Friday, 22 August 2025

ইথানল-মিশ্রিত জ্বালানির রাজনীতি

বিশেষ কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা?

আবু সঈদ আহমেদ



বর্তমানে ইথানল-মিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহার বা E20 ইস্যু নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে, যা আর্থ-রাজনৈতিক মূলধারার আলোচনায় তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ এই বিষয়টি আমাদের স্বার্থ এবং ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর যথাযথ বিশ্লেষণ ও সচেতনতা আমাদের নীতিনির্ধারণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এখনই সময়, আমরা এই ইস্যুটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার এবং বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি, কেন এটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

ভারত সরকারের ইথানল-মিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহারের উদ্যোগ, বিশেষত E20 (২০ শতাংশ ইথানল ও ৮০ শতাংশ পেট্রোল) চালুর সিদ্ধান্ত, একদিকে পরিবেশ ও অর্থনীতির উন্নয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যকে সামনে রেখেছে, অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মধ্যে বাস্তবিক উদ্বেগ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, ভারত ২০২৫ সালের মার্চ মাসে, নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর আগেই, E20 মিশ্রণের লক্ষ্য পূরণ করে, যা সরকারের দ্রুতগতির নীতিগত অগ্রগতির প্রমাণ। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি তেল আমদানি হ্রাস, কার্বন নিঃসরণ কমানো, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে এই নীতির ফলে ₹১.৪০ লক্ষ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে এবং কৃষকরা ইথানল সংক্রান্ত ফিডস্টক বিক্রি করে ₹১.২০ লক্ষ কোটি আয় করেছেন। 

কিন্তু কথিত আছে,  'There are three kinds of lies: lies, damned lies, and statistics.'। এই সাফল্যের সরকারি দাবির বিপরীতে রয়েছে খদ্দেরদের একাধিক উদ্বেগ। ইথানলের শক্তি ঘনত্ব পেট্রোলের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কম, যার ফলে গাড়ির মাইলেজ কমে যায়। বিশেষত পুরনো গাড়িগুলিতে ৩ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত মাইলেজ হ্রাস লক্ষ করা গেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তা ২০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এইজন্য অতিরিক্ত জ্বালানি কিনতে হচ্ছে যা পরিবেশের জন্য তথাকথিত সুবিধা হওয়ার দাবির বিপরীত। ইথানলের হাইগ্রোস্কোপিক প্রকৃতি অর্থাৎ জল শোষণের ক্ষমতা জ্বালানি সিস্টেমে ক্ষয় সৃষ্টি করে, যার ফলে রাবার সিল, গ্যাসকেট ও অন্যান্য অংশ বারবার বদলাতে হয়। ২০২৩ সালের আগে নির্মিত অধিকাংশ গাড়ি E20-সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, ফলে, রেট্রোফিটিং করতে হয় যার খরচ ₹৪,০০০ থেকে ₹৬,০০০ পর্যন্ত হতে পারে। অনেক খরিদ্দার এই অতিরিক্ত খরচকে অন্যায্য বলে মনে করছেন।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হল, E20 জ্বালানির দাম সাধারণ পেট্রোলের সমান হলেও তার শক্তি কম, ফলে প্রতি কিলোমিটারে খরচ বেড়ে যায়। ভোক্তারা মনে করছেন, তারা কম কার্যক্ষমতার জন্য বেশি দাম দিচ্ছেন। এছাড়া, পাম্পে E0, E10 বা E15-এর বিকল্প না থাকায় E20-কে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ করতে হচ্ছে, যা জ্বালানি পছন্দের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। কেন্দ্রীয় সরকার যদিও এই অভিযোগগুলিকে 'অপ্রমাণিত' ও 'স্বার্থান্বেষী মহলের প্রচার' বলে অভিহিত করেছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মতে, ইঞ্জিন টিউনিংয়ের মাধ্যমে মাইলেজের ক্ষতি 'সামান্য' এবং তা সহজেই সমাধানযোগ্য। নীতি আয়োগ কর ছাড়ের সুপারিশ করেছে, যাতে ভোক্তারা ক্ষতিপূরণ পান। গাড়ি নির্মাতারা ইতিমধ্যে E20-সামঞ্জস্যপূর্ণ গাড়ি বাজারে এনেছে, যেখানে উন্নত উপকরণ ও ইঞ্জিন টিউনিং ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের মধ্যে E20-র সাফল্যের দাবির প্রভাব প্রশ্নবিদ্ধ। ইথানল তুলনামূলকভাবে সস্তা হলেও ইথানল-মিশ্রিত পেট্রোল (যেমন E20) প্রায় একই দামে বিক্রি হয়, কখনও কখনও বেশি দামে। এর কারণ, উৎপাদন খরচ, করের হার এবং ইথানলের কম জ্বালানি ক্ষমতা। ইথানলের শক্তি পেট্রলের তুলনায় প্রায় ৩৩ শতাংশ কম, ফলে গাড়ির মাইলেজ কমে যায় এবং জ্বালানি খরচ বাড়ে। সে জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যদিও দাবি করেছে ইথানলের ওপর জিএসটি কমিয়েছে, তবুও সাধারণ ভোক্তারা এর সুবিধা তেমনভাবে পাচ্ছেন না।

প্রচার করা হচ্ছে, পরিবেশগত দিক থেকে E20 জ্বালানি নিঃসরণ কমায় এবং ভারতের Net Zero 2070 লক্ষ্যকে সমর্থন করে। তবে চিনির মতো জল-নির্ভর ফসল থেকে ইথানল উৎপাদন করার ফলে খরাপ্রবণ অঞ্চলে জল সংকট ও ভূমি অবক্ষয়ের আশঙ্কা বাড়ছে। এক ফসলি চাষের প্রবণতা ও মরুকরণের ঝুঁকিও রয়েছে। এই বিতর্কের সারমর্মে দেখা যায়, সরকার E20-কে একটি কৌশলগত ও পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরছে, যেখানে বিদেশি নির্ভরতা কমানো ও কৃষকদের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে। অন্যদিকে, সাধারণ জনগণ পারফরম্যান্স হ্রাস, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, জ্বালানির দাম ও পছন্দের সীমাবদ্ধতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এই বিতর্কের পাশাপাশি উঠে এসেছে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। ভারতের কেন্দ্রীয় পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি দীর্ঘদিন ধরে ইথানলকে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে প্রচার করে আসছেন। তিনি একে পরিবেশবান্ধব, কৃষকদের জন্য লাভজনক এবং বিদেশ থেকে পেট্রোল আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর উপায় হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে ইথানল-চালিত যানবাহনের প্রসার এবং ফ্লেক্স-ফুয়েল ইঞ্জিন ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভারতে ইথানল মূলত তৈরি হয় চিনি উৎপাদনের উপজাত— আখের মোলাসেস থেকে। এই মোলাসেসে থাকা চিনিকে গাঁজন ও পাতনের মাধ্যমে ইথানলে রূপান্তর করা হয়। দেশের বিভিন্ন চিনিকল ও ডিস্টিলারিতে এই প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, যা ইথানল উৎপাদনের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে। নীতিন গড়করি নিজে কটি চিনিকলের সরাসরি মালিক তা নিয়ে সরকারি কোনও নিশ্চিত তথ্য নেই তবে বেশ কিছু সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হয় এই সংখ্যা ১৭। তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন ধরে চিনি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, এটা বিভিন্ন রেকর্ডেই পাওয়া গেছে। গড়করি প্রতিষ্ঠিত পুর্তি গ্রুপ পরবর্তীতে ভাগ হয়ে মানস অ্যাগ্রো ও সিয়ান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজে রূপ নেয়, যা বর্তমানে তাঁর দুই পুত্র সারাং ও নিখিল গড়করি পরিচালনা করেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মহারাষ্ট্রে চিনিকল ও ডিস্টিলারি পরিচালনা করে। মানস অ্যাগ্রো ও সিয়ান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ বর্তমানে সরকারের কাছে ইথানল সরবরাহ করে, যা পেট্রোলের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কোটি লিটার ইথানল উৎপাদন করে এবং নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। 

তাই, E20 নিয়ে সরকারের উৎসাহ বাস্তবেই কি পরিবেশের জন্য নাকি বিশেষ কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।


3 comments:

  1. Shriparna Chakrabarti23 August 2025 at 01:22

    গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রয়োজনীয় লেখা।

    ReplyDelete
  2. প্রথমেই জানতে চাই 'কেন্দ্রীয় সরকার' কথাটা কি ব্যবহার যোগ্য? সংবিধানে 'কেন্দ্রীয় সরকার' কথাটি কি কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে? যদি যোগ্য হয় তাহলে কোন অর্ডার বা সার্কুলার এ এটি ব্যবহার হয় না কেন? অথচ আমাদের ব্যবহৃত নোটে(টাকা বা মুদ্রায় নয়, কারন ওগুলো বাস্তবে নেই) এই কেন্দ্রীয় সরকার কথাটা ব্যবহার হয় কেন?

    ReplyDelete
  3. লেখাটি পড়ে অনেক কিছুই ভিতরের খবর জানতে পারলাম। অনেক ধন্যবাদ

    ReplyDelete