Wednesday 25 August 2021

জাতীয় সম্পদের নগদ লুঠ

বিমুদ্রাকরণের পর এখন মুদ্রাকরণ

সোমনাথ গুহ


এক বিমুদ্রাকরণের ঠ্যালায় মানুষের এখনও নাভিশ্বাস উঠছে, এবার এল মুদ্রাকরণ- সরকারি সম্পদের মুদ্রাকরণ বা নগদিকরণ। এটা সরকারি সম্পদ বেহাত করার একটা নতুন কল- অ্যাসেট মনেটাইজেশন প্ল্যান। সরকারি অভিধান অনুযায়ী ‘বেহাত’ কথাটা ব্যবহার করা ঠিক নাও হতে পারে, কারণ, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন, কোনও সম্পদ বিক্রি করা হচ্ছে না, মালিকানা সরকারের থাকবে। তিনি এই সম্পদগুলিকে বলছেন de-risk brownfield assets। ব্রাউনফিল্ড অর্থে, অব্যবহৃত বা অল্প ব্যবহৃত সম্পদ যেগুলি ঠিক মতো ব্যবহার না করার ফলে অপচয় হচ্ছে। আয়ের উপায় খুঁজে বার করার জন্য সেগুলিকে বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হবে। উদ্দেশ্যটা হচ্ছে, সে সবের মধ্যে যে বিনিয়োগ তালাবন্দি হয়ে পড়ে আছে তা উন্মুক্ত করা। তারা সেই অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহার করে নতুন উদ্যোগ গড়ে তুলবে। 

মনে করা হচ্ছে যে, স্টার্ট-আপ'এর কোনও খরচ বা নতুন নির্মাণের খরচ না লাগার কারণে বেসরকারি সংস্থা এই সম্পদগুলিকে ব্যবহার করতে উৎসাহী হবে। ডি-রিস্ক মানে বোঝাই যাচ্ছে, ঝুঁকি কমানো, কোনও সম্পদকে নিরাপদ করা, যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা যেতে পারে। যেমন, প্রভিডেন্ট ফান্ডে যে লক্ষ কোটি টাকা থাকে সেটা বিশ বছর আগেও সরকারের তহবিলে পড়ে থাকত এবং কর্মচারীরা একটা স্থায়ী হারে তার ওপর সুদ পেত। সরকার মনে করল, এটা ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং, সেটা সে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করল। বিশ বছর আগে এটা ভাবাই যেত না, ইউনিয়ন হল্লা করে দিত। এখন সে রামও নেই অযোধ্যাও নেই! সরকারের একটা আয়ের উপায় খুলে গেল। অপর দিকে কর্মচারীদের সারা জীবনের কষ্টার্জিত উপার্জনের টাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল। এখন সুদ বাজারের সাথে ওঠানামা করে। ২০০০ সালেও পিএফ সুদ ১২ শতাংশ ছিল, এখন ৮.৫ শতাংশ (সুদ কমার অন্য কারণও আছে যেটা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়)। পিএফ'এ গচ্ছিত টাকা কর্মচারীদের কিন্তু তহবিলের মালিকানা সরকারের হাতে। কীসে ঝুঁকি আছে, কীসে নেই- সেটা সরকার নিজের মাপকাঠিতে ঠিক করছে। শেয়ারে টাকা খাটানোর ফলে সরকারের লাভ, কিন্তু কর্মচারীর ঝুঁকি। অনেক প্রাইভেট কোম্পানি পেনশনের গচ্ছিত টাকা সিনেমা প্রযোজনায় লাগিয়ে দেয়। যদি দু' চারটে ছবি ফ্লপ হয় তবে পেনশন হরিবোল হয়ে গেল!  

ধরা যাক আমার ফলতার কাছে একটা বাগানবাড়ি আছে। ছুটিছাটাতে সেখানে যাওয়া হয়, বাকি সময় সেটা ফাঁকা পড়ে থাকে। তো আমি সেটাকে ফেলে না রেখে AIRBNB'এর সাথে চুক্তি করলাম। গঙ্গার ধারে সুন্দর মনোরম ব্যবস্থা। AIRBNB সেটা চড়া দামে পর্যটকদের ভাড়া দেওয়া শুরু করল, আমাকে লাভের ২৫ শতাংশ দিল। আমি ভাবলাম, ভালোই তো সম্পত্তিটা পড়ে ছিল, সেটা থেকে এখন ঘরে বসে কিছু উপার্জন হচ্ছে। আমার বন্ধু যেমন তার মারুতি ইকো গাড়ি ছাত্রছাত্রী পরিবহনে কাজে লাগায়। এমনিতে তার পরিবার মাসে কয়েকটা দিন মাত্র সেটা ব্যবহার করত, বাকি সময় সেটা গ্যারেজে পড়ে থাকত। এখন সেটা থেকে তার ভালো আয় হচ্ছে, ব্যাংকের ঋণও চটজলদি শোধ হচ্ছে। 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' চালু হওয়ার পর থেকে বহু কোম্পানির, বিশেষ করে আইটি সেক্টরের অফিস, খালি পড়ে আছে। এই খালি স্পেস ফেলে না রেখে তারা এখন ছোট কোম্পানিকে সেগুলি ভাড়া দিচ্ছে। 

এগুলি সবই ব্যক্তিগত বা বেসরকারি সম্পত্তি ফেলে না রেখে উপার্জনক্ষম করে তোলার কয়েকটি উদাহরণ। শুনে মনে হয় ভালোই তো, সম্পদ ফেলে না রেখে সেটা থেকে যদি উপার্জন হয় তাতে ক্ষতি কী? এই যে গঙ্গার পাড় ধরে আদিম প্রেতাত্মার মতো চটকলগুলো পড়ে আছে, সেগুলি থেকে যদি আয়ের ব্যবস্থা করা যায় তো মন্দ কী?  কিংবা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন শ্বেতহস্তীর মতো পড়ে থাকে, বছরে মেরেকেটে দশটা খেলা হয়, সেটাকে যদি অন্য কোনও ভাবে ব্যবহার করে ওতে যা বিনিয়োগ হয়েছে তা উশুল করা যায় তাহলে তো ভালোই। কিন্তু সরকার যেটা করছে সেটা হল, অর্থনীতির যে মূল চালিকাশক্তিগুলি যেমন, সড়ক, রেল, জাহাজ বন্দর, বিমানবন্দর, খনি, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহন ইত্যাদি- লিজ, ভাড়া, কনসেশনমূলক নানা মডেলের ভিত্তিতে বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে। এটা ভয়ঙ্কর।    

৬ লক্ষ কোটি টাকা বাজার থেকে তোলার জন্য সরকার এই প্রকল্প শুরু করতে চাইছে, যেটা তারা বলছে পরিকাঠামো তৈরি করতে ব্যবহার হবে। দেখা যাক তারা কী কী সম্পদ হস্তান্তর করতে চাইছে:

ক) সড়ক (২৭ শতাংশ) যার থেকে আয় হবে ১,৬০,২০০ কোটি টাকা। এর জন্য ২৬,৭০০ কিমি রাস্তা বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হবে। তারা টোল আদায় করবে, রাস্তার দু' ধারে বাহারি বিপণি, রিসর্ট, ধাবা, বার খুলবে, উপার্জন করবে, একটা লভ্যাংশ সরকারকে দেবে;

খ) রেল (২৫ শতাংশ)- আয় ১,৫২,৪৯৬ কোটি টাকা, ৯০টা প্যাসেঞ্জার ট্রেন, ৪০০টা স্টেশন (নিউ দিল্লি, মুম্বাই সহ) প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হবে;

গ) টেলিকম (৬ শতাংশ)- আয় ৩৫,১০০ কোটি টাকা, যার জন্য ২,৮৬,০০০ কিমি ভারত নেট ফাইবার নেটওয়ার্ক এবং BSNL ও MTNL'এর ১৪,৯১৭টা মোবাইল টাওয়ার বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিকে হস্তান্তর করা হবে;

ঘ) এছাড়া বন্দর, বিমানবন্দর, তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহন, খনি এমনকি খেলার স্টেডিয়ামও আছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী চার বছরে এই প্রকল্প থেকে আয় হবে: 

২০২২: ৮৮,০০০ কোটি টাকা

২০২৩: ১,৬২,০০০ কোটি টাকা

২০২৪: ১,৭৯,০০০ কোটি টাকা

২০২৫: ১,৬৭,০০০ কোটি টাকা। 

এই সব সম্পদই কি অব্যবহৃত? যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের মতো কিছু স্টেডিয়াম অব্যবহৃত, নিউ দিল্লি স্টেশনও কি তাই? রেলের কোনও হিসাব আছে এই স্টেশন থেকে কত আয় হয়? রাজধানী বা শতাব্দী এক্সপ্রেস কি অলাভজনক? লখনউ থেকে দিল্লি তো বেসরকারি তেজাস এক্সপ্রেস চালু হয়েছে, সাধারণ ট্রেনের থেকে ভাড়া প্রায় ৩০০-৩৫০ টাকা বেড়ে গেছে। এই সব ট্রেন হবে পয়সাওয়ালা মানুষের জন্য, সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। লক্ষাধিক কিমি কেবল লাইন, বিএসএনএল'এর টাওয়ার প্রাইভেট কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে। অতীতে আমরা দেখেছি, সরকারি নীতির ফলে কী ভাবে বিএসএনএল'কে রুগ্ন করে পুরো টেলিকমের বাজার জিও, এয়ারটেল, ভোডাফোনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বিএসএনএল এতদিনে 4G'ও চালু করতে পারল না অথচ তার পরিকাঠামো ব্যবহার করে প্রাইভেট কোম্পানিগুলি রমরমিয়ে চলছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহনের দায় যদি বেসরকারি হাতে যায় তাহলে যে বিদ্যুতের বিল আকাশছোঁয়া হবে এটা নিশ্চিত। এমনিতে কৃষকরা সংশোধিত বিদ্যুৎ বিল ২০২০'র বিরোধিতা করছেন। এই সংশোধনের ফলে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বেসরকারি কোম্পানির প্রবেশ ঘটবে, ভর্তুকি রদ হবে এবং সেচের খরচ ৫০০ শতাংশ বেড়ে যাবে। 

প্রকল্পটি একেবারেই স্বচ্ছ নয়, বহু ধূসর জায়গা আছে। প্রথম কথা, সরকার বলছে টাকা নেই; সরকারি সম্পদ ও বেসরকারি পুঁজির মেলবন্ধনে উন্নয়নে জোয়ার আসবে। টাকা নেই কথাটা ক্লিশে হয়ে গেছে। এই অজুহাত দিয়ে রিজার্ভ ব্যাংকের টাকাতেও সরকার হাত দিয়েছে। কিছুদিন আগে বিদেশি মুদ্রা ব্যবহার করারও প্রস্তাব উঠেছিল, যা একমাত্র অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থাতেই ব্যবহার করা হয়। হৈ চৈ পড়ে যাওয়াতে ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যায়। কোনও স্টেডিয়াম যদি অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে, সরকার নিজে সেটা ব্যবহার করে লাভজনক করুক। নিউ টাউনে নিত্য নতুন অফিস হচ্ছে। সেটা না করে চটকলগুলির (এর মধ্যে অধিকাংশরই পুনরায় চালু হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই) যে বিপুল রিয়েল এস্টেট ফেলনা পড়ে আছে, সেগুলো অফিস হিসাবে কেন ভাড়া দেওয়া হয় না! এসব তো সরকার অনায়াসে করতে পারে, বেসরকারি সংস্থার দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন কী? উপার্জন বাড়ানোর জন্য আজকে আমেরিকাও কর্পোরেট ট্যাক্স বসাচ্ছে, ভারত সরকারের এ ব্যাপারে এত দ্বিধা কেন? 

দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্প কি বিদেশি কোম্পানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? ২০০৭ সালে ভোডাফোন উড়ে এসে হাচিনসন এসারকে কিনে নিয়েছিল। এখন টেসলা কোম্পানি যদি বলে হিন্দ মোটরের পরিকাঠামো ব্যবহার করে তারা গাড়ি তৈরি করবে তাহলে কি তাদের অনুমতি দেওয়া হবে? নির্মলা সীতারমন বলছেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তির ভিত্তিতে সম্পদ হস্তান্তর হবে। চুক্তিটা ঠিক কী হবে, সরকারের কী লাভ, সম্পদটির রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে, নির্দিষ্ট সময়ের পর সম্পদটি যে পুনরায় সরকারের কাছে ফেরত আসবে- এর কী গ্যারান্টি আছে? 

ধরা যাক হাওড়া স্টেশন আম্বানিদের লিজ দেওয়া হল। তাহলে স্টেশনে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা কি রেল কর্মচারীই থাকবেন না আম্বানির কর্মচারী হিসাবে গণ্য হবেন? হকারদের কী হবে? ইতিমধ্যে ট্রেনে, স্টেশনে হকার নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব উঠেছে। কোনও সন্দেহই নেই যে সরকার সেদিকে এগোচ্ছে। হাওড়া স্টেশনের ভিতরে এখন খবরের কাগজ খুঁজুন, পাবেন না। কুড়ি টাকা দিয়ে পুরি-তরকারি খাওয়ার হকার খুঁজুন, পাবেন না। বাহারি কাফেতে চেয়ার টেবিলে বসে অন্তত শ' দুয়েক টাকা গচ্চা দিয়ে জলখাবার খেতে হবে। 

কী আহামরি পরিকাঠামো সরকার তৈরি করছে যার জন্য এত টাকার প্রয়োজন? নাগপুরে কুড়ি তলা স্টেশন তৈরি হয়েছে। ট্রেন তো চলবেই এছাড়া দুটো তলা বরাদ্দ মেট্রো রেলের জন্য, বাকি মল, মাল্টিপ্লেক্স, জিম ইত্যাদি। সমাজের কত অংশের মানুষের কাজে লাগবে এসব। সবার মাথার ওপর আচ্ছাদন কি নিশ্চিত হয়েছে? দু' বেলা খাবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য? কথাগুলো হয়তো তামাদি হয়ে গেছে কিন্তু চিরকাল সত্যি। 


2 comments:

  1. IMF এর উপদেশ অনুযায়ী কেন্দ্রের সরকার এমন নীতি নিয়ে চলছে যাতে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। সেজন্য সব বেসরকারি করা হচ্ছে যাতে ক্রয়ক্ষমতা কমবে কিন্তু ধনী ও গরীবের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বাড়বে। কিন্তু যে সব inefficient system psu গুলোকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে বেড়ে উঠেছে, সেগুলো এবার বন্ধ হওয়াও দরকার। সরকারী ও বেসরকারী ক্ষেত্রের বেতন কাঠামোর অসামঞ্জস্য সরকারি ও psu কর্মীদের অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সঙ্গে তৈরি হয়েছে এক বড়ো অংশের যুবসম্প্রদায় যারা কর্মজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়কে নষ্ট করে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেয়, বিভিন্ন institution এ মোটা টাকা মিটিয়ে অ্যাডমিশন নেয় যাতে পরীক্ষায় crack করতে পারে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির ক্ষতিই হচ্ছে। সড়ক পরিস্থিতি দেশে যা অবস্থায় আছে এর চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে না। সরকারী হওয়া মানেই ভালো নয়, সরকারি মনোপলি অনেক সময় নানা রকম malpractice এর সুযোগ করে দেয়।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ লেখা! চমৎকার বিশ্লেষণ! ঋদ্ধ হলাম!

    ReplyDelete