Monday, 26 May 2025

'নিস্তার নাহি কাহারও সটকে'

কারা যুদ্ধ চায়?

তরুণ লালা



গত ৭ মে ভারতীয় সময় রাত ১:০৫ থেকে ১:৩০-এর মধ্যে, ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে নয়টি স্থানে বিমান হামলা চালায়। এই অভিযানটি 'অপারেশন সিন্দুর' বলে প্রচারিত হয়, যা পহেলগাঁও'এ সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার সরাসরি প্রতিক্রিয়া। সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়, 'এই হামলাগুলোর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী, যেমন জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তইবা'র সঙ্গে জড়িত অবকাঠামোগুলি। এই অভিযান শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে এবং পাকিস্তানি সামরিক বা বেসামরিক স্থানগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।'

তবে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, এতে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এবং অসামরিক স্থাপনা, যেমন মসজিদের, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খুব স্বাভাবিক, একে অপরকে আড়াল করতে এই ধরনের কিছু বিতর্ক থাকবেই।

ভারতের এই বিমান হামলার পর পাকিস্তান জম্মু অঞ্চলে মর্টার শেল ছুঁড়ে প্রতিশোধ নেয়। কথিত, তাতে ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন এবং গুরুতর সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। পরবর্তী কয়েক দিনে এই দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যার ফলে ১০ মে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি 'যুদ্ধ'বিরতির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের দেশে বেশ কিছু মানুষ এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং দেশের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি ও সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সোফিয়া কুরেশি'র ওপর ভয়ঙ্কর ট্রোল শুরু করে দেয় (অথচ যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছেন, সেই সরকার-প্রধানদের বিরুদ্ধে কিন্তু টুঁ শব্দটিও নেই)। এতে সামিল হয়ে পড়ে শাসক দলের কিছু নেতা-মন্ত্রীরাও, যাদের বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থা সরব হলেও শাসক দল বা প্রশাসনের তেমন কোনও হেলদোল দেখা যায় না। ফলে, কোন অংশের মানুষ এই যুদ্ধ উন্মাদনার সমর্থক ও প্রচারক তা বেশ স্পষ্ট বোঝাও যায়! 

যদিও এই 'সিন্দুর অভিযান' ভারতের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করে— এটি ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তানি ভূখণ্ডে ভারতের সবচেয়ে গভীর অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে আমার সাদা মনে কয়েকটা প্রশ্ন ছিল। এই যে এত রক্তপাত, বিপুল খরচ (যার বোঝা পড়ছে আপনার, আমার এবং সকল করদাতাদের উপর) এবং অসংখ্য প্রাণহানি (আমাদের দিকের)— ওদের দিকের কয়েকজন নিরীহ মানুষকে যদি ছেড়েও দিই— এর আসল ও শেষ উদ্দেশ্যটা আপনার মতে ঠিক কী? তা কি

১) পাকিস্তানকে পুরো দখল করা? 

২) নাকি বালুচিস্তানকে মুক্ত করা? 

৩) নাকি পাক-অধিকৃত কাশ্মীর (POK) অধিগ্রহণ?

৪) নাকি শুধু জঙ্গি/সন্ত্রাসবাদীদের নির্মূল করা (তাও কীভাবে? সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে?) 

৫) নাকি পাকিস্তানকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা?

৬) না অন্য কিছু? (দুই দেশেরই কর্ণধারের উদ্দেশ্য হতে পারে এই সুযোগে গদি আঁকড়ে থাকা বা দখল করা। From power (which corrupts) to absolute power (which corrodes)??!)

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, কেবল প্রতিবেশীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার কল্পিত আত্মতৃপ্তির বাইরে গিয়ে সত্যিই জানতে চাই, এই যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তার ব্যাপক প্রভাব সম্পর্কে। বলাই বাহুল্য, পহেলগাঁও'এর ওই অপরাধ ছিল জঘন্য, বর্বর এবং বীভৎস। কিন্তু, আমরা যদি সেই পাঁচজন হত্যাকারীকে এখনও চিহ্নিতই না করতে পারি, গ্রেফতার বা নিকেশ করা তো দূরের কথা, তাহলে আমরা ঠিক কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি? আর সেইজন্যই জানতে চাই, এই যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? ওপরের যে বিকল্পগুলো বললাম, তার কোনটি?

কিন্তু আজ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনও সদুত্তর পেলাম না। উল্টে আমার এক প্রতিবেশী, যিনি একজন প্রথিতযশা CA, তাঁর এমন এক প্রতিক্রিয়া পেলাম (অনুরূপ কথা আরও কেউ কেউ বলেছেন) যার তর্জমা করলে দাঁড়ায়: 

'আমি এখনও মনে করি যে ভারত একটি বিশাল ভুল করেছে, যখন পাকিস্তানের ওপর বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও আমরা পিছিয়ে এসেছি। আমাদের উচিত ছিল পাকিস্তানকে পাঁচটি ভাগে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা— বেলুচিস্তান ও সিন্ধকে স্বাধীন করে দিয়ে, এবং PoK ও গিলগিট-বালতিস্তানকে ভারতের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত করে নেওয়া। এখন PoK ও গিলগিট অংশ খুব শীঘ্রই চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (PLA) দ্বারা দখল হয়ে যাবে এবং ভারতের নাগালের বাইরে চিরতরে চলে যাবে।'

তিনি আরও যোগ করেন:

'বাংলাদেশ সীমান্তেও একই অবস্থা। আমাদের উচিত ছিল, এবং এখনও সম্ভব, আমাদের 'চিকেনস নেক'-এর পাশের ওপরের অংশ (রংপুর অঞ্চল) কেটে আলাদা করা এবং তাদের 'চিকেনস নেক' কেটে চট্টগ্রাম দখল করে নেওয়া। কিন্তু আমাদের সরকার পাছে সারা বিশ্ব কী বলবে, সেই চিন্তায় জর্জরিত। আমরা খুবই বেশি ‘গণতান্ত্রিক’। খুব শীঘ্রই চীন লালমনিরহাটে (আমাদের চিকেনস নেক-এর একেবারে গায়ে) একটি বিশাল বিমানঘাঁটি গড়ে তুলবে এবং কিছু অর্থের বিনিময়ে দরিদ্র বাংলাদেশের থেকে চট্টগ্রাম বন্দরও নিয়ে নেবে। এরপর আমাদের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরবঙ্গ ধীরে ধীরে চীনের দখলে চলে যাবে। আর সমতল ভূমিতে, বিশেষ করে বাংলার ফ্রন্টে, আমরা তাদের আটকানোর মতো শক্তি রাখি না। আমাদের সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে আমাদের পশ্চিম, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব তিন দিকেই বিষ ফল মেনে নিয়ে আমাদের দেশকে আরও ছোট হয়ে যেতে দিতে হবে।'

উপরের এইসব প্রলাপ সম্পর্কে বক্তব্য পরে রাখব, আগে সামান্য ভাবা যাক, সত্যিই যদি যুদ্ধ বাঁধত তাহলে পরিস্থিতি কী হত:

১) সামরিক প্রভাব

ব্যাপক প্রাণহানি:  হাজার হাজার সৈনিক ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার আশঙ্কা, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চল যেমন পাঞ্জাব, রাজস্থান ও জম্মু-কাশ্মীরে। কিছু নিরীহ প্রাণহানি তো ঘটেওছে;

পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি: উত্তেজনা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যা উভয় দেশের জন্যই ধ্বংসাত্মক। একে আষাঢ়ে গল্প বলে ফেলে দেওয়া যাবে না;

সামরিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি: অপরিসীম আর্থিক ক্ষতির বিনিময়ে ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং নৌবাহিনীর জাহাজ ধ্বংস হওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা;

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ঝুঁকি: যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সেনাবাহিনী অতিরিক্ত চাপে পড়বে এবং অন্য সীমান্ত (যেমন চীনের সঙ্গে) দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

২) অর্থনৈতিক প্রভাব

শেয়ার বাজারে ধস: যুদ্ধ শুরু হলে বাজারে ব্যাপক পতন হবে, যার ফলে কোটি কোটি টাকার আর্থিক সম্পত্তির ক্ষয় হবে (যা সংঘর্ষ শুরু হতেই বেশ মালুম হয়েছে);

বৈদেশিক বিনিয়োগ স্থগিত: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বাজারে চলে যাবে, উভয় দেশের প্রতি আস্থা হারাবে;

বাণিজ্য ব্যাহত হবে: শিল্প রফতানিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বিশেষত আইটি, ফার্মা, গার্মেন্টস ইত্যাদিতে;

মুদ্রার মূল্যের পতন: ভারতীয় টাকার মূল্য অবশ্যই পড়ে যাবে, যার ফলে আমদানির খরচ এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে;

তেলের দামের উর্ধ্বগতি: যুদ্ধজনিত অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়বে, যা ভারতের আর্থিক ভারসাম্যে বড় ধাক্কা দেবে;

অর্থ বরাদ্দের পুনর্বিন্যাস: বিশাল পরিমাণ অর্থ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করতে হবে, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পরিকাঠামোর বরাদ্দ থেকে কেটে নিতে হবে।

৩) সামাজিক ও নাগরিক প্রভাব

মানুষের স্থানচ্যুতি: সীমান্ত এলাকার মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি হবে।

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা: যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ধর্মীয় বিভাজন বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ওপর সন্দেহ বাড়তে পারে, যা হিংসা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে;

সন্ত্রাসী প্রতিক্রিয়া: জঙ্গি সংগঠনগুলো এই অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে বড়সড় হামলা চালাতে পারে।

৪) রাজনৈতিক প্রভাব

উগ্র জাতীয়তাবাদ বাড়বে: প্রাথমিক ভাবে চলতি সরকার 'দেশপ্রেমে'র জোয়ারে অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা পেতে পারে;

দীর্ঘমেয়াদে অসন্তোষ: যদি যুদ্ধ দীর্ঘ হয় এবং প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষতি হয়, জনরোষ বাড়বে;

গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস: সেন্সরশিপ, কারফিউ, নজরদারির মতো পদক্ষেপ বাড়বে। অভ্যন্তরীণ 'ইমারজেন্সি' ঘোষিত হতে পারে। তার বিরূপ ফলে আমরা আগেই ভুক্তভোগী;

নির্বাচনে প্রভাব: যুদ্ধের ফলাফল রাজনৈতিকভাবে সরকারকে সাহায্য বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

৫) আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রভাব

ভারতের ভাবমূর্তিতে ধাক্কা: ভারত শান্তিপূর্ণ শক্তি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে উপস্থাপন করতে চায়—যুদ্ধ সেই ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে;

যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য মিত্রদের চাপ: যুদ্ধ হলে কৌশলগত অংশীদারিত্বগুলো প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে;

চীনের সুযোগ: চীন কূটনৈতিক বা সামরিকভাবে সুযোগ নিতে পারে, বিশেষ করে লাদাখ সীমান্তে;

জাতিসংঘের চাপ: মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে ভারত আন্তর্জাতিক চাপ বা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে।

৬) মানবিক বিপর্যয়

সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ: গোলাবর্ষণ, বিদ্যুৎ বিপর্যয়, খাদ্য ও জলের সংকট, ঘরবাড়ি ধ্বংস ও জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে;

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধসে পড়বে: হাসপাতালে রোগীর চাপ সামলানো অসম্ভব হবে;

মানসিক আঘাত: যুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হবে।

আমরা শেষ পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ দেখেছি ১৯৭১ সালে। পরিস্থিতি কী ভয়াবহ হতে পারে সেটা আজকের জমানার কেউ ভাবতেও পারবে না। আজ রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে দুই দেশের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে, আমরা সকলেই অবগত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোটা ইউরোপের কী ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল তা আমরা কেউ ভুলিনি। যে সমস্ত রাজনৈতিক লোকেরা ঘরের নিশ্চিন্ত কোণে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধের গর্জন শোনাচ্ছে ও প্রলাপ বকছে, তারা বা তাদের সন্তান-সন্ততিরা কখনই কোনও যুদ্ধে যায় না, এমনকি সমাজে সংঘটিত কোনও ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে রাস্তার জলে-রোদে নেমে প্রতিবাদটুকুও করে না, মজার ব্যাপার, সেই তারাই আজ যুদ্ধের সব থেকে বড় প্রচারক।

আমরা আশ্বস্ত যে, ভারত-পাক সংঘর্ষ তিনদিনের বেশি গড়ায়নি ও যে ভাবেই হোক আপাত বিরতি ও শান্তি ঘোষিত হয়েছে। 


Saturday, 24 May 2025

মধ্যবিত্তের পড়তি আয়

মধ্যবিত্ত কি প্রায়-বিলোপের পথে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

সারা বিশ্বে যেমন, তেমন আমাদের দেশেও দেখা যাচ্ছে, কাজ অনেক মিলছে বটে, যদিও অধিকাংশ কাজগুলিই অস্থায়ী চরিত্রের, কিন্তু আয় নামছে নিচের দিকে। একমাত্র ব্যতিক্রম ঠিকা মজদুর ও সরকারি চাকরির কর্মক্ষেত্র। ঠিকা মজুরদের দৈনিক আয় বাড়ছে, কারণ, সেখানে চাকরির অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার বালাই নেই, বরং, তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারলে মজুরি বাবদ খরচ সর্বমোটে কমই পড়ে। আর অন্যদিকে সরকারি কর্মক্ষেত্রে ডিএ বাড়ে, না বাড়লে মামলা করে আদায়ও করা যায়, নতুন বেতন কমিশন বসে; লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন যখন সরকারি কোষাগার ঋণ করেও টানা যায়।

আসলে, মধ্যবিত্ত সমাজই পড়ে গেছে এক মহা ফ্যাসাদে। এই যে ফুরফুরে আইটি সেক্টর, যাদের কর্মীদের ঠাটবাটে এক সময়ে সরকারি কর্মচারীরাও লজ্জা পেতেন, দেখা যাচ্ছে, গত ২০১১ সালে আইটি সেক্টরে নতুন কর্মীর বার্ষিক আয় যেখানে শুরু হত ৩.২ লক্ষ টাকা থেকে, ২০২৪’এ এসে তা শুরু হচ্ছে ৩.৫ থেকে ৩.৭ লক্ষ টাকায়। ১৩ বছরে আয় বৃদ্ধি মাত্র ৯ শতাংশ, বছরে ১ শতাংশেরও কম। অথচ, মুদ্রাস্ফীতির বার্ষিক বৃদ্ধির হার অন্তত ৪ থেকে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১১ সালে আইটি সেক্টরে কাজ করতে ঢোকা কর্মীটি যতটুকু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতেন, আজ যিনি কাজে ঢুকছেন তাঁর সে স্বাচ্ছন্দ্য অনেক অনেক কম।  

এক সময়ে মধ্যবিত্ত সমাজের এক বৃহৎ অংশ ছিল সরকারি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের কর্মচারীরা, যেমন বড় বড় রাষ্ট্রীয় ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, ব্যাঙ্ক, বীমা ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রের শ্রমিক, বাবু ও আমলারা। গত তিন দশকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের বিদায় হয়েছে, সরকারও কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে, ফলে, এক বড় অংশের জনতা মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আর বেসরকারি ক্ষেত্রেও কর্মী নিয়োগ বেশ সংকুচিত, যারা আছে তাদের আয় পড়তির দিকে, অতএব, এই অংশের মধ্যবিত্তরাও এখন বিলোপের পথে। হিসেব নিয়ে দেখুন, আইআইটি’এর মতো প্রিমিয়ার প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২৪ সালে পাশ করা ছাত্রদের ৩৮ শতাংশ কোনও চাকরিই পায়নি। তাহলে বাকী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কী অবস্থা তা তো বোঝাই যাচ্ছে! আর যারা চাকরি পায়, তাদের একটা বড় অংশের মাইনেপত্রের অবস্থা কিন্তু যথেষ্ট করুণ। রইল বাকী কিছু পেশাদারি কাজ, যেমন, ডাক্তারি, ওকালতি, শিল্পকর্ম, পরামর্শ-প্রদান প্রভৃতি সহ শিক্ষকতা, স্বাস্থ্যকর্ম, মাঝারি দোকানদারি বা ব্যবসা, গবেষণা, যেখানে রীতিমতো লড়ে জায়গা তৈরি করতে হয়, সকলের নিশ্চিত ভালো রোজগার যে হয় তাও নয় এবং জনসংখ্যার অনুপাতেও এরা নগণ্য।

কেন এই পরিণতি? আর আমরা যাচ্ছিই বা কোন পানে?

