Thursday 12 August 2021

কার হাতে আজ স্বাধীনতার পতাকা?

স্বাধীনতা সংগ্রামে নেই 

লাল কেল্লায় পতাকা উত্তোলনে আছি!

শোভনলাল চক্রবর্তী


বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে সঙ্ঘ পরিবারের অংশগ্রহণের যে কালিমালিপ্ত অধ্যায়, তা থেকে তাদের জাতীয়তাবাদী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠার আগে কংগ্রেসের ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে একবার জেলে গিয়েছিলেন (১৯২২) এবং কংগ্রেস নেতৃত্বের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ব্যক্তিগত কৌঁসুলি নিয়োগ করে জেল থেকে ছাড়া পান। তিনি দ্বিতীয়বার জেলে যান ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দিয়ে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ওই আন্দোলনে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে যোগদান করেছিলেন এবং আরএসএস'কে যোগদান করতে বারণ করেছিলেন। তিনি পুস্তিকা প্রকাশ করে জানিয়ে দেন যে সঙ্ঘ সত্যাগ্রহে অংশ নেবে না, তবে ব্যক্তিগত ভাবে কেউ অংশ নিলে তাতে বাধা দেওয়া হবে না। 

আসলে, সত্যাগ্রহে অংশ নিয়ে জেলে গিয়ে হেডগেওয়ার জেলে বন্দি কংগ্রেসি নেতাদের সঙ্গে সঙ্ঘের ব্যাপারে আলোচনা করেন এবং ভবিষ্যতে তাদের সহযোগিতার আশ্বাস নিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। সুতরাং, তিনি দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী হিসেবে জেলে যাননি, গিয়েছিলেন নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য। 

সঙ্ঘ প্রকাশিত ও অন্যান্য বহু দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটেও ইতিহাসবিদরা সঙ্ঘ পরিবারের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকার কোনও নজির খুঁজে পাননি। ব্রিটিশ শাসকদের উৎখাত করা দূরে থাক, নিদেনপক্ষে তাদের বিরোধিতা করার কোনও নজিরও খুঁজে পাওয়া যায়নি। হেডগেওয়ার যে সব বক্তব্য রেখেছেন সেখানে রয়েছে শুধুই হিন্দু সংগঠনের কথা। ব্রিটিশ সরকার সম্বন্ধে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করার চেয়ে তিনি অনেক বেশি মনোনিবেশ করেছেন হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতি রক্ষায়। কারণ, তিনি মনে করতেন যে হিন্দু সংস্কৃতি হল হিন্দুস্থানের প্রাণবায়ু। তাই হিন্দুস্থানকে রক্ষায় তিনি চেয়েছিলেন হিন্দু সংস্কৃতিকে পুষ্ট করতে। ব্রিটিশ শাসন বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হেডগেওয়ারের মতে ছিল এক অগভীর জাতীয়তাবাদ এবং তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনে কোনওমতেই যেন আরএসএস কর্মীরা যোগদান না করেন। কারণ, তাতে আরএসএস'এর অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। 

হেডগেওয়ারের পরবর্তী আরএসএস প্রধান গোলওয়ালকরের অবস্থান আলাদা কিছু ছিল না। তাঁর সঙ্ঘের প্রধান হওয়ার (১৯৪০) দুই বছরের মধ্যে ঘটে ১৯৪২'এর 'ভারত ছাড়ো'র মতো উত্তাল আন্দোলন যাতে দেশের শ্রমিক-কৃষক সহ ব্যাপক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ঘটে। গোলওয়ালকর যে প্রচলিত অর্থে কোনও বিপ্লবী ছিলেন না তা ব্রিটিশরা খুব ভালো করে জানতেন। ১৯৪৩ সালে আরএসএস'এর কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি রিপোর্টে তৎকালীন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দফতর লেখে, '১৯৪২-এর আগস্টে যে বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল, সঙ্ঘ কর্তব্যপরায়ণতা দেখিয়ে তাতে অংশগ্রহণে বিরত ছিল।' শুধু ১৯৪২ নয়, স্বাধীনতা আন্দোলনের সমগ্র পর্যায়ে সঙ্ঘের কোনও ভূমিকা ছিল না। বরং তাদের মত ছিল, আন্দোলনগুলি জনসাধারণের ওপর অনেক মন্দ প্রভাব ফেলছে। আন্দোলনের ফলে ছেলেরা নাকি শৃঙ্খলাবোধ হারিয়ে ফেলেছে। ব্রিটিশ প্রণীত আইনে তিনি দোষের কিছু পাননি। ব্রিটিশ শাসনের দানবীয় আইন-কানুন ভারতের জনগণের উপর যে ভয়ঙ্কর নিপীড়ন ও অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল, সেই সব আইন-কানুনে গোলওয়ালকরের চিন্তিত না হওয়া নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ শাসকদের তৃপ্ত করেছিল। বিশেষ করে উত্তাল চল্লিশের দশকে প্রায় সমগ্র ভারত ভূখণ্ডে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যেভাবে ব্যাপক সাধারণ মানুষ ধর্ম-বর্ণ-ভাষা ও শ্রেণি নির্বিশেষে সামিল হয়েছিলেন তা গোলওয়ালকরের একেবারেই পছন্দ হয়নি। ৪২'র আন্দোলনের প্রভাবকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছিলেন তিনি। সেই সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে যে স্বাধীনতার দাবি উঠেছিল, তাও ছিল গোলওয়ালকরের না-পসন্দ। বরং তাঁর কাছে অঞ্চলগত জাতীয়তার পরিবর্তে  হিন্দু জাতীয়তা তথা হিন্দু রাষ্ট্র গঠন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি লিখেছেন, 'ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একাসনে দেখা হচ্ছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত পর্যায়ে, তার নেতাদের উপর ও সাধারণ মানুষের উপর এক বিপর্যয়কারী প্রভাব ফেলেছে।' বস্তুত, ব্রিটিশ  সাম্রাজ্যবাদী অধীনতা থেকে জাতীয় মুক্তি অর্জনের বদলে তাঁর মনপ্রাণ একাগ্র ছিল কীভাবে বিদেশি ও বিজাতীয় মুসলমানদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করা যায়। তাঁর নেতৃত্বে সঙ্ঘের নেতারা ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। 

ব্রিটিশ সরকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলকারীদের উপর লাঠির ঘা বসাতে যে সিভিক গার্ড নিয়োগ করে, তার বেশির ভাগই ছিল আরএসএস কর্মী। এহ বাহ্য, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় গোলওয়ালকর কোনওরকম রাখঢাকের বালাই না রেখেই বলে দেন যে দেশের দুর্দশার জন্য ব্রিটিশরা নয়, দায়ী বিজাতীয় মুসলমানরা। তিনি লেখেন, 'আমাদের প্রতিজ্ঞায় আমরা ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করে স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা বলেছিলাম। সেখানে ব্রিটিশদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনও কথা ছিল না।' সঙ্ঘের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিন্দু মহাসভা ও তাদের নেতৃত্বের অবস্থান ছিল আরও ন্যক্কারজনক। ভির সাভারকার কীভাবে ব্রিটিশের কাছে নির্লজ্জের মতো ক্ষমা ভিক্ষা করে সেলুলার জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন তা আমরা সকলেই জানি। অথচ, পোর্ট ব্লেয়ার বিমানবন্দরের নাম দেওয়া হয়েছে ওই বিশ্বাসঘাতকের নামে। সেখান বিমানবন্দরের নাম পাল্টে উল্লাসকর দত্তের নামে করার আন্দোলন চলছে। 

সাভারকার ১৯৩৭ সালে ছাড়া পেয়ে পাঁচ বছরের জন্য 'হিন্দু মহাসভা'র সভাপতি হন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তিনি তৎকালীন গণআন্দোলনের পিঠে কার্যত ছুরি মারেন। ১৯৩৯ সালের ৯ অক্টোবর সাভারকার বড়লাট লিনলিথগো'র সঙ্গে দেখা করেন এবং ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতার প্রস্তাব দেন। পরে লিনলিথগো লেখেন, 'এখন আমাদের স্বার্থগুলি এত নিবিড়ভাবে আবদ্ধ যে প্রয়োজনীয় বিষয় হল হিন্দুবাদ এবং গ্রেট ব্রিটেনের বন্ধু হওয়া দরকার। হিন্দু মহাসভা যুদ্ধ শেষে ডমিনিয়ন মর্যাদা মেনে নিতে সম্পূর্ণরূপে রাজী।' স্বাধীনতার দাবিতে যে সময়ে সমগ্র ভারত জেগে উঠল, সেই সময়ে যুদ্ধ শেষে মহাসভা কথামতো ডমিনিয়ন মর্যাদাতেই সায় দিয়েছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম? নৈব নৈব চ। কিন্তু ব্রিটিশরা এই দেশ থেকে কখনও চলে গেলে হিন্দু রাষ্ট্র গঠিত হবে এবং মুসলমানরা সেই হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদজনক হবে- এই ছিল মহাসভার দর্শন। বিস্ময়কর হল, সেই মুসলমানদের স্বঘোষিত প্রতিনিধি সাম্প্রদায়িক মুসলিম লিগের সঙ্গে ১৯৪২-এর উত্তাল পর্বে নির্বাচনী আঁতাত গড়ে তুলে সরকার গঠনে কোনও নীতিগত বাধা সাভারকার বা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা দেখতে পাননি। 

