Tuesday 6 July 2021

ক্রিকেটের নন্দনতত্ত্ব

টেস্টোস্টেরন ছাড়াই টেস্ট ক্রিকেট

শোভনলাল চক্রবর্তী


নেভিল কার্ডস তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, প্রতিটি ক্রিকেট ম্যাচই তাঁর কাছে এক একটি সুখস্মৃতি। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে ভারত বনাম ইংল্যান্ডের চার দিনের মহিলা ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ বহু দর্শকের মনে এক সুখস্মৃতি হয়ে রয়ে গেল। 

ক্রীড়া ইতিহাসবিদরা যে কোনও ক্রীড়ার সঙ্গে পুরুষের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে সমস্ত খেলাধুলাই প্রসার লাভ করতে শুরু করে উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুতে। এই সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয় বড় বড় ক্লাব, তৈরি হয় খেলাধুলার নিয়মকানুন, তৈরি হয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এবং শুরু হয় ক্রীড়ার বিভিন্ন বিভাগে নানা ধরনের টুর্নামেন্ট। এই সবেরই উদ্ভব হয়েছিল পশ্চিমে, ফলে ক্রীড়া ও পুরুষ সমার্থক হয়ে ওঠে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিমের দেশগুলিতে মহিলাদের ভোটাধিকার মেলে। ফলে, বোঝাই যাচ্ছে কেন বিশ শতকের গোড়ায় ক্রীড়ার সঙ্গে মহিলাদের যুক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন দেশে যে ক্রীড়াবিদের দল তৈরি হয় তা অনিবার্যভাবে ছিল পুরুষ অধ্যুষিত। বিভিন্ন দেশের মধ্যে যখন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হয় তখন ওই পুরুষ ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে ঐতিহাসিক ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে জাতীয়তাবাদ। আজকের আধুনিক অলিম্পিক গেমসের যিনি প্রবর্তক সেই ব্যারন পিয়ের দ্য কুবেরতিন যখন ১৮৯৪ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি গঠন করেন তখন সেই কমিটির উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল বিশ্ব জুড়ে ভ্রাতৃত্ববোধের বৃদ্ধি ঘটানো। এরপর যত সময় এগিয়েছে ততই পুরুষতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ক্রীড়া জমাট বেঁধে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে একজন ক্রীড়াবিদের সাফল্যে সারা দেশ মাতোয়ারা হয়েছে, অসফলতা ডেকে এনেছে দেশ জুড়ে অন্ধকার। ক্রীড়াভিত্তিক জাতীয়তাবাদ চরমে ওঠে ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকে যেখানে স্বয়ং হিটলার মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন জার্মান ক্রীড়াবিদদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ওই বার্লিন অলিম্পিকে হিটলারের উপস্থিতিতে ভারতীয় হকি দল ফাইনালে জার্মানিকে ৮-১ গোলে পরাজিত করে। 

সাম্প্রতিক অতীতে আমরা ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের সদস্যদের দেখেছি জাতীয়তাবাদী ট্যুইট করতে, সরকারের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিতে। এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের প্রতিটি সদস্যকে জাতীয়তাবাদী মাসকট হিসেবে আমরা দেখি। এমন পরিস্থিতিতে ব্রিস্টলে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে এ কথা মানতেই হবে। ওই টেস্ট ম্যাচ দেখতে বসে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল সেটা ৭০-৮০'র দশকে ভারতীয় ক্রিকেটে দেখা যেত। সেটা হচ্ছে ভারতীয় দলে লম্বা, বেঁটে, রোগা, মোটা, ফর্সা, কালো- মোট কথা নানা আকৃতি ও আকারের খেলোয়াড়দের উপস্থিতি, যাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন অনবদ্য। শেফালি ভার্মা এবং স্মৃতি মান্ধানা ওপেনিং জুটিতে যা ব্যাট করলেন, তা বীরেন্দ্র সেহবাগ চলে যাওয়ার পর এই আবার দেখলাম। শেফালি যখন ৯৬ রানে ছয় মারতে গিয়ে আউট হলেন, সেটাও সেহবাগকেই মনে পড়ালো। বিসিসিআই এমন মণিমুক্তকে হেলায় হারাচ্ছেন কী করে তা ভাবতে অবাক লাগছে। এঁদের যা প্রতিভা তা তো বিসিসিআই-এর কাছে সোনার খনি। বিষেন সিং বেদি যেমনটা বলেছেন, বিসিসিআই-এ এখন সেই সব লোকেদের ভিড় বেশি যাঁরা না বোঝেন ক্রিকেট না বোঝেন বিপণন, কারণ তাঁরা রাজনীতির লোক। সৌরভকে সামনে রেখে তাঁরা পিছন থেকে সব নিয়ন্ত্রণ করছেন। বেদির বক্তব্যের সারবত্তা প্রমাণিত হচ্ছে মহিলা ক্রিকেটের ক্ষেত্রে। সে কথা এখানে থাক। যে ব্যাপারটা এই ম্যাচে সবচেয়ে শান্তি দিল তা হচ্ছে ক্রিকেটটা হল ক্রিকেটের মতো। ক্রিকেট যে গুলিগোলাবিহীন যুদ্ধ নয়, ক্রিকেট যে কারণে অকারণে কয়েকটি দাড়িওয়ালা লোকের বাকযুদ্ধ নয়, ক্রিকেট মানেই মাঠের মধ্যে চিৎকার করে এফ-অক্ষর বিশিষ্ট গালাগাল দেওয়া নয়, তা প্রমাণ করল এই টেস্ট ম্যাচ। 

এমন নয় যে এই ম্যাচে উত্তেজনা ছিল না। ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার ক্যাথরিন ব্রান্টকে যখন একের পর এক বাউন্ডারি মারছেন শেফালি তখন ব্রান্ট ফুঁসছিলেন। শেফালির বয়স ১৭, ব্রান্ট তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার শুরু করেছিলেন শেফালির জন্মের আগে থেকে। তাই অধৈর্য হয়ে ব্রান্ট শেফালিকে একবার জিভ বার করে দেখান। বিবিসি প্রচারিত মহিলাদের পডকাস্ট অনুষ্ঠানে (নো বল'স) ইংল্যান্ডের আরেক ফাস্ট বোলার কেট ক্রস বলেন যে ব্রান্ট যখন শেফালিকে জিভ দেখাচ্ছিলেন, তখন হেসে খুন হয়েছিলেন ইংল্যান্ড দলের আউটফিল্ডের বাকিরা। এসব ব্যাপার অবশ্য পুরুষদের ক্রিকেটে নিষিদ্ধ। সেখানে তোমার দলের বোলার যখন মার খাচ্ছে তখন তোমায় ব্যাটসম্যানের প্রতি হাত-পা ছুঁড়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে হবে, গালি পাড়তে হবে, মাটিতে পা ঠুকে অসম্মান দেখাতে হবে- এইসব বাঁদরামির নাম দেওয়া হয়েছে আগ্রাসন। আসলে এগুলি ছেলেমানুষি। যাঁরা এসব করেন সেই সব ক্রিকেটারদের উচিত বেশি করে মহিলা ক্রিকেট দেখা এবং শেখা কী করে আগ্রাসনের নামে এইসব বাড়তি আবর্জনা দূর করে ক্রিকেটে বেশি মনোযোগ করলে ক্রিকেট আরও সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। 

বেশিরভাগ দর্শকের মতো আমিও যে মহিলা ক্রিকেট সম্পর্কে খুব বেশি খবর রাখি তা নয়। তবে অতীতের শ্রীরূপা বসু, শান্তা রঙ্গস্বামী, ডায়না এডুলজি বা আজকের ঝুলন গোস্বামী, মিথালি রাজ'দের সম্পর্কে জানি। কিন্তু যে ভাবে কপিল দেব, শচিন, সৌরভ বা শুভনাম গিল সম্পর্কে জানি, সে ভাবে কিছুই জানি না। এটা কিন্তু এই কারণে নয় যে এদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় না, এটার মূল কারণ এই যে, মহিলা ক্রিকেট টেলিভিশনে একেবারেই অনুপস্থিত। তাঁদের যে প্রতিভার অভাব আছে তা একেবারেই নয়, কিন্তু মহিলা ক্রিকেটের টেস্ট ম্যাচ হয় সাত বছরে একটি, যেমন ভারতের মহিলা দল খেলল ব্রিস্টলে! এই টেস্টে মহিলা দল যা ক্রিকেট খেলল তা দেখে কিন্তু বোঝার উপায় ছিল না যে এই দলটি সাত বছর বাদে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে নেমেছে। 

আমরা বিগত বহু বছর ধরে প্রথমে কান খাড়া করে রেডিওতে এবং পরে টেলিভিশন চ্যানেলে হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছি বিলি জিন কিং'কে, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা'কে, স্টেফি গ্রাফ'কে, গ্যাব্রিয়েল সাবাতিনি'কে বা উইলিয়ামস বোনদের। মহিলা টেস্টে শেফালি ভার্মা যখন ফাস্ট বোলারের মাথার ওপর দিয়ে ছয় হাঁকালেন, তখন বিশ্বাস করুন, ভিভ রিচার্ডস ছাড়া আর কাউকে মনে পড়েনি। মুশকিল হচ্ছে এই যে, আমরা শেফালি বা ঝুলনকে বেশি খেলার সুযোগ দিই না, আর যখন তাঁরা খেলার সুযোগ পান, তখন সেই খেলা টিভিতে দেখানো হয় না বা রেডিও কমেন্টারির ব্যবস্থা থাকে না। যখন মেয়েদের ভাগ্যে টেস্ট ক্রিকেটের শিকে ছেঁড়ে এবং ইংল্যান্ডের মনোরম পরিবেশে টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ জোটে তখন ক্রিকেট প্রশাসনের ক্ষমতাবানরা সেই খেলাটি ইচ্ছে করে ফেললেন সেই সপ্তাহে যে সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে পুরুষদের টেস্ট ক্রিকেটের ফাইনাল। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে রেকর্ড সংখ্যক দর্শক টেলিভিশনে ব্রিস্টল টেস্ট (১৬-১৯ জুন) দেখলেন তার একটা বড় কারণ এই যে পুরুষদের টেস্টের প্রথম দিন (১৮ জুন) বৃষ্টিতে ভেস্তে যাওয়ায় তাঁরা ব্রিস্টলের রৌদ্রোজ্জ্বল টেস্টটি দেখতে শুরু করেন এবং এমন মজে যান যে রিমোট ঘুরিয়ে অন্য চ্যানেলে আর যাননি। আমার মতো বহু মানুষ অবশ্য প্রথম দিন থেকেই ব্রিস্টল টেস্ট দেখেছেন। 

ভারতীয় মহিলা এই ক্রিকেট দলটি, আগেই লিখেছি যে, সাত বছর পর টেস্ট ক্রিকেট খেলল। ফলে, এই দলের অধিকাংশ সদস্য ছিলেন নতুন, যাঁদের মধ্যে পাঁচজনের এটা ছিল টেস্ট অভিষেক। আমাদের বেশ কোটি কোটি টাকার পুরুষ ক্রিকেট দল যখন পাঁচ দিনের বৃষ্টিবিধৌত টেস্ট ম্যাচ সাড়ে তিন দিনে হেরে বসে রইল তখন এই আনকোরা নতুন মেয়েরা ইংল্যান্ডের মতো একটা শক্তিশালী দলের বিপক্ষে ফলো-অন করার পরেও যে ভাবে মাটি কামড়ে পরে থেকে ম্যাচ ড্র করল, তা বহুদিন বিশ্ব ক্রিকেট দেখেনি; না পুরুষদের ক্রিকেটেও নয়। চতুর্থ দিনের খেলার শেষে ভারতীয় মহিলা দলের আট ও দশ নম্বরে খেলতে নামা দুইজন যথাক্রমে স্নেহ রানা এবং তানিয়া ভাটিয়া অপরাজিত ছিলেন ৮০ এবং ৪৪ রানে। দুজনেরই প্রথম টেস্ট ছিল এটি এবং এঁদের কেউই শুধুই ব্যাট করেন না, রানা দলের অল-রাউন্ডার এবং তানিয়া দলের উইকেটরক্ষক। এই দলটি আরও তিনটি টি-২০ এবং সমসংখ্যক একদিবসীয় ম্যাচ খেলবে। যাঁরা এঁদের খেলা একবার দেখেছেন তাঁরা এঁদের বাকি খেলাগুলোও নিশ্চিত ভাবে দেখবেন। কারণ, এই মহিলা ক্রিকেট দলটি ক্রিকেটের মধ্যে যেটার অভাব ছিল, সেই নিখাদ রোমান্টিকতাময় ক্রিকেটকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন। এই খেলাটাতে যে ফুটবল বা রাগবির আগ্রাসন চলে না, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। দর্শকরা ক্রিকেটের পেলবতাকে ফিরে পেয়ে ভীষণ খুশি। 

যে সব ভারতীয় একটি দেশি দলকে তাঁদের শেকড় থেকে ভালোবাসেন, যাঁরা মনে করেন ক্রিকেট খেলবেন ক্রিকেটাররা, কয়েকজন গাট্টা গোট্টা দেশভক্ত নন, তাঁরা অবশ্যই এই এগারোজন মহিলার দলটিকে মন থেকে সমর্থন করবেন, যাঁরা ব্রিস্টলে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। এমন হতেই পারে, আগামী দিনে এই মহিলা দলের পেছনে ছুটবে স্পনসর আর চ্যানেল, কারণ তাঁরা বোঝেন টিআরপি আর দর্শক। আগামী দিনে শুধু পুরুষালি হুঙ্কার দিয়ে ক্রিকেট হবে না, ফেরাতে হবে ক্রিকেটের নন্দনতত্ত্বকে। পুরুষ টেস্টোস্টেরন যুক্ত ক্রিকেটকে সজোরে ধাক্কা দিয়েছে একটি মহিলা ক্রিকেট দল, খবরটি নেহাত ছোট নয়।


No comments:

Post a Comment