Monday 26 July 2021

'পেগাসাস'এর জুজু

ভারতীয় জাসুস পার্টি ও দেশের ভবিষ্যৎ

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


পশিমবঙ্গে বাস করি আর রাজনীতি নিয়ে ভাবব না, তাও হয়? তবে, রাজনীতি নিয়ে আর লিখব না ভেবেছিলাম। তবু লিখতে হচ্ছে, কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের বিচিত্র আচরণ।

এ দেশের সরকারের কোনও আচরণেই রাজনীতি খুঁজতে হয় না, তা এতই জ্বলন্ত। এই যে 'পেগাসাস' কাণ্ড তাতেও রাজনীতি। কী এই  'পেগাসাস'? এ এক অতি কৌশলী গোয়েন্দা সফটওয়ার। এক বিশেষজ্ঞর কথায়, এই স্পাইওয়্যার সরাসরি স্থান করে নেয় মোবাইলের 'সিমে'। একে বিদায় করা যায় না, এর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না- গোপনে ছবি, কথা সবই চালান করতে পারে রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্রের কাছে কেন? কারণ, সেই তো এর মালিক। স্রষ্টা এই স্পাইওয়্যার কেবল রাষ্ট্রের কাছেই বেচে। আমার অন্য এক বন্ধু একবার বলেছিলেন, যারা এসব বানায় তাদের মেধা অসামান্য। হলে কী হয়, এরা যে অর্থলোভে নিয়োগকর্তা তথা বাজারের কথায় চলে!

নিজের ক্ষতি নাকি পাগলেও বোঝে। রাজনীতিজ্ঞরা পাগলও না, ছাগলও না। তাঁরা বেশ বোঝেন। তবে বোঝেন তাই, যা চোখে দেখেন। এর বেশি না। যদি সামান্যও বেশি বুঝতেন, বুঝতেন মানুষের মনের কথা, তবে ইজরায়েলি সংস্থা থেকে এমন স্পাইওয়্যার কেনার আগে বারবার ভাবতেন নিশ্চয়। এমন এক স্পাইওয়্যার তাঁরা কিনেছেন যা মারফত যে কোনও দেশের যে কোনও নাগরিকের (এর মধ্যে লেখক, সাংবাদিক, নেতা, মন্ত্রী, সান্ত্রী, পাঠক, লেখক সবাই আছেন) ব্যক্তিগত জীবন, বন্ধু, আড্ডা, যোগাযোগ ইত্যাদি সব তথ্যাদি চুরি করা সম্ভব। এখন নেতারা বুঝি বাছছেন কার জমিতে ছড়াবেন এই বীজ। ভবিষ্যতে অনেক ছড়ানো হলে নাও বাছাবাছি হতে পারে। যে কোনও মোবাইলেই তার ঘর বাঁধা সম্ভব। এভাবে খুব দূরে নয় যেদিন বিষবৃক্ষে ছেয়ে যাবে দেশ। কারও সাথে আর প্রাণ খুলে কথা বলা যাবে না। এমনকি কেনাকাটা, সিনেমা দেখা, বাইরে ঘুরতে যাওয়া সবই বন্ধ হবে এই স্পাইওয়্যারের কুপ্রভাবে।
 
বর্তমান শাসক তো জানে ভবিষ্যতে শাসক বদল হলে এই স্পাইওয়্যার ব্যুমেরাং হতে পারে। তবু তো দেখি তারা অকুতোভয়। তবে কি তারা ধরেই নিয়েছে সেটি হবে না, হবার নয়। হে শাসক! বাজারকে পাশে নিয়ে আর বন্দুক বাগিয়ে, বুটের আওয়াজে ভয় দেখিয়ে তুমি ভাবছ মানুষের অধিকার অস্বীকার করে সিংহাসন দখলে রাখতে পারবে চিরদিন? কিন্তু যেদিন মানুষ ছেড়ে এই স্পাইওয়্যার বাজারকে আক্রমণের লক্ষ্য করবে! ভয়ংকর সেদিনের দিকে তাকাচ্ছে না আজকের এই দেশের রাজনীতিবিদেরা।