এর পিছনে সর্বপ্রধান কারণ দুটি: এক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে বহু কাজের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, যা যন্ত্রসমাজ আরও নিপুণ ভাবে করে দিতে সক্ষম। তাই, মনুষ্যশ্রমেরও নিয়োগ পূর্ণ ও আংশিক উভয় মাপেই ক্রমশ কমছে। যারা এখনও কাজে থাকছেন তাদেরও বিদায় যেহেতু নিকটবর্তী তাই মজুরি বা মাইনে বাড়ার প্রশ্নও আর নেই; দুই, খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে লাগামছাড়া খরচ, অতি-উচ্চ বাড়ি ভাড়া, তার ওপর ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ-সুবিধা প্রশস্ত হওয়ায় গাড়ি-বাড়ি-পণ্য ক্রয়ে ঋণের চাপ— এইসব বিবিধ জাঁতাকলে মধ্যবিত্ত সমাজ আরও বিপদগ্রস্ত। ২০২৪ সালের তথ্য বলছে, আমাদের দেশে গৃহস্থালী ঋণ বেড়ে এখন জিডিপি’র ৪২.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একদিকে আয়ের পতন অন্যদিকে খরচের ভার, তারপর যদি তা লাগামছাড়া ঋণের জালে আটকে পড়ে, তাহলে আত্মহনন। দেখা যাবে, গত কয়েক বছরে বিপর্যস্ত মধ্যবিত্তের আত্মহত্যার সংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে।

যদিও তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ মধ্যবিত্ত, যাদের বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা, এবং কারও কারও অনুমান, ২০৩১ সালে গিয়ে তা পৌঁছবে ৩৮ শতাংশে। কিন্তু তা কি সত্যি পৌঁছবে? প্রথমত, পড়তি আয়ের নিরিখে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ যে নিম্নবিত্ত হয়ে পড়ছে ও দ্বিতীয়ত, সর্বত্র স্থায়ী চাকরির সংকোচন ও যেটুকু বা নিয়োজন তাও খুব কম মাইনেতে, ফলে, মধ্যবিত্ত সমাজে নতুন জনসংযোজন কিন্তু অপ্রতুল।

তাই, সমাজটা ক্রমেই অতি ধনী ও নিম্নবিত্ত— এই দুই বর্গেই ভাগ হয়ে পড়ছে, যেখানে মধ্যবর্তী এক বিশাল মধ্যবিত্ত সমাজের যে অস্তিত্ব গত কয়েক দশকে গড়ে উঠেছিল তার বাস্তবতা আর থাকছে না। যেটুকু যতটা এখনও আছে, তা রেশ মাত্র, কতকটা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে আগের প্রজন্মের গচ্ছিত অর্থ ও সম্পদের জেরে আরও কিছুকাল বয়ে চলা। অথচ নতুন বাস্তবতা হল, অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও কমছে— নিম্নবিত্ত মানুষ কিন্তু দরিদ্র নয়, আবার মধ্যবিত্তও নয়, কারণ, তাদের বার্ষিক আয় আমাদের দেশের নিরিখে ৫ লক্ষ টাকার নিচেই।

দাঁড়াচ্ছে এই, গড়ে উঠতে থাকা বিশাল এই নিম্নবিত্ত সমাজের মানুষেরা বেঁচে থাকবে নানাবিধ খুচরো ও অস্থায়ী কাজে যুক্ত থেকে এবং সরকারি জনকল্যাণ প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে। এই জনকল্যাণের প্রকল্পই তাদের দরিদ্র হয়ে পড়া থেকে রক্ষা করে। তাই আজ অর্থনৈতিক ভাবে জনকল্যাণের রাজনীতির এতটাই গুরুত্ব। নিম্নবিত্তদের মধ্যে থেকে বিশেষ কেউ কেউ পেশাদারি সাফল্যে মধ্যবিত্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে পারে, কেউ বা অতি ধনীও হতে পারে, কিন্তু দুই বর্গের আয়ের তুমুল বৈষম্যই হবে সাধারণ ভাবে কঠিন বাস্তবতা। এটাই পুঁজিবাদের আজকের নতুন ধরন। কারণ, সমাজটাই পরিচালিত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত এমন এক যন্ত্রসমাজের দ্বারা যারা একদিকে সামাজিক উদ্বৃত্ত উৎপন্ন করতে ও অতি মুনাফার পাহাড় জমাতে সক্ষম, অন্যদিকে সেই উদ্বৃত্তের কিছুটা ভাগ দিয়ে সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র্য মোচনেও ওস্তাদ।

তাই, পুঁজিবাদের আজ আর বহু মানুষ সম্বলিত মধ্যবিত্ত সমাজের দরকার নেই, কারণ, ‘white-collar job’ বলে যে মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক কাজগুলি এতদিন তারা করে এসেছে, তা আজ যন্ত্রসমাজ আরও নিপুণ, নিখুঁত ও ত্বরিৎ গতিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম।

                

Friday, 23 May 2025

বানু মুশতাক

'সাহিত্য এখনও সেই পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে একটি...'

আবু সঈদ আহমেদ



কন্নড় লেখিকা, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী বানু মুশতাক তাঁর ছোটগল্প সংকলন 'হার্ট ল্যাম্প'এর জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার (২০২৫) জিতে কন্নড় ভাষায় এই প্রথম ইতিহাস তৈরি করেছেন। বিচারকরা তাঁর গল্পের চরিত্রদের প্রশংসা করেছেন এই ভাষায়, 'astonishing portraits of survival and resilience.'। তাঁর এই সম্মাননার আগে আমরা বাঙালিরা কজন তাঁকে চিনতাম বা তাঁর কাজ সম্পর্কে জানতাম? সত্যিই কি আমরা এই বৈচিত্র্যময় দেশে পরস্পরকে এখনও চিনি?

তাঁর নিজের কাজ সম্পর্কে এই বিরল সম্মাননার অধিকারী মুশতাক বলেন, 'এই বইটির জন্ম এই বিশ্বাস থেকে যে, কোনও গল্পই কখনও ছোট হয় না; মানুষের অভিজ্ঞতার ছন্দে প্রতিটি সূত্রই সমগ্রের ওজন ধারণ করে। ... যে বিশ্ব প্রায়শই আমাদের বিভক্ত করার চেষ্টা করে, সাহিত্য এখনও সেই শেষ পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে একটি যেখানে আমরা একে অপরের মনের ভিতরে বাস করতে পারি, এমনকি কয়েক পৃষ্ঠার জন্যও।'

বানু মুশতাক ১৯৪৮ সালের ৩ এপ্রিল কর্নাটকের হাসানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বেড়ে ওঠা কর্নাটকের পাহাড়ি মালনাড় অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রামে। পরে তিনি ব্যবসায়ী মহিয়উদ্দিন মুশতাকের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তাঁর লেখালেখির শুরু ১৯৭০-এর দশকে এবং ১৯৭৪ সালে 'প্রজামাথা' নামে একটি সাময়িকীতে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে তিনি কবি ও লেখক পি লঙ্কেশ (নিহত সমাজকর্মী ও সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের পিতা) সম্পাদিত ট্যাবলয়েড 'লঙ্কেশ' পত্রিকায় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮০-এর দশকে তিনি কন্নড় সাহিত্যের বান্দায়া আন্দোলনের সঙ্গে  জড়িয়ে পড়েন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য এই আন্দোলন প্রতিবাদের ঐতিহ্যে চিহ্নিত হয়েছিল, যা মুসলমান ও দলিত সহ প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে সে আন্দোলনে স্থান দেয়। ১৯৮৩ সালে তিনি হাসান সিটি মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন; দুটি মেয়াদে এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালে মুশতাক সাংবাদিকতা ছেড়ে তাঁর পরিবারকে সাহায্য করার জন্য আইনজীবী হিসেবে জীবিকা শুরু করেন।

বছরের পর বছর ধরে মুশতাকের লেখা অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ স্থানীয় ও জাতীয় পুরস্কার জিতেছে, যার মধ্যে রয়েছে কর্নাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার এবং দানা চিন্তামণি আত্তিমব্বে পুরস্কার। ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রকাশিত মুশতাকের পাঁচটি ছোটগল্প সংকলনের অনূদিত ইংরেজি সংকলন - 'হাসিনা এবং অন্যান্য গল্প' - ২০২৪ সালে PEN অনুবাদ পুরস্কার জিতেছে। ২০০০ সালে 'মুসলমান মহিলাদের মসজিদে প্রবেশের অধিকারের পক্ষে' তাঁর প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় মুশতাক এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে তিন মাসের 'সামাজিক বয়কট' ঘোষণা করা হয়। সেই সময় তিনি ভয়ঙ্কর সব টেলিফোন কল পান এবং একদিন এক ব্যক্তি তাঁকে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা করে কিন্তু তাঁর স্বামীর সাহায্যে সেদিন তিনি বেঁচে ফেরেন। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে চিকমাগালুর জেলার বাবা বুদানগিরিতে মুসলমানদের একটি সমকামী মাজারে যেতে বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টার প্রতিবাদে মুশতাক নাগরিক সমাজের দল 'কোমু সৌহার্দ বেদিক'এ যোগ দেন। মুশতাক স্কুলে মুসলমান শিক্ষার্থীদের হিজাব পরার অধিকারকে সমর্থন করেছেন, যা কর্নাটকের আদালতে এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

