Tuesday 23 March 2021

দেশ বিপন্ন বিপর্যস্ত!

সরকারি সম্পত্তি লুট চলছে

সোমনাথ গুহ


সরকারের আর ব্যবসা বাণিজ্যে থাকার কোনও প্রয়োজন নেই; Government has no business to be in business- ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট’এর একটি ওয়েবিনারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ কথা বলেন। ঐ একই অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করেন যে সরকার ১০০টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, যার মূল্য ২.৫ লক্ষ কোটি, বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে গরিবের মাথার ওপর ছাদ করে দেওয়া হবে, পরিকাঠামো তৈরি হবে ইত্যাদি বাগাড়ম্বর। ভবিষ্যতে কেবল মাত্র চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারের যৎকিঞ্চিত উপস্থিতি থাকবে। এই চারটি ক্ষেত্র হল- নিরাপত্তা ও আণবিক শক্তি; যানবাহন ও টেলিকম; বিভিন্ন জ্বালানি যেমন তেল, কয়লা, ইত্যাদি; বিমা, ব্যাঙ্কিং এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিষেবা। এর বাইরে সমস্ত সরকারি সংস্থা বেসরকারি করে দেওয়া হবে, আর যদি সেগুলির কোনও ক্রেতা না পাওয়া যায় তো বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর অর্থ, অন্তত ২৫০টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ওপর খাঁড়া ঝুলছে, লাখো কর্মচারীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এতদিন এই সংস্থাগুলি চালু ছিল বলেই সেগুলোকে আগামী দিনেও চালিয়ে যেতে হবে এর কোনও অর্থ নেই। আমাদের দেখতে হবে সরকারি সম্পদ যত বেশি মানুষের স্বার্থে কাজে লাগানো যায় এবং আমাদের দক্ষ আধিকারিকদের কর্মক্ষমতা কত বেশি সেই লক্ষ্যে ব্যবহার করা যায়। 

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ছাড়া বেসরকারিকরণের তাৎক্ষণিক তালিকায় আছে দুটি ব্যাঙ্ক, একটি বিমা সংস্থা, ৯০টি রেল স্টেশন। ছটি বিমানবন্দর এর মধ্যে আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির বেসরকারিকরণ শুরু হয়ে গেছে। ধ্বনি ভোটে বিল পাস করে বিমা সংস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ ৪৯ শতাংশ থেকে ৭৪ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি ব্যবসায় অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাঙ্কের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটা এখন তুলে নেওয়া হয়েছে। সরকারি ব্যবসা বলতে এখন কর জমা নেওয়া, পেনশন দিতে পারা, অপেক্ষাকৃত লাভজনক সুদে সরকারের সেভিংস স্কিম চালু করা ইত্যাদি। মোদ্দা কথায় সরকার বলতে চাইছে, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এখন বেসরকারি ক্ষেত্রকে সমান দায়িত্ব নিতে হবে। আরেক মন্ত্রী বলছেন যে দেশ গড়ার কাজ শুধু সরকার নয় কর্পোরেট সংস্থাগুলিকেও নিতে হবে। শুনে মনে হবে, এই অতিকায় সংস্থাগুলিকে তারা কাঠগড়ায় চড়াচ্ছে; বাস্তবে দেশ গড়ার মহান দায়িত্বের ধুয়ো তুলে যাবতীয় সরকারি সম্পত্তি তারা এদের হাতে তুলে দিচ্ছে। 

