Saturday 27 March 2021

নতুন শ্রম কোড

শ্রমিকের স্বার্থ ও সুরক্ষার নামগন্ধ নেই

শোভনলাল চক্রবর্তী


যে কোনও সরকারি পরিকল্পনার সঙ্গে বহু মানুষের স্বার্থ পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থাকে। ওই প্রকল্পের কেন্দ্রে যদি উপযুক্ত প্রতিনিধি না থাকে তবে পরবর্তী কালে সিদ্ধান্তের ভালো মন্দ বিচারে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ভারতে গত পাঁচ বছরে এই সমস্যা প্রায় পদে পদে মানুষ টের পেয়েছেন। বিমুদ্রাকরণ হয়েছিল, কিন্তু যে বিরাট পরিমাণ অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষ এর ফলে প্রভাবিত হবেন তাঁদের অন্ধকারে রেখে। জিএসটি চালু করার আগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আশঙ্কা কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। লকডাউন হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থার কী হবে তা শাসন ব্যবস্থার এত বিকেন্দ্রীকরণ সত্ত্বেও কেউ জানতে চাননি। কৃষি বিলে অসংখ্য কৃষকের চাহিদার প্রতিফলন হয়নি, কারণ কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলেননি। 

একই ভাবে শ্রম আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনের প্রস্তাব চলে গেছে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে, কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। সংসদীয় গণতন্ত্রে এত সব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গও যে যথোচিত আলোচনার জায়গা পাচ্ছে না, যাদের নিয়ে আইন তারাই সেখানে ব্রাত্য হয়ে পড়ছেন, নোয়াম চমস্কি যাকে বলেছেন 'ভয়েস অফ স্টেক হোল্ডার'- সেটা না থাকা কিন্তু এক গভীর সংকটের অশনি সংকেত। 

জানুয়ারি ২০২১-এ গৃহীত শ্রম আইনের চারটি কোডের মধ্যে নাকি ৩৯টি পূর্বতন আইন মিশে গিয়েছে। এই চারটি কোড হল: (১) বেতন কাঠামো বিষয়ক (২) শিল্প সম্পর্ক বিষয়ক (৩) সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ক এবং (৪) কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা ও কাজের পরিবেশ বিষয়ক। আগামী এপ্রিলে এই নতুন  শ্রম কোড চালু করার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। অনেকে ভেবেছিলেন, আর্থিক সংকটের কথা মাথায় রেখে নতুন কোডে শ্রমিকদের সুবিধা দেওয়া হবে। বাস্তবে হয়েছে ঠিক বিপরীত। বিশেষ করে এমন একটা সময়ে যখন কর্মসংস্থান তলানিতে। এর উপরে স্ট্যান্ডিং কমিটির সুপারিশ মেনে শিল্প সম্পর্ক নামক কোডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কোম্পানির তরফে স্থায়ী ভিত্তিতে কী নির্দিষ্ট নীতিগত সংস্থান রয়েছে, সেই বিষয়টিও। নতুন ব্যবস্থায় অন্তত ৩০০ কর্মী না থাকলে সরকারের কাছে নীতি ঘোষণার আর কোনও প্রয়োজন নেই। এই সংস্থাগুলোতে প্রায় যে কোনও ব্যবস্থা চলতে পারে। অথচ, দেশে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানই যে সব থেকে বেশি তা তো অজানা নয়। আর আছে ইন্সপেক্টর ব্যবস্থা যারা গিয়ে দেখবে যে সংস্থা নিয়ম মানছে কিনা। যেমন, বেতনের ক্ষেত্রে একটা সর্বনিম্ন হার ঠিক করে দেবে কেন্দ্র এবং তার সাহায্যে কোম্পানি নির্ধারণ করবে ন্যূনতম বেতন, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হওয়া প্রশ্নাতীত নয়। এই পদ্ধতি যে আবার ইন্সপেক্টর রাজ তৈরি করবে তা এক প্রকার নিশ্চিত, আর তার সঙ্গে বাড়বে দুর্নীতি আর ঘুষের প্রসার। এই সরকারই নাকি আবার দুর্নীতি দমন করবে! 

অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্যে কর্পোরেট সংস্থা সামাজিক দায়িত্ব তহবিল থেকে ১-২ শতাংশ হারে অনুদান দেবে, কিন্তু সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ক খরচ তো প্রদেয় কর নয়, এতে যা বিচ্যুতি লক্ষ করা যায় তা মুনাফা করতে চাওয়া কোম্পানির পক্ষে স্বাভাবিক আচরণ। দাতাকর্ণের তো আর তেল পরিশোধনের ব্যবসা ছিল না! যে সংস্থাগুলো অন্তত ৫০ জন চুক্তিভিত্তিক কর্মী রাখে তারা কর্মীর ১৫ দিনের বেতন দান করবে কর্মীর দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষে, তবে যদি ছাঁটাই করে দেওয়া হয় তবেই। এই উদ্দেশ্যে অন্য সাহায্য নাকি দেওয়া হবে, যার না আছে নিশ্চয়তা, না নির্দিষ্ট কোনও হার। সরকারের মন্ত্রকগুলোর মধ্যে যে সমন্বয়ের কত অভাব তা বোঝা যায় যখন বাজেট বক্তৃতার কোথাও শ্রম আইন বিষয়ক কোনও আলোচনা উপস্থাপিত হয় না এবং বেসরকারি ব্যবসার অনুদান নির্ভর না হয়ে সামান্য ট্যাক্সের সাহায্যে এই সব লক্ষপুরণের কোনও সদিচ্ছা দেখা যায় না। 

গত দু' দশকে ভারতের উৎপাদন সংস্থাগুলোতে মিলিত ভাবে মোট কর্মীদের বেতন কমেছে ৩০ শতাংশ আর মুনাফা বেড়েছে প্রায় সমপরিমাণ। স্পষ্টতই বৃদ্ধির সুফল সরকারি মধ্যস্থতায় হাত বদলেছে। এসবকে উন্নত দেশের পরিচয় ভেবে যারা উঁচু গলায় সওয়াল করছেন তাঁদের জেগে ঘুমোনোর দিন কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ভাবতে অবাক লাগে, পরাধীন দেশের প্রথম শিল্প ধর্মঘট হয়েছিল হাওড়া স্টেশনে ১৮৬২ সালে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে, আর তার ১৫ বছর পর নাগপুর এমপ্রেস মিলে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে। আজ দেড়শো বছর পর, শিল্প ধর্মঘট করতে গেলে স্বাধীন ভারতের সমস্ত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ৬০ দিনের আগাম নোটিস দিতে হবে সংস্থাকে, যা ধর্মঘট করতে না পারার সামিল। যেহেতু বেতন কাঠামো বাদ দিয়ে বাকি তিনটি বিষয় পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল মতামতের জন্য, ফলে তাদের সিদ্ধান্ত এখানে জানানো উচিত। স্ট্যান্ডিং কমিটি জানায় যে, জল, বিদুৎ, স্বাস্থ্য, টেলিফোন ইত্যাদি অপরিহার্য পরিষেবা ছাড়া ধর্মঘট করার অধিকার অন্য সব ক্ষেত্রে থাকা উচিত। তা যে সরকার কানে তোলেনি তা বলাই বাহুল্য। দক্ষিণপন্থী দেশগুলোতেও এই ধরনের প্রস্তাব সরকারি খাতায় থাকে না কারণ মনে মনে চাইলেও কোনও সরকার শ্রমিকের অধিকার সম্পূর্ণ খর্ব করার পক্ষপাতী নয়। 

