মৌমাছি সহযোগে চাষই হোক আগামী লক্ষ্য
অর্ণব চক্রবর্তী
চারিদিকে ইদানীং এত রেস্তোরাঁ, নানা পদের লোভনীয় খাবার, কৃষি সংক্রান্ত এত আলোচনা, নানা দেশি-বিদেশি হাইব্রিড কৃষি পণ্যের সমাহার, ঠিক তখনই ততটাই অবহেলিত তাঁরা, যারা নিঃস্বার্থ ভাবে এই কৃষিপণ্য উৎপাদন করছে। এই আলোচনায় কৃষক তো বটেই, তবে বেশি মনোযোগে থাকবে নিবিড় পরাগমিলনকারী ও উপকারী পতঙ্গ মৌমাছিরা।
আইনস্টাইন বলেছিলেন, 'মৌমাছি না থাকলে পৃথিবীর আয়ু মাত্র চার বছর।' এ কথা হয়তো সকলে জানলেও মনে রাখে কজন?
পৃথিবীতে সপুষ্পক উদ্ভিদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তার বংশ বিস্তারের জন্য মৌমাছি এসেছে। মানব সভ্যতার বহু আগে থেকেই মৌমাছি এই পরিবেশে রয়েছে। পরে মানুষ ধীরে ধীরে সমস্ত পশু-পাখির মতো মৌমাছিকে পালন শুরু করে মধু সংগ্রহের জন্য। যে কাজ আজও চলেছে আরও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে দেশ-বিদেশ সর্বত্র। তবে ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে আজও কেবল মধুর জন্য মৌমাছি পালন করা হয়। অন্যদিকে এগিয়ে থাকা দেশগুলো কৃষি ক্ষেত্রে মৌমাছি পালনের মাধ্যমে ব্যাপক উন্নতি করেছে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌমাছির পরাগমিলনের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের বাজার মূল্য বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ₹১.২৫ লক্ষ কোটি থেকে ₹১.৬৫ লক্ষ কোটি)। (সূত্র: USDA (United States Department of Agriculture), Pollinator Partnership, National Honey Board)।
ফসল ভিত্তিক আর্থিক মূল্য:
ফসলের নাম আর্থিক মূল্য
১) বাদাম (Almonds) $৭ বিলিয়ন+
(১০০ শতাংশ মৌমাছি নির্ভর)
২) আপেল $২ বিলিয়ন+
(৯০ শতাংশ মৌমাছি নির্ভর)
৩) ব্লুবেরি $৫০০ মিলিয়ন+
(উচ্চ পরাগমিলন নির্ভর)
৪) সূর্যমুখী $৪০০ মিলিয়ন+
(উচ্চ পরাগমিলন নির্ভর)
৫) তরমুজ, খিরা, স্কোয়াশ $১ বিলিয়ন
(৯০ শতাংশ পরাগমিলন নির্ভর)
অন্যদিকে, মধু ছাড়াও মৌ বিষ থেকে ক্যানসার সহ নার্ভের নানা রোগের ঔষধ তৈরি হচ্ছে, প্রপোলিস অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, রয়েল জেলি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি ও যৌবন রক্ষার্থে, বি পোলেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ও পুষ্টি বৃদ্ধিতে ও মোম বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী প্রস্তুতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া মধুর উপকারিতা তো আমাদের সকলেরই জানা।
মধুর সেবন যারা নিয়মিত করেন তাঁদের করোনা সহ নানা রোগব্যাধি থেকে মুক্তি মিলেছে। এছাড়াও বহু ভিটামিন ও মিনারেল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে বছরে গড়ে মাত্র ১০০-১৫০ গ্রাম মধু ব্যবহৃত হয়। অথচ, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সচেতনতা নেই আমাদের দেশে। যদিও হিমাচল সহ উত্তরাখণ্ড ও কাশ্মীরের কিছু আপেল বাগানে মৌমাছির ব্যবহারে আপেলের ফলন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সেখানে মৌমাছি পালকরা সমাদৃত।
