Monday 23 August 2021

মহিলা হকি দলের অলিম্পিক লড়াই

ঘরে ঘৃণা ও বিদ্বেষ

সুমন সেনগুপ্ত


এবারের টোকিও অলিম্পিক ভারতের হকির জন্য নবজাগরণের বছর। ৪১ বছর পরে পুরুষেরা তৃতীয় স্থান পেয়েছেন আর মহিলারা অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ পদক পেতে অসফল হয়েছেন। মহিলা দল পদক জিতে আসতে পারেননি, কিন্তু তাঁরা আপামর ভারতবাসীর হৃদয় জিতে নিয়েছেন। জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে বিজয়ীর মঞ্চে তাঁদের দেখা যায়নি বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা বিজয়ী। সম্মান, অনুপ্রেরণা, লড়াই সমস্ত কিছুতে তো তাঁরাই জয়ী। 

কিন্তু যে ভারতের তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই ভারতে লিঙ্গানুপাত হিসেবে প্রতি হাজার পুরুষ পিছু মহিলার সংখ্যা ৯৪৩। উত্তর ভারতে এই সংখ্যা আরও কম। ঘটনাচক্রে এমন এক দেশের তাঁরা প্রতিনিধি, যেখানে কন্যা ভ্রূণ হত্যা, গাহর্স্থ্য হিংসা, পদে পদে জাত-ধর্ম নিয়ে লাঞ্ছনা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি ‘মেয়েরা কি হকি খেলবে’- এই মনোভাব অধিকাংশের। সে ক্ষেত্রে এই মানসিকতাকে পিছনে ফেলে যে লড়াইটা তাঁরা দিলেন তা কি কোনও অংশে ‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছবিটির থেকে আলাদা? কিন্তু ছবি তো ছবিই। সেখানে ভারতীয় মহিলা হকি দল সোনা জেতে, আর বাস্তবে এই সময়ে কোনও পদক জিততে না পেরে লাঞ্ছিত হতে হয় অধিনায়ক বন্দনা কাটারিয়ার পরিবারের মানুষজনকে। এমন কথাও শুনতে হয় ‘উচ্চ’ জাতের মানুষদের থেকে- অতিরিক্ত সংখ্যায় দলিত ক্রীড়াবিদ থাকার কারণে ভারত নাকি অসফল হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে সময়ে মহিলা হকি দলের পারদর্শিতা নিয়ে সারা ভারত মগ্ন হয়ে আছে, ঠিক সেই সময়ে আরও একটি ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা যতই মুখে বলি না কেন ‘বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও’, আমাদের মানসিকতা এতটুকুও বদলায়নি। 

দিল্লির বুকে একটি নয় বছরের দলিত বালিকা আক্রমণের শিকার হওয়ায় লজ্জায় আমাদের মাথা নিচু করতে হয়। সেই ২০১২ সালের ‘নির্ভয়া’ থেকে আজ ৮ বছর পরেও দেশ এক বিন্দুও অগ্রসর হয়নি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক পালাবদলের জন্য ‘নির্ভয়া’র উদাহরণকে সামনে রেখে মহিলা নিরাপত্তা কতটা তলানিতে তার প্রচার করা হয়েছিল। শুধু ৮ বছর কেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসেও কি এটা বলা যায় যে মহিলারা স্বাধীনতা পেয়েছেন? পুরুষদের মানসিকতায় কি এতটুকুও অগ্রগতি এসেছে? না হলে, গোয়াতে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, যার প্ররিপ্রেক্ষিতে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীর উক্তি, ‘চৌদ্দ বছরের মেয়েটি অত রাতে সমুদ্রের পাড়ে কী করছিল?’ কি সেই পুরুষতান্ত্রিকতার দিকেই দিকনির্দেশ করে না? 

হয়তো ভারতীয় মহিলা হকি দলের গল্প আমাদের পরের প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাবে, হয়তো বা আবার ‘চক দে ইন্ডিয়া’র পরবর্তী ছবি তৈরি হবে, হয়তো অনেক পরিবার যাঁরা ছোট স্কার্ট পরে খেলতে দেওয়ার বিরোধী ছিলেন, তাঁরা তাঁদের কন্যা সন্তানদের এই দিকে উৎসাহিত করবেন। কিন্তু তাতেও কি মানসিকতার বদল হবে? হয়তো রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা এই ক্রীড়াবিদদের সম্বর্ধনা দেবেন, হয়তো প্রচুর পুরস্কার ঘোষণা করবেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের আচরণ কি আমরা ভুলে যাব? আমরা কি ভুলে যাব এই কিছুদিন আগেই উত্তরপ্রদেশে একটি ১৭ বছরের মেয়েকে জিন্স পরার অপরাধে তাঁর পরিবারের মানুষেরা মেরে ফেলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে? 

আজ অনেক রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা হয়তো আসবেন এই অলিম্পিকে যাওয়া এবং পদক পাওয়া বা না-পাওয়া মহিলাদের কৃতিত্বে নিজেদের সামিল করতে। কিন্তু তার মধ্যে থেকে কি আমরা আসল-নকল চিনব না? এই নেতা-মন্ত্রীরাই কিন্তু এখনও বিধানসভা বা লোকসভায় মহিলাদের ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের বিরোধী। এই মানুষেরাই কিন্তু মহিলাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অগ্রগতির একমাত্র প্রতিবন্ধক। আমরা কি ভুলে যাব কিছুদিন আগে উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ছেঁড়া জিন্স পরা নিয়ে কি বলেছিলেন? আমরা কি হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর সেই বিখ্যাত উক্তি- মহিলারা যদি ‘ভদ্র সভ্য’ পোশাক পরেন তাহলেই পুরুষদের চাহনি থেকে বাঁচতে পারেন- ভুলে যাব? তাঁকে কি আমরা উল্টে প্রশ্ন করব না- ৯ বছরের মেয়েটি কী পোশাক পরেছিল যার ফলে ধর্ষিতা হতে হল তাকে? 