তাঁর একটি গল্প 'কারি নাগরাগালু' (কালো গোখরো) যা 'হার্ট ল্যাম্প'-এ অন্তর্ভুক্ত, গিরিশ কাসারাবল্লির পুরস্কারপ্রাপ্ত কন্নড় ছবি 'হাসিনা'-তে (২০০৪) চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল। প্রধান অভিনেত্রী তারা হাসিনা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন। এই গল্পের কাহিনি এক ভারতীয় মুসলমান মহিলাকে নিয়ে যে তার স্বামী দ্বারা পরিত্যক্ত হয়। গল্পে হাসিনা তার মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অটোচালক ইয়াকুবকে বিয়ে করে। এই দম্পতির তিন মেয়ে: দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মুন্নি, শুব্বি ও হাবিবা। তাদের চতুর্থ সন্তান যখন গর্ভে, তারা সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য গর্ভাবস্থা স্ক্যান করে। যখন ইয়াকুব জানতে পারে যে সেটি আরও একটি মেয়ে, তখন সে পালাক্রমে নির্যাতনকারী ও অবহেলাকারী হয়ে ওঠে। অবশেষে হাসিনাকে পরিত্যাগ করে।

বানু মুশতাক তাঁর ছয় দশকের দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে ৬০টিরও বেশি গল্প লিখেছেন। তাঁর গল্পগুলি ইতিমধ্যেই ছয়টি সংকলনে প্রকাশিত। ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মুশতাকের লেখা ১২টি ছোটগল্প সম্বলিত 'হার্ট ল্যাম্প' দক্ষিণ ভারতে বসবাসকারী মুসলমান নারীদের কষ্টের কথা মর্মস্পর্শী ভাবে তুলে ধরেছে। তাঁর এইসব অসাধারণ গল্পগুলির মধ্যে সেরা কয়েকটি হল: হেজ্জে মুদিদা হাদি (১৯৯০), বেঙ্কি মালে (১৯৯৯), এদেয়া হানাতে (২০০৪), সাফিরা (২০০৬), হাসিনা মাত্তু ইতারা কাঠেগালু (২০১৫) ও হেন্নু হাদিনা স্বয়ম্বরা (২০২২)। গল্পগুলি কর্নাটকে কথিত কন্নড় থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি। আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জেতা প্রথম ভারতীয় অনুবাদক ভাস্তি বলেন, তিনি আশা করেন যে এই পুরস্কার কন্নড় ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ভাষার সাহিত্য এবং অনুবাদের কাজকে বিপুল ভাবে উৎসাহিত করবে।

ভারতে বইটির প্রকাশক পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া'র প্রধান সম্পাদক মানসী সুব্রহ্মণ্যম বিবিসিকে বলেন যে এই পুরস্কার আঞ্চলিক সাহিত্যের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য জয়। তাঁর ভাষায়, '২০২২ সালে 'টম্ব অফ স্যান্ড'এর ঐতিহাসিক জয়ের পর (গীতাঞ্জলি শ্রী'র বইটি হিন্দি থেকে ডেইজি রকওয়েল অনুবাদ করেছিলেন) এই বছর 'হার্ট ল্যাম্প'এর সম্মান এমন একটি শক্তিশালী স্মারক যে তা ভারতের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের প্রতি আমাদের পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে।'


Sunday, 18 May 2025

এবার বলতে বাকী 'জয় শ্রীট্রাম্প'

সেনাবাহিনীকেই আক্রমণ?

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



কুঁয়ার বিজয় শাহ'র পর জগদীশ দেবড়া! ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অসম্মান করতে বেপরোয়া। কুরুচিকর মন্তব্যে এঁরা কেউ কম যান না।

যে সেনাবাহিনী সন্ত্রাস ও তার মদতদারদের চোখে চোখ রেখে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের প্রতি কু বা অবমাননাকর মন্তব্য করা কেন? আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় এসব অপকর্ম হঠাৎ করে বা মুখ ফসকে নয়, এটা দীর্ঘ লালিত এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ম্যানিফেস্টেশন। কারণ, দেখাই যাচ্ছে, আদালতের কড়া ধমকের পরেও প্রশাসন বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিজয় শাহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও হেলদোলই নেই। মনে রাখতে হবে, উগ্র জাতীয়তাবাদ হয়তো রাজনৈতিক দলের জন্য সাময়িক ডিভিডেন্ড এনে দিতে পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় তা রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি হয়ে উঠলে সাড়ে সর্বনাশ। বিপন্ন সময়ের সেই ধ্বনিই এখন শুনতে পাচ্ছি। আমার বলতে দ্বিধা নেই, সেই গোধরা পর্ব থেকে এখন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সহযোগীরা কোনও রাজধর্ম পালন করেননি, কুর্শি'তে বসে স্রেফ সেলফ-মেড 'হিন্দুধর্ম'এর রাজনীতি করে চলেছেন। 

আচ্ছা বলুন তো, মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী দফতরের মন্ত্রী কুঁয়ার বিজয় শাহ কেন হঠাৎ কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে টার্গেট করলেন? আগে দেখে নেওয়া যাক বিজয় ঠিক কী বলেছেন। তিনি বলেন, 'ওরা আমাদের হিন্দু ভাইদের পোশাক খুলে ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করে হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীজী ওদের বোনকে ওদের বাড়িতে হামলার জন্য পাঠিয়েছেন। ওরা আমাদের বোনকে বিধবা করেছে, তাই মোদীজী ওদের সম্প্রদায়ের বোনকেই ওদের পোশাক খুলে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন।' এই মন্তব্যে কোথাও কর্নেল সোফিয়া কুরেশির নাম না নিলেও মন্তব্য যে তাঁকে উদ্দেশ্য করেই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অপারেশন সিঁদুরের পর দেশকে সেই ঘটনার ব্রিফ করেছিলেন সেনাবাহিনীর তরফে কর্নেল কুরেশি। তাঁকে 'জঙ্গিদের বোন' বলে উল্লেখ করাটা শুধু সোফিয়াকে নয়, গোটা সেনাবাহিনীকে অসম্মান। কেননা, এই ব্রিফিং করতে কেউ নিজের ইচ্ছে মতো এসে বসে পড়তে পারেন না। সেনাকর্তাদের কম্যান্ডেই এটা হয়।

ফলে, আদতে সেনাবাহিনীকেই ছোটো করা। আর সেটাই যে বিজেপির একাংশের মানসিকতা, তা পরমূহুর্তেই প্রমাণ করে দিলেন জগদীশ দেবড়া। মধ্যপ্রদেশের এই উপমুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'আমি অপারেশন সিঁদুরের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আজ গোটা দেশ, দেশের সেনাবাহিনী ও প্রত্যেক জওয়ান ওঁর চরণে মাথা নত করেছে। ওনার চরণে নতমস্তক হয়েছে গোটা দেশ। কারণ, উনি যোগ্য জবাব দিয়েছেন। যা বলেছিলেন তাই করেছেন।' এই বক্তব্যের ভিডিও দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। দেশপ্রেমী মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদবের ডেপুটির এই মন্তব্যকে সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত অসম্মান বলে মনে করছেন। সেনার গায়ে রাজনীতির রঙ লাগিয়ে ভোট রাজনীতিতে সাফল্য কুড়োতে চাইছে বিজেপি। অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যকে ব্যক্তি মোদীর সাফল্য বলে তুলে ধরতে চাইছে। তবে এর চেয়েও মারাত্মক, এই সাফল্যর ধুনিতে মুসলিম বিরোধী জিগির তোলা হচ্ছে। 