এছাড়া জৈবচাষে মৌমাছির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক। মৌমাছি শুধু মধু উৎপাদনের জন্যই নয়, বরং ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম প্রাকৃতিক মাধ্যম।
পরাগমিলন (Pollination):
• মৌমাছিরা বিভিন্ন ফুলে ফুলে গিয়ে পরাগরেণু (pollen) এক ফুল থেকে অন্য ফুলে স্থানান্তর করে;
• এর ফলে, ফল, সবজি, তেলবীজ, ডাল জাতীয় ফসল সহ বহু গাছের ফলন বৃদ্ধি পায়;
• পরাগমিলন ছাড়া অনেক ফসলই যথাযথভাবে ফল ধরতে পারে না।
পরাগমিলন-নির্ভর কিছু ফসল:
টমেটো, বেগুন, কুমড়ো, তিল, সরিষা, আম, আপেল, আঙুর, সূর্যমুখী, বাদাম ইত্যাদি।
জৈবচাষে ফল ও বীজের গুণগত মান উন্নত করে:
• মৌমাছির সাহায্যে গঠিত ফল বা বীজ আকারে বড়, ভারী ও রোগমুক্ত হয়;
• হরমোন ও কৃত্রিম রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়াই ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা:
• পরাগমিলনের মাধ্যমে জৈব ফার্মে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ও গুণগত মান উভয়ই উন্নত হয়;
• গবেষণায় দেখা গেছে, মৌচাষ যুক্ত ফলন ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হতে পারে।
পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা:
• মৌমাছি প্রাকৃতিক পরাগমিলনের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সাহায্য করে;
• গাছপালা ও বনজ উদ্ভিদদের বংশ বৃদ্ধি মৌমাছির মাধ্যমে সহজ হয়, যা একটি টেকসই বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলে।
রাসায়নিক মুক্ত চাষে সহায়ক:
• ফলে, মৌচাষ ও জৈবচাষ একে অপরের পরিপূরক;
• জৈব কৃষিতে কীটনাশক, হরমোন বা কৃত্রিম সার ব্যবহারের পরিবর্তে মৌমাছির মতো প্রাকৃতিক উপাদান নির্ভরতা বেশি যা মৌমাছির জন্য নিরাপদ;
• মৌমাছির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে জমি নিষ্কলুষ ও পরিবেশবান্ধব।
ফসলের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করে:
• মৌমাছির সক্রিয় পরাগমিলন ফসলের ফুল থেকে ফল হওয়ার সময়কে দ্রুততর করে তোলে;
• এর ফলে এক জমিতে বছরে দুই থেকে তিনবার ফসল তোলা সম্ভব হতে পারে।
অতিরিক্ত আয় ও জীবিকা:
• চাষিরা জৈবচাষের পাশাপাশি মৌচাষ করলে মধু, মোম ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করে অতিরিক্ত আয় করতে পারেন;
• গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৌচাষ একটি টেকসই বিকল্প জীবিকা।
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরে অনেক কৃষক এখন জৈবচাষের সঙ্গে সঙ্গে Apis cerana indica বা Apis mellifera প্রজাতির মৌমাছি পালন করছেন। জৈবচাষে মৌমাছির ভূমিকা শুধু কৃষি উৎপাদন বাড়ানো নয়, বরং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই, জৈব কৃষি নীতি পরিকল্পনায় মৌচাষকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এছাড়াও বিকল্প জীবিকা হিসাবে মৌমাছি পালন একটি লাভজনক দিক হয়ে উঠতে পারে আগামী প্রজন্মের কাছে।
মৌমাছি পালন শিখে বাড়িতে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে বা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ যেমন একটি পেশা হতে পারে, তেমনি মধু বা মধুজাত সামগ্রী ক্রয় করে বিক্রি বা জোগান আরেকটি লাভজনক পেশা হয়ে উঠতে পারে। প্রয়োজন শুধু একটি যুক্তিপূর্ণ পরিবেশবান্ধব ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির।
এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সকল চাষী, প্রকৃতিপ্রেমী, সমাজসেবী সংগঠন ও সকল স্তরের চিন্তাশীল মানুষের কাছে আবেদন, সমাজের নানা স্তরে মৌমাছি পালনে উৎসাহ প্রদান করুন। যে কেউ নিজের বাড়িতে খুব সহজেই মৌমাছি পালন করতে পারেন-- এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিন চারিদিকে। সরকার বিভিন্ন চাষে যেমন উৎসাহ প্রদান করে তেমনি সচেতনতা তৈরি হোক মৌমাছি পালন নিয়ে। বিশেষ করে সকল চাষী ভাইদের কাছে আবেদন, আপনারা আপনাদের চাষের জমিতে কোম্পানির চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন দেখে কোনও প্রকার বিষ বা রাসায়নিক ব্যবহার করবেন না এবং চাষের জমিতে প্রতি বিঘাতে ৪-৬টি সেরেনা মৌমাছির বাক্স রাখুন। বছরের শেষে দেখবেন, আপনার জৈব চাষের ফলন কয়েক গুণ বাড়বে, বিষমুক্ত ফসল ব্যবহার করার ফলে শরীর সুস্থ থাকবে, সঙ্গে ব্যবসায় লাভ বাড়বে। এছাড়া পরিবারের প্রয়োজনীয় খাঁটি মধু পাবেন সারা বছর। কৃষি ক্ষেত্রে 'মৌমাছি সহযোগে চাষ' এটাই হোক আমাদের আগামীর লক্ষ্য।
এই বার্তা যে সকল সরকারি কৃষি বিভাগের আধিকারিক, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি গবেষক, ছাত্র-ছাত্রী, কৃষি বিশেষজ্ঞ, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের আধিকারিকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, তাঁদের অনুরোধ, এছাড়াও মৌমাছি পালক, কীটপতঙ্গ গবেষক ও মৌমাছি প্রেমী মানুষজন তাদের সকলের কাছেই অনুরোধ, আসুন, সকলে মিলে পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগী হয়ে মৌমাছি পালন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে সমাজ সংরক্ষণের কাজে এগিয়ে আসি আগামী প্রজন্মের জন্য।
মৌমাছি দীর্ঘ জীবী হক
ReplyDeleteনাম প্রকাশ করবেন আর আপনার ভালোলাগার বিষয়ে কিছু বলবেন।
Deleteখুব ভালো প্রস্তাবনা।
ReplyDeleteনাম প্রকাশ করবেন আর আপনার ভালোলাগার বিষয়ে কিছু বলবেন।
Deleteসমৃদ্ধ হলাম। তোমার উদ্যোগকে কুর্নিশ✊
ReplyDeleteআমার বাড়িতে ফল বাগানে ৪ কে মৌ বক্স থেকে খুব ভালো ফলাফল পেয়েছি।
ReplyDeleteখুব ভালো প্রস্তাব অর্নব। প্রত্যেক ফল চাষির বাগানে মৌবাস্ক রাখার অনুরোধ করছি।
টে
ReplyDeleteKhub sundor lekha. Sobar awareness dorkar - Rupam Acharya
ReplyDeleteখুব সুন্দর লিখেছ,অনেক না জানা তথ্য জেনে সমৃদ্ধ হলাম। আমিও এই সকল তথ্য আমার কাছের মানুষ দের কাছে পৌঁছে দেব।চেষ্টা করবো এভাবেই যদি সমাজের কোনও কাজে লাগা যায়।
ReplyDeleteলেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ, এত সাবলীল ভঙ্গিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন।
ReplyDeleteআশা করি, পরিবেশ ও বিজ্ঞানের মতো প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি নিয়ে আরও সহজবোধ্য ও তথ্যনিষ্ঠ লেখা প্রকাশিত হবে, যা সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে|