বিস্ময়হীন শিশুকাল ও আমরা
সোমা চ্যাটার্জি
'বাড়ি থেকে পালিয়ে' ছবির সেই দৃশ্যটা মনে আছে? যখন কিশোর কাঞ্চন গ্রাম থেকে শহরে এসে হাওড়া ব্রিজ দেখতে পায়! বা গঙ্গায় ধোঁয়া ওঠা ছোট জাহাজের চলাচল! কিংবা 'তারে জমিন পর' ছবির ছোট ঈশান যখন স্কুল থেকে পালিয়ে মুম্বই'তে আকাশছোঁয়া অট্টালিকার রঙ করা দেখতে উপরের দিকে বড় বড় চোখ তুলে তাকায়! অথবা, 'পথের পাঁচালি'র সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য, যা আমাদের মনে শিশু বয়সের একটি চিরন্তন ধারণাকে গেঁথে দেয় -- কাশে ভরা মাঠের মধ্যে, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে এগিয়ে আসছে দৈত্যরূপী রেলগাড়ি আর অপার বিস্ময়ে তা দেখছে বালক অপুর চোখ।
এক শিশু মনের এই বিস্ময়ই তাকে বাঁচিয়ে রাখে, জন্মলগ্ন থেকে বড় হওয়া, আমৃত্যু এই কৌতূহলই তার জীবন সঞ্জীবনী। তিন-চার থেকে বারো বছর পর্যন্ত একটি শিশু যা কিছু দেখে, সেই দেখার সঙ্গে তার নিজের বোঝাপড়া ও বিস্ময়কে মিলিয়ে নেয়। সেই দেখা তার মনের মধ্যে গেঁথে থাকে। মানবশিশু শৈশবে যা দেখে, বোঝে, সব কিছুতে শুধু বিস্ময় আর বিস্ময়! ফলে, পুরো জীবনের রঙ, রূপ, রস, গন্ধ সব কিছুই তৈরি হয় বিস্ময়ের আবহে।
কিন্তু আজ আমাদের শিশুদের মধ্যে এই বিস্ময়-নিবিষ্টতা সত্যিই কি আর আছে? আজ সত্যিই কি আমরা প্রাত্যহিক ইঁদুর দৌড়ে শিশুর এই কৌতূহলী মনকে সঠিক মাত্রায় বুঝতে পারি… বা তার কল্পনাশক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে তার সৃজনশীল মনকে গড়ে ওঠার সুযোগ দিই? পাহাড় কেন অত উঁচু, আকাশ নীল কেন বা সাগরের জল কেন নোনা-- এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বিড়ম্বনা থেকে নিজেদের এড়াতে আমরা নিজেরাই কি যন্ত্রচালিতের মতো তাদের প্রযুক্তিভিত্তিক বা গতানুগতিক তথাকথিত সুশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত করে তুলছি না?
