Tuesday 30 March 2021

শীর্ষ আদালতের সিঙ্গুর রায়

কর্মসংস্থানের মিথ্যাচার

প্রবুদ্ধ বাগচী

 


ফেসবুক জুড়ে রব উঠেছে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে কারখানা করতে না দিয়ে এবং প্রকারান্তরে 'ষড়যন্ত্র' করে পশ্চিমবঙ্গকে নাকি শিল্পায়নে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এক দশকে একটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নাকি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এটুকু অন্তত সকলেই জানেন, সিঙ্গুর নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই হয়েছিল যা সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়িয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালতের সেই রায়ে কী কী বলা হয়েছিল তার দু-একটা নমুনা দেখা যেতে পারে:

১) টাটা মোটর প্রথমে ৬০০ একর জমি নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, পরে তা বেড়ে হয় ১০০০ একর- এতখানি বাড়তি জমি কেন তাদের দরকার হল তার সপক্ষে কোনও উপযুক্ত কারণ তারা দেখাতে পারেনি। রাজ্য সরকার ও তাদের আধিকারিকদের কাজকর্ম দেখে মনে হয় তারা বিষয়টা আদৌ মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেননি এবং টাটা মোটরস'এর পক্ষে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে আদৌ কতটা জমি লাগতে পারে রাজ্য মন্ত্রীসভাও সে বিষয়ে কোনও হিসেব নিকেশ করেনি।

('TML had submitted a proposal of requirement of 600 acres of land, which was subsequently increased to 1000 acres without any justification for seeking such vast extent of lands in favour of TML. This action of the State Government and its officers shows a complete non application of mind on the part of the cabinet while assessing how much land is needed for the project, before acquiring lands at the behest of TML.')

২) বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ, নথি ও প্রকৃত অধিগ্রহণের ফাইল পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে যে, জমি অধিগ্রহণ আইনের ৪ নম্বর ধারা অনুসারে অধিগ্রহণের নোটিশ দেওয়ার আগেই  জমির মালিকদের পক্ষে প্রচুর আপত্তি জমা পড়েছিল। আইনের ৫-এ/২ ধারা মাফিক সেগুলি ঠিক ঠিক ভাবে বিচার করে দেখা হয়নি। আপত্তি যারা জানিয়েছিলেন, তাঁদের ব্যক্তিগত ভাবে নোটিস দেওয়া হয়েছিল কিন্তু যে জমি অধিগ্রহণ করা হবে সেই জমির মালিক বা যারা সেগুলি চাষ করেন তাঁদের নোটিশ দিতে পারা যায়নি। 

('From a perusal of the materials on record and original acquisition files, it is evident that a large number of objections were filed by the land owners before the notification was issued under Section 4 of the L.A. Act. The same were not considered properly under Section 5-A (2) of the L.A. Act. Notices were issued to the objectors individually but the same could not be served upon the owners/cultivators of the proposed lands to be acquired.' (p/97)) 

৩) জমি অধিগ্রহণ আইনের ৩(এফ) ধারায় যে জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের কথা বলা আছে সেখানে খুব স্পষ্টভাবেই জানানো হয়েছে কোনও কোম্পানির জন্য জমি অধিগ্রহণ জনস্বার্থের মধ্যে পড়ে না।  

('Section 3(f) of the L.A. Act, which defines what public purpose is for the purpose of acquisition of land, clearly indicates that the acquisition of land for companies is not covered within the public purpose.')

৪) সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা স্বাধীনতার পর থেকে বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়ায় জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ, শিল্প বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করা ইত্যাদি সংখ্যায় অনেক বেড়ে গেছে। এগুলো অনিবার্য হলেও, জনস্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে যাদের জমি নেওয়া হবে সেইসব ব্যক্তিগত মানুষের অধিকারের বিষয়টারও সামঞ্জস্য রাখা দরকার, কারণ তাঁরা তাঁদের জীবিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এবং ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণের সঙ্গে জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের বিষয়টা একই বিচারে দেখলে চলবে না।

