Tuesday 24 August 2021

বাইক বহ্নিমান

গতির আনন্দ ও আত্মহনন

প্রদ্যুম্ন বন্দ্যোপাধ্যায়


ইদানীং বেপরোয়া বাইকারদের নিয়ে সরকারি-বেসরকারি নীতি নির্ধারকেরা, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, সমাজবিদ এবং এমনকি নাগরিক সমাজও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রতিনিয়ত বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর চোখের সামনে, খবরের কাগজের পাতায়, টিভির সংবাদে এখন প্রায় গতানুগতিক। সরকারের তরফে বেপরোয়া বাইক নিয়ন্ত্রণের নানা কঠোর নিদান দেওয়া হলেও তা কমার কোনও লক্ষণ চোখে পড়ে না। শহর-গঞ্জ-গ্রামে, এখানে-ওখানে ঘটে চলা মৃত্যু সত্ত্বেও এই ভয়ঙ্করের যাত্রাপথে কমবয়সীদের কেনই বা বারবার যাওয়া? 

টিভি'র নিয়মিত সান্ধ্যবাসরে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা বসে, প্রায় শিল্পকর্মের আদলে রঙ-বেরঙের পাই-চার্টের মাধ্যমে পথ-দুর্ঘটনার ধরতাই দেওয়া হয়। রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা আর তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মাত্রা যত বাড়ে, ততই পরিসংখ্যানের ধরন-ধারণ আর রেখাচিত্রের গতিবিধি পালটে পালটে যায়। সর্বভূতে যার গতি- সেই সঞ্চালকের প্রগাঢ় ছত্রছায়ায় বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন। রাস্তাঘাটের পরতে পরতে গতি রুদ্ধকারী বন্দোবস্ত, প্রযুক্তির নজরদারি, পুলিশি তৎপরতা আর এর পাশাপাশি বেপরোয়া বাইকবাজদের আত্মলালনের সঠিক পন্থা বারবার উল্লেখ করা হয়। নাগরিক আবেদন আর ললিত বাণীর অবিরাম প্রচার সত্ত্বেও বাইকের গতি তরঙ্গ কমে না। পুলিশি তৎপরতা বাড়লে হয়তো এর প্রকোপ খানিকটা কমে, কিছুদিন পরে আবার শুরু হয়। রাত-বিরেতে শহরের রাস্তাঘাট আর নানা শুনসান তল্লাট জুড়ে চলে বাইকারদের বিপদজনক কেরামতি আর কসরত। বাইকারদের এই চূড়ান্ত গতি স্বাভাবিক ভাবেই নাগরিক সমাজের চোখে অযাচিত, অহৈতুকী। এই গতির কোনও মানে নেই, কোনও ঠিকঠাক গন্তব্যও বোধহয় নেই। আলাপচারী বিশেষজ্ঞরা এর সমাধানে নিদান দেওয়ার পাশাপাশি ব্যস্ত থাকেন অসহায় অতীত চারণায়। 

বাইকের ইতিবৃত্ত: বঙ্গে এবং পশ্চিমে

এই বঙ্গে, বিশেষ করে এই সাধের শহরে মোটর বাইক চালানো আর তা নিয়ে রোমান্টিকতার ইতিহাসও হয়ে গেল তা বেশ কয়েক দশক। ‘সপ্তপদী’ ছবিতে নায়ক বাইকের পিলিয়নে নায়িকাকে বসিয়ে শহর ছাড়িয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার দৃশ্য বোধহয় মধ্যবিত্ত বাঙালিকে বাইক ব্যবহারের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করেছিল। সমাজ সংসারের চেনা চেনা নিষেধাজ্ঞার তর্জনীকে উপেক্ষা করে প্রেমিক যুগলের আত্মপ্রকাশের পিছনেও সেই বাইক। স্কুটারের উল্লেখ এই প্রসঙ্গে চলে আসতে পারে। কারণ, শহরের প্রেক্ষাগৃহে ‘রোমান হলিডে’ ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছে, আর বাঙালি তা দেখে উচ্ছ্বসিত। তবে স্কুটারের আবেদন বোধহয় ষাট-সত্তরের দশকে অনেকটাই কমে আসে।

গত কয়েক দশকের মধ্যে বাইক বিচরণের সেই পেলব রোমান্টিকতায় দ্রুত ছেদ পড়তে শুরু করে। আশির দশকের প্রথম দিকে মুক্তি পায় 'ম্যাড ম্যাক্স'এর মতো তুমুল জনপ্রিয় ছবি। বাইকের দৃশ্য-তাণ্ডব ছিল এই ছবির উপজীব্য। বেপরোয়া ভাবে দুর্দান্ত গতিতে সশব্দে এগিয়ে যাওয়ার দিন আসে। নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করাই হয়ে ওঠে দস্তুর। কলকাতা শহর ছাড়িয়ে গ্রামে-গঞ্জে এর এখন চূড়ান্ত রমরমা। এই বাইক চালনা বোধহয় আলাদা জীবনচর্যার ভূমিকা নিয়েছে। 

বিদেশে সমাজবিদ আর জীবনযাত্রা চর্চাকারীদের চোখে আধুনিক যুব-সংস্কৃতির এটি একটি অন্যতম ভিন্ন প্রকরণ, এক ধরনের ‘সাব-কালচার’, যা স্পষ্টতই এক ভিন্নতর জীবনযাপনের ইঙ্গিত দেয়। পশ্চিমে এই বাইক বাহিত ভিন্ন সংস্কৃতি অনেক দিন ধরেই জনপ্রিয়। গত শতকের ষাটের দশকেই তা তুঙ্গে ওঠে। বেশ কয়েকটি হলিউডি ছবিতে তা ধরাও পড়ে। সমাজ গবেষকরা বেপরোয়া এই জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা বোঝার চেষ্টা করেন। বাইকারদের পোশাক-আশাক, ভীতিপ্রদ ভঙ্গিমা আর বিচিত্র শব্দ ব্যবহার ষাটের দশকেই পশ্চিমি দুনিয়ার বিভিন্ন শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। আদ্যন্ত পুরুষালি ক্ষমতা জাহির করার এমন মাধ্যম আর কিই বা আছে! মূলত গরিব-গুর্বো পরিবার থেকে উঠে আসা উঠতি বয়সীদের এ এক ধরনের আত্মপ্রকাশের অদম্য প্রয়াস। এই বাইকার গোষ্ঠীতে সবাই স্বাগত। প্রয়োজন শুধু একটা বাইক আর চূড়ান্ত বেপরোয়া গতিতে বাইক চালানোর সদিচ্ছা। আর দুর্ঘটনায় মৃত্যু তো শেষ পর্যন্ত তাদের নায়কোচিত জীবনযাত্রারই চূড়ান্ত স্বীকৃতি, অন্তত তাদের কাছে। গবেষকরা লক্ষ করেছেন যে, অচেনা এই জগতে নানা ভাবে জুটে যাওয়া তাদের সতীর্থদের বীরত্বব্যঞ্জক মৃত্যুর স্মৃতি তারা জীইয়ে রাখে একদম নিজস্ব ‘রিচুয়াল’এর মধ্য দিয়ে। তাদের নিজেদের লোককথা সমৃদ্ধ হয়। 

অশ্বারোহী: একা কিংবা কয়েকজন

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে মান্দারনের পথে অশ্বারোহী সেই পুরুষের একাকী গমনের আধুনিক সংস্করণ এই মোটর বাইক স্বভাবতই অনেক বেশি অশ্বশক্তি সম্পন্ন। তার গতিও এখন সর্বত্র। ব্যক্তিগত অথবা গোষ্ঠীর ক্ষমতা জাহির করার অতুলনীয় এই মাধ্যম ইদানীং ভারতীয় দৈনন্দিন রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলি স্থানীয় স্তরে তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতির জোরদার ভাবে জানান দিতে দলীয় পতাকা শোভিত বাইক বাহিনীর উপযোগিতা সম্পর্কে খুবই সচেতন। এলাকায় সশব্দ রাজনৈতিক উপস্থিতি, নজরদারি, ভিজিল্যানটিজম'এর এই প্রকরণ গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে সমস্ত ধরনের কেজো রাজনীতির অঙ্গ। 

মহারাষ্ট্রে শিবসেনার বাইক-বাহিত চূড়ান্ত রাজনীতি নিয়ে একাধিক গবেষণা চোখে পড়ে। বঙ্গে বাম আমলে প্রচারের বিশেষ ক্ষণে লাল পতাকা সজ্জিত বাইক বাহিনীর তুর্য নিনাদ আর তার দৃশ্য-তাণ্ডবের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। দৈনন্দিন কেজো রাজনীতির এই চেনা প্রকরণ বামোত্তর আমলেও একইরকম ভাবে আছে। যে কোনও নির্বাচনের প্রাক্কালে ভোট-প্রচারে বাইক বাহিনী ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করে নির্বাচন কমিশন। যুবশক্তি জাহিরের এমন প্রতীক আর কীই বা আছে! বয়োঃবৃদ্ধ নেতা-নেত্রীদের নানা তত্ত্ব-তাবিজ জনমানসে গেঁথে দিতে এমন উচ্চকিত মাধ্যমের জুরি নেই। কঠিন বর্তমান আর অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় আকুল নিম্নবিত্ত স্তর থেকে উঠে আসা কমবয়সীদের একটা বড় অংশই সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায় এই বাহিনীতে সামিল হয়ে। এও এক ধরনের ক্ষমতায়ন বৈকি!

এভাবেই কি ফিরে আসা?

সংগঠিত রাজনীতির চৌহদ্দির বাইরে দলছুট বাইকার, যাদের নিয়ে এই সমস্যা, তারাই বা কেন ফ্লাইওভার থেকে ফ্লাইওভার আর হাইওয়ে জুড়ে দুর্দান্ত গতিতে বাইক চালায়? মনে হয়, ক্রমাগত পালটে যেতে থাকা শহরগুলিকে তারা বুঝে নিতে চায় নিজেদের মতো করে সশব্দে। নতুন নাগরিক জীবনের হাল হকিকতকে তোয়াক্কা না করেই তাদের এগিয়ে চলা। তারা মোটেও ‘শাপমোচন’ ছবির নায়কের মতো 'প্রাণহীন শহরের দারুণ মর্মব্যথা' নিয়ে বেদনা-বিধুর হতে রাজি নয়। বরং তারা তাদের চাল-চলন, বেশ-ভূষা, বাইকি-কেরামতি দিয়ে ক্রমাগত অচেনা হতে থাকা শহরকে যুঝতে চায়। হাইওয়ে, বাইপাস, সুপার এক্সপ্রেসওয়ে চলে আসে তাদের বেপরোয়া হাতের মুঠোয়। চলে স্টান্টবাজি, সামনের বা পিছনের চাকা তুলে চালানো, রাস্তায় আগুনের ফুলকি তোলা অথবা পিছনের চাকার উপর ভর করে বাইক ক্রমাগত ঘোরানো। হাইওয়ে, বাইপাস আর অসংখ্য ওভারব্রিজের আশেপাশে রাত-বিরেতে তাদের জমায়েত। চলে বাজি ধরা, জুয়া খেলা, কখনও কখনও কোনও অপরাধ ঘটানো। প্রতিযোগিতাও থাকে কখনও সখনও। নানা ভীতিপ্রদ শর্ত দেওয়া হয়। যেমন, হেলমেট না পরে আশি-একশো কিলোমিটার বেগে নিরন্তর বাইক চালানো। এখানে তারা আত্মমগ্ন অচেনা গতিকে খোঁজার আনন্দে। বাপ-মা, পরিবার-পরিজনদের হা-হুতাশ, প্রতিদিনের অজানা আশঙ্কা আর তাদের চেনা চেনা স্বপ্ন প্রকল্পকে নস্যাৎ করেই চলে এই অনিকেত যাত্রা। 

নাগরিক আর প্রশাসনের নজরদারির বাইরে নবীকৃত শহরের নানা ফাঁক-ফোকর, আনাচকানাচ আবিষ্কার করে গড়ে ওঠে বিচিত্র নামের সব বাইকার ক্লাব। ধ্বংস হয়ে যাওয়ার নানা আশঙ্কা সত্ত্বেও তারা ধাবমান। নিজেদের অকিঞ্চিৎকর জীবনযাপনকে নস্যাৎ করেই এমন বিপদজনক গতি তোলার মধ্যে যে অনির্বচনীয় আনন্দ, সেখানেই বোধহয় আছে মুক্তির হাতছানি। কোনও মায়ার বন্ধনেই এরা বাঁধা পরে না। প্রশাসনিক কড়া বন্ধনের দাবি ওঠে, ধরপাকড় চলে। কোনও সুভাষ মুখোপাধ্যায় এদের জন্য নিশ্চয় ‘ছেলে গেছে বনে’র মতো কবিতা লেখেন না। দলছুট হয়ে যাওয়ার দরুণ ‘শহীদ’ বনে যাওয়ার সুযোগও তাদের নেই। নিতান্ত ছাপোষা পরিবার থেকে উঠে আসা বাইকার গোষ্ঠীর সদস্যরা রসদ জোগাড় করে নানা বিক্ষিপ্ত কাজ-কারবার থেকে। অর্থ উপার্জনের নানা আলো-আঁধারি উপায়ও এরা খুঁজে বার করে। 

দশ ফুট বাই দশ ফুটের উপচে পরা আলগোছ পরিবারের আওতা থেকে তারা বোধহয় ক্ষণিক মুক্তি খোঁজে ধূ ধূ কালো রাস্তায়। সমাজ, সংসার, পড়শী জীবনের যাবতীয় হিসেব-নিকেশ ভেঙে ভেঙে যায়। ভেঙে পরার অভিজ্ঞতা এরা বোধহয় বহন করে নিজেদের শরীরে, জীবন যাপনে। দুর্দান্ত গতির আনন্দ আর আত্মহনন মিলে মিশে যায়।

 

2 comments:

  1. বাঃ, এই বাইক চিত্রকল্প নৈমিত্তিক জীবন যাপনে চোখে দেখি, সংবাদ পত্রে দুর্ঘটনার সংবাদ পাই, কিন্তু তাকে নিয়ে উন্নত সংলাপ পড়িনি। prodyumna কে অজস্র ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. একদম অন্য ধরনের লেখা । লেখক যে এইভাবে ভিন্ন দৃষ্টিতে ভেবেছেন, তারজন্য প্রদ্যুম্নকে বিশেষ ধন্যবাদ । 👍🏼🌹

    ReplyDelete