অতিরিক্ত সুরক্ষা, প্রযুক্তির অতি-প্রভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষার কারণে শিশুরা এখন স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ও কম্পিউটারে এত বেশি সময় কাটাচ্ছে যে তারা বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তাদের চারপাশের জগৎ সম্পর্কে জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, জীবনের ছোট বড় কোনও অভিজ্ঞতাই তাদের কৌতূহল উদ্রেক করছে না, ফলে তারা বিস্ময়রহিত অনুভুতিহীন এক প্রজন্মে পরিণত হচ্ছে, যাদের ভবিষ্যৎ ও কর্মশক্তি সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ও বুদ্ধিবৃত্তিহীন। কিন্তু বিজ্ঞান বা মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, আগামী দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই জগতে লড়াই করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ারই মানুষের সৃষ্টিশীল মন; মানুষের থেকে যন্ত্র অনেক তাড়াতাড়ি শিখতে পারে, কিন্তু মানুষের আবেগ, অনুভূতি আছে যেটা যন্ত্রের নেই; যন্ত্র সমস্যার সমাধান করতে পারলেও মানুষের সৃজনশীলতাকে কখনই চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। অর্থাৎ, আবেগগত বুদ্ধিমত্তাই সাফল্যের ভিত্তি।
একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্র কখনই মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। মানুষ জন্মগতভাবেই এমন বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে যা খুব তাড়াতাড়ি শিখতে ও চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে। আমরা সমস্যাগুলি বিশ্লেষণ করে সেগুলির সমাধান করি। আমাদের আবেগ আছে, আমরা সহানুভূতিশীল এবং অনুভূতি প্রকাশও করতে পারি। আমরা যুক্তি দিই, প্রশ্ন করি, আশপাশের পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হই এবং আমাদের সিদ্ধান্তকে পরিবর্তনও করতে পারি। যখন আমরা ভুলবশত একটি গরম জিনিস হাতে ধরি, তাৎক্ষণিকভাবে তা ফেলে দিই, কিন্ত AI এমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। এই অনুভূতিগুলির ভিত্তিই হল মানুষের কল্পনা ও অভিজ্ঞতা।
আইনস্টাইন বলেছিলেন, 'জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।' কল্পনা হল সম্ভাবনার দরজা। কল্পনাপ্রসূত মনই সৃজনশীল। প্রতিটি শিশুই সৃষ্টিশীল এবং এই সৃষ্টিশীলতা একটি চলমান প্রক্রিয়া। শিশু যখন ছোটবেলায় খেলনা নিয়ে খেলে, তার মধ্যে খেলনা বিষয়ে কৌতূহল তৈরি হয়, তা জন্ম দেয় এক কল্পনাশক্তির; মাটির বুকে চলা গাড়িকে হয়তো শিশু কল্পনার উড়ান দেয় আকাশে, সেই অদৃশ্য ডানা তার মনের গোচরে তাকে সৃষ্টিশীল করে তোলে, তাকে নানা উপায়ে ভাবনা-চিন্তা উদ্ভাবনের রসদ দেয়। ছোট বাচ্চাদের জন্য বিস্ময় তাই একটি অমূল্য সম্পদ। বিস্ময়ের অর্থ, চারপাশের জগৎ সম্পর্কে কৌতূহল ও আগ্রহের অনুভূতি। তা শেখার একটি শক্তিশালী চালিকা শক্তিও, যা শিশুদের নতুন কিছু অন্বেষণ ও আবিষ্কার করতেও উদ্বুদ্ধ করে।
