Sunday, 10 August 2025

এক পরিকল্পিত ডিজাইন

ভদ্দরজনেরা মজা পাচ্ছেন গরিব বাঙালির লাঞ্ছনায়?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

এক ধরনের বামপন্থীরা বলছেন, অমিত মালব্যকে তাঁরা পঞ্চম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বই পাঠিয়ে দেবেন; কারণ, বিজেপি’র লোকজনেরা নাকি বাংলা ভাষাটাই জানে না। অপর এক পক্ষ, যারা ড্রয়িং-রুম বামপন্থী, মূলত ‘আহা আনন্দ’ টিভি চ্যানেল দেখে ও ‘বাজার আনন্দ’ খবরের কাগজ পড়ে দেশ ও দশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হন, তাঁরা আরও মজার কথা বলছেন: কই, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের তো পেটাচ্ছে না, যারা মার খাচ্ছেন তাঁরা আসলে ওইসব রাজ্যে লেবরদের কাজে ভাগ বসাচ্ছেন, তাই। এঁদেরই একজন বললেন, ‘labour rate’ নিয়ে ঝামেলা, মানে মজুরি-টজুরি নিয়ে দরাদরি করছে, ফলে, মারধোর খাচ্ছে।

ভাগ্যিস, আপামর বাঙালি আর এদের কথা কেউ শোনেন না। কিন্তু সেই বাসি, পচা কথাগুলি পাড়তে হল, কারণ, কতকগুলি বিষয় আজ স্পষ্ট করে নেওয়ার সময় হয়েছে। দেশ ও রাজ্য এক নতুন বিভাজন-বিন্যাসের কবলে পড়েছে, সেখানে নতুন করে এক রাজনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণি বিন্যাস নির্মিত হচ্ছে; সেই নবতর বিন্যাসে আজ নিজ নিজ উপলব্ধিতে অবস্থিত হওয়ার পালা।

প্রথমত, এ কথাটা খুব স্পষ্ট করে জেনে নিতে হবে যে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে যে সমস্ত বাঙালি শ্রমজীবী মানুষদের উপরে হামলা ও সন্ত্রাস চলেছে তারা মূলত গরিব এবং প্রধানত নিম্নবর্ণ হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের। দ্বিতীয়ত, এই হামলাগুলি সেই সেই রাজ্যের বসবাসকারী শ্রমজীবী বা অন্যান্য মানুষেরা করছেন না; করছে পুলিশ, প্রশাসন ও কতিপয় বানর সেনার দল। অতএব, এমন ভাবার কোনও কারণই নেই যে, বহিরাগত ও স্থানীয়দের মধ্যকার অর্থনৈতিক রেষারেষি থেকে এই আক্রমণ। এই হামলা সংগঠিত হচ্ছে এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ডিজাইন থেকে। সেই ডিজাইনকে বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও এনডিএ জোটের বিপুল জয়ের পরে অমিত শাহের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে, যেখানে তিনি বলছেন, সেই সাংঘাতিক জয়েও তাঁদের ভারত বিজয় সম্পন্ন হয়নি, তা হবে যখন তাঁরা বঙ্গভূমিকে দখলে নিতে পারবেন। কথাটা খেয়ালে রাখবেন। ঠিক যে ভাবে যুদ্ধের শেষ দিনগুলিতে যখন হিটলার তাঁর গোপন বাঙ্কারে প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখনও তিনি তাঁর সেনাপতিদের আদেশ দিচ্ছেন, এখনও যে কজন ইহুদী অউশভিৎস কনসেন্ট্রশন ক্যাম্প অথবা এদিক-ওদিক বেঁচেবর্তে আছে তাদের নিকেশ করে দাও। অর্থাৎ, টার্গেট একটা জাতি বা মতাদর্শ, যাকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করতে পারলে হিংস্র একমাত্রিক ফ্যাসিস্ট শাসনকে কায়েম রাখা যায় না। কারণ, ফ্যাসিবাদের মূল চরিত্রই হল এক বর্ণ, এক রঙ, এক ভাবনা, এক ঢঙ।

বাংলা ও বাঙালি তাহলে কীভাবে অমিত শাহের দলের মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে? হচ্ছে বৈকী! আর সে কারণেই গেরুয়া দলবলকে বারবার পিছুও হঠতে হচ্ছে। বঙ্গদেশ হল এমন এক শস্য-শ্যামলা ছয় ঋতুর দেবভূমি যেখানে উদারতাবাদ এর জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে প্রবহমান। তা চৈতন্যদেব ও সুফিতন্ত্রের ভাব-মতাদর্শই হোক কি রামপ্রসাদের ভক্তিসায়রে ডুব, স্বাধীন বাংলা রক্ষায় পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের নেতৃত্বে আত্মবলিদান কিংবা আধুনিক সময়ে রামকৃষ্ণদেব-বিবেকানন্দের সর্বধর্ম সমন্বয়, অথবা রবীন্দ্র-নজরুলের বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বোধ বা নেতাজী-ক্ষুদিরাম-মাস্টারদার স্বাধীনতার লড়াই ও বিভূতি-মানিক-সত্যজিতের সৃষ্টিকর্ম— এমন এক ব্যাপ্ত পরিধিতে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত জয়গান তো বাঙালির ঐতিহ্যেই রয়েছে। সে বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য মোদী-শাহের দলবলের একবগগা উগ্র হিন্দুয়ানির ঘোর পরিপন্থী। এই ঐতিহ্য যতদিন তার সুললিত ভাষ্যে প্রবহমান থাকবে, ততদিন কোনও উগ্র পাষণ্ড মতাদর্শ এ দেশে সার্বিক ভাবে জায়গা করে নিতে পারবে না, বাংলাতে তো নয়ই। বাংলা ও বাঙালি হল কাউন্টার-পয়েন্ট, এক অপ্রতিরোধ্য ভাষ্য। তাই, বাংলাকে নিশানা।

ফলে, যতক্ষণ না প্রাণচঞ্চল বাংলার জীবনবোধকে উৎপাটিত করা যাচ্ছে, ততক্ষণ বর্ণবাদী বিদ্বেষমূলক ধর্মব্যবস্থাকে কোনওভাবেই জয়ী করানো যাচ্ছে না। তাই, নেতা, দল ও মিডিয়া কিনে, পয়সা ছড়িয়ে, ফেক রিল ও ভিডিও’র রগরগে রমরমায়, গল্পের গরুকে গাছে তুলে নিত্য নতুন বিকৃত ন্যারেটিভ নির্মাণে ও উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তদের একটা অংশকে কাছে টেনে উদোম চেষ্টা চলেছে বাংলাকে ক্ষতবিক্ষত করে এর দখল নেওয়ার। তবুও সে কাজে যখন সফলতা আসছে না, প্রভূত হিন্দু-উল্লাস চাগিয়ে হিন্দু বাঙালিদের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নামানো যাচ্ছে না, তখন ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ করে, প্রায় সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের টাকা আটকে ‘শালে বাঙালি লোগো কো’ ভাতে মারো আর আক্রমণ হানো অন্য রাজ্যে বাঙালি গরিবদের উপর যারা কিনা কিছুতেই অমিত শাহের দলকে ভোট দেয় না।

তাই, বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালি শ্রমজীবী মানুষের ওপর আক্রমণ একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক ডিজাইন। ‘অনুপ্রবেশের’ সেই পুরাতন গল্প ছড়িয়ে একে যতই যাথার্থ্য দেওয়ার চেষ্টা চলুক না কেন, মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। প্রথমত মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে কোনও লব্জ নেই। কারণ, কোনও ব্যক্তির বিদেশে প্রবেশ আইনগত ভাবে অনিয়মিত হতে পারে, কাগজপত্রহীন হতে পারে, কিন্তু তিনি কখনই ‘অনুপ্রবেশকারী’ নন যা অত্যন্ত অমর্যাদাকর একটি শব্দ, এবং বহু দেশে এই ধরনের প্রবেশকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেও দেখা হয় না; তাই, ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটির মধ্যেই অভিবাসীদের মর্যাদা লঙ্ঘনের মাত্রা লুকিয়ে আছে, যা অমানবিক। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রসংঘ নীতি হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে, প্রত্যেক মানুষের ‘has a right to have rights.’। তথাপি, তর্কের খাতিরে আমরা যদি বাংলাদেশ থেকে আগত ‘কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের’ও গণ্য করি, তাহলেও নির্দ্বিধায় বলতে হয়, এ বিষয়ে কোনও প্রামাণ্য পরিসংখ্যান তো নেইই, উপরন্তু বাংলার শহর ও গ্রামকে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও কিছুই মিলবে না। কারণ, ১৯৭১-৭২’এর পর বড়সড় কোনও কাগজপত্রহীন অভিবাসন বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশে হয়নি। তবে হতে পারে, অথবা সীমান্তবর্তী দেশ হিসেবে কেউ কেউ কাগজ ছাড়াই সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন। তাদের সংখ্যা নগণ্যই। আসলে, ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ’এর গুজব হল সেই পরিকল্পিত রাজনৈতিক ডিজাইনের একটি উপাদান মাত্র। এর কোনও বাস্তব তথ্যগত ভিত্তি নেই।

ফলে, বিজেপি শাসিত বহির্রাজ্যে এ দেশিয় গরিব শ্রমজীবী বাঙালিদের উপর এই যে একতরফা আক্রমণ নেমে এসেছে, তার এক সুদূরপ্রসারী অভিঘাত তৈরি হতে চলেছে। বাংলার রাজনীতি এ তাবৎকাল উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তদের নেতৃত্বেই প্রবাহিত হয়েছে, যদিচ, এখানে বাম রাজনীতির বহু ইতিবাচকতা সেই বর্ণ ও বিত্তের প্রাবল্যকে কিছুটা খাটো করলেও, সে গন্ধ ও দম্ভকে মুছতে পারেনি। যে ভাবে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ুতে নিম্নবর্ণের উত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের নিজস্ব দল তৈরি হয়েছে, তারা ক্ষমতায় এসেছে, অনুরূপ ঘটনা এ রাজ্যে ঘটেনি। একমাত্র ১৯৩৭ সালে ভারত আইন অনুসারে অবিভক্ত বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে যে কোয়ালিশন সরকার তৈরি হয়েছিল তা বাংলার নিম্নবর্গীয় মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের এক প্রতীক ছিল। সেই ধারা আজ অবলুপ্ত।

