Thursday 22 July 2021

অশ্বমেধের ঘোড়া

স্বৈরাচারীর ব্রহ্মাস্ত্র

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যার টুল নিয়ে আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্ব আজ তোলপাড়। ইজরায়েল’এর একটি গুপ্ত সংস্থা ‘এনএসও’ কৃত এই অত্যন্ত শক্তিশালী টুলটি যে কোনও মোবাইলে ঢুকে সমস্ত তথ্যকে শুধুমাত্র যে অপহরণ করতে পারে তাই নয়, প্রতি মুহূর্তে সেই মোবাইলে কী কাজকর্ম চলেছে তার সমস্ত তথ্য ও বয়ানকেও সে জীবন্ত আহরণ করতে পারে। বলা হয়, এই ‘পেগাসাস’ টুলটি ‘জিরো ক্লিক’ ব্যবস্থাপনায় তার সমস্ত কাজকে নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করে। অর্থাৎ, কোনও লিঙ্কের ওপরে ব্যবহারকারীর ক্লিক বিনাই সে যে কোনও মোবাইলে নিঃশব্দে অধিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে। ২০১৬ সাল থেকে এই প্রযুক্তি-টুল তার কাজ সারা বিশ্বে নীরবে সমাপন করে আসছে।

সম্প্রতি, ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকা ও ১৬টি সংবাদ সংস্থার ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ শীর্ষক যৌথ তদন্তে এই ‘পেগাসাস’ স্পাইওয়্যারের শীতল গোয়েন্দাগিরির যাবতীয় তথ্য সকলের সামনে উদ্ঘাটিত হয়েছে। জানা যাচ্ছে, গোটা বিশ্বে এই পর্যন্ত ৫০,০০০’এর বেশি মোবাইল ফোনে এই ‘পেগাসাস’ ঘাপটি মেরে বসে ব্যবহারকারীর সমস্ত তথ্য আহরণ করে কারও না কারও কাছে পাচার করছে। এই শিকারের তালিকায় ভেসে উঠেছে ফরাসি রাষ্ট্রপতি মাক্রো থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সহ বহু রাষ্ট্রপধানের নাম, বাদ যাননি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টরও। যদিও ‘এনএসও’র দাবি যে তারা এই স্পাইওয়্যার টুলটিকে শুধুমাত্র বিক্রি করে, তা কাজে লাগিয়ে কাদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে সে তথ্য তাদের জানা নেই। তারা এও দাবি করেছে যে, শুধুমাত্র তাদের আস্থাভাজন ৩৬টি দেশের সরকারগুলির কাছেই তারা এই প্রযুক্তি বিক্রি করে থাকে, অন্যত্র নয়। আর এর মূল উদ্দেশ্য নাকি ‘সন্ত্রাসবাদ’কে দমন করা।

প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দুটি দিক খুব স্পষ্টতই উঠে আসছে।

