Monday, 28 July 2025

'অনুপ্রবেশের' কোনও তথ্যই নেই!

'অনুপ্রবেশ' ভোট রাজনীতির হাতিয়ার মাত্র

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়



অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি মূলত— আর্থনীতিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক— গভীর বৈশ্বিক বৈষম্যের একটি লক্ষণ। মানুষ তাদের জীবনকে উপড়ে ফেলতে বা ছিন্নমূল হতে চায় না। কেউই বাধ্যতামূলক কারণ ছাড়া এক অচেনা, অজানা, অনিশ্চিত ও প্রায়শই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যায় না। আসলে, সীমানা রাষ্ট্র দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে, কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির হতাশা মানচিত্রের রেখা দ্বারা আবদ্ধ নয়।

অবৈধ অভিবাসন তখনই ঘটে যখন আইনি পথগুলি মানুষের প্রত্যাশা পূরণে অসমর্থ হয়ে পড়ে। অবৈধভাবে অভিবাসনকারী বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র্য, সংঘাত, রাজনৈতিক নিপীড়ন, জলবায়ু বিপর্যয়, যুদ্ধ অথবা তাদের নিজ দেশে পদ্ধতিগত অস্থিতিশীলতা থেকে পালিয়ে বেড়ায়। তাই অবৈধ অভিবাসন কেবল একটি আইনি সমস্যা নয় বরং একটি নৈতিক ও কাঠামোগত সামাজিক সমস্যা। এখানে শোষণের তীব্রতা ঢের বেশি। যেমন, অভিবাসীরা (আইনি হোক বা না হোক) প্রায়শই যে অর্থনীতি ও সমাজে যোগদান করে, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, কম পয়সায় প্রয়োজনীয় কাজ ও কর প্রদান করে, অথচ খুব কম সুরক্ষা বা স্বীকৃতি পায়। তবুও কাঁটাতার পেরিয়ে এরা চলে আসতে চায়, কারণ, অর্থ ও মর্যাদার চেয়েও তখন জরুরি নিরাপত্তা ও শান্তি।

অবৈধ অভিবাসন সম্পর্কে আলোচনাগুলি প্রায়শই সহানুভূতি, তথ্য বা দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাভাবনার পরিবর্তে ভয়-সৃষ্টি, উগ্র-জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক সুবিধা দ্বারা পরিচালিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালে তৎকালীন ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল সংসদে বলেছিলেন যে ভারতে ১ কোটি ২০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে; ২০১৬ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু ভারতের সংসদে বলেছিলেন, 'ভারতে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় ২ কোটি অবৈধ অভিবাসী রয়েছে', আবার বাংলাদেশি নাগরিকদের ‘উইপোকার’ সঙ্গে তুলনা করে ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০১৮ সালে বলেছিলেন, বিজেপি ৪০ লক্ষ অবৈধ অভিবাসীকে চিহ্নিত করেছে। 

অথচ ‘ইকোনমিক টাইমস’এর ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে দেশে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। সরকারের হলফনামায় বলা হয়েছে, অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্তকরণ ও বহিষ্কার একটি জটিল এবং চলমান প্রক্রিয়া কারণ তাদের নথিভুক্ত প্রবেশ নেই। অথচ, কখনও ১ কোটি ২০ লক্ষ, কখনও ২ কোটি আবার কখন ৪০ লক্ষ দাবি চলতেই থাকে। কীসের ভিত্তিতে এই সব দাবি করা হয়, কখনও কোনও নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না। 

ভারতে অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্যের একমাত্র উৎস হল ‘সেন্সাস’ বা আদমশুমারি। ভারতে অভিবাসন সম্পর্কিত তথ্য আদমশুমারি'র D-Series'এর মধ্যে পাওয়া যায়। এই সারণিগুলি জন্মস্থান, শেষ বাসস্থান, বসবাসের সময়কাল, অভিবাসনের কারণ এবং বয়স, লিঙ্গ, বর্ণ, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও বৈবাহিক অবস্থা ধরনের সামাজিক-জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মতো বিভিন্ন পরামিতির (parameter) উপর ভিত্তি করে অভিবাসী জনসংখ্যাকে শ্রেণিবদ্ধ ও বিশ্লেষণ করে। যেমন, D-01 ও D-02 সিরিজ জন্মস্থান এবং শেষ বাসস্থান অনুসারে জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে তথ্য প্রদান করে, লিঙ্গ ও থাকার সময়কাল অনুসারে বিভক্ত। D-02 (SC/ST) টেবিলগুলি বিশেষভাবে তফসিলি জাতি ও উপজাতি অভিবাসীদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, সাধারণ টেবিলের মতোই বিশদ বিবরণ সহ। D-03 সিরিজটি আন্তঃরাজ্য অভিবাসন, অভিবাসনের কারণ এবং সময়কাল পরীক্ষা করে, যার মধ্যে শহর-নির্দিষ্ট ও শহুরে সমষ্টিগত তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। D-04 থেকে D-10 টেবিলগুলি বয়স, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও বৈবাহিক অবস্থার আরও গভীরে যায়, যা অভিবাসী কর্মীদের, বিশেষ করে যাদের সাম্প্রতিক অভিবাসনের ইতিহাস (0-9 বছর) রয়েছে তাদের সম্পর্কে একটি সূক্ষ্ম ধারণা প্রদান করে। প্রত্যেকটি রাজ্যের জন্য আলাদা-আলাদা টেবিল সেখানে থাকে। 

ভারতে অভিবাসনের তথ্য সংগ্রহ ১৮৭২ সালে শুরু হয়েছিল, যা প্রাথমিকভাবে জন্মস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৬১ সালে পরিধিটি গ্রামীণ/শহুরে অবস্থা এবং বাসস্থানের সময়কাল অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রসারিত হয়েছিল। ১৯৭১ সাল নাগাদ শেষ বাসস্থানের স্থান সম্পর্কিত তথ্য যোগ করা হয় এবং ১৯৮১ সালে পরিযানের কারণ সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন চালু হয়। ১৯৯১ ও ২০০১ সাল পর্যন্ত এই বিন্যাসটি মূলত অপরিবর্তিত ছিল, ছোটখাটো সমন্বয় সহ— যেমন, ২০০১ সালে গ্রামীণ/শহুরে বিবরণ বাদ দেওয়া ও কারণ হিসাবে ‘জন্মের সময় স্থানান্তরিত’ যোগ করা ইত্যাদি। 

আন্তর্জাতিক অভিবাসন, দেশভাগের পর এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের ফলে প্রচুর পরিমাণে অভিবাসীর আগমন ঘটে। ২০০১ সালের হিসাবে ৫১ লক্ষ আন্তর্জাতিক অভিবাসী ভারতে ছিলেন— ৩০ লক্ষ বাংলাদেশ থেকে, ৯ লক্ষ পাকিস্তান থেকে, ৫ লক্ষ নেপাল থেকে এবং ১ লক্ষ শ্রীলঙ্কা থেকে। তবে, ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক অভিবাসন তীব্রভাবে (৩১.৬ শতাংশ) হ্রাস পায়। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, ভারতে প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষ তাদের শেষ বাসস্থান দেশের বাইরে বলে জানিয়েছেন। এই অভিবাসীদের মধ্যে ৪২ শতাংশ বাংলাদেশ (২৩ লক্ষ) ও ১২.৭ শতাংশ পাকিস্তান (৭ লক্ষ) থেকে এসেছে, যেখানে আফগানিস্তান থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬,৬০০। বাংলাদেশি (৭৬ শতাংশ) এবং পাকিস্তানি (৭৯ শতাংশ) অভিবাসীদের বেশিরভাগই ১৯৯১ সালের আগে ভারতে বসবাস করছিলেন, মূলত দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরে ব্যাপক অভিবাসনের কারণে। ১৯৯১ সালের পরে যারা ভারতে প্রবেশ করেছিলেন তাদের সংখ্যা ছিল এই দুই দেশ থেকে আসা মোট অভিবাসী জনসংখ্যার ২১ শতাংশেরও কম। ২০১১ সালে নতুন আগমন আরও কম ছিল, প্রায় ২২,০০০ বাংলাদেশি এবং ৬,৪০০ পাকিস্তানি ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, যারা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ অভিবাসী জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম প্রতিনিধিত্ব করেন। অর্থাৎ, সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান।

অন্যদিকে অভিবাসনের মূল তথ্য প্রদানদাকারী উৎস আদমশুমারির প্রধান সীমাবদ্ধতা হল যে এটি দশ বছর অন্তর গৃহীত হয়। যার অর্থ, ২০১১ সালের পর ভারতে প্রবেশকারী মানুষের কোনও আপডেটেড গণনা নেই। ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই সংসদে বলেছিলেন যে অবৈধ অভিবাসীদের গোপনে প্রবেশের কারণে তাদের সম্পর্কে কোনও সঠিক কেন্দ্রীয় তথ্য নেই। বেশিরভাগ বাংলাদেশি অভিবাসী অর্থনৈতিক অভিবাসী বা শরণার্থী নন, কারণ তারা ধর্ম, জাতিগত বা রাজনীতির কারণে পালিয়ে আসেন না। তাই, তারা ভারতে শরণার্থী মর্যাদার জন্য যোগ্য নন। কিন্তু যদি তথ্যের বিচার করা হয় তাহলে যে প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি করে ওঠে তা হল, যদি ভারতে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসনের সংখ্যা এতই বেশি হবে তাহলে কেন নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ হয় না? ২০২১ পেরিয়ে ২০২৫ হয়ে গেল, আদমশুমারির কোনও নামগন্ধ নেই। আর আলাদা করে অভিবাসনের জন্য কোনও সমীক্ষাও নেই (ব্যতিক্রম, পর্যায়ক্রমিক শ্রমশক্তি জরিপ, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে প্রায় ১.২ লক্ষ পরিবারের নমুনা আকার অন্তর্ভুক্ত করে যা কাজের জন্য আন্তঃরাজ্য অভিবাসনের সঙ্গে যুক্ত)। অথচ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থা নিয়ে বহু সমীক্ষা আছে, অভিবাসন নিয়ে নেই, যেখানে এত বিতর্ক দানা বাঁধছে। ফলে অবশ্যই প্রশ্ন ওঠে, রাজনৈতিক ফায়দার অঙ্কই কি সমীক্ষা না করানোর কারণ? 

অন্যদিকে দেখুন, বিদেশ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী রাজ্য ও বছরভিত্তিক অবৈধ অভিবাসন/মানব পাচারের মামলার সংখ্যা ২০১৬ সালে ছয়টি রাজ্য থেকে মোট ৪২টি অনুমোদিত হয়েছিল। সর্বাধিক সংখ্যাটি তামিলনাড়ু (১৫), তারপরে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা (৯), পাঞ্জাব (৮), কেরালা (৪), রাজস্থান (৪) ও মহারাষ্ট্র (২) থেকে এসেছে। ২০১৭ সালে (৩০ নভেম্বর পর্যন্ত), সাতটি রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে ৩০টি মামলা মঞ্জুর হয়েছিল। তেলেঙ্গানা (১০) শীর্ষে ছিল, তারপরে কেরালা (৫), তামিলনাড়ু (৫), রাজস্থান (৫), পাঞ্জাব (৩), দিল্লি (১) এবং গোয়া (১)। উভয় বছরেই সমস্ত অনুরোধকৃত মামলার অনুমোদন জারি করা হয়েছিল।

দুনিয়াতে যতগুলি বড় ধরনের অভিবাসন ঘটেছে গুগল করে তার ছবি দেখুন, দল বেঁধে সার দিয়ে কাতারে-কাতারে লোক ঢুকে পড়ছে। অথচ শেষ পাঁচ বছরে, কি রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি কোনও ক্ষেত্রেই এরকম কোনও ছবি আমাদের চোখে পড়েছে কী? যদি পড়ত তাহলে বিএসএফ কী করছিল? তবে এও বলা জরুরি যে, 'অবৈধ অনুপ্রবেশ' কি ঘটেনি? নিশ্চয় ঘটেছে? বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশেই ঘটে। কিন্তু তার সংখ্যা কি কোটি-কোটি বা লাখ-লাখ হতে পারে? পারে না, বড়জোর কয়েকশো বা কয়েক হাজার সর্বাধিক হতে পারে।

তাহলে ভোটার কার্ড সংশোধনীর মতো আবশ্যক ও জরুরি কাজের পিছনে এত মিথ্যা প্রচার কেন? কারণ, মুসলমান ও আর্থনীতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর উপর লক্ষ্যবস্তুগত হয়রানি তৈরি করে নির্বাচনী ফায়দা তোলা। সামগ্রিকভাবে, অভিবাসী-বিরোধী বক্তব্য ও নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়শই তথ্য-ভিত্তিক সমর্থনের অভাব থাকলেও এটি সাম্প্রদায়িক স্টেরিওটাইপ, ভাষা প্রোফাইলিং ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লক্ষ্যবস্তুর উপর নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলিকে বিশেষ সুবিধা দেয়। ফলে, যখন নির্বাচন নিকটে এবং সেখানে জেতাটা প্রায় অসম্ভব, সেখানেই এই কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে। দেশবাসীও কাকে কান নিয়ে গেল বলে কাকের পিছনে ধাওয়া করছে কিন্তু কেউ কানে হাত দিয়ে দেখতে চাইছে না যে আদৌ কান কি কাক নিয়ে গেল? তথ্যই নেই অথচ দাবি আছে-- এই তথ্যহীন দাবিকে কি মানুষ পাত্তা দেবে? তবে আজকাল হোয়াটস অ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশের হার এত বেশি যে কী হবে বলা কঠিন।


3 comments:

  1. হাটে হাঁড়ি ভাঙার জন্য ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  2. লেখাটা খুবই ভাল, তবে শেষটা আর একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল মনে হল, WhatsApp, facebook, সব ই গুজব ছড়ানোর জন্য সমান, তবে তার দায়িত্ব কে কিভাবে নেবে সেটা ও উল্লেখ করার বিষয়

    ReplyDelete
  3. লেখাটা যথেষ্ট তথ্যসমৃদ্ধ এবং বিশ্লেষণ প্রশংসনীয়। তবে শেষের বক্তব্য আরো বিশদ হলে ভালো হত।

    ReplyDelete