চল্লিশের দশকের উত্তাল সময়ে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ বাংলার গভর্নর স্যার জন হারবাটকে একটি চিঠিতে লেখেন, 'যুদ্ধের সময়ে যদি কেউ গণ অনুভবকে নাড়া দিয়ে বিশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে, তবে মহাসভা তা প্রতিরোধ করবে।' এই ভাবে ব্রিটিশ শাসকদের সেবক হিন্দু মহাসভা ভারতের গণ আন্দোলনকে প্রতিহত করার দায়িত্ব নিয়েছিল। সঙ্ঘ ও মহাসভা এরপর স্পষ্ট করে বলে যে স্বাধীনতার একমাত্র অর্থ হিন্দু রাষ্ট্র গঠন, যার জন্য তারা প্রাণ দিতে পারে। 

স্বাধীনতার এই অর্থের যাঁরা উত্তরসূরী তাঁরাই এখন আমাদের স্বাধীনতার পাঠ পড়াচ্ছেন। দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদ কাকে বলে বোঝাচ্ছেন। যে দলের অস্তিত্ব স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হাব্বল টেলিস্কোপ লাগিয়েও টের পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের হাতে নিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে ভারতের জাতীয় পতাকা। এটা তাঁরাও জানেন। তাই তাঁরা ক্ষমতায় এসেই শুরু করেছেন ভারতের স্বাধীনতার বিনির্মাণ। পাকিস্তানকে মুসলমান প্রতিপক্ষ খাড়া করে সকাল-বিকাল গাল পারা, কাশ্মীর সমস্যা জিইয়ে রাখা, চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ জীবন্ত রাখা- এই সবই সেই বিনির্মাণের অংশ। অর্থাৎ, স্বাধীনতার নামে আমরা এই পেয়েছি- এটাই লোককে গেলানো। স্বাধীনতা যুদ্ধ ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য টাটকা জাতীয়তা সৃষ্টি করেছে তারা। সেই জাতীয়তাবাদে ভারতকে অমর্যাদা করার সকল প্রয়াস শক্ত হাতে দমন করা হবে। ভারত মাতার জয়ধ্বনি কেউ না দিলে তিনি জাতীয়তা বিরোধী। সরকারের সমালোচনা করলে দেশদ্রোহী। ইতিহাস কিন্তু বলছে, সবচেয়ে বড় জাতীয়তা বিরোধী, সবচেয়ে বড় দেশদ্রোহী শাসক দল নিজেই। তাই তো আজ তাদের লালকেল্লার একশো মিটার পর্যন্ত সুরক্ষা বলয়ে ঘিরে ফেলে স্বাধীনতা উৎসব যাপন করতে হয়। 

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি।' ভারত তীর্থ ভারতবর্ষের পতাকা বহনের শক্তি কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দলের নেই। স্বাধীনতা দিবসে তাই ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতির আত্মমগ্ন প্রধানমন্ত্রী সং সেজে আরও একবার স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলন করবেন। তাঁর সাহস নেই এ কথা বলার যে তাঁর পূর্বসূরীরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বস্তুত বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর তাই নৈতিক অধিকার নেই এই পতাকা তোলার। এই পতাকা তুলে তিনি ভারত মাতাকে অসম্মান করছেন। পতাকার অবমাননা কিন্তু মানুষ মনে রাখছেন। একদিন সব কিছু কড়ায় গণ্ডায় সুদে আসলে মেটাতে হবে জনতার দরবারে।


2 comments:

  1. আজকের ফ্যাসিবাদী বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জায়গা থেকে লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তুস্বাধীনতার পতাকা প্রথমদিন থেকেই বিশ্বাসঘাতকদের হাতে। যারা ভগৎ সিংদের ফাঁসীর জন্য লড়েছিলো আর যারা সেদিন কোনো প্রতিবাদ করবেনা বলে প্রকাশ্যে জানিয়েছিলো, তার দুদলই বিশ্বাসঘাতক। যারা ৮২এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন যখন তাদের হাত থেকে জনতার হাতে গণবিদ্রোহে পরিণত হচ্ছিলো তখন সেই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, তারাও বিশ্বাসঘাতকই। আজ অনেক বড় শত্রু বিজেপির বিরুদ্ধে তাদের সাথে হাত মেলাতে হবে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে দ্বন্দ্ব ভুলে যেতে হবে। দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে লেখায় মাওএর মার্ক্সবাদী চিন্তায় মৌলিক অবদান - বৈরীতামূলক ও অবৈরীতামূলক দ্বন্দ্ব। সেটা ভুলে গেলে লেজুরবৃত্তি করা হবে।

    ReplyDelete
  2. ** চাবি টেপার ভুল - ৮২র নয় ৪২এর।

    ReplyDelete