নির্বাচন কমিশন ও বিপন্ন গণতন্ত্র
সুজাত ভদ্র
'If the electoral machinery... is worked by the people whose integrity can not be depended upon, democracy will be poisoned at source...'
- H N Kunzru
গত ১২ অগস্ট (২০২৫) 'বিশেষ নিবিড় ভোটার' তালিকা সংশোধন সম্পর্কিত মামলার শুনানি চলাকালীন সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করে, 'দেখে শুনে মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের উপর অবিশ্বাস বা বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।' প্রশ্ন হল: তা কেন দেখা দিল? এর প্রধান উত্তরটা নিহিত আছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের তিন কমিশনারের নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে।
২০২৩ সালের ২ মার্চ অনুপ বারানওয়াল (Anoop Baranwal) মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ এক যুগান্তকারী রায়ে বললেন, সংসদে নতুন আইন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্য নির্বাচন করবেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং দেশের প্রধান বিচারপতি। এই রায় বাছাইয়ের পদ্ধতি হিসেবে ২০১৩ সালের লোকপাল আইনের ধারা ৪'এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। উদ্দেশ্য একটাই, সংবিধানের স্পিরিট মেনে কমিশনের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা, পূর্ণ স্বচ্ছতা যেন বজায় থাকে। কোনও চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে, পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে সংস্থা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে। এই রায়কে নস্যাৎ করতে ২০২৩ সালের অগস্ট মাসেই মোদি সরকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে ও বাইরে প্রবল বিরোধিতাকে যথারীতি উপেক্ষা করে এক নতুন আইন প্রণয়ন করে। তাতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা ও সরকারের মন্ত্রীসভার একজন (প্রধান বিচারপতি নয়) মিলে ঠিক করবেন নির্বাচন কমিশনের তিন কমিশনারকে।
পরিণতি: একেবারে আরএসএস'এর মতাদর্শে লালিত তিনজনকে বসিয়ে দেওয়া হল।
স্মরণ করুন শাসক দলেরই ঘনিষ্ঠ এক আমলার পরিণতি: অরুণ গোয়েল'কে সরকার একদিনের মধ্যে স্বেচ্ছা অবসর করিয়ে, তৎসংক্রান্ত ফাইলপত্র সই সাবুদ করিয়ে কমিশনের সদস্য করল। আবার কোনও অদৃশ্য কারণে দু' দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করলেন। ধনকড়ের মতোই গোয়েলের ঝটিকা আগমন, বিদায় আজও রহস্যাবৃত। তারপর SIR'এর নামে বর্তমান নতুন ফুল বেঞ্চের (২৬তম মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার সহ দুজন) নতুন একগুচ্ছ নির্দেশিকার মুখোমুখি হল বিহার তথা ভারতের নাগরিকরা। অবশ্য, ১৪ অগস্ট সুপ্রিম কোর্টের এক অন্তর্বর্তী আদেশের মাধ্যমে আপাতত এ দেশের চালু গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ -- সর্বজনীন ভোটাধিকার -- রক্ষিত হল কাগজে কলমে। একটা পরিসর তৈরি হল, রাতারাতি ৬৫ লক্ষ নাম বাদ পড়ার সত্যতা যাচাইয়ের।
উল্লেখ্য, সংবিধান রচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত গণ পরিষদের দুজন সদস্য -- অধ্যাপক শিব্বান লাল সাক্সেনা ও হৃদয়নাথ কুঞ্জরু (H N Kunzru) -- ১৯৪৯ সালেই বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই মর্মে যে, অনুচ্ছেদ ৩২৪ অনুসারে কমিশনের স্বাধীনতা বজায় রাখতে গেলে সরকার ও শাসক দলের রাজনীতির বিরুদ্ধে কমিশনকে 'fully insulated' হতে হবে। ১৯৯০ সালের দীনেশ গোস্বামী কমিশন, ২০১৫ সালের আইন কমিশনের ২৫৫তম রিপোর্ট একই কথা বলেছিল। শাসক দলের নিজস্ব লোক বসালে স্বাধীন সংস্থাটি অচিরেই তার চরিত্র হারাবে, তাঁদের এই আশঙ্কার কথা আজ বাস্তব হয়ে উঠেছে।
কমিশনের প্রথম শক থেরাপি ছিল, এপিক কার্ড ও আধার কার্ড নথি হিসেবে বিবেচ্য নয়। যুক্তি: নথি জাল হয় (ভাবটা এমন, কমিশনের চাওয়া নথি যেন জাল হয় না, বুলেট প্রুফের মতো সব জাল প্রুফ!) এবং আধার নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি নয় (পাসপোর্ট ছাড়া কমিশনের চিহ্নিত বাকি ১০টা নথি যেন নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি!)। তাই, ১১টা নথির একটা (যা ঝাড়খণ্ডের বেলায় ছিল ৭টা) দেখিয়ে খাঁটি নাগরিকত্বও প্রমাণ করতেই হবে, তাহলেই খসড়া নির্বাচনী ভোটার তালিকায় নাম উঠবে। এটা অসাংবিধানিক। কারণ, লাল বাবু হুসেইন মামলায় নিষ্পত্তি হয়েছে যে, একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই নাগরিকত্ব বিষয়টিকে ঠিক করার অধিকারী।
বর্তমান মামলার প্রথম দিনেই সুপ্রিম কোর্টের আধার, এপিক কার্ড'কে নথি হিসেবে গ্রহণ করার অনুরোধ কমিশন হলফনামা দিয়ে বিরোধিতা করে এবং ভারতবাসীর নাগরিকত্ব যাচাই করার অধিকার, ক্ষমতা নাকি কমিশনের রয়েছে বলে দাবি করে (প্রাগুক্ত রায়কে অস্বীকার করে)। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রয়োজনই হত না আধারকে ১২ নং নথি হিসেবে বিবেচনার করার। কমিশন নিজেই নিজের মুখ পোড়ালো। কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত 'প্রায়শই যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি' কমিশন হয় ও 'তার উত্তর সম্পর্কিত' (FAQ) দলিলের (পৃষ্ঠা ১৮) ৪২ নং প্রশ্নোত্তর দেখুন: তাতে বলা আছে, নাম তোলার ক্ষেত্রে আধার কার্ড জমা দেওয়া প্রত্যাশিত ভোটার তালিকা শুদ্ধিকরণের জন্য ('for the sake of purification of electoral roll')। এটাই যদি অবস্থান হয়, তাহলে 'বিশেষ নিবিড় সংশোধনের' প্রক্রিয়া তো অতি শুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া। সেখানে আধারকে নৈব নৈব চ বলাটা কমিশনেরই ঘোষিত নাগরিক-বান্ধব নীতির নির্লজ্জ লঙ্ঘন।
এপিক কার্ড সম্পর্কে কমিশনের নিজস্ব ঘোষণাটা শোনা যাক: এপিক বৈধ ভোটারের চিরস্থায়ী পরিচয় পত্র ['EPIC, once issued, is valid for lifetime.' (দ্র: কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত Handbook For Electoral Registration Officers/( ২০১২) অধ্যায় ৯, প্যারা ২৪, পৃ ৭৬)]। পংক্তি ২৭ বলছে, '...EPIC Number is designed to act as the permanent unique identity for every elector' (তদেব, পৃ ৭৬-৭৭)। এর অর্থ, এপিক কার্ড বহনকারী বৈধ ভোটার স্বয়ংক্রিয় ভাবে ভারতের নাগরিক। আবার, কোনও অবস্থাতেই এই নথি ফর্ম ভর্তির সময় বাদ যাবে না (তদেব, পৃ ২০-২১)। তাহলে কী উদ্দেশ্যে ও কেন ভোটার তালিকায় নাম তোলার ক্ষেত্রে কমিশন এপিক'কে বাদ দিচ্ছে? আবার কমিশন জানাচ্ছে, ভোটার তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তি মানেই যে তিনি ভারতের নাগরিক নন, তা নয়। এর অর্থ, কমিশন দু' ধরনের নাগরিকত্বের স্তর সৃষ্টি করছে (ভোটাধিকার সহ নাগরিক আর এপিক থাকা সত্ত্বেও ভোটাধিকার বিহীন নাগরিক), যা সংবিধান বিরোধী। প্রশ্নটা এখানেই-- কমিশন এমন কোনও পদ্ধতি আবিষ্কার করে চাপিয়ে দিতে পারে কিনা যার পরিণতি লক্ষ লক্ষ নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ! সমস্ত নাগরিককে সম্ভাব্য সন্দেহভাজন হিসেবে দেখা যা কদাপি সংবিধান বা জন প্রতিনিধিত্বমূলক আইনের লক্ষ্য ছিল না, আজও নেই। কমিশনের এই বিষাক্ত বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি বিপুল সংখ্যক নাগরিকের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে সর্বজনীন ভোটাধিকারের মূলে আঘাত করছে। ভোটাধিকার থেকে বাদ যাওয়া মানেই অসমের ধাঁচে ডি-ভোটার ক্যাটাগরির সৃষ্টি করা। অমনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সক্রিয় হয়ে উঠবে, তাদের বিদেশি পঞ্জীভুক্ত আইনের আওতায় এনে দেশ থেকে গণ বিতাড়নের প্রকল্প নেওয়া শুরু করবে; নয়তো 'উইপোকা'র মতো মারবে। অনুপ্রবেশ কত ক্ষতি করছে -- সে আওয়াজ তো প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসে লাল দূর্গ থেকে দিয়ে দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে, জন প্রতিনিধিত্বমূলক আইনে এরকম কোনও সংস্থান নেই যে কত বছর পর পর (অর্থাৎ, পাঁচ বা দশ বা পনেরো) সারা রাজ্য জুড়ে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ভোটার তালিকার 'বিশেষ সংশোধন' কর্মসূচি নেওয়াটা বাধ্যতামূলক। যখন কমিশন বলে, বিহারে ২০০২ সালে বা পশ্চিমবাংলায় ২০০৩ সালে শেষবারের মতো 'বিশেষ সংশোধন' হয়েছিল, তখন কমিশন দু' ভাবে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এক, যেন এসব রাজ্যে 'বিশেষ সংশোধনী' বাকি আছে। দুই, সেটি আসন্ন নির্বাচনের আগেই শেষ করতে হবে, না হলে নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে করা সম্ভব হবে না। অথচ আইন বলছে, রাজ্য বা দেশ জুড়ে যদি সাধারণ নিয়মের অন্তর্ভুক্ত সংশোধনী না হয়, তাহলেও নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে হবে। কারণ, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২৫'এর স্পিরিটই হল, ভোটার তালিকাভুক্ত যাবতীয় এন্ট্রিকে সঠিক বলে ধরে নিতে হবে ('presumption of correctness') [দ্র: লাল বাবু হুসেইন মামলা, ১৯৯৫, AIR, SC, 1189 (paras, 6, 13]; অনুচ্ছেদ ৩২৪'এর ব্যাখ্যায় সুপ্রিম কোর্ট তিন তিনটে রায়ে জানিয়েছে, আইন অনুসারে ভোটার তালিকা যদি সংশোধনও না হয়, ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে দেশের আদালতও সেই নির্বাচনকে বাতিল করতে পারবে না। আর, রুলস'এর আলোচ্য ২১ নং ধারাটি পরিষ্কারভাবে নন-অবস্ট্রাকশন ক্লজ। বাস্তবে, এই কমিশন অতীত থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের দেশব্যাপী (বিহার সহ) ভোটার তালিকাকে অপমান করছে। কমিশনের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, ২০০২'এর পর বিহারে (বা এ রাজ্যে ২০০৩'এর পর) যেন ভোটার তালিকা উন্নীতকরণ হয়নি! প্রাগুক্ত আইনটি ও তৎসংক্রান্ত নিয়মাবলীতে (১৯৫০, ১৯৬০) ভোটার তালিকা কখন কীভাবে, কোন ফর্ম (যেমন ৬, ৭) পূরণের মাধ্যমে সুচারুভাবে সম্পন্ন হবে, তার নিয়মকানুন দেওয়া আছে। প্রাগুক্ত হ্যান্ডবুকের অষ্টম অধ্যায়ের নামই হচ্ছে 'ক্রমাগত আপগ্রেডেশন'। অর্থাৎ, বিধানসভা, লোকসভা, এমনকি উপনির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা ঝাড়াই বাছাই অতি স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া। এছাড়াও সংশোধনী পদ্ধতির ব্যবস্থা আছে।
তাহলে 'বিশেষ নিবিড় সংশোধনের' স্থানটি ঠিক কোথায় নির্বাচনী আইন বা নিয়মাবলীতে?
কমিশন তার ২৪ জুন (২০২৫) তারিখের বিহারের প্রধান নির্বাচনী আধিকারিককে একটি চিঠিতে লিখছে, ১৯৫০ সালের জন প্রতিনিধিত্ব আইনের ধারা ২১ অনুসারে বিহারে SIR ২০২৫ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে শুরু হবে। ধারা ২১ হল ভোটার তালিকা প্রস্তুতি ও সংশোধন সংক্রান্ত। এতে তিনটি উপধারা আছে। তিন নম্বর উপধারাতে শুধুমাত্র 'বিশেষ সংশোধনী' করার কথা বলা আছে। লক্ষণীয়, এতে কোথাও 'intensive' (নিবিড়) শব্দটি নেই। সংসদে গৃহীত আইনকে কমিশনের এই ফুল বেঞ্চ বিকৃত করল। উপরন্তু, এই আলোচ্য উপধারাতে স্পষ্ট বলা আছে, বিশেষ সংশোধনী শুধুমাত্র একটি কেন্দ্রে বা সেই কেন্দ্রের অংশে হতে পারে, সমগ্র রাজ্যে নয়। কমিশন জানে তারা বিকৃত করছে। তাই প্রাগুক্ত বিজ্ঞপ্তিতে শুধু ধারা ২১ বলে উল্লেখ করেছে। উপধারাকে সচেতনভাবে উপেক্ষা করে বিকৃত করেছে উপধারা ২'কে। ১৯৬০ সালের রুলস্'এর ধারা ২৫'এর (১) ও (২) পড়লে পরিষ্কার হয়ে যাবে কমিশনের অসততা। এই ধারা বলছে, প্রাগুক্ত ২১ (২) মোতাবেক ভোটার তালিকা সংশোধনী [খেয়াল করবেন, শুধু সংশোধনী] প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য [every constituency] যদি করতে হয় তাহলে দু' ভাবে হতে পারে: নিবিড় বা সামারি অথবা আংশিক নিবিড় বা আংশিক সামারি। কোথাও এই ধারাতেও বা অন্যত্র 'বিশেষ নিবিড় সংশোধনী'র কথা বলা নেই। এটা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত শব্দবন্ধ যার মধ্য দিয়ে কমিশন বিজেপির এজেন্ডা পূরণের চেষ্টা করছে।
আবেদনকারীরা এই দিকটার প্রতি আদালতের দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন। আদালতের ১৪ অগস্টের আদেশে 'SIR' ব্যবহৃত হয়নি। উল্লেখ্য, মোহিন্দর সিং গিল মামলায় (১৯৭৮) পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের পক্ষে রায়ে বিচারপতি কৃষ্ণা আইয়ার বলেছিলেন, কমিশনের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ক্ষমতা থাকলেও তা নিরঙ্কুশ নয়। দেশের আইনের প্রতি, প্রকৃতিগত ন্যায়বিচারের প্রতি কমিশন দায়বদ্ধ থাকবে; কমিশনের আদেশ যদি স্বেচ্ছাচারী ও অবৈধ হয় তাহলে আদালতের হস্তক্ষেপের পূর্ণ অধিকার আছে। [রায়ের চমৎকার তাৎপর্যের জন্য দ্র: S K Mendiratta, How India Votes (4th edn), pp.196-198)]।
আদালতে হলফনামা দিয়ে যেহেতু বলা যাবে না (কারণ কোনও প্রমাণ নেই) যে দেশ রোহিঙ্গায় ভরে গেছে, সর্বত্র গিজগিজ করছে বাংলাদেশি, সেহেতু নির্বাচন কমিশন বিজেপি-আরএসএস'এর ভাষ্যটাকে সামান্য শুধরে নিয়ে বলছে, জনবিন্যাস বদলে গেছে, বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থান পরিবর্তন হয়েছে ইত্যাদি। তাই সংশোধনী দরকার। সাধারণ্যে জানাচ্ছে, অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে হবে, তাড়াতে হবে, তাই শুদ্ধিকরণ দরকার ইত্যাদি। কিন্তু সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদের নিদানটা একটু খেয়াল করুন: সর্বজনীন ভোটাধিকার যা 'We the People'এর অন্যতম সর্বোচ্চ রূপ যেখানে গরিব, দরিদ্রতম মানুষটি থেকে গৃহহীন, যৌন কর্মী সকলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার আছে, তাই কমিশন এই আদর্শগত অবস্থানের বদল করার অপচেষ্টায় ব্যস্ত। নির্বাচনে অংশগ্রহণ কোনও এন্ট্রান্স পরীক্ষা নয়-- আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে সঠিকভাবেই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর যদি জন্মের কোনও কাগজ না থাকে এবং তারপরেও তিনি ভারতীয় ও প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলে লক্ষ কোটি ভারতীয়ের কাছ থেকে জন্ম সার্টিফিকেট চাইবার কোনও অধিকার কমিশনের আছে কী?
ভোট শুধু একটা কাগজ নয়। ভোটাধিকার ঘোষণা করে আমরা নাগরিক হিসেবে সবাই সমান। সেই অধিকারকে নির্বাচন কমিশন আঘাত করছে। প্রথম দিনের শুনানিতে প্রকাশ্য আদালতে বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া কমিশনের আইনজীবীকে বলেছিলেন, কে নাগরিক কে নয়, তা জিজ্ঞাসা করা কমিশনের এক্তিয়ারে পড়ে না ('none of your business')। তবু, নাগরিকত্ব প্রমাণের দাবিতে কমিশন নতুন ১১টি নথির কথা বলছে যা সংগ্রহ করা দুরূহ এবং তাই বৈষম্যমূলক। 'ফ্রন্টিয়ার' পত্রিকা (অগস্ট ১০- ১৬, ২০২৫ সংখ্যা) চমৎকার ভাবে দেখিয়েছে, নতুন নথিগুলি সংখ্যায় বেশি দেখাতে পারে, কিন্তু মোটেই ভোটার অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। বরং উল্টো। এই কষ্টসাধ্য নথি সংগ্রহ করতে না পারার দরুণ নাম বাদ চলে যাবে, বিদেশি তকমা দিয়ে দেবে। বকলমে অসমের এনআরসি লাগু করে দিতে চাইছে বিজেপি; নির্বাচন কমিশন তার দোসর। করণ থাপার, যোগেন্দ্র যাদব এই পরিকল্পনাকে নোটবন্দির মতো 'ভোটবন্দি' আখ্যা দিয়েছেন।
আর এই অনিয়ম করা হচ্ছে এ দেশের মৌলিক নিয়মগুলোকে লঙ্ঘিত করেই। অনুচ্ছেদ ১০ অনুসারে ভারতে বসবাসকারী সকল নাগরিককে ধরে নিতে হবে নাগরিক। ভোটার হিসেবে নাম নথিভুক্তকরণের কাজ রাষ্ট্রের, নাগরিকের নয়। কারও নামে কেউ আপত্তি তুললে আধা-বিচারবিভাগীয় পদ্ধতির মাধ্যমে যাচাই হবে। গণ ভোটাধিকার কাড়ার কোনও এক্তিয়ার কোনও সংস্থার নেই। এখন কমিশন বলতে চাইছে, তুমি নাগরিক নও, অতএব নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দেখাও, নয়তো ডি-ভোটার করে দেব। ভোটার প্রমাণের দায়িত্ব ব্যক্তি নাগরিকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল, যা ভারতের ইতিহাসে প্রথম। ফর্ম ভরো, না ভরতে পারলে তোমার নাম কাটা যাবে। বাদ যাওয়ার সংখ্যা দেখুন: ৬৫ লক্ষ। মৃতদের ক্ষেত্রে কমিশন মৃত ব্যক্তির শংসাপত্র যাচাই করবে (প্রাগুক্ত হ্যান্ডবুক)। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, এক বা দেড় মাসে ২২ লক্ষ মৃতের ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করে নিশ্চিত হয়েছে কমিশন!!
