Tuesday 27 July 2021

২০২৪'এর লড়াই

বিরোধী জোটের সম্ভাবনা

মালবিকা মিত্র


২০১৯ থেকেই কিছু বিরোধী নেতা মোদী সরকার বিরোধী একটা জোট গঠন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই কাজে প্রধান আগ্রহী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসন্ন বিপদাশঙ্কা তিনি বোধ করি সর্বাগ্রে টের পান। নোটবন্দী জিএসটি বালাকোট এনআরসি ভ্যাকসিন সব ক্ষেত্রে প্রথম সোচ্চার প্রতিবাদে তাঁকেই দেখা গেছে। আর এবারেও ২১ জুলাই মঞ্চ থেকে এক সর্বাত্মক উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। দিল্লিতেও এসেছেন এর সম্ভাবনার সমস্ত রকম অঙ্ক কষে। ধীরে ধীরে এক পা এক পা ফেলে এগোতে চাইছেন। আসার আগে, 'পেগাসাস' বিষয়ে দুই প্রাক্তন বিচারপতির একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন যারা পশ্চিমবঙ্গে এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে কাদের কাদের ফোনের ওপর কেমন নজরদারি ও তথ্য চুরি হয়েছে তার তদন্ত করবে। 

স্পষ্টতই তিনি মোদির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় মাঠে নেমেছেন যা একদিকে বিরোধীদের মনোবল জোগাবে ও অন্যদিকে মোদির বাহিনীর ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করবে। দেশ জুড়েই দেখা যাচ্ছে, মমতা'র এই মনোভাবকে প্রায় সকলেই (রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজ, কৃষক সমাজ, এমনকি শাসকেরা পর্যন্ত) বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমার মনে হয়, এই প্রক্রিয়ায় এতাবৎ একটাই ভুল হয়ে এসেছে- আগে নির্বাচনী জোট গঠন তারপরে লড়াই- এটা ভ্রান্ত। আগে পথে লড়াই, তারপর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জোট গঠন ও ভোটের লড়াই। এমনতর একটা আভাস যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলনবলনে বেশ স্পষ্ট।

জাতীয় স্তরে অন্যান্য অনেক নেতা সেদিন (২০১৯) আসন্ন বিপদের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হলেন। তাঁরা নিজ শক্তি ও ক্ষমতায় অতিরিক্ত আস্থাবান। প্রতিপক্ষ যে কত নিম্নস্তরের হতে পারে, পুলওয়ামা, বালাকোট, সন্ত্রাস, জঙ্গি মুসলিম, পাকিস্তানের চর, নগদ অর্থ ছড়ানো, সরাসরি বিরোধী সাংসদ কেনা, দাঙ্গা লাগানো, খোলামেলা হিন্দু রাষ্ট্রের ঘোষণা করে সংখ্যাগুরুর ভোটে মেরুকরণ- সব অস্ত্রের প্রয়োগ হল। বিজেপি জোট বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা, রাম মন্দির এজেন্ডা, কর্নাটকে সরকার ভাঙানো, মধ্যপ্রদেশের সরকার ভাঙানো- সমস্ত রকম নোংরা খেলা আমরা দেখলাম। আবার মহারাষ্ট্রে আরও নির্লজ্জ নোংরামি করে, রাজ্যপাল বিচারপতি সকলকে জড়িয়েও শেষ অবধি মুখে কালি। এরপরে দিল্লি, ঝাড়খণ্ডে হার অব্যাহত রেখে অতঃপর হরিয়ানা, বিহারে গ্রেস নম্বরে কোনও মতে পাশ। বাংলা, কেরল, তামিলনাড়ুর কথায় আর আসছি না। 

২০১৯'এর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্ষমতায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসার পর অঙ্গরাজ্যের জনতা হিসেবে ভেবেছিলাম আগামী পাঁচ বছর কী এক ভয়ানক টেস্ট ক্রিকেট দেখব। দেখলাম, টেস্ট ক্রিকেট নয়, এক একটা রুদ্ধশ্বাস টি-টোয়েন্টি। প্রথম দিনের হাঁটু মুড়ে নতজানু হয়ে সংসদ ভবনের সিঁড়িতে প্রণামের ঘটা আর বাহারটা ভাবুন। সেদিনই সব স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল। মনে পড়েছিল চাণক্য উক্তি- 'তোমাকে আমি পূজা করবো... না না না তোমাকে আমি আগে বধ করব, তারপর তোমার মূর্তি গড়ে তোমাকে পূজা করব।' স্বচক্ষে আমরা দেখলাম, ৩০৩'এর গরিষ্ঠতা নিয়েও সংসদের অধিবেশনে কী অনীহা। ৩৭০ থেকে তিন কৃষি আইন, মহারাষ্ট্রের দেবেন্দ্র ফড়নবিশ থেকে এনআরসি, বিদেশে কোটি ভ্যাকসিন রফতানি থেকে দেশের জন্য ভ্যাকসিনের দাম ধার্য করা- সংসদ সর্বত্রই মূর্তিবৎ। সরকার কখন কোন কোম্পানি বিক্রি করছে কেউ জানে না। মহামহিম শ্রী শ্রী সংসদে কোনও আলোচনা বিতর্ক কিছুই নেই। স্পষ্ট বোঝা যায়, স্বৈরাচারী শাসক সংসদে ৫০০ থাকলেও কোনও আলোচনা চায় না, বিতর্ক চায় না। আর তাই তো সাত বছর হল মোদী সরকারের বয়স, তবুও আজ অবধি তিনি কোনও সাংবাদিক সম্মেলনে বসেননি। তবে পোষ্য অনুগত সাংবাদিকদের বাছাই করা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে নিজেকে জাহির করেছেন। করবেন নাই বা কেন? পণ্ডিতদের বানিয়ে দেওয়া বক্তৃতাও তালগোল পাকিয়ে 'extra 2ab' তত্ত্ব বা ছাত্র ছাত্রীদের 'climate change' প্রশ্নের উত্তর শুনলেই Entire Political Science'এর ঝুলির ম্যাঁও বেরিয়ে পড়বে। 