রোজ সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন মহিলারা যে আক্রমণের শিকার হন, তাতে কি দেশের সম্মান বাড়ে? রোজ বিভিন্ন ভাবে ঘরে এবং বাইরে যে ভাবে মহিলারা অসম্মানিত হন, তাতে কি এটা প্রমাণিত হয় না যে আমাদের মানসিকতা এতটুকুও বদলায়নি? সেই জন্যেই পদক কিংবা পুরস্কার নয়, এখন যা প্রয়োজন তা হল মানসিকতার বদল। শুধু মহিলাদের প্রতি নয়, দলিতদের প্রতিও। নির্বাচনের আগে কোনও দলিত পরিবারের সদস্যের পা ধুইয়ে দেওয়ার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর চমকই কাজ করে; কিংবা ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এর বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রীর মুখের ছবি দেওয়ার মধ্যে শুধু প্রচারের মানসিকতাই থাকে, ভিতর থেকে সমাজকে বার্তা দেওয়ার মানসিকতা থাকে না। যদি তা থাকত তাহলে বন্দনা কাটারিয়ার বাড়িতে গিয়ে- যাঁদের পরিবার বংশানুক্রমে উঁচু জাতের কাছে অপমান সহ্য করেছেন- আজকে অলিম্পিকে এইরকম অভিনব পারদর্শিতা দেখানোর পরেও ওইরকম টিটকিরি দেওয়া হত না। যদিও মহিলা হকি দলের পক্ষ থেকে অধিনায়ক রানি রামপাল খুব কড়া ভাবে এই আচরণের নিন্দা করেছেন। বলেছেন, ‘যখন তাঁরা তাঁদের সর্বস্ব বাজি রেখে দেশের জন্য খেলছেন, তখন তাঁদেরই এক সহ ক্রীড়াবিদের বাড়িতে এই রকম হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয়।’ কিন্তু তাতেও কি দৃষ্টিভঙ্গির বদল হবে?  তিনি বলেছেন, ভারতের নানান প্রান্ত থেকে নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা ধর্মের মানুষ মিলেমিশে আজ যখন এক হয়ে দেশের জন্য অলিম্পিকের ময়দানে নামছেন, তখন কিছু মানুষের এ হেন আচরণ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া জরুরি। 

কিন্তু বললেই তো আর হয়ে যাচ্ছে না। মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ রয়েছে, তা কখনও এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের বা এক জাতের সঙ্গে অন্য জাতের এমনকি এক ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে অন্য ভাষার মানুষের, তা কি সহজে কমবে? এই জাতি বিদ্বেষ এতটাই গভীরে যে, জনগণনাতে কেন জাতি সংক্রান্ত বিষয় আনা হবে না তা নিয়ে সংসদে বিতর্ক উঠে গেছে। শাসক বিজেপি শুধুমাত্র এসসি এবং এসটি ছাড়া আর কোনওরকম জাতি আছে বলে মান্যতা দিতে রাজি নয়। কিন্তু তা করলে কি সমস্যার সমাধান হবে? মানুষে মানুষে যে জাতপাত সংক্রান্ত বিভেদ আছে, তা কি শুধু রাজনৈতিক কাজের মধ্যে দিয়ে কমানো সম্ভব, নাকি সামাজিক কিছু উদ্যোগেরও প্রয়োজন আছে তা ভেবে দেখারও কি সময় হয়নি? যদিও বিজেপির যুক্তি যে এই জাত সংক্রান্ত জনগণনা যদি কার্যকরী করা হয়, তাহলে সমাজে বৈষম্য বাড়বে এবং তার মধ্যে দিয়ে আম্বেদকরের যে স্বপ্ন (জাতিভেদ প্রথার বিলোপ) তা ধাক্কা খাবে। 

কিন্তু সত্যকে আড়াল করে কি কোনও মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব? যদিও তাঁরা শুধু কত সংখ্যক দলিত এবং আদিবাসী আছে তা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক, কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হবে কী? বরং কত ধরনের জাত এই মুহুর্তে ভারতে আছে, তাদের কার কী সামাজিক অবস্থান, কতজন শিক্ষিত হয়েও রোজ লাঞ্ছনার শিকার হন- তা জানা কি জরুরি নয়? না হলে, রোজ কোথাও না কোথাও বন্দনা কাটারিয়া এবং তাঁদের পরিবারের মানুষজন নিগৃহীত হবেন, আর আমরা ভাবব যে আমাদের দেশে জাত সংক্রান্ত কোনও বিদ্বেষ নেই, আমাদের দেশে মহিলারা যথেষ্ট সম্মান পাচ্ছেন। 


2 comments:

  1. লেখক সঠিক লিখেছেন। নারী অর্ধেক আকাশ - বইয়ের পাতাতেই রয়ে গেছে। আমরা নারীকে "The second sex" বানিয়েই রেখে দিয়েছি। আমাদের গো ভক্তরা তাতে কুলোর বাতাস করছেন।

    ReplyDelete
  2. ভাল লেখা । কিন্তু মানসিকতা বদল হওয়া বা মানসিকতার বদল করতে পারা খুব কঠিন ব্যাপার । 🤔

    ReplyDelete