সুখ আর প্রকৃতির সম্পর্ক
সুব্রত কুণ্ডু
কোন দেশের মানুষজন কতটা সুখী তা জানা যায় 'ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস' রিপোর্টে। গত মার্চ মাসের ২০ তারিখে এ বছরের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। বসন্তে প্রকাশিত এই রিপোর্ট কিন্তু ভারতের নাগরিকদের খুশিতে রাঙিয়ে দিতে পারেনি। কারণ, সুখের তালিকার ১৪৭টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১১৮ নম্বরে। প্রায় শেষের দিকে। কিছু মানুষদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে লেগেছে, যখন তারা দেখেছে যে, চিন (৬০) নেপাল (৯২), পাকিস্তান (১০৯) আমাদের থেকে ‘বেশি সুখে’ আছে। যদিও গত বছরে ১৪৩টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ছিল ১২৬। সে তুলনায় আমরা এ বছর একটু বেশি সুখে আছি। অন্যান্য সব সূচক বা তালিকার মতোই ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘উন্নত’ দেশগুলি সুখের তালিকারও ওপরের দিকে রয়েছে।
রাষ্ট্রসংঘের 'সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্ক' এই রিপোর্টটি পেশ করে। রিপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, তাঁরা সুখী কি না। পাশাপাশি হিসেবনিকেশ চলে সমীক্ষাধীন দেশগুলির আর্থিক বৃদ্ধির হার, দেশবাসীর গড় আয়ু, সামাজিক সহায়তা, কাজ করার স্বাধীনতা, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে। এছাড়া ব্যক্তি স্বাধীনতা, সরকারের উপর আস্থা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশার মতো মাপকাঠিও রাখা হয় সুখ মাপতে। উল্লেখযোগ্য হল, এসব মাপকাঠিই অন্যান্য ‘উন্নতি’র তালিকাতেও ব্যবহার করা হয়। আর তাই ‘উন্নত’ দেশই সুখী দেশ হয়ে যায়। পরোক্ষে বলা হয়, দেখ বাপু বর্তমান ভোগের উন্নয়ন মডেলেই তোমার সুখ লুকিয়ে রয়েছে।
নিউ ইকনমিক ফাউন্ডেশন নামে লন্ডনের একটি সংস্থা 'হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স' নামে আরও একটি সুখের সমীক্ষা করে। ২০০৬ সাল থেকে তিন বছর অন্তর এই সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ২০২১ সালে শেষ হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স-এর সুখী দেশের তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এই তালিকায় কিন্তু প্রথম সারিতে রয়েছে ভানুয়াটু, সুইডেন, এল সালভাদোর, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, ডেনমার্ক, স্পেন, পানামা, ফ্রান্স, চিলে। তবে এখানেও ভারতের স্থান নীচের দিকে - ১৪৭টি দেশের মধ্যে ১২১। আরও অবাক করা বিষয় হল, অন্যান্য এবং ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস তালিকায় এগিয়ে থাকা দেশগুলি যেমন ফিনল্যান্ড রয়েছে ১৭ নম্বরে, আইসল্যান্ড ৫৮, নেদারল্যান্ড ১৪, নরওয়ে ১৫, ইসরায়েল ২২, কানাডা ৭৯, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১০২ নম্বরে।
হ্যাপি প্ল্যানেট ইনডেক্স (HPI) হল দীর্ঘস্থায়ী ভালো বা আনন্দে থাকার একটি মাপকাঠি যাকে ইংরেজিতে ‘সাস্টেনেবল ওয়েলবিয়িং’ বলে। এটা মাপা হয় তিনটি সূচকের মাধ্যমে:
১) পরিতৃপ্ত জীবন - লোকেরা তাদের জীবন নিয়ে কতটা সন্তুষ্ট (এটা মাপা হয় গ্যালপ ওয়ার্ল্ড পোল পদ্ধতির মাধ্যমে);
২) গড় আয়ু - মানুষ সাধারণত কতদিন বেঁচে থাকে (এই তথ্য নেওয়া হয় রাষ্ট্রসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি সংগৃহীত তথ্য থেকে);