কর্মীদের অধিকার নিয়ে ভারতের অবস্থান এই মুহূর্তে কোন মেরুতে তাতে কারওর সন্দেহ নেই। প্রচলিত শ্রম আইন কেন্দ্র রাজ্য যৌথ তালিকায় থাকার দরুণ এতদিন রাজ্যগুলো নিজেদের স্বার্থ ও আর্থিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইন সম্পূর্ণ রূপে মেনে বা সংশোধন করে নিত। গৃহীত আইন শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করছে নাকি পুঁজি মালিকের, তার ভিত্তিতে রাজ্যগুলিকে পুঁজি দরদি অথবা শ্রমিক দরদি আখ্যা দেওয়া হত। পশ্চিমবঙ্গ আর কেরালাকে  শ্রমিক দরদি বলা যায় কারণ শ্রমিকের স্বার্থে কেন্দ্রীয় আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয় এখানে। অন্য দিকে গুজরাট, মহারাষ্ট্র যে পুঁজি দরদি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, এই রাজ্যগুলোতে শ্রমিকের অধিকার ন্যূনতম রেখে ব্যবসার সুবিধা করে দেওয়াই সরকারের উদ্দেশ্য। ব্যবসায় সুবিধা করে দেওয়ার মধ্যে অবশ্যই অন্যায় কিছু নেই, কিন্তু তা শ্রমিকদের অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে করা যায় না নিশ্চয়ই। ফলে, কোন রাজ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্র কতটা সৃষ্টি হবে তার একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল আগেই। যে রাজ্য শ্রমদরদি, সেখানে সহজে পুঁজির বিনিয়োগ করবে না পুঁজিপতিরা, কারণ শ্রমিকের মাথাপিছু খরচ বেশি পড়তে পারে, প্রাপ্য পরিবেশ কিংবা অধিকার নিয়ে আন্দোলন হতে পারে, এমনকী ধর্মঘটও। সুতরাং, কম পুঁজিনিবেশ মানেই প্রথাগত সংগঠিত ব্যবসা কম হবে আর কাজের জন্যে হয় অসংগঠিত ক্ষেত্র পরে থাকবে না হলে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে হবে। অন্যদিকে, যে রাজ্য পুঁজিদরদি সেখানে শ্রমিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পুঁজি মালিকের উপকার করা হয় বলে পুঁজিনিবেশ অঢেল, সংগঠিত শিল্প গড়ে ওঠে, যদিও শ্রমিক সংগঠন নখ দন্তহীন হয়ে থাকে কিন্তু স্রেফ বাঁচার তাগিদে ফুটপাথের দোকানের ভরসায় থাকতে হয় না। 

যেটা অবাক করে সেটা হল, এত পুঁজিনির্ভরতা সত্ত্বেও কিন্তু গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে অসংগঠিত ক্ষেত্র বহরে পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালার থেকে বিন্দুমাত্র কম নয়। আসলে, ব্যবসার ধরন যদি এমন হয় যে ছোট- মাঝারি আয়তনেই অনেক কর্মী না রেখে কোম্পানি চূড়ান্ত মুনাফা করতে পারে, তাহলে বাড়তি কর্মসংস্থানের দায় কেন নেবে তারা? তাছাড়া, অটোমেশন-এর দরুন কোম্পানিগুলোতে এমনিই কমছে কর্মী ও চাকরির সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে নতুন শ্রম কোড যেন খাঁড়ার ঘায়ের উপরে নুনের ছিটে। 

তা হলে কি কোনও সুবিধে হয়নি? হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকরা এই আইনের আওতায় দেশের বাড়ি থেকে যাতায়াত করার জন্য এককালীন ট্রেন কি বাস ভাড়া পাবে মালিকের কাছ থেকে। ফলে, আবার যদি লকডাউন হয় তা হলে অন্তত হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে না তাদের। এই তো অনেক পাওয়া ওদের কাছে।


3 comments:

  1. This act seems to be fully capitalistic. It has been framed by the capitalist for the capitalist.

    ReplyDelete
  2. এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি বিষয়ে আলোচনা ও আলোকপাত আমাদের ঋদ্ধ করবে। উপকার হবে শ্রম আইন সংশোধন বিষয়ে চর্চা ক্ষেত্রে।

    ReplyDelete
  3. কিছু ক্ষেত্রে সরলিকরন হয়ে গেল। কিছু ভালো দীক্ও আছে।

    ReplyDelete