কিন্তু আমরা অধিকাংশ বাবা-মায়েরাই শিশুর সৃজনশীলতাকে গুলিয়ে ফেলি তার কর্মদক্ষতার সঙ্গে। বুদ্ধিমান শিশুমাত্রই যে কর্মদক্ষ হবে তার কোনও মানে নেই। একটি শিশু খুব ভাল ছবি আঁকতে পারে, সেটা তার কর্মদক্ষতা। কিন্তু সে যদি তার সৃষ্টিশীল মন দিয়ে একটি কল্পনা-প্রসূত ছবি আঁকে, তার মধ্যে তার মানসিক বিকাশের লক্ষণ আছে, সেটা তার বুদ্ধিমত্তা। আমরা বাবা-মায়েরা এই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার আপেক্ষিক কর্মদক্ষতাকে মিলিয়ে ফেলতে গিয়ে অচিরেই তার ক্ষতি করে দিচ্ছি, তার সহজাত স্বাভাবিক ভাবনাকে বেড়া দিয়ে তার মৌলিক চিন্তার বিষয় থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। এতে তার গড়পড়তা কর্মদক্ষতা বেড়ে সে ভবিষ্যৎ জীবনে হয়তো আপাত সাফল্যর দিকে ধাবিত হবে কিন্তু তার সম্ভাবনাময় চেতনার উন্মেষ কখনই ঘটবে না। একটি শিশু যখন নিজে কিছু তৈরি করতে শুরু করে, তা যতই অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন, সেটি তার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস জাগায়। সে বুঝতে পারে যে কিছু অর্জন করতে সময় ও প্রচেষ্টা লাগে এবং একবারেই সব কিছু ঠিকঠাক তৈরি হয় না, সে বুঝতে পারে সৃষ্টি একটি প্রক্রিয়া, সৃজনশীল হওয়া অনেক উত্থান-পতন ও ব্যর্থতার ঝুঁকি নিয়ে আসে।
কোন্ শিশুর ভিতর কোন্ প্রতিভা লুকিয়ে আছে তা আমাদের অজানা। শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ অবারিত হলেই বিকশিত হবে তাদের মেধা ও সৃজনশীলতা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সৃজনশীলতা বিকাশে শিশুর বেড়ে ওঠার সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টিতে শিশু যেন তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশের সুযোগ পায়, সে দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এ দায়িত্ব আমাদের পরিবার ও সমাজের। বাবা-মাকে তাই শিশুর মনোজগতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তাদের অনুসন্ধিৎসু মনকে যতটুকু পারা যায় সন্তুষ্ট করার প্রয়াস চালাতে হবে। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জল পড়ে পাতা নড়ে' এই পর্যবেক্ষণ ও অনুভূতির ব্যাপক সাড়া থেকে তাঁর কবিত্ব শক্তির উন্মেষ। তাই উৎসাহ ও উদ্দীপনা সর্বদাই সৃজনশীলতাকে উজ্জীবিত করতে পারে।
অনেকে মনে করেন, শিল্প, সঙ্গীত, লেখালিখি, অভিনয়ের মতো শৈল্পিক প্রচেষ্টার মধ্যেই সৃজনশীলতা সীমাবদ্ধ। কিন্তু যে কোনও কিছুই শেখার আধার হল সৃজনশীল মন; তা অঙ্ক, বিজ্ঞান বা অন্য কিছুও হতে পারে, কারণ, যে কোনও সমস্যা সমাধান সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগেই হয়। একটি শিশু খুব সহজেই এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় বিচরণ করতে পারে, মৌলিক কোনও ধারণায় পৌঁছতে পারে এবং সেখান থেকেই আরোপিত খোপের বাইরে তার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। তাই কল্পনা করা, নতুন নতুন উপায়ে কিছু চেষ্টা করা এবং পরীক্ষা করা, শিশুদের মধ্যে আত্মমূল্যায়নে সহায়তা করে, শিশুদের সামাজিক-আবেগগত বিকাশ গড়ে তোলে।
ছোট বাচ্চারা সব সময় শিখছে। যখন তারা খেলে, সেটি তাদের জীবনে দক্ষতা তৈরি করে, তাদের এবং অন্যদের অনুভূতি কেমন তা বোঝায়। খেলার মাধ্যমে তারা আপস করতে শেখে, সহমর্মিতা শেখে। কল্পনাপ্রসূত খেলা, যেমন একটি ট্রেন মহাকাশে উড়তে পারে, আজগুবি লাগলেও তাদের নতুন ধারণা প্রকাশ করতে শেখায়। তাই শিশুদের জন্য এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেখানে সে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই উদ্ভাবনী আচরণ ও খেলাধুলা করতে পারে, অন্যান্য শিশুদের ধারণাগুলোকে আত্মস্থ করতে পারে; আমাদের ধারণাগুলোই শুধু তাদের উপর চাপিয়ে না দেওয়া, তাদের অস্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা ও ধারণাগুলোকে গ্রহণ করা এবং স্বাভাবিক সমাধানে উৎসাহিত করা। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলেই তাদের মস্তিষ্কের যথাযথ বিকাশ হয়।