৩) ইকলজিক্যাল ফুট প্রিন্ট বা পরিবেশ পদাঙ্ক - বিভিন্ন দেশের আয়তন এবং তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ওপর যে চাপ বা প্রভাব তৈরি হয় তার মাপকাঠি। এটা মাপা হয় গ্লোবাল হেক্টর দিয়ে। আর এই তথ্য নেওয়া হয় গ্লোবাল ফুটপ্রিন্ট নেটওয়ার্ক থেকে।
পরিতৃপ্ত জীবন মানের সঙ্গে গড় আয়ু দিয়ে গুণ করে সেই গুণফলকে পরিবেশ পদাঙ্ক দিয়ে ভাগ করে 'হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স' তৈরি হয়। উল্লেখ্য, পরিতৃপ্ত জীবন মানের মধ্যে সাম্য বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। আর এই গুণভাগের প্রক্রিয়াটি জটিল। বোঝার জন্য একটি সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরা যাক ফিনল্যান্ড, যে দেশটি ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইন্ডেক্সের ১ নম্বরে রয়েছে তার পরিতৃপ্ত জীবন মান এবং গড় আয়ুর গুণফল ৯০ আর কোস্টারিকার ৭০। কিন্তু পরিবেশ পদাঙ্ক অনুযায়ী ফিনল্যান্ডের প্রকৃতির ওপর প্রভাব বা চাপ ৯ এবং কোস্টারিকার ৫ গ্লোবাল হেক্টর। এবারে ভাগ করলে ফিনল্যান্ডের নম্বর হবে ১০। আর কোস্টারিকার নম্বর হবে ১৪। অর্থাৎ, হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স অনুযায়ী কোস্টারিকা এগিয়ে।
হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স-এ জীবনধারণের গুণগত মান কতটা ভালো তার ওপর নির্ভর করে সুখী দেশের তালিকা তৈরি হয় না। এই সূচকে দেখা হয়, পরিবেশের ওপর সব থেকে কম চাপ বা প্রভাব ফেলে কোন দেশ সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষকে দীর্ঘ এবং পরিতৃপ্ত জীবন দিতে পারছে। উল্লেখ্য, হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স হল প্রথম সূচক, যেখানে সুখে থাকার সঙ্গে এত ব্যাপকভাবে পরিবেশকে যুক্ত করা হয়। আর মজার ব্যাপার হল, হ্যাপি প্ল্যানেট ইন্ডেক্স-এ থাকা দেশ কোস্টারিকা এবং ভানুয়াটু'র কোনও সেনাবাহিনী নেই। সেনাবাহিনী নেই পানামারও।
সব সুখের সূচক নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে বিস্তর। তার মধ্যে অন্যতম হল, সুখের মতো বিমূর্ত অনুভবকে কীভাবে মূর্ত জিনিস দিয়ে মাপা যাবে। তবে এ কথাও সত্যি, অসম্ভব লাভ এবং লোভের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য প্রকৃতি শোষণ চললে, প্রকৃতি মানুষের জীবনকে ক্রমশ দুর্বিষহ করে তুলবে। তুলবেই।
খুব ই চমৎকার এক তথ্য এবং তার বিশ্লেষণ। অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteএনারা কাদের কে কল করে? ফাইনালাইস করে ? এটা জানার ইচ্ছে ছিলো ?
ReplyDeleteপ্রশ্নের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ.আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন করেছেন. এই ধরনের সমীক্ষায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ফোনে তথ্য সংগ্রহ একটি অন্যতম কাজ. পদ্ধতিটির সঙ্গে খানিকটা ভোটের আগে ওপিনিয়ন পোলের সাযুজ্য রয়েছে. নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে স্থান, কাল, পাত্র নির্দিষ্ট করে ফোন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়. তবে বাছাইয়ে বিষয়টি বেশ জটিল এবং এক এক বছরের সমীক্ষার স্থান কাল পাত্র পরিবর্তিত হয় যায়. পরিবর্তিত হয় বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও. এ নিয়ে বিশদে জানতে চাইলে আপনি Gallup এর ওয়েবসাইট - এ খোঁজ করতে পারেন. আর আপনার নামটি জানতে পারলে ভালো লাগত.
Delete