ফরাসি সরকার নাকি তদন্তে নেমেছে। ভারত বা পাকিস্তান সরকার এমন কোনও তদন্তের নির্দেশ এখনও দেয়নি। পাকিস্তান সরকার না দিতে পারে কিন্তু ভারত সরকার দেবে না কেন তেমন আদেশ? এই দেশ নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ! পাকিস্তানের চেয়ে অনেক উন্নত নাকি আমাদের সংস্কৃতি! কিন্তু, এ কেমন গণতন্ত্র? সারা দেশ চাইছে, দেশের সব বিরোধী দল চাইছে (তারা সবাই মিলে কিন্তু দেশের নির্বাচকমণ্ডলীর দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেয়েছে গত নির্বাচনেও, যার যোগফল শাসকের প্রাপ্ত ভোটের প্রায় দেড় গুন বা আরও বেশি); দলের সমর্থকরাও কী চাইছেন না সত্য সামনে আসুক? চাইছেন, তবে মুখ খুলে বলতে পারছেন না। বলতে পারছেন না তদন্ত হোক। সোনা-জহরৎ মোড়া সত্য নয়, মানুষের আস্থা অর্জনকারী সত্য আসুক দিনের আলোর মতো। কেমন করে বলবেন! তাদের মাথার ওপর যে এক জোড়া ভয়ংকর সর্বগ্রাসী স্বৈরশাসক 'সন্ন্যাসী' আছেন, কে আর হরেন পান্ড্যিয়া হতে চান! অন্তত এখন এ কালে, এ দেশে আর কেউ চান না। এখন আর দেশে বিপ্লবী মেলে না, মেলে সন্ত্রাসবাদী, আতঙ্কবাদী। কানাইলাল বা ক্ষুদিরামদের দিন গিয়াছে! আমাদের দেশে শাসনদণ্ড যাদের হাতে সেই খুনে যুগল গুজরাটে ভয় দেখিয়ে, প্রাণ কেড়ে জনসমর্থন আদায় করেছে। ওরা জানে সে সব ছলাকলা, যে ছলাকলার সাহায্যে জনমত পদানত করা যায়। এই বাংলায় তাদের জারিজুরি বা ছলাকলা খাটেনি। তাতে কী, উত্তরপ্রদেশে খাটবে না?
 
এখন সময় এসেছে সেই শপথ নেবার, যে শপথে ওদের রঙ্গ, ওদের কৌশল, ওদের ভয় দেখানোর অস্ত্র ভোঁতা করে দেওয়া সম্ভব হয়। এখন সময় এসেছে ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার মানুষ খুনের, মানবতা খুনের, মানবাধিকারকে হাস্যাস্পদ করে তোলার। সম্মানের সাথে বাঁচার অধিকার আমাদের অস্ত্র। মানবতার এমন শত্রুকে যদি পরাস্ত করতে না পারি তবে ইতিহাস তথা আমাদের পরের প্রজন্ম আমাদের করুণাও করবে না। 
 
আসুন শপথ নিয়ে বলি, ভয় করি না তোমাকে, তোমার চৌর্যবৃত্তির ঐ স্পাইওয়্যারকে। শপথ নিন, বিকল্প হতে পারেন যারা তাঁরাও। শপথ নিন যে একই রকম অন্যায় আপনারাও করবেন না। মনে রাখবেন, যদি তেমন কিছু করেন তো লোকে কেবল আপনাদের নয়, এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক কাঠামোটাকেও ঘৃণা করবে। কানাইলালরা ফিরবে।


1 comment:

  1. বিরোধীদের উপর নজরদারি সব দলই ক্ষমতায় এলে করে থাকে, নতুন কি? খেটে খাওয়া মানুষের কিছু এসে যায় না pegasus নিয়ে। শাসক যেই আসুক সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

    ReplyDelete