বিজয় শাহদের মতো বিজেপিওয়ালাদের সেনার ওপর সবচেয়ে বেশি ক্ষোভের কারণ কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে এগিয়ে দেওয়ায়। এই লড়াকু ভারত কন্যা ইসলামাবাদের মসজিদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হানার প্রতিবাদ করে স্পষ্ট  বলেছেন, 'ভারত কোনও ধর্মস্থানে আঘাত করেনি, কেননা, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।' আমার ধারণা, সোফিয়ার মুখে  'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটা শুনেই তাদের মাথায় আঘাত লেগেছে। আরএসএস থেকে বিজেপি, এরা সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি বাদ দিতে বহুদিন থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদের একটি অতিপ্রিয় গালি হল, 'সেকু'। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেই তাকে 'সেকু' বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক এখান থেকেই যুদ্ধ-বিরোধী মিছিলের ওপর বিজেপি চড়াও হচ্ছে। খাস কলকাতার বুকে এ কাণ্ড ঘটেছে। গত বুধবার রাতেও বারাসতের টালিখোলার আরিফবাড়ি এলাকায় মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী বাপ্পা ভূঁইয়ার বাড়িতে এদের একটি বড় দল চড়াও হয়। মৌলালিতে যুদ্ধ-বিরোধিতার পক্ষ নিয়ে পথে নামা লোকজনের দলে ছিলেন বাপ্পার মেয়ে। অভিযোগ, তাঁর পোস্টকে দেশ বিরোধী বলে দাবি করে হামলাকারীরা শাসানি দিয়ে গেছে যে, মেয়েকে ক্ষমা চাইতে হবে। কোনও সহনাগরিক যদি ওদের পঙক্তিতে না পড়ে, তবে তার অসীম দুর্বিপাক। একজন সহনাগরিকের যে প্রশ্ন করার অধিকার থাকতে পারে, ভিন্ন মত থাকতে পারে, এ কথা তারা বিশ্বাসই করে না। শুধু তাই নয়, আমাদের মতো যারা যুদ্ধবিরোধী, তাদের ইউএপিএ ধারায় গ্রেফতার করে বিচার চায় তারা।

মানে আমি-আপনি কেউ বলতে পারব না, আমরা যুদ্ধ চাই না। বলতে পারব না, যুদ্ধ কোনও সমস্যার স্থায়ী সমাধান আনতে পারে না। অথচ নরেন্দ্র মোদী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বলতে পারেন যে, 'যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়, আলোচনা করেই সঙ্কট মেটাতে হবে।' ঠিক আছে, মোদীর বেলা ছাড়। তিনি বিশ্বগুরু, তাই তাঁর ব্যক্তি স্বাধীনতা আর আমার মতো এলিতেলি গুজরালির ব্যক্তি স্বাধীনতা কখনই এক মাত্রার নয়। 

ওহে ভক্তকুল, আমি না হয় আপনাদের মতো যুদ্ধবাজই হলাম। দুর্যোধনের মতো বললাম, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। কিন্তু তারপরেই যে প্রশ্নটি আমার মাথায় আসছে, অপারেশন সিঁদুর লঞ্চ করে আমরা যখন 'পাকিস্তানকে পেড়ে ফেলেছিলাম', 'গুঁড়িয়ে দেওয়া' হয়েছিল পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ৯টি জঙ্গি ঘাঁটি আর সেই অবস্থায় গোটা দেশবাসী যখন পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার দাবিতে ফুঁসছিলেন, যখন আমরা যুদ্ধবাজ ভক্তরা ভাবতে শুরু করেছিলাম (গোদি মিডিয়াও ভিডিও গেমসে সে সব দেখাচ্ছিল), দু'-একদিনের মধ্যে ঘুম থেকে উঠে দেখব লাহৌরের রাজপথে শিস দিতে দিতে ভারতীয় সেনা ঘুরে বেড়াচ্ছে, করাচি বন্দর নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের নৌসেনা, ঠিক তখনই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে সেই স্বপ্নভঙ্গ করে দেওয়া হল কেন? আরও আশ্চর্য, যুদ্ধবিরতি বা সংঘর্ষ বিরতি ঘোষণা করলেন ১৩ হাজার কিলোমিটার দূরে বসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! তাঁর নিজের 'ট্রুথ' সোশ্যাল হ্যান্ডলে সিজফায়ারের ব্রেকিং দিয়েছিলেন তিনি! সমাজমাধ্যমে তাঁর ঘোষণায় সারা বিশ্ব জেনে গেল সংঘর্ষ বিরতির কথা। এরপর মুখ রাখতে আমাদের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি সংক্ষিপ্ততম সাংবাদিক সম্মেলনে সিজফায়ার ঘোষণা করলেন বটে, কিন্তু এমন কাণ্ডে ৫৬ ইঞ্চি কি এক ধাক্কায় ২৬-এ নেমে এল না! যদিও ভারত গত কয়েক দিনে সরাসরি ট্রাম্পের নাম না করলেও ঠারেঠোরে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে সংঘর্ষ বিরতির সিদ্ধান্ত ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক। কিন্তু তারপরও অন্তত আরও তিনবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি ছিল, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ বিরতির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনিই।

এমনকি বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও ট্রাম্প নিঃসংশয়ে বলেন, 'পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হচ্ছিল। হঠাৎ করে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দেখা দিতে শুরু করল। আমরা এটিকে থামাতে পেরেছি। দু’দিন আগেও আমার মনে হচ্ছিল, হয়তো এটির সমাধান হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সমস্যা মিটে গিয়েছে। আমরা ওদের (ভারত এবং পাকিস্তান) সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমরা বলেছিলাম যুদ্ধের বদলে ব্যবসা করার কথা।' আর কিছুটা হুমকির সুরেই ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তাঁর প্রশাসন ভারত এবং পাকিস্তানকে বলেছিল সংঘর্ষ বন্ধ না-করলে আমেরিকা দুই দেশের সঙ্গে কোনও বাণিজ্য করবে না। ভারত-পাকিস্তানকে একাসনে বসিয়ে যেন তিনিই সবক শেখালেন, ভাবখানা তেমনই। ট্রাম্পের এই ঔদ্ধত্য বহু দেশপ্রেমী ভারতীয়কে আঘাত দিলেও দিল্লির শাসকদের যে কিছু এসে যায়নি তা তাদের নীরবতা দেখেই সকলে বুঝেছেন।

অবশ্য আমাদের বিদেশমন্ত্রক সাংবাদিক সম্মেলন করে জানায় যে, গত ৭-১০ মে'র (ভারত-পাক সংঘর্ষের সময়) মধ্যে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও আলোচনাতেই বাণিজ্যের প্রসঙ্গ আসেনি। যদি নাই আসে তবে অ্যাপেল নিয়ে ট্রাম্প কেন পরোক্ষ থ্রেট দেবেন? বাণিজ্য মহলের খবর, অ্যাপলের সিইও টিম কুকের সঙ্গে বৈঠকের সময়ে ট্রাম্প নাকি তাঁকে স্পষ্ট চেতাবনি দেন, 'তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু শুনছি তুমি নাকি গোটা ভারত জুড়ে আইফোনের উৎপাদন বাড়াতে চাইছ। আমার কিন্তু সেটা মোটেই পছন্দ নয়। চাইলে তুমি ভারতে অ্যাপেলের পণ্য তৈরি করতেই পার। কিন্তু ভারতে শুল্কের হার খুব বেশি। তাই ভারতে অ্যাপেলের পণ্য বিক্রি করা খুব কঠিন হবে।' ট্রাম্পের দাবি, ভারত নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এমন নীতি গ্রহণ করবে যেন মার্কিন পণ্যে কোনও শুল্কই না থাকে। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প চান না ভারতে অ্যাপেলের কারখানা হোক। 

কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি হল, সাংসদ-অভিনেত্রী তথা মোদীভক্ত কঙ্গনা রানাউত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে এক্স হ্যান্ডেল'এর পোস্টে লেখেন, 'ভারতের প্রতি ট্রাম্পের ভালোবাসা হারানোর কারণ হল, প্রথমত, তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেও বিশ্বের সবচেয়ে প্রিয় রাষ্ট্রনেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী; দ্বিতীয়ত, এটা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ কিন্তু নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদ এবং তৃতীয়ত, ট্রাম্প নিঃসন্দেহে একজন আলফা মেল হলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী হলেন সব আলফা মেলদের বাবা। আপনাদের কী মনে হয়? এটা ব্যক্তিগত ঈর্ষা নাকি কূটনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা?’ কিন্তু বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা অভিনেত্রীকে কড়া ধমক দিলে কঙ্গনা রানাউত বিস্ফোরক পোস্টটি ডিলিট করে দেন। আরও হাস্যকর, সে কথা জানিয়ে কঙ্গনা লিখেছেন, ‘সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডাজী আমাকে ফোন করে ট্রাম্প-টিমকে নিয়ে করা পোস্টটি মুছে ফেলতে বলেন। তাই ডিলিট করে দিলাম। আমার ইনস্টাগ্রাম থেকেও সেই পোস্ট ডিলিট করলাম। ধন্যবাদ।’

তার আগে গত ১০ এপ্রিল নিয়ম মতো ভারতের তরফে সংবাদমাধ্যমের কাছে যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করেন বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি। আর যায় কোথা! সোশ্যাল মিডিয়ায় গোটা গেরুয়া শিবির ঝাঁপিয়ে পড়ে মিস্রি'র ওপর। রবিবার সকাল থেকে এক্স-হ্যান্ডলে দেশের বিদেশ সচিবকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ শুরু করে ভক্ত বাহিনী। গেরুয়া শিবিরের ট্রেনিং প্রাপ্ত এই ট্রোল-বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পাননি বিক্রম মিস্রি'র কন্যা ও তাঁর গোটা পরিবার। কতটা অসহায় অবস্থায় পড়লে শেষ পর্যন্ত সমাজ মাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্টটি লক করে দিতে বাধ্য হন বিদেশ সচিব। ভাবুন, মোদী সরকারের বিদেশ সচিব যদি এই 'ফ্যাসিস্ত' বাহিনীর হাত থেকে রেহাই না পান, তবে আমার-আপনার হাল কী? দেশের বিদেশ সচিবের পারিবারিক ছবির নীচে ‘দেশদ্রোহী’, ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে কুৎসা করার পাশাপাশি মানবাধিকার বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করায় বিদেশ সচিবের আইনপড়ুয়া মেয়েকেও আক্রমণ করা হয়। এমনকী, বিক্রম-কন্যার ফোন নম্বরও ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ তো সরাসরি যুদ্ধবাজ নাৎসি বাহিনীর গুন্ডাদের কাজ! তার আগে এই ভয়ঙ্কর ট্রোল বাহিনী পহেলগামে সদ্য নিহত জওয়ানের স্ত্রী হিমাংশী নারিওয়ালকে পর্যন্ত ছেড়ে কথা বলেনি। আমাদের কি এক গৃহযুদ্ধের পথে ঠেলে দিতে চাইছে এই নাৎসি বাহিনী? 

আমি এই গেরুয়া বাহিনীকে বলব, হিম্মত থাকলে মোদীর প্রিয় বন্ধু ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হও না দেখি! সে বেলা মুরোদ হবে না। কঙ্গনারই হল না, আর তোরা তো কোন ছাড়। দেখবি তখন শাহ'র বাহিনী তোদেরই কী অবস্থা করে! বলিয়ে ছাড়বে 'জয় শ্রীট্রাম্প'।


Friday, 9 May 2025

মুদ্রাস্ফীতির গণনায় খাদ্যপণ্য বাদ!

বৃহৎ পুঁজির একবগগা স্বার্থে সরকার?

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়



এইবার মুদ্রাস্ফীতির গণনায় ব্যাপক ফাঁক রাখতে খাদ্যপণ্যকে মুদ্রাস্ফীতির সূচক তালিকা থেকে বাদ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার; অথচ খাদ্যপণ্যেই দাম বাড়ে গড়ে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ! দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ভালোমন্দ যে সমস্ত জিনিসের দামের ওঠানামার সঙ্গে যুক্ত, তাকেই এরা উপেক্ষা করতে চাইছে। অর্থাৎ, দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি কম করে দেখাতে চাইছে। সেই মর্মে প্রস্তাব এসেছে এবারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে অর্থমন্ত্রক থেকে আবেদন করা হয়েছে, এভাবেই ভেবে দেখার জন্য। কিন্তু তাতে লাভ কার? কীভাবে? পুঁজির স্বার্থ ছাড়া এই সরকার আর কিছু কি ভাবে?   

মুদ্রাস্ফীতি গণনার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সেই নিয়মে এ দেশের প্রায় ২০০টি পণ্যের দাম নিয়ে প্রতি সপ্তাহে তা নিরূপণ করা হয়। খাদ্যপণ্য ছাড়াও ভাড়া এবং নানা পরিষেবা ও উপযোগিতামূলক খরচ,  আবাসন খরচ, পেট্রোলের মতো পরিবহন খরচ, স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদিকে ধরা হয়। খোলা বাজারে পাইকারি ও খুচরো বিক্রির দাম উভয়কেই ধরে দু'রকম দামের ভিত্তিতে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির হার গোনা হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেশে মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নগদের জোগান কমিয়ে-বাড়িয়ে, তার জন্য ব্যাঙ্কের রেপো রেট কমে-বাড়ে। সেই সূত্রে সুদের হার কমানো বাড়ানো হয়। বাণিজ্যের স্বার্থে শিল্প মহল সর্বদাই চায় এই সুদ কমিয়ে রাখা হোক। তাতে তাদের ঋণের উপর সুদের খরচ কমে। কিন্তু সেই খরচ কমলেই যে জিনিসের দাম কমে তা নয়, ফলে পুঁজির মুনাফা বাড়ে। কম্পাউন্ডিং হিসেবে এই মুনাফা বেশ অনেকখানি হয়। ঠিক ততখানিই চাপে পড়ে সাধারণ মানুষ এবং আমজনতার পকেট থেকে গুনাগারও যায় ঠিক ততটাই, যদি না মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে ঠিক ঠিক অঙ্ক কষে সুদ বাড়ানো বা কমানো হয়। ভারতের মতো অর্থ ব্যবস্থায় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দায়িত্ব আমজনতার কথা ভেবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রয়োজনে সুদের হার বাড়িয়ে নগদের জোগান কমিয়ে নেওয়া। তাতে বড়লোকদের উপর চাপ পড়লেও সাধারণ মানুষ বাঁচে। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই রীতি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।

এই নিয়েই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর রঘুরাম রাজনের সঙ্গে সরকারের গোলমাল শুরু। পরবর্তীকালে অন্য গভর্নরদেরও ভূমিকা মেনে নিতে পারেনি মোদি সরকার। তারা চায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্ষমতা খর্ব করে তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে বেশি বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করানোর জন্য সুদের হার কমিয়ে দিতে। এটা চাইলেই হয় না, অত  সোজা কথাও নয়। তা অর্থনীতির জটিল হিসেবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নগদের জোগান বেড়ে গেলে জিনিসের দাম বাড়বে তখন দেশের উৎপাদন খরচ বাড়বে, কর্মসংস্থান কমবে, মানুষের সঞ্চয় কমবে এবং দেশের রফতানি বাণিজ্যেও তার প্রভাব পড়বে। তাই শিল্পপতিদের বিনিয়োগ খরচ কমাতে সুদের হার কমিয়ে রাখলেই দেশের উন্নয়ন হবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয় বরং উল্টোটাই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাতে সর্বনাশ। মোদি সরকার এই ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করে অর্থনীতির ভারসাম্যটা নষ্ট করতে চাইছে শুধুমাত্র পুঁজির স্বার্থে। তাদের বক্তব্য, তা না হলে বিনিয়োগ আসবে না, আর পুঁজির উন্নয়ন না হলে দেশের সর্বনাশ। 

স্বার্থ ও ভাবনাচিন্তার এই মেরুকরণের ফলে বিরক্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নররা। প্রত্যেকেই তাঁদের মতো করে এর বিরোধিতা করেছেন। বস্তুত, সারা বিশ্বেই মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, জিনিসের দাম ওঠা নামা, অর্থনীতিতে নগদের জোগান এবং সুদের হার ঠিক রাখার দায়িত্বটা সেই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হাতেই থাকে। এখানে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে দেশের অর্থনীতি ও আমজনতা ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব কিছু জেনেও মোদি চাইছেন তাঁর মতো করে চলতে। ঠিক যে ভাবে নোট বাতিলের সময় তিনি একরোখা অবস্থান নেন, এই ব্যাপারেও তাঁর মনোভাব তেমনি।

তাই, সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না-- এমন একটি ফর্মুলা তৈরি করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের বক্তব্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে রেপো রেট ঠিক করে তা নির্ধারণের সময় যেন খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে আর বিচার না করা হয়। রঘুরাম রাজন এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর থাকাকালীন তিনি নিজেই রেপো রেট নির্ধারণের সময় উৎপাদকের মূল্য, যাকে বলে প্রোডিউসার প্রাইস ইনডেক্স (বা পিপিআই), তা দেখে এগোতেন। পরবর্তীকালে সরকারের তরফে কেন্দ্রের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরন গত ২৩-২৪ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ফের একই কথা বলেন। এবারে সরকারের বক্তব্য একটু অন্যরকম: মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির ফলে সুদের ওঠানামা নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যা খুশি করছে করুক, তাতে সরকার আর কোনও হস্তক্ষেপ করবে না, তবে মুদ্রাস্ফীতি গণনার ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যের দামটা বাদ রাখা হোক। কারণ, দেশে সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ে খাদ্যপণ্যের। আর দাম বৃদ্ধি হলে সুদ কমানোর জায়গা থাকে না। তাই মুদ্রাস্ফীতির হার নিরূপণের ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যকে সরিয়ে অন্য কিছু রাখা হোক যার দাম কমে কিংবা খুব বেশি বাড়ে না। তাহলে মুদ্রাস্ফীতি কম দেখানো যাবে, ফলে, সুদের হার আরও কম হবে। পুঁজি মহল সন্তুষ্ট হবে।

কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে নগদের জোগানের নিয়ন্ত্রণ হবে না। আরও বেশি অসাম্য বাড়বে। যে মুষ্টিমেয় শ্রেণির মানুষ যথেষ্ট নগদ ও ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী, কেবলমাত্র তারাই ভালো থাকবে। আর যারা সীমিত আয়ের মধ্যে দিন গুজরান করেন, তাদের জন্য জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারের টনক নড়ানোর মতো কেউ থাকবে না। এখন যেরকম ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার ফলে মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেলে আলোচনা শুরু হয়ে যায় অর্থনীতির শীর্ষ মহলে, কারণ, বর্তমানে পণ্যের খুচরো দরে মূল্যবৃদ্ধি নির্ধারণে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অংশ ৪৬ শতাংশ! স্বাভাবিকভাবেই মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে সুদের হার বাড়ানো বা কমানোর নীতি। খাদ্যপণ্যকে বাদ দিলে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির হার কম দেখাবে। কিন্তু তাতে প্রকৃত দাম বাড়তে থাকবে। রাজনের কথায়, 'খাদ্যপণ্যের দর যদি দীর্ঘ সময় বেশি থাকে তাহলে চাহিদার তুলনায় জোগান কম ধরে নিতে হবে। এর অর্থ ভারসাম্য বজায় রাখতে অন্য ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি কমাতে হবে। যা শীর্ষ ব্যাঙ্ক করতে পারে'; আর সেটাই যদি শীর্ষ ব্যাঙ্ক না করে তাহলে আমজনতাকে পুড়তে হবে দাম বৃদ্ধির আগুনে, অন্যদিকে সরকার ঘোষণা করবে দাম বৃদ্ধি হচ্ছে না, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। তাতে শীর্ষ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাতে পথ পাবে।

উদ্যোগপতিদের কথা ভেবে সরকার এই পথেই এগোতে চায়। কিন্তু আমজনতা, যাঁরা সীমিত অর্থে সংসার চালান, তাদের কথা কে ভাববে?


Tuesday, 6 May 2025

'সেই তো মল খসালি...'

হঠাৎ উলটো পথে হাঁটা কেন

সোমা চ্যাটার্জি



পহলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সৌদি সফর বাতিল করে তড়িঘড়ি দেশে ফিরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার আট দিন পর যখন দেশের বহু মানুষ, বিজেপি'র ক্যাডারকুল, এমনকি বিরোধী দলগুলি পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদী তথা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আশা করেছিল, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী প্রথমে নিজে সর্বদলীয় বৈঠকে অনুপস্থিত থেকে বিহারের নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করলেন, তারপর আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে বৈঠক সারলেন। ঠিক তার দু' দিন পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত নিল যে জাতপাতের আদমশুমারি হবে। এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে অনেকেই হতবাক, কারণ, এ তাবৎ মোদিজী স্বয়ং, অমিত শাহ এবং আদিত্যনাথ সহ সংঘ পরিবার জাতপাতগত গণনার তীব্র বিরোধিতা করে এসেছে। 

মাত্র এক বছর আগে ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে যারা জাতপাত গণনার জন্য তদ্বির করেছিল, মোদিজী তাদের 'শহুরে নকশাল' বলে নিন্দা করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ 'বাঁটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে' এবং 'এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়'— এই স্লোগান দিয়ে জাতপাতগত জনগণনার দাবিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বরং মুসলমান-ভয় দেখিয়ে 'হিন্দু ঐক্য'কে জোরদার করতে বলেছিলেন। ২০২৩ সালে যখন আরজেডি এবং কংগ্রেসের সমর্থনে নীতীশ কুমারের সরকার বিহারে একটি জাতপাত ভিত্তিক আদমশুমারি পরিচালনা করে, তখন মোদী তাকে 'হিন্দু সমাজকে জাতপাতের ভিত্তিতে ভাগ করার পাপ' বলে অভিহিত করেন। উপরন্তু, তিনি বিহারের সরকারি চাকরিতে প্রান্তিক শ্রেণির জন্য কোটা বাড়িয়ে ৬৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেন।

বোঝাই যাচ্ছে, বিজেপি'র এই হঠাৎ ভোলবদল আপাতভাবে আসন্ন বিহার বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের একটি কৌশলগত রাজনৈতিক চাল, কোনও বাস্তব কর্মসূচি নয়। কারণ, এই জনগণনার কোনও নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়নি বা ২০২৫-২৬ সালে এর জন্য নির্দিষ্ট কোনও বাজেটও বরাদ্দ হয়নি। সকলেই জানেন, শেষ জাতপাত ভিত্তিক আদমশুমারি হয়েছিল ১৯৩১ সালে। 

ভারতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা সামাজিক ও শিক্ষাগত ভাবে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলিকে উন্নত করার জন্য ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ভারতের সংবিধানে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায়সঙ্গত প্রতিনিধিত্বের প্রচারের জন্য শিডিউল কাস্টস (এসসি), শিডিউল ট্রাইবস (এসটি) এবং পরে অন্যান্য অনগ্রসর জাতি (ওবিসি)-র জন্য সংরক্ষণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়; ১৯৭৯'এর ১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের অধীনে সামাজিক ও শিক্ষাগত ভাবে অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন সংসদ সদস্য বিপি মণ্ডল। মণ্ডল কমিশনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ ছিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি চাকরিতে ২৭ শতাংশ আসন সংরক্ষণ। ১৯৯০ সালে ভিপি সিং সরকার মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ আংশিক বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের ফলে দেশ জুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তখন আরএসএস সমর্থিত বিজেপি 'এক জাতি, এক ধর্ম' এই শ্লোগান তুলে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকার ফেলে দেয়। সেই সময়ই রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠার মূল এজেন্ডা'কে সামনে রেখে আদবানি'র নেতৃত্বে বিজেপি রামরথ যাত্রা শুরু করেছিল, যা 'মণ্ডল বনাম কমণ্ডল' রাজনীতির সূত্রপাত বলে অনেকের অভিমত।

আমরা জানি, মণ্ডল কমিশনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, সংরক্ষণ অবশ্যই যোগ্যতা ও সমতার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ হবে, শুধুমাত্র প্রমাণের মাধ্যমেই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে ওবিসি-র সংরক্ষণ সর্বোচ্চ ৫0 শতাংশ অতিক্রম করতে পারে। এর ফলে ৫০ শতাংশ সীমা সমগ্র দেশে সংরক্ষণের জন্য একটি নির্দেশক হয়ে ওঠে এবং কয়েকটি রাজ্য এই সীমা অতিক্রম করার সপক্ষে যুক্তি দেয়; যেমন, ১৯৯৪ সালে তামিলনাড়ুতে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি কর্মসংস্থানের ৬৯ শতাংশ সংরক্ষণ করা হয়, ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রে মোট সংরক্ষণ হয় ৬৮ শতাংশ, তেমনই রাজস্থানেও সরকার গুজ্জর সম্প্রদায় সহ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলির অতিরিক্ত সংরক্ষণ চেয়েছিল, যদিও সেটি তদন্ত সাপেক্ষ। তদুপরি, ২০২২ সালে ঝাড়খণ্ড সরকার ওবিসি, এসসি, এসটি'দের জন্য ৭৭ শতাংশ সংরক্ষণ নীতি প্রস্তাব করেছে, ছত্তিশগড় সম্প্রতি এসটি, এসসি ও ওবিসি সম্প্রদায়ের জন্য ৭৬ শতাংশ সংরক্ষণ করার প্রস্তাব এনেছে। এমনকি উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে উপজাতি জনসংখ্যার একটি বড় শতাংশ রয়েছে যা নিয়েও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হচ্ছে। আবার অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্নাটক সুবিধা-বঞ্চিত গোষ্ঠীগুলিকে অতিরিক্ত সংরক্ষণ প্রদানের জন্য ৫০ শতাংশের সীমাকে চ্যালেঞ্জ করে বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।  

মণ্ডল কমিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল ওবিসিদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করা। সরকারি চাকরি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন সংরক্ষণের ফলে ওবিসি'রা একটি বৃহত্তর কণ্ঠস্বর ও ভারতীয় রাজনীতিতে প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছে। সামাজিক ভাবেও আসন সংরক্ষণ ওবিসিদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ উন্মুক্ত করায় তাদের সামাজিক অবস্থানের ধীরে ধীরে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আরএসএস ও বিজেপি প্রথম থেকেই এটিকে নেতিবাচক প্রবণতা হিসেবে চিহিত করে এসেছে। তাদের মতে এটি জাতপাতগত বিভাজনকে শক্তিশালী করে। কারণ, তাদের মূল লক্ষ্যই হিন্দু-মুসলমান বিভাজন। 

দেখাই গেছে, গত ৩৪ বছর ধরে বিজেপি সামাজিক ন্যায়বিচারের দলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রাম, অযোধ্যা, মথুরা, কাশী, সম্ভল, ঔরঙ্গজেব, বাবর-- এইসব ধর্মীয় বিষয়গুলিকে লাগাতার ব্যবহার করেছে। তবে, পহলগামের ঘটনাকে সামনে রেখে বিজেপি বিভাজনমূলক এজেন্ডা বাস্তবায়িত করার জন্য চেষ্টা চালালেও মোদী বুঝতে পেরেছেন, শুধু ধর্মের ভিত্তিতে এবারের ভোট বাক্স দখল করা যাবে না। কারণ, বিজেপি প্রথম থেকেই কংগ্রেসের মতো উচ্চবর্ণের ভোটের উপর নির্ভরশীল এবং কোনও জাতপাতের বিভাজন স্বীকার করে না। বিহারের মতো জায়গায় যেখানে ১৭ শতাংশ মুসলমান ভোটার, সেগুলি সবই আরজেডি-কংগ্রেস-সিপিআই(এমএল) জোটের দিকে যাবে। সে ক্ষেত্রে বিহারে বিজেপি জোটের পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা মুশকিল হবে যদি না নিম্নবর্ণের ভোটগুলিকে বিশেষ কোনও উপায়ে টেনে আনা যায়। তাই, এখন সম্পূর্ণ উলটো পথে হেঁটে যুদ্ধের ভানটুকু বজায় রেখে সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে কীভাবে নিজেদের এজেন্ডায় পরিণত করা যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে জাতপাত গণনার ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত।

এছাড়াও ওয়াকফ বিল নিয়ে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছে। জাত-গণনার জন্য ইন্ডিয়া জোট ও বিরোধী দলের প্রবল চাপ তো ছিলই এমনকি শরিক দল যেমন জেডিইউ, এলজেপি'র মতো দলগুলির কাছেও নতি স্বীকার করতে বাধ্য হল মোদি সরকার। তাছাড়া উত্তরপ্রদেশে বিজেপি'র খারাপ ফলের অন্যতম কারণই ছিল পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ভোটকে নিজেদের দিকে টানতে না পারা।

আদমশুমারিতে জাতপাত গণনার মূল চ্যালেঞ্জ হবে জাত নির্ধারণ এবং মোট সংখ্যাকে তালিকাভুক্ত করা। এই তালিকায় পৌঁছনোর জন্য আদমশুমারি কমিশনারকে অবশ্যই শিক্ষাবিদ, ব্যক্তি, জাত গোষ্ঠী, রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে, কারণ, ১৯৩১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারিতে ৪১৪৭'টিরও বেশি জাত ও উপজাত গণনা হয়েছিল, যার মধ্যে খ্রিস্টান, ইসলাম, জৈন, বৌদ্ধ ও হিন্দু ব্রাহ্মণরাও ছিল। ১৯৩১ সালে গবাদি পশুর সঙ্গে যুক্ত জাতের একটি গোষ্ঠী নিজেদের 'যাদব' হিসাবে চিহ্নিত করে এবং কিছু উপজাতি ও জাতকে একত্রীভূত করা হয়।

বর্তমানে ৩৬৫১'টিরও বেশি সম্প্রদায়কে ওবিসি, ১১৭০'টি এসসি এবং প্রায় ৮৫০'টি এসটি হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। ২০১১ সালে জরিপের সময় জাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে অনেকেই তাঁর উপ-জাত ও গোত্র, কোনও ঋষির নাম উল্লেখ করেছিলেন। সুতরাং, এসইসিসি'র উল্লিখিত ৪৬'টি 'জাত'এর মধ্যে পদবী, উপ-জাত ও গোষ্ঠী আছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাছাড়া একটি নির্দিষ্ট জাতের বিভিন্ন পরিবারের বিভিন্ন উপাধি থাকতে পারে। সরকার নীতি আয়োগের তৎকালীন সহ-সভাপতি অরবিন্দ পানাগারিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে যাতে এসইসিসি'র বিশৃঙ্খলা দূর করা যায়, কিন্তু কমিটি এখনও তাদের প্রতিবেদন পাঠায়নি এবং সরকার জাত সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করেনি।

জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের প্রাক্তন অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি মোহনন বলেন, বিভিন্ন অঞ্চলে একই জাতের বিভিন্ন নাম অথবা একই নাম থাকতে পারে। কিছু কিছু এলাকায় বিভিন্ন মানুষ একই জাতের নাম ভিন্নভাবে লিখতে পারে। জনগণনা শুরু করার জন্য মোহনন সরকারকে তাদের রেজিস্টারে নথিভুক্ত সমস্ত জাতের নাম প্রকাশ করার পরামর্শ দেন। মোহনন বলেছেন যে, জাতিগত জনগণনা হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, কারণ, 'মুসলমান, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধরা সমজাতীয় নয়', তাদের মধ্যেও বিবিধ সামাজিক গোষ্ঠী রয়েছে, তাই তাদের জনসংখ্যাও এই বিভাগ অনুযায়ী গণনা করা উচিত।

বিহারই প্রথম রাজ্য যেখানে ২০২৩ সালে জেডি (ইউ), আরজেডি সহ অন্য সমস্ত দল মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে বিহারে একটি সমীক্ষা করে এবং পরবর্তীকালে তার ভিত্তিতে সংরক্ষণ ৬৫ শতাংশে বৃদ্ধি পায়; এর উপর ছিল EWS'এর জন্য ১০ শতাংশ কোটা। ২০২৪ সালের জুন মাসে পাটনা হাইকোর্ট বিহার সংরক্ষণের সংশোধনী সম্পর্কিত আইন বাতিল করে দেয়। পরে বিহার সরকার সেই আদেশের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলেও স্থগিতাদেশ পায়নি। অতএব, ৫০ শতাংশ সীমা সহ পূর্ববর্তী সংরক্ষণই অব্যাহত আছে। এই সিদ্ধান্তকে সংবিধানের নবম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দায়িত্ব এখন মোদী সরকারের। কিন্তু হঠাৎ করে আবার জাত গণনা ঘোষণার মাধ্যমে মোদী সরকার আগের গণনাগুলি বাতিল করে পুরো বিষয়টি অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। 

বর্তমানে জাতগত তথ্য না থাকার কারণে এবং সুপ্রিম কোর্টের ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ সীমার ভিত্তিতে ওবিসি সংরক্ষণ ২৭ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, যা ভারতের ওবিসি জনসংখ্যার আনুমানিক অনুপাতে অনেক কম। এমনকি এই ২৭ শতাংশ সংরক্ষণও ধাপে ধাপে এসেছে— প্রথমে ১৯৯০ সালে সরকারি চাকরিতে এবং পরে ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কিন্তু একটানা সরকারি চাকরি সংকোচন, আমলাতন্ত্রের উচ্চ পর্যায়ে সংরক্ষণ এড়াতে ল্যাটারাল এন্ট্রির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং সম্প্রতি উচ্চবর্ণদের জন্য আনা অর্থনৈতিক ভিত্তিক সংরক্ষণের ফলে সংরক্ষণ ব্যবস্থা তার কার্যকারিতা অনেকটাই হারিয়েছে। তাছাড়াও জাতপাতের গণনা নিম্নবর্ণের সংরক্ষণ আরও বৃদ্ধি করবে, উচ্চবর্ণের কমবে। এই অবস্থায় সমাজবাদী ও বামপন্থী দলগুলি তুলনামূলক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও তা বিজেপির কাছে একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ, বহু বছর ধরে বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক উচ্চজাত ভিত্তিক। তাই জাত গণনার জন্য ওকালতি করে তারা কীভাবে ওই ভোট ব্যাঙ্ক টিকিয়ে রাখবে তা দেখার ব্যাপার। অবশ্য, কংগ্রেসেরও উচ্চজাতের ভোট হারানোর ভয় আছে।

কথায় বলে, 'সেই তো মল খসালি/ তবে কেন লোক হাসালি!'