('With the enormous expansion of the State's role in promoting public welfare and economic development since independence, acquisition of land for public purposes, industrialisation, building of institutions, etc., has become far more numerous than ever before. While this is inevitable, promotion of public purpose has to be balanced with the rights of the individual whose land is acquired, thereby often depriving him of his means of livelihood. Again, acquisition of land for private enterprises ought not to be placed on the same footing as acquisition for the State.' (p/29)) 

৫) সর্বোপরি, সুপ্রিম কোর্ট প্রকল্প বিষয়ে টাটা মোটরস'এর জমা দেওয়া হলফনামা থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিল: 

এই প্রকল্পে সরাসরি চাকরি হতে পারে ১৮০০ জনের এবং বাড়তি ৪৭০০ জন কাজ পেতে পারেন বিভিন্ন সরবরাহকারী ও পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ।

('The employment potential of this project was assessed at 1,800 employees in direct employment by TML and a further 4,700 employees through vendors and service providers.' (p/7))

এই ৬৫০০ জনের চাকরির জন্য আইনকে উপেক্ষা করে প্রায় ১৭০০০ জনকে উচ্ছেদ করার ব্যবস্থা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, এটাকে শিল্পায়নের স্বার্থ বলে কোনওভাবেই বিবেচনা করা যায় না। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঠিক কত লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য কখনই দিতে পারেননি। শিল্পমন্ত্রী বারবার বলেছিলেন, অধিগৃহীত জমি কোনওভাবেই আর ফিরিয়ে দেওয়ার আইনি সংস্থান নেই। ফেসবুকে অনেকেই নানা পুরনো খবর/ ভিডিও পোস্ট করছেন। খুঁজলে এইসব কথাও তারা পেতে পারেন। 

যাই হোক, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

সুপ্রিম কোর্টের রায় পাওয়া যাবে এই লিঙ্কে: 

http://www.indiaenvironmentportal.org.in/content/434997/judgement-of-the-supreme-court-of-india-regarding-acquisition-of-land-by-tata-motors-ltd-singur-district-hooghly-west-bengal-31082016/


7 comments:

  1. এই মুহূর্তে খুবই প্রাসঙ্গিক।

    ReplyDelete
  2. 1.Engineering ও ডিগ্রী কলেজ গুলো বন্ধ করে চাষ আবাদ শেখানো হোক। এই দাবি উঠুক ঘরে ঘরে। 2. শিক্ষার প্রয়োজন সেরকম না থাকায় বইপত্র ছাপানোর কোনও মানে হয় না, বন্ধ হোক ছাপাখানা। প্রাথমিক শিক্ষাই যথেষ্ট। (যতো কম শিখবে ততই ভালো)। 15 বা 20 বছর ধরে পড়াশুনার পরিশ্রম করিয়ে তার দায় ঝেড়ে ফেলার চেয়ে এটা অনেক মানবিক।

    ReplyDelete
    Replies
    1. চিন্তা নেই সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৫'এর মধ্যে ১০ জন ভারতীয়ের মধ্যে ৬ জন এই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত রোবর্টের কাছে কাজ হারাবে। আর আপনাদের এই ঔপনিবেশিক চাকুরীমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মধ্যবিত্ত পেনশনভোগী ব্যবস্থার পতন অনিবার্য। একটা অনুন্নয়নকে উন্নয়নের নাম দিয়ে পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটানো শুধুমাত্র অমানবিকই নয় তদুপরি অপরাধ

      Delete
    2. কোন শিক্ষা ব্যবস্থার ই দরকার নেই। প্রস্তর যুগে ফেরত যাওয়া হোক।

      Delete
  3. ভালো লাগলো এই নির্মোহ প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ

    ReplyDelete
  4. লেখকের নির্মোহ তথ্য পরিবেশন স্পষ্ট করে দিয়েছে সিঙ্গুরে প্রকল্পের সাথে জনস্বার্থ যুক্ত ছিল না। ঠিক সেই কারণেই গুজরাটে কারখানা যাবার পর কারখানার অস্তিত্ব নেই, এটাও লক্ষণীয়। শ্রী বাগচী কে সময়োপযোগী রচনা পরিবেশন করার জন্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  5. একদম ঠিক সময়ে ঠিক লেখা।

    ReplyDelete