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আশুতোষ ভার্সনে আমেরিকার অতীত ইতিহাসের নজির টেনে দেখিয়েছেন, ষাটের দশকে জিম ক্রো'এর মতো এ দেশে সর্বপ্রথম গরিব, ক্ষমতাহীন, মুসলিম, দলিত, আদিবাসী সম্প্রদায়কে ভারতের গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। নাগরিকত্বের ইস্যুটাকে গণ বিতাড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত করতে চাইছে বিজেপি ও তাদের নব্য দোসর নির্বাচন কমিশন।
আশার কথা, দেশ জুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ আদেশ আশার আলোকবর্তিকা হয়েছে। এও আশা করতে দোষ কী যে, দেরিতে হলেও ২০২৩ সালের কমিশনের গঠন সংক্রান্ত সংশোধনীটিও অসাংবিধানিক বলে বাতিল হবে।
বাহ্, চমৎকার বিশ্লেষণ।
ReplyDeleteমাননীয় শ্রী সুজাত ভদ্র মহাশয়ের লেখার তথ্যধর্মীতা বা লেখনীর বিচার বিশ্লেষণ করা ধৃষ্টতা হবে কিন্ত এই ধরনের একটি যথাযথ বিষয়কে সঠিক ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে এই সময়ে দায়িত্বশীল ভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একক মাত্রাকে আন্তরিক ধন্যবাদ , এই বিষয়টি আজ সর্বসাধারনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সমাজের সব স্তরের মানুষের এই ঘটনাসূত্র ও তথ্য জানা থাকলে সম্মিলিত জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে বলেই আমার বিশ্বাস!
ReplyDeleteঅত্যন্ত দরকারি ও জরুরি লেখা। তথ্যের সমাহার আরও অনেক লেখার ভিত্তি হতে পারে। ধন্যবাদ।
ReplyDeleteসুপ্রিম কোর্ট কোথাও আঁধারকে 12 নম্বর নথি হিসেবে মান্যতা দেওয়ার নির্দেশ দেয় নি।
ReplyDeleteআমার নিবেদন: অন্তর্বর্তী আদেশে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপন দিয়ে কমিশন কে জানাতে হবে, যাদের নাম বাদ গেছে তাদের আধার গ্রহণ করা হবে অতিরিক্ত আইডি হিসেবে। তার অর্থ একটাই, যে ১১ টা নথি আছে, তার সঙ্গে নাম সংযুক্তিকরণের জন্য আরেকটি নথি যুক্ত হবে -- আধার। গাণিতিক হিসেবে ১১+১= ১২ হয়। যেহেতু ১১ টি কোনোটাই বাদ যায় নি, সেহেতু আরেকটি যোগ করার অর্থ ১২। মন্তব্যেও বিচারপতিরা আধার কে statutory দলিল বলেছেন, যা বাদ দেওয়া যাবে না। এই আদেশের প্রভাব পরবর্তী সব ভোটার তালিকা সংশোধনের উপর পড়বেই। এটা বাদ দিতে ইসি আর পারবে না।-- সুজাত ভদ্র
ReplyDeleteপুনশ্চ: এমনকি কি ১২ নং নথি হিসেবে গ্রহণ করতে অসুবিধা কোথায় - এটাও কমিশনের আইনজীবীকে আদালত প্রশ্ন করেছিলেন। দি স্টেটসম্যান ১৫ আগস্ট এর সংস্করণে আছে, বিচারপতি বাগচীর মন্তব্য quotation চিহ্ন সহ যে, " your list of 11 documents seems citizen friendly, but Aadhar and EPIC are readily available...your notice can say those not submitted so far can submit their Aadhar and EPIC also."( Pg 1).- সুজাত ভদ্র
ReplyDelete