কিন্তু প্রতিরোধে-প্রতিশোধে নিম্নবর্গীয় রাজনীতির পুনরুত্থান আবারও বাস্তব। বাংলার সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত-উচ্চবর্ণ শ্রেণি যে ভাবে গরিব মানুষের উপর আক্রমণে নীরবতা পালন করছে, শুধু তাই নয়, ভাবছে অমিত মালব্য বাংলা ভাষা সম্পর্কে না জেনেই যা খুশি বলছে, অথবা, তারা এইসব কথাবার্তার জবাব দেওয়ার তেমন গুরুত্বই খুঁজে পাচ্ছে না, তারা আসলে বুঝতেই অপারগ যে রাজনৈতিক ঝড়টা এবার কোনদিক থেকে আসছে। যারা টিভি’র টক’শোতে বসে বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে দু-চার বাণী বিতরণ করেন, তাঁরা জানেনই না যে বাংলার নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবী মানুষ কীভাবে গড়ে তুলতে পারেন নিজেদের আত্মরক্ষার ঢাল ও মনন, কীভাবে তাঁরা টেনে নিয়ে চলেন জীবনের রথ, কীভাবে তাঁরা ভালোবাসেন পরস্পরকে ও গড়ে তোলেন উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত অধরা এক ধাত্রীভূমিকে। সাবেক বাম বুলি আওড়ানো ভদ্দরলোকেরা আসলে বুঝেই উঠতে পারছে না যে তাদের মাতব্বরির দিন প্রায় শেষ। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর খিস্তি করে, মিম ছড়িয়ে, বক্রোক্তিতে দিনাতিপাত করতে পারে, কলেজ স্ট্রিটে দু-চার নিষ্ফলা চর্বিতচর্বণ বক্তিমে ঝেড়ে ঘরে ফিরতে পারে, কিন্তু মুশকিল হল, তাদের দিকে আপামর বাংলার মানুষ যে কেউ আর ফিরেও তাকাচ্ছে না, সেটা যখনই তারা ধরতে পারছে, তাদের সে পাগলদশায় তাদেরই আরও বিপদ বাড়ছে।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'নূতন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙল ধরে, চাষের কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনা ওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক ঝোপ জঙ্গল, পাহাড় পর্বত থেকে।' নতুন বাংলার স্বপ্ন এইভাবেও হতে পারে। হয়তো হচ্ছে। ভদ্দরজনেদের নজরে আসছে না, তাই পিছু হঠছে উচ্চবিত্ত-উচ্চবর্ণেরা, তাদের ছড়ি ঘোরানো ও কর্তামশাইয়ের চিরায়ত ভূমিকা থেকে। হয়তো তাই কোণে দাঁড়িয়ে অতীব গোসায় তারা মজাও পাচ্ছে নিম্নবর্ণীয় বাঙালির লাঞ্ছনায়।


4 comments:

  1. বেশ লিখেছো, তবে মনেহচ্ছে তুমি একটু যেন বেশি মাত্রায় আশান্বিত। নিম্ন বর্গীয় খেটে খাওয়া মানুষেরা কি সত্যিই ঢাল তৈরি করতে পারবে যেভাবে এবং যে গতিতে সমাজে ধর্মীয় রঙ ও বিভাজন হচ্ছে।

    ReplyDelete
  2. বাংলাদেশী বলার মধ্যে ভোটার তালিকার কারচুপি লুকিয়ে আছে. এটা পবিত্র সরকার রা এখনও বুঝলো না

    ReplyDelete
  3. লেখার বিষয়.বস্তু অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং তাৎপর্যপূর্ণ, বাংলার রাজনীতি অদ্যাবধি উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তদের নেতৃত্বে প্রবাহিত হয়েছে, লেখকের এই মন্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ সহমত নিয়েই বলছি কর্পোরেট চাকরির দৌলতে উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে বাংলা ভাষী তথা বাঙালি সংস্কৃতির যে নৈতিক অবনমন হয়েছে, এবং বাংলা ভাষা দিনে দিনে তার গৌরব হারাচ্ছে তাতে শ্রমজীবি মানুষের হাত ধরে জাতির তথা ভাষার উত্থান বা আন্দোলন বিষয়টা আশাকর হলেও বাস্তবিক কিনা , সেটা বিচার্য্য ,

    ReplyDelete
  4. খুব সুন্দর লেখা এবং একদম প্রাসঙ্গিক। এমন লেখা যত হয় ততই মঙ্গল। ফ্যাসিজমের সিক্রেট বা ওপেন সব ন্যারেটীভগুলো একটা অত্যন্ত সঙ্গত প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।

    ReplyDelete