এক, আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সার্বিক যুগে ক্রমশই রাষ্ট্রের সাবেকি ভূ-রাজনৈতিক-সামরিক আদল থেকে প্রবেশ করছি ভার্চুয়াল-তথ্যভিত্তিক-প্রযুক্তিগত এক রাজনৈতিক-অর্থনীতির অবয়বে; যেখানে ভৌগোলিক সীমানা, রাজনৈতিক দল, যুদ্ধ-বিগ্রহ ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে ও সেই জায়গায় এমন এক ভার্চুয়াল রাষ্ট্র নির্মিত হবে যেখানে তথ্য ও প্রযুক্তিই হবে আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ ও শাসন-শোষণের শেষ কথা। তা যে আর রূপকল্প নয়, প্রতিদিনকার ঘটনাবলী থেকে তা ক্রমশই স্পষ্ট। ভার্চুয়াল দুনিয়ার মহারথীদের (গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন প্রভৃতি) সঙ্গে সাবেকি রাষ্ট্রের যে নিত্য লড়াই বেঁধেছে- আমাদের দেশেও যা প্রকট ভাবে দেখা দিয়েছে- তা থেকে এটা বুঝে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না যে এই লড়াইয়ের নির্ধারক অবসান আগামী কয়েক বছরের ব্যাপার মাত্র। ক্ষমতাধর ‘পেগাসাস’ প্রযুক্তি-টুল এই লড়াইয়ের একটি অন্যতম দিগদর্শন। কেউ কেউ বলছেন, এই স্পাইওয়্যারটি কৃষ্ণগহ্বরের মতো, যার কবলে পড়লে কারও নিস্তার নেই। চাইলে তারা জো বিডেন বা বরিস জনসনের মোবাইলেও নীরবে ঘাঁটি গেড়ে বসে থেকে খবর চালান করতে পারে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে সাবেকি রাষ্ট্রপ্রধানদের হাতে এমন কোনও উন্নতর প্রযুক্তি নেই বা তা আয়ত্বাধীন নয় যে তারা এই ধরনের স্পাইওয়্যারগুলিকে মোকাবিলা করতে অক্ষম। তাই লড়াইটা এখনও কিছুটা সমানে সমানেই। এই লড়াইয়ের পরিণতির জন্য আমাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, অতি-সুরক্ষিত রাষ্ট্রপ্রধানদেরই যখন এই হাল তখন সাধারণজনের মোবাইল ফোনটি তো কোনও অর্থেই সুরক্ষিত নয়! বরং, তাতে ফাঁকফোকর রেখে দেওয়াটাই রীতিমতো দস্তুর, না হলে আজকের অতুলনীয় সম্পদ ভাণ্ডার যে তথ্য, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ নাগালই তো পাবে না কর্পোরেট ভার্চুয়াল মহারথীরা।

এই মুহূর্তে দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণটি হল আতঙ্কের ও ভয়ঙ্কর ভাবে রাজনৈতিক। প্রশ্ন হল, এই যে সারা বিশ্বে ৫০ হাজারের ওপর মোবাইল ফোনে নজরদারি চালানো হচ্ছে তার ‘সুপারি’টা কে বা কারা দিয়েছে? আর কেনই বা? অভিযোগ, ২০১৬ সাল থেকে এই নজরদারি চলছে। তাহলে এই নজরদারির ফলে বহু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যে ঘটে গেছে বলেও অনুমান। সেগুলিই বা কী অথবা কেমন। এ নিয়ে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’এর তদন্তে হয়তো অনেক বিষয় ও তথ্য খোলসা হবে।

কিন্তু, আমাদের কাছে আরও ভয়াবহ হল এই যে, এই দেশে ৩০০’রও বেশি মোবাইল ফোনে ‘পেগাসাস’ প্রযুক্তি-টুল অন্তর্ঘাত করে বসে আছে বলে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ তদন্ত থেকে জানা গেছে। এই টার্গেট-তালিকায় কিন্তু কোনও তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীরা নেই। আছেন বিরোধী দলের নেতা থেকে শুরু করে সাংবাদিক, সমাজকর্মী, বিচারপতি, প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের দুজন মন্ত্রীও। প্রায় সমস্ত বিরোধী দলের নেতাদের ফোনে এই কীর্তিটি করা হয়েছে এবং বিশেষ করে গত পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের সময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে প্রশান্ত কিশোর সকলের ফোনেই ‘পেগাসাস’ প্রযুক্তি ঢুকিয়ে দিয়ে যথেচ্ছ তথ্য চুরি করা শুধু নয়, কথাবার্তা, দলীয় সভার আলোচনা, বার্তালাপ- সমস্ত কিছুই আহরণ করা হয়েছে। অন্যত্র, যেখানে যেখানে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা মুখ খুলেছেন বা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেখানে সেখানেই মোবাইল ফোনে ‘পেগাসাস’ টুল ঢুকিয়ে দিয়ে নজরদারি চালানো হয়েছে যা সম্পূর্ণ ভাবে অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক শুধু নয়, চরমতম ভাবে বেআইনি। এমনকি, শীর্ষ আদালতের পূর্বতন বিচারপতি রঞ্জন গগৈ’এর বিরুদ্ধে তাঁরই অধস্তন কর্মচারী যে মুহূর্তে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনেন, ঠিক তার পরপরই সেই অভিযোগকারিণীর মোবাইলেও ‘পেগাসাস’ প্রযুক্তিকে চালান করে দেওয়া হয়। শুধুমাত্র তাই নয়, তৎকালীন অন্যতম নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে নির্বাচনবিধি ভঙ্গের অভিযোগ আনায় তাঁর মোবাইলেও 'পেগাসাস' স্পাইওয়্যারটিকে চুপটি করে বসিয়ে দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে এ এক নির্মমতম ও অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। অবস্থা এমন ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছেছে যে বিজেপি’র নেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রকাশ্যে এটা জানাতে দ্বিধা বোধ পর্যন্ত করছেন না যে, পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোনে কী বার্তালাপ হয়েছে তার রেকর্ডিং নাকি তাঁর কাছে আছে।

আমরা ১৯৭২ সালের আমেরিকার ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা জানি। যেখানে ওয়াশিংটন শহরের ওয়াটারগেট কমপ্লেক্স'এর একটি ঘরে বিরোধী দলের একটি মিটিং’এর বয়ানকে গোপনে রেকর্ড করা হয়েছিল বলে রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন’এর গদিটি পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। যদিও প্রথমে নিক্সন এই ঘটনার কথা অস্বীকার করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, এ দেশে মোদি সরকারের মতো একটি চরম অনৈতিক সরকারের আমলে এসব কিছুই হবে না। এখানে বরং চোরের মায়ের বড় গলা। মন্ত্রী প্রকাশ্যে বিবৃতি দিচ্ছেন, এরকম কোনও ঘটনা নাকি ঘটেইনি। কিন্তু তিনি একবারও বলছেন না যে এত বড় একটি আন্তর্জাতিক অভিযোগের তদন্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী তো মৌনবাবা সেজে গিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, একেকটি মোবাইলের পিছনে ‘পেগাসাস’ টুলের ব্যবহারের খরচ ভারতীয় মুদ্রায় এক কোটি টাকার মতো। প্রশ্ন, তাহলে ৩০০ কোটি টাকা কে বা কারা খরচ করল আর কেনই বা? আর সে টাকা এলই বা কোথা থেকে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, মানুষকে ভ্যাকসিন ও অক্সিজেন না দিয়ে এবং পেট্রল-ডিজেল-এলপিজি’র দাম বাড়িয়ে যে বাড়তি টাকা মোদি সরকার সংগ্রহ করেছে তা দিয়েই মেটানো হয়েছে ‘পেগাসাস’ প্রযুক্তি ব্যবহারের খরচ। 

বোঝাই যাচ্ছে, এই উন্মাদ্গ্রস্ত সরকার নিজের ছায়াকেও এখন ভয় পাচ্ছে (যে কারণে কিছুদিন আগে মন্ত্রীসভায় বড়সড় বদল করল), তাই বিরোধী স্বরকে স্তিমিত করতে নজরদারি ও তার ভিত্তিতে এজেন্সি লাগানোই এখন তাদের একমাত্র কাজ। ইতিমধ্যেই ইউএপিএ'এর যথেচ্ছ ব্যবহারে যে কোনও প্রশ্নকারীকে জেলে ঢুকিয়ে পচিয়ে মারা এই সরকারের নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর এক-দুজন নেতা নন, ৩০০'র বেশি নানা ঘরানার মানুষের মোবাইল ফোনে নজরদারি চালিয়ে এই সরকার যে এক ভয়ঙ্করতম স্বৈরাচারী শাসন-প্রক্রিয়া এ দেশে চালু করেছে, তার বিরুদ্ধে আশা করা যায় সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ উপযুক্ত প্রত্যাঘাতের রাস্তা খুঁজে নেবেন।

       

3 comments:

  1. আরো একটি ভালো লেখা । দরকারিও । 👌🏽🌹

    ReplyDelete
  2. Very sharp pin pointed and authentic write up.you have raised some questions which is very important.

    ReplyDelete
  3. জীবন জীবিকা বিপন্ন করে, চিন্তা শক্তির উপর আঘাত মোদি সরকার ব্যস্ত।
    সুপ্রিমকোর্ট যা বলছে এবং করছে তা যথেষ্ট নয়। শেষ পর্য্যন্ত নীরবতা তাদের পথ।
    নতুবা UAPA, ও ভীমাকরেগাঁও ইস্যুতে নীরব কেন?
    এখন NCB হয়ে উঠূছে অন্যতম নির্যাতনের হাতিয়ার।

    ReplyDelete