২০২৪'এর নির্বাচন বিরোধীদের কাছে একটা ধর্মযুদ্ধ। কথা হল: ১) স্পষ্টতই সংসদ ও সংসদীয় গণতন্ত্র বর্তমান শাসকেরা চায় না। তাই, সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই ২০২৪ সাল। ২) আইনশৃঙ্খলা, কৃষি, বিক্রয় কর, এসবই ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপাদান। এখন অঙ্গ রাজ্যের অনুমতি ছাড়াই দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার অঙ্গরাজ্যে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা পাঠাচ্ছে, আদালতের কোনও নির্দেশ, কোনও বৈধ আদেশ, কোনও পূর্ব বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই শহরের মহানাগরিককে গ্রেফতার করতে যাচ্ছে ৪০/৫০ জন কেন্দ্রীয় জওয়ান নিয়ে। ভাবটা যেন, এরা আত্মগোপন করা জঙ্গি। অথচ নিজাম প্যালেস থেকে বৈধ চিঠি দিয়ে এঁদের যতবার তলব করা হয়েছে এঁরা সহযোগিতা করেছেন। মহামান্য আদালতও কিছুতেই বুঝতে পারল না মুখ্যমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী কেন নিজাম প্যালেসে হাজির হলেন। একটি নির্বাচিত সরকারের বরিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা মন্ত্রী গ্রেফতার হলেন অপ্রত্যাশিত ভাবে কোনও প্ররোচনা ছাড়াই। আর সরকারের অভিভাবক চুপচাপ হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবেন? এটা প্রত্যাশিত আচরণ? যেভাবে শিষ্টাচার না দেখিয়ে অসভ্যের মতো আচরণ করে রাজ্যের বরিষ্ঠ, সদ্য বিপুল জনসমর্থনে নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীদের গ্রেফতার করা হল- একটু বেলা বাড়ার সাথে সাথে নিজাম প্যালেসের বাইরেটা কী চেহারা নিয়েছিল ভাবুন। শুধু ববি হাকিমের কন্যার কাতর মিনতি জনরোষ সামলাতে পারত না। মুখ্যমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী উপস্থিত না থাকলে কলকাতা অগ্নিগর্ভ হত। সেটা হয়নি, সেই ছক পণ্ড হয়েছে। 

অঙ্গরাজ্যের আয়ের একটি প্রধান উৎস ছিল বিক্রয় কর। সেই কর মিলে গেল জিএসটি'র সাথে। এখন অঙ্গরাজ্যকে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রধান সেবক নির্লজ্জভাবে বলছে অঙ্গরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে একটি দলের সরকার (ডবল ইঞ্জিন) থাকলে উন্নয়নে গতি আসবে। খোলামেলা সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিরোধিতা। মহারাষ্ট্র কেরল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল, দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর নির্লজ্জ ভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে রাজভবনকে বিজেপির সদর দফতর বানিয়েছে। এক কথায় নির্লজ্জ। ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সেই কাঠামোর রক্ষাকবচ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, বহুদলীয় অস্তিত্ব এসবই আজ একদলীয় আগ্রাসনের মুখে। বলা হচ্ছে, লোকসভা-বিধানসভা একবারই ভোট হবে। ডাবল ইঞ্জিন সরকার হবে। সংসদের দুই কক্ষে একদলীয় আধিপত্য। আর কোনও সমস্যা নেই। যেন, 'খেলার ছলে ষষ্টিচরণ হাতি লোফেন যখন তখন'। 

'নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান'- এই অতুল অনুপম ভাবনা শিশু পাঠ্যপুস্তক থেকেও বিদায় নেবে। এক দেশ, এক দল, এক নেতা, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক আইন, একটা সমসত্ত্ব সংস্কৃতি, গোলি মারো শালো বহুত্ববাদকো। লুঙ্গি পাজামা দেখে, চিঁড়ে খাওয়া দেখে দেশদ্রোহী চেনা যাবে। এর বিরুদ্ধে এখনই জোটবদ্ধ যুদ্ধ ঘোষণা চাই। এটা প্রধানমন্ত্রী হবার যুদ্ধ নয়। ভারতের বহুত্ববাদ, ভারতের ঐতিহ্য সংস্কৃতি, ভারতের সংবিধান, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জাতি ধর্ম গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য, আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার লড়াই। জোটের নেতারা আগেই ঘোষণা করুক আমি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নই। এটা মহাভারতের যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ। 

অনিবার্য ভাবেই এসে পড়ে প্রশ্ন। কারা এর জোট শরিক হবে? একটাই উত্তর: সকল আঞ্চলিক দল, যারাই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের উচ্ছিষ্ট ভোগী নয়, অঙ্গরাজ্যের হকদার। কংগ্রেস দল কি এই জোটের অংশ হতে পারে? অংশ হতে পারে কিন্তু নেতা নয়। এখানে কেউ নেতা নয়। তার আগে কংগ্রেসকে অঙ্গীকার করতে হবে যে ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির ইউনিয়ন হল ভারতের যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, একদা কংগ্রেস নিজেই স্থায়ী সরকার, কেন্দ্রে-রাজ্যে এক দলের সরকার ইত্যাদি শ্লোগান দিয়েছে। মনে রাখবেন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার ক্ষয় রোগের শুরু নেহেরু প্যাটেল গুলজারিলাল নন্দার যুগেই। সাংবাদিক নুরানী দেখিয়েছেন, ৫৬ বার ৩৭০ ধারার অধিকার ক্রমশ দুর্বল করা হয়েছে। ৮০-৯০'এর দশকে সারা ভারতে জ্যোতি বসু, রামা রাও, রামকৃষ্ণ হেগড়ে, নাম্বুদ্রিপাদ, বিজু পট্টনায়ক, প্রকাশ সিং বাদল, ফারুক আবদুল্লাহ, মুলায়ম, লালুপ্রসাদ, নৃপেন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখদের যৌথ উদ্যোগে অঙ্গরাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করার প্রতিবাদে ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্রমাগত কেন্দ্র মুখিনতার প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। যে আন্দোলনের মূল শত্রু ছিল জাতীয় কংগ্রেস। 

অতএব, এবারের লড়াই পবিত্র সংবিধান রক্ষার লড়াই। সবাই এখানে ধর্মযোদ্ধা। কেউ প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার নয়। পঞ্চপাণ্ডব যেমন যুদ্ধ জয় করেও লোলুপ দৃষ্টিতে ফল বন্টন করেনি নিজেদের মধ্যে, ২০২৪'এর লড়াই তেমনই। ক্ষমতা দখলের নয়- ক্ষমতার কেন্দ্রকে ভাঙা ও অঙ্গরাজ্যগুলির ইউনিয়ন গঠনের লড়াই। আক্ষরিক অর্থে, গণতন্ত্র ও পার্লামেন্টকে গুড়িয়ে দিয়ে সেন্ট্রাল ভিস্তা গড়ে তোলার কুনাট্য এবং এক দল এক দেশ এক নেতা এক ধর্ম এক ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই। আরও স্পষ্ট করে বললে, সমগ্র দেশের গুজরাটিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই। অর্থাৎ, আবারও একটি স্বাধীনতার আন্দোলন।


4 comments:

  1. সব দলই সমান। কে এলো আর কে গেল তাতে সাধারণ মানুষের কিছু আসে যায় না।

    ReplyDelete
  2. ২০২৪ লড়াইটা আসলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষের, বহুত্ববাদের লড়াই। এখানে আঞ্চলিক দলগুলোকে মূলতঃ অনুঘটকের কাজ করতে হবে। কংগ্রেসের ভূমিকাও অনুঘটকের মতই রাখতে হবে। অহংকার বর্জন করে।

    ReplyDelete
  3. কেউ প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার নন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষা করার জন্য একসাথে লড়তে হবে, এসবই আমরা চাই, আমাদের ইচ্ছা। বাস্তবে কতটা কার্যকরী হবে তা একেবারেই অনিশ্চিত। ইউপি ইলেকশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওখানে একটা ধাক্কা দিতে পারলে বিরোধী ঐক্যের সম্ভাবনা খুলে যাবে।

    ReplyDelete
  4. মুস্কিলটা অন্য জায়গায়। বিজেপির বিরুদ্ধে যারা আছেন, কংগ্রেস ছাড়া আর কেউই সর্বভারতীয় দল নয়। ইন্দিরার উল্টোদিকে জয়রকাশ নারায়নের মত একজন ছিলেন, যিনি তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিতে ৫টা দলকে এক করে জনতা দল গড়তে পেরেছিলেন। তেমন কেউ বিজেপির উল্টোদিকে নেই। মমতা এখনো বাংলার বাইরে কোন শক্তিই নন। ফলে বিষয়টা বেশ জটিল।

    ReplyDelete