আজকের অধিকাংশ শিশুর জীবনই অতিশৃঙ্খলা বা দৈনন্দিন রুটিনের আবর্তে বন্দী। প্রাক-কৈশোর বয়স থেকেই তারা স্কুল, তারপর টিউশন বা অন্য যে কোনওরকমের নিয়মিত পড়াশোনা বা খেলাধুলার কোচিং'এ ব্যস্ত। ফলে, তাদের মুক্ত চিন্তা গড়ে ওঠার পরিসর নেই, নেই সময়। চাইলেও তারা তাদের কল্পনাপ্রসূত মনের চর্চা করতে পারে না। আবার অন্যদিকে মা-বাবা'রাও নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা সামাজিক অবস্থান বজায় রাখার জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেন শিশুটির উপর, ফলে, তার মন বা বুদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। আমরা নিজেরা যা করতে পারিনি বা অসফল হয়েছি, তা সম্পূর্ণভাবে উশুল করে নিতে চাই আমাদের সন্তানদের মধ্য দিয়েই। রিয়ালিটি শো'এর রমরমা দেখলে বোঝা যায়, অভিভাবকদের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা শিশুদের কোথায় নিয়ে ফেলছে! কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় জন্মলগ্ন থেকেই একটি শিশুর না-ফোটা বুলি বা অমলিন হাসিও পণ্য হয়ে আনন্দ, হাততালি বা 'লাইক' কুড়োচ্ছে, অভিভাবকরা বুঝে কিংবা না-বুঝে শিশুদের হাতে অত্যধিক শক্তিশালী মোবাইল যন্ত্রটি তুলে দিচ্ছেন।
অথচ, বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো, সৃজনশীল কাজ, যেমন, ছবি আঁকা, গল্প করা, নাচ-গান ও শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও গল্প করলে তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়াতে নিয়ে যাওয়াও অত্যন্ত আবশ্যক, কারণ, প্রাকৃতিক জগৎ শিশুদের চিন্তা করতে, প্রশ্ন করতে, অনুমান করতে ও সৃজনশীল মন তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে। শিশুরা বালিতে আঁকতে পারে, নুড়িপাথর সাজিয়ে নকশা বানাতে পারে, বালি দিয়ে দূর্গ তৈরি জানে অথবা আকাশে একটি দৃশ্যকল্প উদ্ভাবন করতে পারে। সৃজনশীলতা শিশুবেলা থেকেই ফুটে ওঠে শিশুর আচার, আচরণ ও কাজেকর্মে। তবে সে জন্য চাই যোগ্য পরিবেশ। তাই বাবা-মাকেও সমান ভাবে শিশুর সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনে ছোট ছোট আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। খুঁজে নিতে হবে বিস্ময়-- বৃষ্টির ফোঁটায়, সাদা মেঘের পালে, বা রেলগাড়ির ধোঁয়ায়…।
বাহ্! পড়ে ভালো লাগলো, সঠিক চিন্তা আর দিক নির্নয়।
ReplyDeleteখুব সুন্দর ও সাবলীল লেখা। বেশ ভালো লাগলো। লেখিকাকে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteহক কথা। কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। বদলে গেছে অনেক কিছুই। ঘুড়ি নয়, কিশোর-কিশোরী ড্রোণ ওড়ায় আজ। VR চশমা, augmented reality, driverless গাড়ি হাতের নাগালে।
ReplyDeleteএখন কল্পনার স্তর ঠিক কিরকম হতে পারে বলে লেখিকা মনে করেন?
মাঠ-ঘাট, ঘাস-কাশ এসব চোখে পড়ে কি আজ?
Khub sunder hoyeche. Satti kore amra bachader childhood ta nosto kore dichi
ReplyDeleteAwesome
ReplyDeleteEkdom thik likhecho.Lekha khub bhalo hoyeche. Pore bhalo laglo.
ReplyDeleteখুব ভালো লিখেছেন। সত্যি বলতে কি আমরা আমাদের শিশুদের শৈশবই দিতে পারিনি।
ReplyDeleteKhub sundor hoyeche lekhata .. amio eta khub anuvab kori.
ReplyDeleteKhub sundor lekha.pore khub bhalo laglo
ReplyDeleteসুন্দর হয়েছে, পড়ে ভালো লাগলো।
ReplyDelete