেশীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার কল্পিত আত্মতৃপ্তির বাইরে গিয়ে সত্যিই জানতে চাই, এই যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তার ব্যাপক প্রভাব সম্পর্কে। বলাই বাহুল্য, পহেলগাঁও'এর ওই অপরাধ ছিল জঘন্য, বর্বর এবং বীভৎস। কিন্তু, আমরা যদি সেই পাঁচজন হত্যাকারীকে এখনও চিহ্নিতই না করতে পারি, গ্রেফতার বা নিকেশ করা তো দূরের কথা, তাহলে আমরা ঠিক কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি? আর সেইজন্যই জানতে চাই, এই যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? ওপরের যে বিকল্পগুলো বললাম, তার কোনটি?

কিন্তু আজ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনও সদুত্তর পেলাম না। উল্টে আমার এক প্রতিবেশী, যিনি একজন প্রথিতযশা CA, তাঁর এমন এক প্রতিক্রিয়া পেলাম (অনুরূপ কথা আরও কেউ কেউ বলেছেন) যার তর্জমা করলে দাঁড়ায়: 

'আমি এখনও মনে করি যে ভারত একটি বিশাল ভুল করেছে, যখন পাকিস্তানের ওপর বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও আমরা পিছিয়ে এসেছি। আমাদের উচিত ছিল পাকিস্তানকে পাঁচটি ভাগে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা— বেলুচিস্তান ও সিন্ধকে স্বাধীন করে দিয়ে, এবং PoK ও গিলগিট-বালতিস্তানকে ভারতের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত করে নেওয়া। এখন PoK ও গিলগিট অংশ খুব শীঘ্রই চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (PLA) দ্বারা দখল হয়ে যাবে এবং ভারতের নাগালের বাইরে চিরতরে চলে যাবে।'

তিনি আরও যোগ করেন:

'বাংলাদেশ সীমান্তেও একই অবস্থা। আমাদের উচিত ছিল, এবং এখনও সম্ভব, আমাদের 'চিকেনস নেক'-এর পাশের ওপরের অংশ (রংপুর অঞ্চল) কেটে আলাদা করা এবং তাদের 'চিকেনস নেক' কেটে চট্টগ্রাম দখল করে নেওয়া। কিন্তু আমাদের সরকার পাছে সারা বিশ্ব কী বলবে, সেই চিন্তায় জর্জরিত। আমরা খুবই বেশি ‘গণতান্ত্রিক’। খুব শীঘ্রই চীন লালমনিরহাটে (আমাদের চিকেনস নেক-এর একেবারে গায়ে) একটি বিশাল বিমানঘাঁটি গড়ে তুলবে এবং কিছু অর্থের বিনিময়ে দরিদ্র বাংলাদেশের থেকে চট্টগ্রাম বন্দরও নিয়ে নেবে। এরপর আমাদের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরবঙ্গ ধীরে ধীরে চীনের দখলে চলে যাবে। আর সমতল ভূমিতে, বিশেষ করে বাংলার ফ্রন্টে, আমরা তাদের আটকানোর মতো শক্তি রাখি না। আমাদের সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে আমাদের পশ্চিম, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব তিন দিকেই বিষ ফল মেনে নিয়ে আমাদের দেশকে আরও ছোট হয়ে যেতে দিতে হবে।'

উপরের এইসব প্রলাপ সম্পর্কে বক্তব্য পরে রাখব, আগে সামান্য ভাবা যাক, সত্যিই যদি যুদ্ধ বাঁধত তাহলে পরিস্থিতি কী হত:

১) সামরিক প্রভাব

ব্যাপক প্রাণহানি:  হাজার হাজার সৈনিক ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার আশঙ্কা, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চল যেমন পাঞ্জাব, রাজস্থান ও জম্মু-কাশ্মীরে। কিছু নিরীহ প্রাণহানি তো ঘটেওছে;

পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি: উত্তেজনা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যা উভয় দেশের জন্যই ধ্বংসাত্মক। একে আষাঢ়ে গল্প বলে ফেলে দেওয়া যাবে না;

সামরিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি: অপরিসীম আর্থিক ক্ষতির বিনিময়ে ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং নৌবাহিনীর জাহাজ ধ্বংস হওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা;

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ঝুঁকি: যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সেনাবাহিনী অতিরিক্ত চাপে পড়বে এবং অন্য সীমান্ত (যেমন চীনের সঙ্গে) দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

২) অর্থনৈতিক প্রভাব

শেয়ার বাজারে ধস: যুদ্ধ শুরু হলে বাজারে ব্যাপক পতন হবে, যার ফলে কোটি কোটি টাকার আর্থিক সম্পত্তির ক্ষয় হবে (যা সংঘর্ষ শুরু হতেই বেশ মালুম হয়েছে);

বৈদেশিক বিনিয়োগ স্থগিত: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বাজারে চলে যাবে, উভয় দেশের প্রতি আস্থা হারাবে;

বাণিজ্য ব্যাহত হবে: শিল্প রফতানিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বিশেষত আইটি, ফার্মা, গার্মেন্টস ইত্যাদিতে;

মুদ্রার মূল্যের পতন: ভারতীয় টাকার মূল্য অবশ্যই পড়ে যাবে, যার ফলে আমদানির খরচ এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে;

তেলের দামের উর্ধ্বগতি: যুদ্ধজনিত অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়বে, যা ভারতের আর্থিক ভারসাম্যে বড় ধাক্কা দেবে;

অর্থ বরাদ্দের পুনর্বিন্যাস: বিশাল পরিমাণ অর্থ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করতে হবে, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পরিকাঠামোর বরাদ্দ থেকে কেটে নিতে হবে।

৩) সামাজিক ও নাগরিক প্রভাব

মানুষের স্থানচ্যুতি: সীমান্ত এলাকার মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি হবে।

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা: যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ধর্মীয় বিভাজন বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর সন্দেহ বাড়তে পারে, যা হিংসা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে;

সন্ত্রাসী প্রতিক্রিয়া: জঙ্গি সংগঠনগুলো এই অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে বড়সড় হামলা চালাতে পারে।

৪) রাজনৈতিক প্রভাব

উগ্র জাতীয়তাবাদ বাড়বে: প্রাথমিক ভাবে চলতি সরকার 'দেশপ্রেমে'র জোয়ারে অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা পেতে পারে;

দীর্ঘমেয়াদে অসন্তোষ: যদি যুদ্ধ দীর্ঘ হয় এবং প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষতি হয়, জনরোষ বাড়বে;

গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস: সেন্সরশিপ, কারফিউ, নজরদারির মতো পদক্ষেপ বাড়বে। অভ্যন্তরীণ 'ইমারজেন্সি' ঘোষিত হতে পারে। তার বিরূপ ফলে আমরা আগেই ভুক্তভোগী;

নির্বাচনে প্রভাব: যুদ্ধের ফলাফল রাজনৈতিকভাবে সরকারকে সাহায্য বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

৫) আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রভাব

ভারতের ভাবমূর্তিতে ধাক্কা: ভারত শান্তিপূর্ণ শক্তি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে উপস্থাপন করতে চায়—যুদ্ধ সেই ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে;

যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য মিত্রদের চাপ: যুদ্ধ হলে কৌশলগত অংশীদারিত্বগুলো প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে;

চীনের সুযোগ: চীন কূটনৈতিক বা সামরিকভাবে সুযোগ নিতে পারে, বিশেষ করে লাদাখ সীমান্তে;

জাতিসংঘের চাপ: মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে ভারত আন্তর্জাতিক চাপ বা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে।

৬) মানবিক বিপর্যয়

সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ: গোলাবর্ষণ, বিদ্যুৎ বিপর্যয়, খাদ্য ও জলের সংকট, ঘরবাড়ি ধ্বংস ও জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে;

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধসে পড়বে: হাসপাতালে রোগীর চাপ সামলানো অসম্ভব হবে;

মানসিক আঘাত: যুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হবে।

আমরা শেষ পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ দেখেছি ১৯৭১ সালে। পরিস্থিতি কী ভয়াবহ হতে পারে সেটা আজকের জমানার কেউ ভাবতেও পারবে না। আজ রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে দুই দেশের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে, আমরা সকলেই অবগত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোটা ইউরোপের কী ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল তা আমরা কেউ ভুলিনি। যে সমস্ত রাজনৈতিক লোকেরা ঘরের নিশ্চিন্ত কোণে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধের গর্জন শোনাচ্ছে ও প্রলাপ বকছে, তারা বা তাদের সন্তান-সন্ততিরা কখনই কোনও যুদ্ধে যায় না, এমনকি সমাজে সংঘটিত কোনও ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে রাস্তার জলে-রোদে নেমে প্রতিবাদটুকুও করে না, মজার ব্যাপার, সেই তারাই আজ যুদ্ধের সব থেকে বড় প্রচারক।

আমরা আশ্বস্ত যে, ভারত-পাক সংঘর্ষ তিনদিনের বেশি গড়ায়নি ও যে ভাবেই হোক আপাত বিরতি ও শান্তি ঘোষিত হয়েছে। 


1 comment:

  1. অপূর্ব বিশ্লেষণ। লেখক এবং প্রকাশককে ধন্যবাদ এরকম একটি মূল্যবান লেখা সামনে আনার জন্যে ।

    ReplyDelete