অবিশ্রান্ত দৌড়
ঋতম ঘোষ
ছুটছি মোরা ছুটছি দেখ, ছুটছি মোরা হল্লা দি,
সবাই মিলে জটলা করে ছোটার সাথে পাল্লা দি।
আজ এই একবিংশ শতাব্দীর মধ্যগগনে দাঁড়িয়ে সুকুমার রায় হয়তো এভাবেই আজকের পৃথিবীকে দেখতেন। পিঠের সঙ্গে অলৌকিক ভাবে সংযুক্ত সেই কল, যার আবেশে মানুষ যন্ত্রবৎ সম্মুখে ধাবমান। এই দৌড়নোয় ব্যক্তি মন এতটাই আবিষ্ট যে, সে তার সহজাত মানবিক প্রজ্ঞার পথ থেকে চ্যুত। ফলত, প্রকৃত ‘আহ্লাদ’ই এখন মানবজীবনের সংকট ও অতি দুর্লভ বস্তু হিসেবে দৃষ্ট।
প্রযুক্তি, নগরায়ন ও অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় জীবনযাত্রার ধরন আজ আমূল পরিবর্তিত। থেমে থাকলেই পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত সকলেই। এই গতিময়তার বাহ্যিক প্রভাব আমরা সজ্ঞানে উপলব্ধি করতে অপারগ। কারণ, আজ সভ্যতার চক্র গতি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু তা হয়তো একই সঙ্গে মানবচিত্তকে অনেকাংশে পশ্চাদগামীও করে তুলেছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ও কৄত্রিম বুদ্ধিমত্তা মুঠোবন্দী করেছে সমগ্র বিশ্বকে। কিন্তু এই বুদ্ধিবৄত্তির সুপ্রভাবে উদ্ভূত উপাদানাদি, কতিপয় উপযোগিতার পাশাপাশি, মানব মননের সুকুমার বৃত্তিগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জীবনযাত্রার যান্ত্রিকতায় মনের স্বাভাবিক সহজতা সংক্রমিত হচ্ছে। পূর্বে যে ব্যক্তি কিছু সময় হলেও বৈষয়িক ধ্যানধারণা ও জড়বাদী পৃথিবী থেকে ক্ষণিকের বিশ্রাম নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসায় নিমগ্ন হত, অবকাশ যাপন করত সাহিত্য, শিল্প বা তার আত্মিক ভাবনা জগতের সঙ্গে, সেই মূহুর্ত আজ বিরল। মন আজ অতিশয় প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন। মানব মননের অন্যতম যে গুণ মনোসংযোগ, যার বলে সে দীর্ঘকালীন কোনও প্রক্রিয়ায় ধৈর্য ও সংযমের সঙ্গে ন্যস্ত থাকতে পারে, তার লেখচিত্রও নিম্নগামী। ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার বোমারু প্রবণতা ও টুকরো টুকরো অর্থহীন অথচ সাময়িক সুখপ্রদ দৃশ্যাবলীতে আমাদের মস্তিষ্ক ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে, ফলত অজ্ঞাতেই আমাদের অন্তর্দৃষ্টি লুপ্ত হচ্ছে এবং অহেতুক অধৈর্যপনা আজকের জীবনযাত্রায় একটি অতি স্বাভাবিক গুণ হিসেবে প্রকাশিত।
সম্প্রতি মাইক্রোসফট'এর একটি বিজ্ঞাপনী প্রচার বিষয়ক সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে, একজন মানুষের স্বাভাবিক মনোযোগ ব্যাপ্তি (Average attention span) ক্রমহ্রাসমানতায় ৮.২৫ সেকেন্ডে এসে দাঁড়িয়েছে, যা একটি গোল্ডফিশের মনোযোগ ব্যাপ্তির সমতুল্য; বরং তাদের মনোযোগ ব্যাপ্তি মানুষের তুলনায় কিছুটা বেশি (৯ সেকেন্ড'এর কাছাকাছি)। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জানাচ্ছে যে, বর্তমানে ৭০ শতাংশ মানুষ কোনও বিষয়ে ২০ মিনিটের বেশি সময় ধৈর্য ধরে থাকতে অক্ষম। মাল্টি-টাস্কিং, অনর্গল তথ্যাদি ও অহরহ বিজ্ঞাপনের প্রভাব মনোসংযোগের মজবুতিতে ঘূণ সঞ্চার করছে।
গতি আমাদের আরও গতির জন্য প্ররোচিত করে। আমাদের সজ্ঞান মন ধীরে চলতে বা প্রয়োজনে থামতে ভুলে যায়। থামা আসলে থেমে যাওয়া নয়। থামা, পুনরায় চলতে আরম্ভ করার পূর্ব ধাপ, যেখানে চিন্তাশীল মনন আমাদের আগামী সফর সম্পর্কে সচেতন করায় ও অবস্থান নির্বিশেষে তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে শেখায়। কিন্তু এই সদা প্রতিযোগিতামূলক প্রবণতা মনুষ্যত্বের নৈতিক চেতনা বিকাশের পথে আজ অন্তরায় হয়ে উপস্থিত। সুস্থিত জীবনযাপন যেন ইউটোপিয়া। ২৪x৭ প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্তি, অ্যালগরিদম চালিত মানব মননের একমুখী সংহতিকরণ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক চাপানউতোর ব্যক্তিকে এমন কতকগুলি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে যে সে অভ্যন্তরীণ স্থৈর্য ও মানবিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ স্থিতিশীল জীবনশৈলীর সঙ্গে আপস করে বসছে। অজান্তেই এমন এক ঘূর্ণাবর্তের শিকারে পরিণত হচ্ছে যেখানে হ্যামস্টারের মতোই ইচ্ছা, অনিচ্ছা ব্যতিরেকে তাকে সেই আবর্তনীর ভিতর অবিশ্রান্তভাবে দৌড়তে হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার চিন্তক বিউং চুল-হান এই সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার এক বিশ্লেষিত চিত্র এঁকেছেন। জন্মসূত্রে কোরিয়ান হলেও তিনি মূলত জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক এবং একজন প্রশংসিত সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক। ফুকো পরবর্তী আজকের এই যুগের যে চিত্রকে তিনি পাঠককের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছেন সেখানে তিনি উল্লেখ করছেন কয়েকটি পরিণতির কথা, যেমন বার্নআউট সোসাইটি, দ্য সোসাইটি অফ টায়ার্ডনেস, দ্য সেন্ট অফ টাইম প্রভৃতি। খুব সাধারণভাবে বললে এমন দাঁড়ায় যে, আমরা বর্তমানে একটি অতি সক্রিয় (Hyperactive) সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস করছি যার প্রথম উপসর্গ অবিশ্রান্ততা। বিশ্রাম না নিয়েও আমরা ক্রমাগত আমাদেরই আরও এক শ্রেষ্ঠতর সংস্করণে পরিবর্তিত হবার ঝোঁকে অহর্নিশ এক নিরন্তর প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। অবচেতন এক বীরত্বপূর্ণ মরীচিকার দিকে ধাবমানরত। চুল-হান তাঁর পূর্বসূরি মার্টিন হেইডেগার, হান্না আর্ডেন্ট প্রমুখ তাত্ত্বিকদের সাহায্যে দেখাচ্ছেন যে মানুষ আজ তার সহজাত মানবিক সত্তা হারিয়ে একটি জান্তব শ্রমসর্বস্ব প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। সদা সক্রিয় অস্থির মনোভাব ক্রমাগত তার অন্তর্জগৎ'কে পঙ্গু করে চলেছে। মানবসমাজ সম্মুখীন হচ্ছে ADHD (Attention Deficit/ Hyperactivity Disorder), BPD (Borderline Personality Disorder)'এর মতো রোগের।
ভাইরাস, ব্যাকট্রিয়াল যুগ অতিক্রম করে আজ আমরা এমন একটি সময়ে পদার্পণ করেছি যেখানে আমাদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সত্ত্বেও আমরা সংক্রমিত হয়েছি স্নায়বিক রুগ্নতায়। অত্যধিক ইতিবাচকতায় আজকের জীবনযাত্রা পর্যুদস্ত। আর এই অতি-ইতিবাচক মনোভাবের ফলাফল স্ব-শোষণ, যা ঘটে চলেছে আমাদের অজান্তেই। অপরিমিত করতে পারার প্রবণতা সদাই আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সময় বিশেষে 'হয়তো না' বা দৃঢ়চিত্তে 'না স্বীকারকে' দুর্বল চিত্তের লক্ষণ বলে মনে করে একটি রসকষহীন বাহ্যিক প্ররোচনার ফাঁদে আমরা ক্রমশ নিমজ্জিত হচ্ছি। ফলত, ব্যক্তি বিশেষকে ওই পূর্বোক্ত ক্রিয়াগুলি 'হ্যাঁ আমি পারি', 'আমার করা উচিত' বা 'আমরা পারি ' বলিয়ে নিয়ে তাঁর মনকে এক মাত্রাতিরিক্ত ইতিবাচকতায় ভরিয়ে দিচ্ছে। সামগ্রিকভাবে ব্যক্তি বিশেষের কার্যক্ষমতা বা উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বটে, কিন্তু তা কেবল এই কৃতিত্ব সর্বস্ব সমাজের সর্বাঙ্গীন চাহিদা মেটাতেই ব্যবহৃত হচ্ছে। না সেখানে লক্ষ করা যাচ্ছে ব্যক্তি মননের স্বাতন্ত্র্য, না তা পরিচয় দিচ্ছে গভীর উৎকর্ষ চেতনার।
আর এ হেন পরিবেশে প্রত্যেক ব্যক্তিও নিজেকে এভাবেই অভ্যস্ত করে নিচ্ছে যা এই কোনওরকম অনুভূতিহীন, জ্বলে যাওয়া বা ঝলসে যাওয়া মননের বিস্তারকে তরান্বিত করছে। ব্যক্তি সাধারণ এই অবস্থাকে উপলব্ধি করতে অপারগ। এই শ্রান্তি বা অস্থিরতাকে উপেক্ষা করেও আমরা আমাদের জীবন চালনাতে বড় একটা সমস্যা-তাড়িত হচ্ছি না। বরং উল্টোটাই; আরাম আয়েসেই দিন কাটছে।
এখন নিন্দুকগণ বলবেন, তাহলে আর সমস্যা কোথায়? কিন্তু সমস্যা এখানেই যে রোগ যখন কোনওরকম উপসর্গ ছাড়াই শরীরে বাসা বাঁধে তখন তাকে চেনার কোনও উপায় থাকে না। কখনও ছোটোখাটো সমস্যা দেখা দিলেও রোগী সেই দুশমনকে স্বমনেই পুষে রেখে জীবনযাত্রা সচল রাখে। এর পরিণতি হয় ভয়ানক। সঞ্জীবনীও সেই মারণযন্ত্রণার কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
উপায়?
এই যে গতিময় জীবনের আধিক্য আজ রাজপথে নির্বিবাদে বিচরণ করছে তাকে কিছুটা সংযমের লাগামে সিক্ত করতে হবে। অযথা প্রতিযোগিতায় না ভিড়ে সুস্থ, স্বাভাবিক চিত্তে সহিষ্ণুতা, সহানুভূতিশীল ও বিবেক পরবশ হয়ে প্রতিযোগীদের সারি থেকে পৃথক হয়ে চলার প্রয়াস নিতে হবে। অভিমুখ নির্বাচন করতে হবে মননশীল অনুশীলনের মাধ্যমে। আত্মসমীক্ষা ও আত্মউপলব্ধির উপর আস্থা রাখলে তবেই হয়তো তা প্রসন্ন দীপ্তিতে উদ্ভাসিত করবে মানব চিত্তের অন্দরমহলকে।
বাহঃ, অন্য রকম একটা লেখা.. খুব ভাল লাগল, আজকাল কার যান্ত্রিক জীবনে এগুলো গভীরে ভাববার বিষয় বৈ কি
ReplyDeleteখুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়!
ReplyDeleteবাহ্ !
ভালো লেখা । অল্পে সন্তুষ্ট থেকে সহযোগিতা মলক জীবন যাপন করার চেষ্টা একটা আন্দোলন হিসেবে গড়ে উঠুক।
ReplyDeleteউপায় টা অবাস্তব।
ReplyDeleteKhub valo lekha kintu protijogita manus k ai pothe niya jachhe
ReplyDeleteAshim kr chakraborty
Delete