সরকারি ব্যবসায় বেসরকারি ব্যাঙ্ককে অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার অর্থ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে আরও রুগ্ন করে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করা। প্রাইভেট ব্যাঙ্ক কর জমা নেবে, পেনশন দেবে কিন্তু তারা কি জিরো ব্যাল্যান্সে জনধন অ্যাকাউন্ট খুলবে? মুদ্রা ঋণ (যার অঙ্ক মাত্র ৫০০০০-১০০০০০০ টাকা) যার থেকে আয় সামান্যই সেটা দিতে রাজি হবে? কৃষি লোন দেবে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষিদের? প্রায়ারিটি সেক্টরের (অর্থাৎ যে ক্ষেত্রগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন) বিধি অনুযায়ী ৪০ শতাংশ ঋণ কৃষি, শিক্ষা, সমাজের দুর্বল মানুষদের প্রাপ্য। আরবিআই রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রামে শাখা খুলতেই প্রাইভেট ব্যাঙ্কের অনীহা আছে, দুঃস্থ মানুষদের লোন দেওয়া তো অনেক দূরের কথা। অর্থ দফতরের প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের বক্তব্য অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং গ্রামীণ ব্যাঙ্ক একত্রে ৪০.৪৮ কোটি জনধন খাতা খুলেছে যেখানে বেসরকারি ব্যাঙ্ক খুলেছে মাত্র ১.২৭ কোটি। মোট মুদ্রা ঋণের ৩৫ শতাংশ সরকারি ও গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে, ২০ শতাংশ বেসরকারি। এর অর্থ শাসক দলের আনুকূল্যে সরকারি ব্যবসার ক্ষীরটা তারা খাবে, ঝুঁকিপূর্ণ, কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির দায়ভার সরকারি ব্যাঙ্ককেই বহন করতে হবে। এতদিন যাবৎ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হাজারও বিভাগের যে বিপুল তহবিল তা সরকারি ব্যাঙ্কের কাছেই গচ্ছিত থাকত। এখন বসরকারি ব্যাঙ্ক যে তাতে ভাগ বসাবে শুধু তাই নয়, এই বিশাল অঙ্কের আমানত কেন্দ্রের নেতানেত্রীদের অঙ্গুলি হেলনে তাদের করায়ত্ত হবে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সরকারি ব্যাঙ্কের ব্যবসা আরও কমে যাবে। সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্ম- ঠিক যে উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল- তা থমকে যাবে। 

অথচ ইদানিং কালে বারবার দেখা গেছে, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্কই  লাটে ওঠার জোগাড় হয়েছে। যেমন, ইয়েস ব্যাঙ্ক, পিএমসি ব্যাঙ্ক, লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক। প্রথম দুটি ব্যাঙ্ক তো ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের চূড়ান্ত উদাহরণ। দুটি ক্ষেত্রেই মালিক নিজের পরিবারের লোকজনদের ঋণ দিয়ে সাধারণ মানুষদের টাকা লুটপাট করেছে। ইয়েস ব্যাঙ্ককে উদ্ধার করতে এসবিআইকে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের শেয়ার কিনতে। একই ভাবে আইডিবিআই ব্যাঙ্ককে উদ্ধার করতে ব্যবহার করা হয়েছে এলআইসিকে। এটাই গল্প। কোনও বেসরকারি সংস্থা লুটপাট হলে সরকারি সংস্থাকে ব্যবহার করা হয় সেটাকে উদ্ধার করতে। এর ফলে ঐ সংস্থাগুলি নিজেই যে রুগ্ন হয়ে যেতে পারে তাতে সরকারের কিছু যায় আসে না। যখন সেটা হবে তখন বলা হবে কর্মচারীরা কামচোর, আধিকারিকরা অদক্ষ, পেশাদারিত্বের অভাব, অতএব বেসরকারি করো। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাই। লকডাউনের পরে বিদেশে আটকে যাওয়া ভারতীয়দের উদ্ধার করতে কোনও ইন্ডিগো বা স্পাইসজেট নয়, ব্যবহার করা হয়েছে সুপরিকল্পিত ভাবে রুগ্ন করে দেওয়া, বহু অবহেলিত এককালের মহারাজ এয়ার ইন্ডিয়াকে। বিএসএনএল'কে এখনও 4G চালু করার অনুমতি দেওয়া হয়নি, যেখানে প্রাইভেট টেলিকম সংস্থাগুলি 5G চালু করার পথে। টেলিকম ক্ষেত্রে জিও'র উত্থান অভুতপূর্ব যেখানে ভোডাফোনের মতো একটি শক্তিশালী কোম্পানিও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সীমাহীন সরকারি প্রশ্রয় ও বাণিজ্যিক ছলচাতুরি করে এই সংস্থা টেলিকম ক্ষেত্রে প্রায় একাধিপত্য কায়েম করেছে। 

আর শুধু যে অলাভজনক সংস্থাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এমনটাও তো নয়। তাহলে তো ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করার কোনও যুক্তি ধোপে টেঁকে না। মার্চ ২০২০ অবধি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের লাভ ১৭৪০০০ কোটি টাকা। অনুৎপাদক সম্পদ আছে ২০০০০০ কোটি টাকা। কিন্তু এই খারাপ হয়ে যাওয়া ঋণগুলির জন্য দায়ী কারা? এআইবিএ (ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের সর্ববৃহৎ কর্মচারী ইউনিয়ন) সরকারি ব্যাঙ্কে উইলফুল ডিফল্টারদের (যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণ পরিশোধে অক্ষম) একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ২৪২৬টি এই ধরনের সংস্থার থেকে ব্যাঙ্কের মোট পাওনা ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। এদের সর্বাগ্রে কুখ্যাত মেহুল চোক্সির গীতাঞ্জলী জেমস লিমিটেড। এই বিপুল অঙ্ক উদ্ধারে সরকার সচেষ্ট হোক। সরকার কেন এইসব সংস্থাগুলির থেকে ব্যাঙ্কের টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছে না। সরকারের এই অনীহার ফলে পুরো সরকারি ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। থিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরও লাভজনক। সেখানে কর্মচারী, অফিসার, কেরালা সরকারের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সেটা আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া হল। নতুন মালিকদের বলা হয়েছে অন্তত ৬০ শতাংশ কর্মচারী তাদের পুনর্নিয়োগ করতে হবে। তাহলে বাকি ৪০ শতাংশের কী হবে? যে সংস্থাগুলি বেচে দেওয়া বা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে সেগুলির কর্মীদের যে কী অসহায়, অনিশ্চিত অবস্থা তা সংবাদমাধ্যম তুলে ধরছে না। 

বেসরকারিকরণ করলেই যে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে না এটা তো প্রমাণিত। প্রাইভেট ব্যাঙ্কেও অনুৎপাদক সম্পদের হার উর্ধ্বমুখি। গত অর্থবর্ষে তারা ৫৩৯৪৯ কোটি টাকা রাইট অফ করেছে, অর্থাৎ ব্যাল্যান্স শিট থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এর পুরোটাই কর্পোরেট লোন। সরকার কি এটা জানে না? আসলে সরকার ও সমাজের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক বর্তমান শাসক দল আমূল পালটে ফেলছে। এতদিন ছিল সরকার সমাজের দুর্বল, অনগ্রসর মানুষদের স্বনির্ভর হতে সাহায্য করবে। এখন বলা হচ্ছে সরকার শুধু উপার্জন করার আবহ তৈরি করে দেবে, এবার তুমি করে খাও। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা আজ বিশ্ব জুড়ে তামাদি হয়ে গেছে। এখন বল্গাহীন, লাগামছাড়া পুঁজির আধিপত্যের যুগ। নির্লজ্জ ক্রোনি ক্যাপিটালিজম! মনে রাখতে হবে, সরকারি ব্যাঙ্কের আমানত প্রায় ১৪০ লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্ক ব্যাঙ্কের অতি উচ্চপদস্থ আধিকারিক, আমলা, IBA, RBI এবং সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের লালফিতেতে বাঁধা। এখন যা ব্যবস্থা রয়েছে তাতে এটা করায়ত্ত করতে অনেক বাধা ডিঙোতে হয়। তাই, লাল ফিতে ছিন্ন করে এই বিশাল তহবিল মুক্ত করার জন্য বেসরকারিকরণ আবশ্যিক। এর ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করা কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার প্রিয় দুই সাঙাতের বিশেষ প্রয়োজন। রেল, বিমানবন্দর এবং অন্যান্য সংস্থাকে বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যও তাই। আজ আমাদের বুঝতে হবে, ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা শুধু তাঁদের মাইনে বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করছেন না, তাঁরা আমাদের যে গচ্ছিত ধন ব্যাঙ্কে সঞ্চিত রয়েছে তাকেও সুরক্ষিত রাখার জন্য পথে নেমেছেন। আমাদের তাঁদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। 


2 comments: