Thursday, 31 July 2025

বিকল্প রাজনীতির একটি পরীক্ষা

নিজেদের কথা নিজেরাই বলা যাক

উত্তাল ঘোষ



বিধানসভা ভোটের বেশ কয়েক মাস বাকি। কিন্তু এখন থেকেই ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। রাজনীতি যে শুধুই ভোটের জন্য এটা তার প্রমাণ। একটা ভোট মিটলেই শুরু হয়ে যায় পরের ভোটের অঙ্ক। ভোটসর্বস্ব এই রাজনীতিতে সভ্যতার বিপদের কথা, সাধারণ মানুষের রোজকার যন্ত্রণার কথা থাকে না। তাই ক্রমশ রাজনীতি সম্পর্কে মানুষের শ্রদ্ধা কমছে। অনেকেই রাজনীতির এই দেউলিয়াপনা বুঝতে পারলেও বিকল্প নেই। 

ভোটযুদ্ধের এই রমরমার মধ্যেই কার্যত চুপচাপ কাজ শুরু করেছে একটি সংগঠন: জনমঞ্চ; ঘোষণা অনুযায়ী সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক মঞ্চ। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির বিকল্প রাজনীতির সম্পূর্ণ এক নতুন পরীক্ষা শুরু করেছেন বিভিন্ন পেশায় যুক্ত কিছু সাধারণ মানুষ।  

বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক মঞ্চ। ধারণাটা নতুন। জনমঞ্চ বলছে,   

রাজনৈতিক মঞ্চ হলেও তারা এখনই ভোটে লড়ার কথা ভাবছে না;

জনমঞ্চ কোনও সরকার বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়;

তারা পন্থা নিয়ে বিতর্কে যেতে চায় না; 

ওদের ক্যাচলাইন: আমরা যা বিশ্বাস করি তাই বলি, যা বলি তাই করি।

জনমঞ্চের বেশ কিছু দাবি থাকলেও, মূল দাবি দুটো:

কোনও সরকারি অনুদান ছাড়া প্রত্যেক পরিবারের মাসিক আয় অন্তত ২০ হাজার টাকা করতে হবে; 

প্রকৃতি, বন্যপ্রাণ ও পরিবেশকে রক্ষা করেই উন্নয়নের কাজ করতে হবে।

কোন রাস্তার কথা বলছে জনমঞ্চ?

এতদিন নানা পার্টি তাদের মঞ্চ থেকে নিজেদের কথা বলেছে। সাধারণ মানুষ নিচে বসে হাততালি দিয়েছেন। এবার সাধারণ মানুষ তাঁদের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে নিজেদের অধিকারের দাবি তুলবেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে ঠিক করতে হবে তারা কী ভূমিকা নেবে।

সাধারণ মানুষের অধিকার কোনগুলো? 

অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বিষহীন খাবার, যথেষ্ট পুষ্টি, ব্যক্তি ও সমষ্টির নিরাপত্তা, ভয়হীন ভাবে কথা বলতে পারা, নিজের ধর্ম পালনের অধিকার-- এগুলো মানুষের জন্মগত অধিকার। জনমঞ্চের মতে, এই অধিকার আদায়ে সবার আগে দরকার স্বনির্ভর পরিবার গড়ে তোলা। তাহলে আর রাজনৈতিক দলের মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁচতে হবে না। 

দাবি আদায়ের পথ সম্পর্কে জনমঞ্চের ধারণাতেও নতুনত্ব। বলছে, প্রয়োজনে তারা মিটিং-মিছিল করবে (অবরোধ ইত্যাদি করে সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলবে না), কিন্তু কথার চেয়ে কাজকে বেশি গুরুত্ব দেবে। কী ভাবে পরিবারগুলোকে স্বনির্ভর করা যায়, প্রকৃতি-পরিবেশকে রক্ষা করেই উন্নয়ন করা যায়, সে সব হাতেকলমে করে দেখানোর উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছে জনমঞ্চ। 

প্রশ্ন, বহু সহৃদয় মানুষ, বিভিন্ন সংস্থা মানুষের জীবনমান বাড়ানোর জন্য কাজ করেন। জনমঞ্চ কি সেরকম কোনও সংগঠন? জনমঞ্চের উদ্যোক্তারা বলছেন, তাঁরা সমাজসেবায় নামেননি। তাঁরা কোনও এনজিও নন। কারণ তাতে মানুষের কিছু সুবিধা হলেও সিস্টেম বদলায় না। মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই-ই পারে শুধু সিস্টেম বদলাতে। সে কাজ করার জন্যই তাঁরা জনমঞ্চ তৈরি করেছেন। 

কোন সিস্টেম বদলের কথা বলছে জনমঞ্চ? 

সে কথায় ঢুকতে গেলে কিছু নিরস তথ্য দিতেই হচ্ছে। 

OXFAM-এর রিপোর্ট বলছে, 

ভারতে গরিব ৭০ শতাংশ মানুষের ৪ গুণ সম্পদ আছে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের হাতে; 

সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের হাতে আছে দেশের ৭৭ শতাংশ সম্পদ। 

World Inequality Lab প্রকাশিত রিপোর্ট আরও ভয়ঙ্কর:

আজকের ভারতের অবস্থা ব্রিটিশ আমলের চেয়েও খারাপ: 

সাল                সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের হাতে দেশের মোট আয়ের কত শতাংশ

১৯২২                                            ১৩

২০২২                                            ২২.৬ (সর্বকালীন রেকর্ড)

সাল                সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের হাতে দেশের মোট আয়ের কত শতাংশ

১৯৮২                                        ৩০

২০২২                                            ৬০

শুধু গরিবেরই নয়, মধ্যবিত্তেরও হাল খারাপ হচ্ছে। ৯০'এর দশকে ধনী ১০ শতাংশের পরের ৪০ শতাংশের হাতে ছিল মোট আয়ের ৪৪.১ শতাংশ। ২০২২ সালে সেটা কমে হয়েছে ২৭.৩ শতাংশ।

সারা দুনিয়ার ছবিটা কেমন?

২০২৩ সালে প্রকাশিত UBS Global Wealth Report অনুযায়ী, দুনিয়ার ধনী ১ শতাংশের হাতে আছে দুনিয়ার সম্পদের ৪৭.৫ শতাংশ। আর গরিব ৪০ শতাংশের হাতে আছে ১ শতাংশেরও কম সম্পদ। দুনিয়া জুড়ে চলছে বাজার অর্থনীতির দাপট, যার মূল নীতিটাই হচ্ছে, আরও আরও আরও মুনাফা। দেখা যাবে, ১৯৯১ সালে আমাদের দেশে বাজার অর্থনীতি চালুর পর থেকে ধনী-গরিবের আয় ও সম্পদের ফারাক দুদ্দাড় গতিতে বাড়ছে। ২০১৪ সালের পর থেকে ফারাক বাড়ছে রকেট গতিতে। 

মুনাফার জন্য বাজার দখল করতে এই মুনাফাবাজদের যুদ্ধ বাঁধাতেও হাত কাঁপে না। International Committee of the Red Cross-এর হিসেব, এখন সারা দুনিয়ায় ১২০টিরও বেশি সশস্ত্র লড়াই চলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, আরও লাভের লোভে সভ্যতাকে বলি দিতেও আপত্তি নেই ধনকুবেরদের। 

সভ্যতার অস্তিত্বের সামনে আরেক বিপদ পৃথিবীর ক্রমশ গরম হয়ে যাওয়া বা বিশ্ব উষ্ণায়ন। এটাও আরও মুনাফার ধান্দারই একটা ফল। বিপদ বাড়াচ্ছে ধনীরা আর ফল ভুগতে হচ্ছে গরিবদের। 

Oxfam-এর রিপোর্ট বলছে,   

সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের ছড়ানো দূষণের দ্বিগুণ দূষণ ছড়ায় সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ;

১৯৯০-২০১৯ পর্যায়ে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের ছড়ানো দূষণের ধাক্কায় ২০২৩ পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ২,৯০,০০০ কোটি ডলার। সেই ক্ষতির ধাক্কা পোহাতে হচ্ছে গরিব মানুষকেই। 

বিশ্ব ব্যাঙ্কের পূর্বাভাস, উষ্ণায়নের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন করে ৭-১৩ কোটি মানুষ গরিবির গাড্ডায় পড়বেন। Earth.Org-র হিসেবে, উষ্ণায়নের ধাক্কায় শুধু ২০২৪ সালে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন। সম্পদের বৈষম্য আর পরিবেশের বিপদ-- এ দুটোই সভ্যতার গোড়ার রোগ। এই রোগ সারাতে না পারলে সভ্যতা টিকবে না। 

জনমঞ্চ প্রশ্ন তুলছে, রাজনীতি কি এই বিপদ সম্পর্কে ভাবছে? আর্থিক অসাম্য আর বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদ আটকাতে না পারলে সভ্যতা বাঁচবে না। সভ্যতা না বাঁচলে বিজেপি-তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেস, মমতা-মোদী-ট্রাম্প, হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-শিখ-ইহুদি, কর্পোরেটের বস্-পরিযায়ী শ্রমিক, কেউ কি বাঁচবে?  জনমঞ্চ মনে করে, রাজনীতির নেতারা এই বিপদের কথা ভালই জানেন। কিন্তু সচেতন ভাবেই আসল রোগ আড়াল করে পরিযায়ী শ্রমিক হেনস্থা-NRC-CAA, হিন্দু জাগো-বাঙালি জাগো, ওয়াকফ আইন, সেটিং তত্ত্ব-‘শ্রী’ প্রকল্প-অনুপ্রবেশ-অপারেশন সিঁদুর-দুর্নীতি-গুণ্ডারাজ ইত্যাদি নিয়ে পাবলিককে মাতিয়ে রাখেন। কারণ, সব রাজনৈতিক দলই এই সিস্টেমের অংশ হয়ে গিয়েছে।

জনমঞ্চের ব্যাখ্যা, যে সিস্টেম শেখায় যে করে হোক মুনাফা আরও বাড়াতে হবে, সেই সিস্টেমের অংশ রাজনৈতিক দলগুলিরও তাই একটাই অঙ্ক, যে করেই হোক ভোটে জিততে হবে। ভোটে জিততে দেদার টাকা ছড়ানো-গুণ্ডা ব্যবহার, ধর্ম ও জাতের সুড়সুড়ি, মিথ্যে কথা বলা-বুথ দখল-সরকারি সংস্থাকে ব্যবহার, কোনও কিছুই বাদ যায় না। Centre for Media Studies (CMS)-এর হিসেব অনুযায়ী, লোকসভা ভোটে খরচ:

২০১৯: ৬০ হাজার কোটি টাকা;

২০২৪: ১.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা।

এত খরচ করে, অনৈতিক পথে জিতে ক্ষমতায় গেলে অনৈতিক কাজ বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন রাজনীতির কোনও নীতি-নৈতিকতা নেই। সেই ঘরে দুর্নীতি-লোভ-লালসা-দলবদল-অপরাধের বাসা বাঁধাটাই স্বাভাবিক। তার ছাপ পড়ছে সামাজিক জীবনেও। 

জনমঞ্চ মনে করে, সাধারণ মানুষের জীবন-যন্ত্রণা পার্টিগুলোর কাছে গুরুত্বহীন। কিছু ললিপপ ধরিয়ে দিয়ে নেতারা ব্যান্ড বাজান-- আমি এটা দিলাম, আমি ওটা দিলাম। কিন্তু সরকারের টাকা মানে তো সাধারণ মানুষেরই টাকা। অর্থাৎ, মাছের তেলে মাছ ভেজে নেতারা ব্যান্ড বাজান। আর সাধারণ মানুষ সেই কথা শুনে নিজেদের মধ্যে তর্ক-হাতাহাতি-লাঠালাঠি-খুনোখুনি শুরু করে। মারে নয়তো মরে। বেশির ভাগ মানুষের বেঁচে থাকাটা পার্টির উপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছে। 

পরিত্রাণের রাস্তা কী?

রাহুল সাংকৃত্যায়নের কথা: ভাগো নেহি দুনিয়াকো বদলো। 

কার্ল মার্কসের কথা: দার্শনিকেরা নানা ভাবে দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসল কথা হল একে পরিবর্তন করা। 

বাঙালি সব কিছুতেই নেতিবাচক ভাবনায় অভ্যস্ত। এটা খারাপ-ওটা খারাপ-সেটা খারাপ বলতেই অভ্যস্ত। তাই বাংলার সমাজ-অর্থনীতির মতো রাজনীতিও খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যাওয়াটাই ভবিতব্য। কিন্তু কোনটা মানুষের রাজনীতি সেটাও শিখিয়েছেন এক বাঙালি, সুভাষচন্দ্র বসু: জনগণের হাতে সব ক্ষমতা। সেই বিকল্প রাস্তাতেই হাঁটতে চাইছে জনমঞ্চ। তাদের মতে, এটাই সব রোগের বিশল্যকরণী। মানুষের অধিকারের লড়াই-ই বিপদ থেকে বাঁচার রাস্তা। 

জনমঞ্চ বলে রবীন্দ্রনাথের কথা: মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। গৌতম বুদ্ধ, গুরু নানক, গান্ধীজী, আম্বেদকার, লালন, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুর, ভগত সিং, বিবেকানন্দ, পেরিয়ার, রামমনোহর লোহিয়া, জ্যোতিবা ফুলে, বেগম রোকেয়া, বিদ্যাসাগর, বীরসা মুণ্ডা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, নানা ভাবনা, নানা চেতনা মিলেমিশেই তৈরি তাদের ভাবনা। চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির- এমন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখে জনমঞ্চ।

দুঃখ-কষ্টের জন্য কান্নাকাটি-রাগারাগি-অন্যকে দোষ দেওয়া তো অনেক হল। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষায় বলতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি, মারামারি, খুনোখুনি করলাম। তাতে লাভ হয়নি। এবার দুঃখ-কষ্টের জন্য দায়ী সিস্টেম বদলের মতো বিকল্প রাজনীতি তৈরির চেষ্টা করা যাক। কঠিন কঠিন তত্ত্বকথা, রাজনীতির নানা আঁকাবাঁকা কূটকচালি ছেড়ে সরাসরি নিজেদের কথা নিজেরাই বলা যাক। 

জনমঞ্চ এখনও খুব ছোট। ৫-৬টি ব্লকে কাজ শুরু করেছে। তাদের ধারণা নিয়ে চলতে রাজি এরকম যে কেউ যুক্ত হতে পারেন, এমনকী তিনি অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আপত্তি নেই। ইতিবাচক বদল ঘটাতে সমমনস্ক যে কোনও সংগঠন বা ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করতে তৈরি জনমঞ্চ। শুধু আমরাই সব বুঝি বা পারি, একদমই সেটা মনে করে না তারা। শিখতে শিখতেই এগোতে চায় অচেনাকে চিনে চিনে।


Tuesday, 29 July 2025

জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর

শাসক-জনতার দূরত্ব কমিয়ে আনার লড়াই

শাহেদ শুভো



'The creatures outside looked from pig to man, and from man to pig, and from pig to man again; but already it was impossible to say which was which.' (Animal Farm, George Orwell). 

ব্যক্তিগত ভাবে অরওয়েলের 'অ্যানিমেল ফার্ম' উপন্যাসের এই লাইনগুলো আমার কাছে ৫ অগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রায়-প্রতীকী মনে হয়! হাসিনা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আসলে আজ কোথায় দাঁড়িয়ে? এই 'একক মাত্রা'র ব্লগে গত বছরের (২০২৪) ৯ অগস্ট প্রকাশিত লেখার শেষ অংশে যে আশঙ্কার কথা বলেছিলাম, তার প্রায় অনেকাংশই কি দৃশ্যমান হচ্ছে? অথচ এত মানুষের হত্যা, তাদের আহত ও আক্রান্ত হওয়া-- সেই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হাসিনা-শাসনের অবসান, এরপর নোবেল বিজয়ী ডঃ মুহাম্মদ ইউনিসের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলনের নেতা সমূহ ও সিভিল সোসাইটির কয়েকজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে সরকার গঠন, ফলত, গত এক বছরের শাসনে বাংলাদেশে কি কোনও গুণগত পরিবর্তন এসেছে নাকি বাংলাদেশ এখনও সেই পুরনো চক্করেই ঘুরপাক খাচ্ছে? এই প্রশ্নটিই সকলকে ভাবাচ্ছে। 

প্রায় রাজনীতি-শূন্য (জুলাই অভ্যুত্থানে কোনও একক রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল না, সেই অর্থে তা রাজনীতি-শূন্য) এই জনপদের মানুষের এক ফ্যাসিস্ট শাসকের প্রতি ক্ষোভ, সঙ্গে সেই জনপদের মানুষকে স্রেফ ন্যূনতম নাগরিক না মনে করা, তাদেরই করের টাকায় কেনা সামরিক যানে ছাত্র হত্যা করে তার লাশ 'এপিসি'র (সামরিক যান) ছাদে তুলে মানুষকে দেখানো যে, দেখ, আমি হাসিনা অথবা হাসিনা বাহিনী কত শক্তিশালী, আমরা জনগণকে থোড়াই কেয়ার করি, প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে মানুষ ছিল একটা সংখ্যা মাত্র! দৃশ্যমান ফ্যাসিস্ট শাসন তার গোটা সরকারি অধীনস্থকে কীভাবে একটা রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলে, তার প্রকৃত উদাহরণ ছিল বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারী, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, লুটেরা ব্যবসায়ী, নানা পরিচয়ে পার্টিজান কর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক-- কোন অংশ ছিল না যারা হাসিনার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়নি? আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, নানা পরিচয়ে হাসিনা এক সর্বব্যাপী রাষ্ট্র তৈরি করেছিল, যা মাফিয়া-স্টেটের সঙ্গে তুলনীয়। গত ১৫ বছরের দুঃশাসন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষকে জুলাই ২০২৪'এ এক জায়গায় নিয়ে এসেছিল; তা ছিল খুনী হাসিনা ও তার বাহিনীর বিচার। এটা সর্বাত্মক সত্য, যদিও তখনও রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠান হাসিনার আনুগত্যাধীন ছিল। 'রাষ্ট্রের কোনও ছবি নাই' সম্ভবত সুমন মুখোপধ্যায়ের কোনও নাটকের শিরোনাম। রাষ্ট্র নিজে কোনও দৃশ্যমান অবয়ব নয়। তা একটি বিমূর্ত শক্তি, যার অস্তিত্ব বোঝা যায় তার কাজ, নিয়ন্ত্রণ, দমন-পীড়ন, আইন ও প্রশাসনের মাধ্যমে। হাসিনার এই বিমূর্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই মানুষ দাঁড়িয়েছিল। সেই লড়াই ছিল রাষ্ট্র বনাম জনগণের। 

৫ অগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ এক নতুন বাংলাদেশে বিনির্মিত হবে-- এই স্বপ্ন অনেকেই দেখেছিলেন। যদিও গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হলে আদৌ কি সেখানে বাস্তবিক কোনও সুসংগঠিত রাজনৈতিক কর্মসুচী ভিত্তিক আকাঙ্ক্ষা থাকে? আবার জুলাই অভ্যুত্থানের চরিত্র কিন্তু কোটা আন্দোলন উদ্ভূত, যা ছিল মূলত সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, অবশ্যই দল নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে শুরু হয়েছিল। প্রথমে কোটা বাতিলের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন, যে আন্দোলনকে হাসিনার 'রাজাকার' ট্যাগ দেওয়া, এরপর তা দমন করতে রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক বাহিনীকে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর লেলিয়ে দেওয়া। তারপর দেশ জুড়ে গণহত্যা চালানো, তারই ফলশ্রুতিতে সর্বস্তরের মানুষের রাস্তায় নেমে আসা ও হাসিনার বিদায়। প্রশ্ন হতে পারে, কেন ১৫ বছরে হাসিনার পতন হল না? মানুষ কেন জাগলো না? আসলে, কোন সূত্র মানুষের আত্মমর্যাদায় কখন আঘাত করে তা কি বলা যায়? রাস্তায় নেমে মানুষ যখন দেখেছে হাসিনার বাহিনী পশুর মতো মানুষ মারছে, এমনকি নিজের ঘরের বারান্দায়, ছাদেও মানুষ নিরাপদ নয়, তখনই মানুষ পালটা লড়াই করেছে, যা কোনও রাজনৈতিক দল তার একক কর্মসুচী দিয়ে করে উঠতে পারে না। সারা দুনিয়ার অভ্যুত্থান-আন্দোলনের ইতিহাস পাঠ করলে এমন সময় বারবার দেখা গেছে। 

হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ প্রায় তিনদিন সরকারবিহীন ছিল। আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা ও কর্মীরা এই আতঙ্ক ছড়াত যে হাসিনার পতন হলে এক রাতেই ৫ লক্ষ আওয়ামী লীগের কর্মী মারা যাবে, সংখ্যালঘুদের বাংলাদেশ ছাড়তে হবে! হাসিনা পতনের পর নানা আশঙ্কা থাকার পরেও আসলে বিরুদ্ধ মতের ওপর তেমন কোনও বড়সড় আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু প্রশ্ন হল, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র সমাজ ও ডঃ ইউনুস এবং বিভিন্ন সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত এক বছরে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গেল? যে আন্দোলন সর্বাত্মক ছিল, সেই আন্দোলন পরবর্তী সরকার কি সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি যারা কিনা বাংলাদেশের এলিটোক্রেসির অংশ, তাদের কব্জায় চলে গেল? প্রথমে বিপ্লব তারপর অভ্যুত্থান এরপর রাজ বদল (রেজিম চেঞ্জ)-- ‘জুলাই অভ্যুত্থান'কে নিয়ে নানা ন্যারেটিভ তৈরি করা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সোসাইটি সাধারণ জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, অথচ 'জনপরিসর' শব্দটি এই বুদ্ধিবৃত্তিক সোসাইটি ব্যবহৃত জনপ্রিয় টার্ম হলেও আসলে কি জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশকে এই বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পেরেছে? আমাদের এই প্রশ্ন সমস্ত রাজনৈতিক দল, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাকে আমরা অভ্যুত্থানের সরকার মনে করি, তাদের কাছে; অথবা আমাদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র প্রতিনিধি যারা পরবর্তীতে ‘এনসিপি' নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, যাদের প্রতি এই সরকারের আনুকূল্য দৃশ্যমান, তাদের কাছেও! তাদের রাজনৈতিক কর্মসুচী আসলে কী? সেখানে উল্লিখিত 'সাধারণ মানুষের রাজনীতি' আসলে কী? এই প্রশ্ন এখন জনমনে উঠেছে। 'দিল্লি না ঢাকা'-- এই শ্লোগান আদৌ কোনও রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান না আসলে এক ধরনের ধর্মীয় উসকানি? যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউনুস সরকারের নানা চুক্তির প্রসঙ্গ উঠলেও এই ছাত্র নেতারা নীরব। দলের মধ্যে বহুত্ববাদের কথা বললেও ইসলামিস্ট অংশের প্রচ্ছন্ন শক্তি টের পাওয়া যায়; শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী জামাত ইসলাম সহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে তাদের যোগ দৃশ্যমান। বাংলাদেশে এই ধরনের রাজনীতি এক সময় বিএনপি করেছে, এরশাদের 'জাতীয় পার্টি' করেছে এবং আওয়ামী লীগও করেছে! বাংলাদেশের মানুষ এই সুবিধাবাদের রাজনীতি বোঝে! সে কেন আরেকটা সুবিধাবাদের রাজনীতিকে সমর্থন করবে? প্রশ্ন, ছাত্র নেতৃত্বের এই দল কি আসলে কোনও নতুন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করতে পেরেছে? বরং তাদের প্রিয় কিছু বুদ্ধিজীবীর শেখানো পাঠ চিন্তাকে নিজেদের বয়ান মনে করছে এবং অন্যান্যদের মতো বরাবর ভাবছে জনগণ কত বোকা। এরা ৭১'এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে ২৪'এর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, যা জনগণ প্রত্যাখান করেছে। মুক্তিযুদ্ধ এক সর্বব্যাপী জনযুদ্ধ ছিল এবং এক-ভাষা ভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, আর অন্যদিকে জুলাই ২০২৪ ছিল স্বরাষ্ট্রের নাগরিকের বিরুদ্ধে শাসক শ্রেণির আগ্রাসন! 

বহু আলোচিত বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নানান সন্দেহের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধারায় যাওয়ার জন্য নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হলেও এক সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে এই সরকার কতটা আন্তরিক? এই প্রশ্ন প্রায় সব বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আছে। বাংলাদেশের এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রথম থেকেই নির্বাচনের দাবি করছে, যদিও গত ১৫ বছর ধরে প্রায় অধিকাংশ বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যে লড়াই করছিল তার অন্যতম দাবি ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন, কারণ, গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাটাকেই আওয়ামী লীগ প্রহসনে পরিণত করেছিল। তাই, ৫ অগস্ট ২০২৪'এর পর অধিকাংশ বিরোধী দল আশা করেছিল এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুতই এক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করবে। কিন্তু এই সরকার এজেন্ডা আকারে আনল সংস্কার এবং হাসিনা আমলের গণহত্যা, গুম খুনের সঙ্গে যুক্তদের বিচার। যদিও এই দাবি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সকল বিরোধী দলই করেছে কিন্তু তার সাথে সাথে নির্বাচন প্রক্রিয়াও গুরুত্ব পেয়েছে। এই সরকার বেশ কিছু কমিশন করলেও এবং তাদের অধিকাংশ রিপোর্ট পেশ হলেও জনপ্রশাসন ও পুলিশে আদৌ কোনও সংস্কার হয়নি। তবে, তারা খুব গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কিছু পলিসি লেভেলের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘ঐক্যমত কমিশন' নামে সংস্কার বিষয়ক মোড়লগিরি শুরু করেছে। টেলিভিশনে লাইভ দেখানো হচ্ছে এই ঐকমত্য কমিশনের আয়োজন, যেন সরকারের একটা পক্ষ বলতে চাইছে, 'দেখুন, এ দেশের রাজনীতিবিদেরা কত খারাপ, আমরা বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসে যে সব সংস্কারের আইডিয়া দিচ্ছি এটা তারা মানছে না!'   

বাংলাদেশের রাজনীতি ঘোলাটে হওয়ার অন্যতম কারণ, এখানে আদৌ কোনও রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটেনি। বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যারা কিনা ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্ববহ, এই দুই দলই সরকার গঠনের যোগ্যতা রাখে। অনেক অভিযোগ থাকার পরেও শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী দলটাকে একটা 'হাইব্রিড রেজিমে' পরিণত করেছিল। ৫ অগস্টের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরা অসম্ভব। যদিও তাদের বিশ্বাসী সমর্থক গোষ্ঠী তা মনে করে না, কিন্তু এই ১৫ বছরের অন্যায়ের দায় নিতে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের অনেক ত্যাগী নেতা ও কর্মীরা আগ্রহী নয়। বিএনপি এরপর সবচেয়ে বৃহৎ দল, যদি ভোট হয় বিএনপি ক্ষমতা আসছে এটা নিশ্চিত। কিন্তু বিএনপি'র রাজনীতির প্রধান সমস্যা তাদের তৃণমূলে পার্টি কর্মীরা বিভিন্ন পরিচয়ে চাঁদাবাজি, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব সহ খুনের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিএনপি'র মূল নেতৃত্ব অনেকাংশে প্রগতিশীল হলেও এটা একটা মধ্যপন্থী দল এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন ডানপন্থার রাজনীতির অভিযোগ আছে। ২০০১ থেকে ২০০৭-- বিএনপি তাদের জোটসঙ্গী জামাতকে নিয়ে ইসলামি উগ্রপন্থার অংশ হয়েছিল। ভোটের রাজনীতির অংশ হতে গিয়ে এই দলটিতে এক ধরনের মিশ্র চিন্তার বিকাশ ঘটেছে যা নির্ভর করে ভোটের পাল্লা কোন দিকে বেশি তার উপর। যদিও এত কিছুর পরেও বিএনপি'তে অনেকেই আস্থাশীল। 

ইসলামপন্থী দলগুলো ভোটের রাজনীতিতে খুব শক্তিশালী না হলেও বদরুদ্দিন উমর থেকে শুরু করে অনেকেই বলেছেন, ৫ অগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিকাশ হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে আবারও গত ৯ অগস্টের (২০২৪) আমার লেখাতে ('একক মাত্রা' ব্লগ) ফিরে যাই, সেখানে লিখেছিলাম দলহীন অথবা জোটবদ্ধ নৈরাজ্যবাদ ফ্যাসিজম হটায় কিন্তু তারপর আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিজমে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা তীব্র হয়। আর তাদের অন্যতম টুলস নানা উপায়ে ঘৃণাবাদ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, কালচার ওয়ার শব্দের আড়ালে 'কনফ্লিক্ট জোন' তৈরি করে ভবিষ্যৎ সাম্রাজ্যবাদী অবস্থান নিশ্চিত করা। এই সরকার সেই কাজই করছে। যুক্তরাষ্ট্র সহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে তারা আঁতাতে মত্ত, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে ‘সিক্রেট অ্যাক্ট'এর ব্যবহার হচ্ছে (এগুলো শেখ হাসিনাই করত)। 

বাংলাদেশে বাম ধারার দুটো অংশ বিদ্যমান-- একটা অংশ রাজনৈতিক দল হিসেবে বাম পরিচায়ক, আরেকটা তরুণ বামপন্থীরা, অনেকটা দল শূন্য অথচ নৈরাজ্যবাদী নয়। দুই অংশের দ্বন্দ্ব আছে। দ্বিতীয় অংশ মূল ধারার বামদের অস্বীকার এবং হাসিনার ফ্যাসিজমের জন্য তারা পার্টিগুলোকেই দায়ী করে। আবার এই অংশ জুলাই অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এখন ইসলামপন্থীদের দ্বারা নানা পরিচয়ে ট্যাগড হচ্ছে, যা এদের জুলাই কেন্দ্রিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে মোহভঙ্গের কারণ। যদিও এই অংশ জুলাই অভ্যুত্থানকে ধারণ করে এবং হাসিনার বিরুদ্ধে যে মধ্যবিত্ত অংশটি প্রথম দিকে রাস্তায় নামছিল না, তাদের রাজপথে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। তবে তাদের অনেকেই এনসিপি ও ছাত্র নেতাদের প্রতি মোহগ্রস্ত ছিল। শেখ হাসিনা সকল রাজনীতিকে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণ করার পরও ইসলামী দলগুলো নানা উপায়ে তাদের রাজনীতির বিকাশ ঘটিয়েছে; এতে হাসিনারও প্রচ্ছন্ন মদত ছিল, সে বিশ্বকে দেখিয়েছে তার দল ছাড়া সবাই ইসলামপন্থী। তাই তার ফ্যাসিজম যেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। ৫ অগস্ট'এর পর জামায়াত ইসলামের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের অনেকেই নিজ পরিচয় দিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে যারা কিনা ছাত্র জীবনে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারাই হুট করে নিজেদের এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড ও মূল নেতৃত্বদানকারী শক্তি হিসেবে দাবি করছে। ক্যাম্পাসগুলোকে বিভিন্ন পরিচয়ে তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন ঘোলাটে। জুলাই ২০২৪ আর ২০২৫ এক নয় নিশ্চয়ই। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন অংশীজনের নানা ফন্দিফিকির বেরিয়ে আসছে এবং এটাই স্বাভাবিক যে কেউ কেউ বলছেন, ৫ অগস্ট পরবর্তীকালে সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করা যায়নি; না হলে পরিস্থিতি নাকি অন্যরকম হত। কী হত বা কী হতে পারত, তা না বুঝলেও এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাকে অভ্যুত্থানের সরকার বলা হয়, তারা সাধারণের উপর গুলি চালিয়েছে। গোপালগঞ্জে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে ইউনুস সরকার। প্রশ্ন উঠবে, শেখ হাসিনার শাসনামলের পর বাংলাদেশের জনগণ কী পেল? 'অ্যানিমেল ফার্ম'এর শেষ অংশে অরওয়েল লিখছেন, 'খামারের প্রাণীরা জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছে, নেপোলিয়ন সহ শূকররা মানুষদের সঙ্গে একসাথে বসে খাচ্ছে, খেলছে এবং চুক্তি করছে। শূকর ও মানুষদের মধ্যে যে ভেদরেখা একসময় ছিল, তা মুছে গেছে। উভয়ের মুখাবয়ব, আচরণ ও লোভ একই হয়ে গেছে।' 

আসলে ক্ষমতা পেলেই কি মানুষ বদলে যায়? কিন্তু কেন? আর যে মানুষগুলো জীবন দিল, আহত হল, যারা রাজপথে লড়াই করল, তারা কী পেল? তাই, 'জুলাই অভ্যুত্থান' এখনও চলমান, যতদিন শাসক আর  জনগণের দূরত্ব না ঘুচবে এরকম 'জুলাই' বারবার ফিরে আসবে। 


Monday, 28 July 2025

'অনুপ্রবেশের' কোনও তথ্যই নেই!

'অনুপ্রবেশ' ভোট রাজনীতির হাতিয়ার মাত্র

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়



অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি মূলত— আর্থনীতিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক— গভীর বৈশ্বিক বৈষম্যের একটি লক্ষণ। মানুষ তাদের জীবনকে উপড়ে ফেলতে বা ছিন্নমূল হতে চায় না। কেউই বাধ্যতামূলক কারণ ছাড়া এক অচেনা, অজানা, অনিশ্চিত ও প্রায়শই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যায় না। আসলে, সীমানা রাষ্ট্র দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে, কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির হতাশা মানচিত্রের রেখা দ্বারা আবদ্ধ নয়।

অবৈধ অভিবাসন তখনই ঘটে যখন আইনি পথগুলি মানুষের প্রত্যাশা পূরণে অসমর্থ হয়ে পড়ে। অবৈধভাবে অভিবাসনকারী বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র্য, সংঘাত, রাজনৈতিক নিপীড়ন, জলবায়ু বিপর্যয়, যুদ্ধ অথবা তাদের নিজ দেশে পদ্ধতিগত অস্থিতিশীলতা থেকে পালিয়ে বেড়ায়। তাই অবৈধ অভিবাসন কেবল একটি আইনি সমস্যা নয় বরং একটি নৈতিক ও কাঠামোগত সামাজিক সমস্যা। এখানে শোষণের তীব্রতা ঢের বেশি। যেমন, অভিবাসীরা (আইনি হোক বা না হোক) প্রায়শই যে অর্থনীতি ও সমাজে যোগদান করে, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, কম পয়সায় প্রয়োজনীয় কাজ ও কর প্রদান করে, অথচ খুব কম সুরক্ষা বা স্বীকৃতি পায়। তবুও কাঁটাতার পেরিয়ে এরা চলে আসতে চায়, কারণ, অর্থ ও মর্যাদার চেয়েও তখন জরুরি নিরাপত্তা ও শান্তি।

অবৈধ অভিবাসন সম্পর্কে আলোচনাগুলি প্রায়শই সহানুভূতি, তথ্য বা দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাভাবনার পরিবর্তে ভয়-সৃষ্টি, উগ্র-জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক সুবিধা দ্বারা পরিচালিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালে তৎকালীন ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল সংসদে বলেছিলেন যে ভারতে ১ কোটি ২০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে; ২০১৬ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু ভারতের সংসদে বলেছিলেন, 'ভারতে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় ২ কোটি অবৈধ অভিবাসী রয়েছে', আবার বাংলাদেশি নাগরিকদের ‘উইপোকার’ সঙ্গে তুলনা করে ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০১৮ সালে বলেছিলেন, বিজেপি ৪০ লক্ষ অবৈধ অভিবাসীকে চিহ্নিত করেছে। 

অথচ ‘ইকোনমিক টাইমস’এর ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে দেশে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। সরকারের হলফনামায় বলা হয়েছে, অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্তকরণ ও বহিষ্কার একটি জটিল এবং চলমান প্রক্রিয়া কারণ তাদের নথিভুক্ত প্রবেশ নেই। অথচ, কখনও ১ কোটি ২০ লক্ষ, কখনও ২ কোটি আবার কখন ৪০ লক্ষ দাবি চলতেই থাকে। কীসের ভিত্তিতে এই সব দাবি করা হয়, কখনও কোনও নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না। 

ভারতে অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্যের একমাত্র উৎস হল ‘সেন্সাস’ বা আদমশুমারি। ভারতে অভিবাসন সম্পর্কিত তথ্য আদমশুমারি'র D-Series'এর মধ্যে পাওয়া যায়। এই সারণিগুলি জন্মস্থান, শেষ বাসস্থান, বসবাসের সময়কাল, অভিবাসনের কারণ এবং বয়স, লিঙ্গ, বর্ণ, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও বৈবাহিক অবস্থা ধরনের সামাজিক-জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মতো বিভিন্ন পরামিতির (parameter) উপর ভিত্তি করে অভিবাসী জনসংখ্যাকে শ্রেণিবদ্ধ ও বিশ্লেষণ করে। যেমন, D-01 ও D-02 সিরিজ জন্মস্থান এবং শেষ বাসস্থান অনুসারে জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে তথ্য প্রদান করে, লিঙ্গ ও থাকার সময়কাল অনুসারে বিভক্ত। D-02 (SC/ST) টেবিলগুলি বিশেষভাবে তফসিলি জাতি ও উপজাতি অভিবাসীদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, সাধারণ টেবিলের মতোই বিশদ বিবরণ সহ। D-03 সিরিজটি আন্তঃরাজ্য অভিবাসন, অভিবাসনের কারণ এবং সময়কাল পরীক্ষা করে, যার মধ্যে শহর-নির্দিষ্ট ও শহুরে সমষ্টিগত তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। D-04 থেকে D-10 টেবিলগুলি বয়স, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও বৈবাহিক অবস্থার আরও গভীরে যায়, যা অভিবাসী কর্মীদের, বিশেষ করে যাদের সাম্প্রতিক অভিবাসনের ইতিহাস (0-9 বছর) রয়েছে তাদের সম্পর্কে একটি সূক্ষ্ম ধারণা প্রদান করে। প্রত্যেকটি রাজ্যের জন্য আলাদা-আলাদা টেবিল সেখানে থাকে। 

ভারতে অভিবাসনের তথ্য সংগ্রহ ১৮৭২ সালে শুরু হয়েছিল, যা প্রাথমিকভাবে জন্মস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৬১ সালে পরিধিটি গ্রামীণ/শহুরে অবস্থা এবং বাসস্থানের সময়কাল অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রসারিত হয়েছিল। ১৯৭১ সাল নাগাদ শেষ বাসস্থানের স্থান সম্পর্কিত তথ্য যোগ করা হয় এবং ১৯৮১ সালে পরিযানের কারণ সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন চালু হয়। ১৯৯১ ও ২০০১ সাল পর্যন্ত এই বিন্যাসটি মূলত অপরিবর্তিত ছিল, ছোটখাটো সমন্বয় সহ— যেমন, ২০০১ সালে গ্রামীণ/শহুরে বিবরণ বাদ দেওয়া ও কারণ হিসাবে ‘জন্মের সময় স্থানান্তরিত’ যোগ করা ইত্যাদি। 

আন্তর্জাতিক অভিবাসন, দেশভাগের পর এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের ফলে প্রচুর পরিমাণে অভিবাসীর আগমন ঘটে। ২০০১ সালের হিসাবে ৫১ লক্ষ আন্তর্জাতিক অভিবাসী ভারতে ছিলেন— ৩০ লক্ষ বাংলাদেশ থেকে, ৯ লক্ষ পাকিস্তান থেকে, ৫ লক্ষ নেপাল থেকে এবং ১ লক্ষ শ্রীলঙ্কা থেকে। তবে, ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক অভিবাসন তীব্রভাবে (৩১.৬ শতাংশ) হ্রাস পায়। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, ভারতে প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষ তাদের শেষ বাসস্থান দেশের বাইরে বলে জানিয়েছেন। এই অভিবাসীদের মধ্যে ৪২ শতাংশ বাংলাদেশ (২৩ লক্ষ) ও ১২.৭ শতাংশ পাকিস্তান (৭ লক্ষ) থেকে এসেছে, যেখানে আফগানিস্তান থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬,৬০০। বাংলাদেশি (৭৬ শতাংশ) এবং পাকিস্তানি (৭৯ শতাংশ) অভিবাসীদের বেশিরভাগই ১৯৯১ সালের আগে ভারতে বসবাস করছিলেন, মূলত দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরে ব্যাপক অভিবাসনের কারণে। ১৯৯১ সালের পরে যারা ভারতে প্রবেশ করেছিলেন তাদের সংখ্যা ছিল এই দুই দেশ থেকে আসা মোট অভিবাসী জনসংখ্যার ২১ শতাংশেরও কম। ২০১১ সালে নতুন আগমন আরও কম ছিল, প্রায় ২২,০০০ বাংলাদেশি এবং ৬,৪০০ পাকিস্তানি ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, যারা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ অভিবাসী জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম প্রতিনিধিত্ব করেন। অর্থাৎ, সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান।

অন্যদিকে অভিবাসনের মূল তথ্য প্রদানদাকারী উৎস আদমশুমারির প্রধান সীমাবদ্ধতা হল যে এটি দশ বছর অন্তর গৃহীত হয়। যার অর্থ, ২০১১ সালের পর ভারতে প্রবেশকারী মানুষের কোনও আপডেটেড গণনা নেই। ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই সংসদে বলেছিলেন যে অবৈধ অভিবাসীদের গোপনে প্রবেশের কারণে তাদের সম্পর্কে কোনও সঠিক কেন্দ্রীয় তথ্য নেই। বেশিরভাগ বাংলাদেশি অভিবাসী অর্থনৈতিক অভিবাসী বা শরণার্থী নন, কারণ তারা ধর্ম, জাতিগত বা রাজনীতির কারণে পালিয়ে আসেন না। তাই, তারা ভারতে শরণার্থী মর্যাদার জন্য যোগ্য নন। কিন্তু যদি তথ্যের বিচার করা হয় তাহলে যে প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি করে ওঠে তা হল, যদি ভারতে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসনের সংখ্যা এতই বেশি হবে তাহলে কেন নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ হয় না? ২০২১ পেরিয়ে ২০২৫ হয়ে গেল, আদমশুমারির কোনও নামগন্ধ নেই। আর আলাদা করে অভিবাসনের জন্য কোনও সমীক্ষাও নেই (ব্যতিক্রম, পর্যায়ক্রমিক শ্রমশক্তি জরিপ, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে প্রায় ১.২ লক্ষ পরিবারের নমুনা আকার অন্তর্ভুক্ত করে যা কাজের জন্য আন্তঃরাজ্য অভিবাসনের সঙ্গে যুক্ত)। অথচ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থা নিয়ে বহু সমীক্ষা আছে, অভিবাসন নিয়ে নেই, যেখানে এত বিতর্ক দানা বাঁধছে। ফলে অবশ্যই প্রশ্ন ওঠে, রাজনৈতিক ফায়দার অঙ্কই কি সমীক্ষা না করানোর কারণ? 

অন্যদিকে দেখুন, বিদেশ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী রাজ্য ও বছরভিত্তিক অবৈধ অভিবাসন/মানব পাচারের মামলার সংখ্যা ২০১৬ সালে ছয়টি রাজ্য থেকে মোট ৪২টি অনুমোদিত হয়েছিল। সর্বাধিক সংখ্যাটি তামিলনাড়ু (১৫), তারপরে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা (৯), পাঞ্জাব (৮), কেরালা (৪), রাজস্থান (৪) ও মহারাষ্ট্র (২) থেকে এসেছে। ২০১৭ সালে (৩০ নভেম্বর পর্যন্ত), সাতটি রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে ৩০টি মামলা মঞ্জুর হয়েছিল। তেলেঙ্গানা (১০) শীর্ষে ছিল, তারপরে কেরালা (৫), তামিলনাড়ু (৫), রাজস্থান (৫), পাঞ্জাব (৩), দিল্লি (১) এবং গোয়া (১)। উভয় বছরেই সমস্ত অনুরোধকৃত মামলার অনুমোদন জারি করা হয়েছিল।

দুনিয়াতে যতগুলি বড় ধরনের অভিবাসন ঘটেছে গুগল করে তার ছবি দেখুন, দল বেঁধে সার দিয়ে কাতারে-কাতারে লোক ঢুকে পড়ছে। অথচ শেষ পাঁচ বছরে, কি রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি কোনও ক্ষেত্রেই এরকম কোনও ছবি আমাদের চোখে পড়েছে কী? যদি পড়ত তাহলে বিএসএফ কী করছিল? তবে এও বলা জরুরি যে, 'অবৈধ অনুপ্রবেশ' কি ঘটেনি? নিশ্চয় ঘটেছে? বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশেই ঘটে। কিন্তু তার সংখ্যা কি কোটি-কোটি বা লাখ-লাখ হতে পারে? পারে না, বড়জোর কয়েকশো বা কয়েক হাজার সর্বাধিক হতে পারে।

তাহলে ভোটার কার্ড সংশোধনীর মতো আবশ্যক ও জরুরি কাজের পিছনে এত মিথ্যা প্রচার কেন? কারণ, মুসলমান ও আর্থনীতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর উপর লক্ষ্যবস্তুগত হয়রানি তৈরি করে নির্বাচনী ফায়দা তোলা। সামগ্রিকভাবে, অভিবাসী-বিরোধী বক্তব্য ও নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়শই তথ্য-ভিত্তিক সমর্থনের অভাব থাকলেও এটি সাম্প্রদায়িক স্টেরিওটাইপ, ভাষা প্রোফাইলিং ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লক্ষ্যবস্তুর উপর নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলিকে বিশেষ সুবিধা দেয়। ফলে, যখন নির্বাচন নিকটে এবং সেখানে জেতাটা প্রায় অসম্ভব, সেখানেই এই কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে। দেশবাসীও কাকে কান নিয়ে গেল বলে কাকের পিছনে ধাওয়া করছে কিন্তু কেউ কানে হাত দিয়ে দেখতে চাইছে না যে আদৌ কান কি কাক নিয়ে গেল? তথ্যই নেই অথচ দাবি আছে-- এই তথ্যহীন দাবিকে কি মানুষ পাত্তা দেবে? তবে আজকাল হোয়াটস অ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশের হার এত বেশি যে কী হবে বলা কঠিন।


Tuesday, 22 July 2025

'কল করেছেন আজব রকম...'

অবিশ্রান্ত দৌড়

ঋতম ঘোষ



ছুটছি মোরা ছুটছি দেখ, ছুটছি মোরা হল্লা দি,

সবাই মিলে জটলা করে ছোটার সাথে পাল্লা দি। 


আজ এই একবিংশ শতাব্দীর মধ্যগগনে দাঁড়িয়ে সুকুমার রায় হয়তো এভাবেই আজকের পৃথিবীকে দেখতেন। পিঠের সঙ্গে অলৌকিক ভাবে সংযুক্ত সেই কল, যার আবেশে মানুষ যন্ত্রবৎ সম্মুখে ধাবমান। এই দৌড়নোয় ব্যক্তি মন এতটাই আবিষ্ট যে, সে তার সহজাত মানবিক প্রজ্ঞার পথ থেকে চ্যুত। ফলত, প্রকৃত ‘আহ্লাদ’ই এখন মানবজীবনের সংকট ও অতি দুর্লভ বস্তু হিসেবে দৃষ্ট।

প্রযুক্তি, নগরায়ন ও অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় জীবনযাত্রার ধরন আজ আমূল পরিবর্তিত। থেমে থাকলেই পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত সকলেই। এই গতিময়তার বাহ্যিক প্রভাব আমরা সজ্ঞানে উপলব্ধি করতে অপারগ। কারণ, আজ সভ্যতার চক্র গতি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু তা হয়তো একই সঙ্গে মানবচিত্তকে অনেকাংশে পশ্চাদগামীও করে তুলেছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ও কৄত্রিম বুদ্ধিমত্তা মুঠোবন্দী করেছে সমগ্র বিশ্বকে। কিন্তু এই বুদ্ধিবৄত্তির সুপ্রভাবে উদ্ভূত উপাদানাদি, কতিপয় উপযোগিতার পাশাপাশি, মানব মননের সুকুমার বৃত্তিগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জীবনযাত্রার যান্ত্রিকতায় মনের স্বাভাবিক সহজতা সংক্রমিত হচ্ছে। পূর্বে যে ব্যক্তি কিছু সময় হলেও বৈষয়িক ধ্যানধারণা ও জড়বাদী পৃথিবী থেকে ক্ষণিকের বিশ্রাম নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসায় নিমগ্ন হত, অবকাশ যাপন করত সাহিত্য, শিল্প বা তার আত্মিক ভাবনা জগতের সঙ্গে, সেই মূহুর্ত আজ বিরল। মন আজ অতিশয় প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন। মানব মননের অন্যতম যে গুণ মনোসংযোগ, যার বলে সে দীর্ঘকালীন কোনও প্রক্রিয়ায় ধৈর্য ও সংযমের সঙ্গে ন্যস্ত থাকতে পারে, তার লেখচিত্রও নিম্নগামী। ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার বোমারু প্রবণতা ও টুকরো টুকরো অর্থহীন অথচ সাময়িক সুখপ্রদ দৃশ্যাবলীতে আমাদের মস্তিষ্ক ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে, ফলত অজ্ঞাতেই আমাদের অন্তর্দৃষ্টি লুপ্ত হচ্ছে এবং অহেতুক অধৈর্যপনা আজকের জীবনযাত্রায় একটি অতি স্বাভাবিক গুণ হিসেবে প্রকাশিত। 

সম্প্রতি মাইক্রোসফট'এর একটি বিজ্ঞাপনী প্রচার বিষয়ক সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে, একজন মানুষের স্বাভাবিক মনোযোগ ব্যাপ্তি (Average attention span) ক্রমহ্রাসমানতায় ৮.২৫ সেকেন্ডে এসে দাঁড়িয়েছে, যা একটি গোল্ডফিশের মনোযোগ ব্যাপ্তির সমতুল্য; বরং তাদের মনোযোগ ব্যাপ্তি মানুষের তুলনায় কিছুটা বেশি (৯ সেকেন্ড'এর কাছাকাছি)। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জানাচ্ছে যে, বর্তমানে ৭০ শতাংশ মানুষ কোনও বিষয়ে ২০ মিনিটের বেশি সময় ধৈর্য ধরে থাকতে অক্ষম। মাল্টি-টাস্কিং, অনর্গল তথ্যাদি ও অহরহ বিজ্ঞাপনের প্রভাব মনোসংযোগের মজবুতিতে ঘূণ সঞ্চার করছে।

গতি আমাদের আরও গতির জন্য প্ররোচিত করে। আমাদের সজ্ঞান মন ধীরে চলতে বা প্রয়োজনে থামতে ভুলে যায়। থামা আসলে থেমে যাওয়া নয়। থামা, পুনরায় চলতে আরম্ভ করার পূর্ব ধাপ, যেখানে চিন্তাশীল মনন আমাদের আগামী সফর সম্পর্কে সচেতন করায় ও অবস্থান নির্বিশেষে তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে শেখায়। কিন্তু এই সদা প্রতিযোগিতামূলক প্রবণতা মনুষ্যত্বের নৈতিক চেতনা বিকাশের পথে আজ অন্তরায় হয়ে উপস্থিত। সুস্থিত জীবনযাপন যেন ইউটোপিয়া। ২৪x৭ প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্তি, অ্যালগরিদম চালিত মানব মননের একমুখী সংহতিকরণ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক চাপানউতোর ব্যক্তিকে এমন কতকগুলি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে যে সে অভ্যন্তরীণ স্থৈর্য ও মানবিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ স্থিতিশীল জীবনশৈলীর সঙ্গে আপস করে বসছে। অজান্তেই এমন এক ঘূর্ণাবর্তের শিকারে পরিণত হচ্ছে যেখানে হ্যামস্টারের মতোই ইচ্ছা, অনিচ্ছা ব্যতিরেকে তাকে সেই আবর্তনীর ভিতর অবিশ্রান্তভাবে দৌড়তে হচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার চিন্তক বিউং চুল-হান এই সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার এক বিশ্লেষিত চিত্র এঁকেছেন। জন্মসূত্রে কোরিয়ান হলেও তিনি মূলত জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক এবং একজন প্রশংসিত সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক। ফুকো পরবর্তী আজকের এই যুগের যে চিত্রকে তিনি পাঠককের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছেন সেখানে তিনি উল্লেখ করছেন কয়েকটি পরিণতির কথা, যেমন বার্নআউট সোসাইটি, দ্য সোসাইটি অফ টায়ার্ডনেস, দ্য সেন্ট অফ টাইম প্রভৃতি। খুব সাধারণভাবে বললে এমন দাঁড়ায় যে, আমরা বর্তমানে একটি অতি সক্রিয় (Hyperactive) সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস করছি যার প্রথম উপসর্গ অবিশ্রান্ততা। বিশ্রাম না নিয়েও আমরা ক্রমাগত আমাদেরই আরও এক শ্রেষ্ঠতর সংস্করণে পরিবর্তিত হবার ঝোঁকে অহর্নিশ এক নিরন্তর প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। অবচেতন এক বীরত্বপূর্ণ মরীচিকার দিকে ধাবমানরত। চুল-হান তাঁর পূর্বসূরি মার্টিন হেইডেগার, হান্না আর্ডেন্ট প্রমুখ তাত্ত্বিকদের সাহায্যে দেখাচ্ছেন যে মানুষ আজ তার সহজাত মানবিক সত্তা হারিয়ে একটি জান্তব শ্রমসর্বস্ব প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। সদা সক্রিয় অস্থির মনোভাব ক্রমাগত তার অন্তর্জগৎ'কে পঙ্গু করে চলেছে। মানবসমাজ সম্মুখীন হচ্ছে ADHD (Attention Deficit/ Hyperactivity Disorder), BPD (Borderline Personality Disorder)'এর মতো রোগের। 

ভাইরাস, ব্যাকট্রিয়াল যুগ অতিক্রম করে আজ আমরা এমন একটি সময়ে পদার্পণ করেছি যেখানে আমাদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সত্ত্বেও আমরা সংক্রমিত হয়েছি স্নায়বিক রুগ্নতায়। অত্যধিক ইতিবাচকতায় আজকের জীবনযাত্রা পর্যুদস্ত। আর এই অতি-ইতিবাচক মনোভাবের ফলাফল স্ব-শোষণ, যা ঘটে চলেছে আমাদের অজান্তেই। অপরিমিত করতে পারার প্রবণতা সদাই আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সময় বিশেষে 'হয়তো না' বা দৃঢ়চিত্তে 'না স্বীকারকে' দুর্বল চিত্তের লক্ষণ বলে মনে করে একটি রসকষহীন বাহ্যিক প্ররোচনার ফাঁদে আমরা ক্রমশ নিমজ্জিত হচ্ছি। ফলত, ব্যক্তি বিশেষকে ওই পূর্বোক্ত ক্রিয়াগুলি 'হ্যাঁ আমি পারি', 'আমার করা উচিত' বা 'আমরা পারি ' বলিয়ে নিয়ে তাঁর মনকে এক মাত্রাতিরিক্ত ইতিবাচকতায় ভরিয়ে দিচ্ছে। সামগ্রিকভাবে ব্যক্তি বিশেষের কার্যক্ষমতা বা উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বটে, কিন্তু তা কেবল এই কৃতিত্ব সর্বস্ব সমাজের সর্বাঙ্গীন চাহিদা মেটাতেই ব্যবহৃত হচ্ছে। না সেখানে লক্ষ করা যাচ্ছে ব্যক্তি মননের স্বাতন্ত্র্য, না তা পরিচয় দিচ্ছে গভীর উৎকর্ষ চেতনার।

আর এ হেন পরিবেশে প্রত্যেক ব্যক্তিও নিজেকে এভাবেই অভ্যস্ত করে নিচ্ছে যা এই কোনওরকম অনুভূতিহীন, জ্বলে যাওয়া বা ঝলসে যাওয়া মননের বিস্তারকে তরান্বিত করছে। ব্যক্তি সাধারণ এই অবস্থাকে উপলব্ধি করতে অপারগ। এই শ্রান্তি বা অস্থিরতাকে উপেক্ষা করেও আমরা আমাদের জীবন চালনাতে বড় একটা  সমস্যা-তাড়িত হচ্ছি না। বরং উল্টোটাই; আরাম আয়েসেই দিন কাটছে।

এখন নিন্দুকগণ বলবেন, তাহলে আর সমস্যা কোথায়? কিন্তু সমস্যা এখানেই যে রোগ যখন কোনওরকম উপসর্গ ছাড়াই শরীরে বাসা বাঁধে তখন তাকে চেনার কোনও উপায় থাকে না। কখনও ছোটোখাটো সমস্যা দেখা দিলেও রোগী সেই দুশমনকে স্বমনেই পুষে রেখে জীবনযাত্রা সচল রাখে। এর পরিণতি হয় ভয়ানক। সঞ্জীবনীও সেই মারণযন্ত্রণার কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

উপায়? 

এই যে গতিময় জীবনের আধিক্য আজ রাজপথে নির্বিবাদে বিচরণ করছে তাকে কিছুটা সংযমের লাগামে সিক্ত করতে হবে। অযথা প্রতিযোগিতায় না ভিড়ে সুস্থ, স্বাভাবিক চিত্তে সহিষ্ণুতা, সহানুভূতিশীল ও বিবেক পরবশ হয়ে প্রতিযোগীদের সারি থেকে পৃথক হয়ে চলার প্রয়াস নিতে হবে। অভিমুখ নির্বাচন করতে হবে মননশীল অনুশীলনের মাধ্যমে। আত্মসমীক্ষা ও আত্মউপলব্ধির উপর আস্থা রাখলে তবেই হয়তো তা প্রসন্ন দীপ্তিতে উদ্ভাসিত করবে মানব চিত্তের অন্দরমহলকে।


Monday, 14 July 2025

আরও এক মৃত নদী বাঁচানো

মরালী নদীর পুনরুজ্জীবন চাই

বিবর্তন ভট্টাচার্য



মৃত নদী বুড়িগঙ্গা প্রাণ ফিরে পেতেই চাকদহ ব্লকে হৈ হৈ পড়ে গিয়েছে। মৃত নদীতে জোয়ার-ভাঁটা খেলছে দেখে এলাকার মানুষ দারুণ ভাবে উৎসাহিত। হরিণঘাটা ব্লকের প্রাক্তন এমএলএ একদিন আমাকে অনুরোধ করলেন, বুড়িগঙ্গা তো অনেকটা সংস্কার হল, এবার মরালী নিয়ে একটু ভাবুন।  আসলে নদিয়া জেলা হল নদীর জেলা। এই জেলায় প্রধান নদী ছয়টি; যেমন, গঙ্গা, ইছামতী, চূর্ণী,  মাথাভাঙা, জলঙ্গী, অঞ্জনা। এছাড়াও প্রচুর মৃত নদী আছে; এগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, মরালী, যমুনা উল্লেখযোগ্য। তাই শুরু হল পর্যবেক্ষণ।  

চাকদহ ব্লক অঞ্চলে অবলুপ্ত নদীগুলোর মধ্যে মরালী একটি। মরালীর ইতিহাস খুঁজে পাওয়া এতটাই কঠিন আর কোন দশকে এই নদী একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে তা' অনুমান করাও বেশ শক্ত। রেনেল সাহেব কৃত ১৭৬৪ সালের একটি মানচিত্রে মরালী নদীর প্রবাহপথ হিসেবে চাকদহ শহরের দেড় মাইল উত্তরে সামান্য এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি সরু সংকীর্ণ জলরেখা দৃষ্ট হয়। এছাড়া ১৯১৭-২১ সালে সার্ভেকৃত ও ১৯৩১ সালে প্রকাশিত চাকদহ থানার মানচিত্রে ওই গতিপথ বরাবর সর্পাকৃতি একটি জলরেখা হিসেবে চিহ্নিত আছে। তবুও পূর্বদিকে বনগ্রাম থানার মানচিত্রেও ওই গতিপথ অঙ্কিত আছে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে ওই নদীকে মরাইল (MORAIL) বিল নামে অভিহিত করা হয়েছে। বর্তমানে যেমন অঞ্জনা নদীকে সরকার খাল বানিয়েছে, কারণ, খাল-বিল-বাঁওড় বিক্রি করা অত্যন্ত সহজ। তাই নদীকে খাল বানাও।  

মরালী নামের উৎপত্তি কোথা থেকে তা' বলা কঠিন। এমন কত অজানা অখ্যাত নদী স্নেহময় সুধায় পলি দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের কল্যাণ সাধন করে গিয়েছে অথচ তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া ভার। আজও জগৎ সংসারে কত মানুষ নীরবে জগতের হিতসাধন করে থাকেন কিন্তু তাঁদের কথাই বা কজন মনে রাখে? তেমনই এককালের মঙ্গলদায়িনী মরালীও হারিয়ে গিয়েছে ইতিহাসের অতল তলে।

মরাল থেকে মরালী নাম হওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মুরলীগঞ্জ থেকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব দিয়ে ভাগীরথী পর্যন্ত একটি সহজ জলপথ ছিল। সেই জলপথই মরালী। মরালীর যে বৃহত্তর অংশটুকু এখন নদীর আকারে আছে, তার বুকে চড়া পড়ে নদীর প্রবাহ বন্ধ। এই মরালীর ওপর রাজ্য হাইওয়ে এবং বড় বড় ইমারত গড়ে উঠেছে। নদীটি ভাগীরথী থেকে বেরিয়ে যে যমুনাতে গিয়ে মিশেছে, তা' খানিকটা বোঝা গিয়েছিল ২০০০ সালের বন্যার সময়। বর্তমানে তা হেড়ের খাল ও পূর্ব বিষ্ণুপুর হয়ে শ্রীনগর, হিঙনাড়া, বল্লভপুর, বৈরামপুর, বৃদ্ধপাল্লা, পাল্লা, গোপালনগর দিয়ে যমুনাতে মিশেছে। কিন্তু মরালীতে জল সরবরাহকারী ১৭টি বিল-বাঁওড়ের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গাঙ্গরা বিল, ধর্মদহ বিল, নেউলিয়া বিল, সাতশলাকি বিল, ট্যাংরা খাল, মরালী বিল, পারুলিয়া বিল, শ্রীরামপুর খাল, কচুয়া বিল, বড় বিল,  কামডোব বিল, গা বিল, হাতিবাঁধা বিল, চেতলা বিল, চুমুকদহ বিল, মাতলা বিল, ঢাকা বিল-- এগুলো সবই মরালীর জল সরবরাহকারী খাল বিল।

আনুমানিক ১৫ কিমি হেজে ও মজে যাওয়া এই নদীতে কোনও এক সময়‌ কুমীরের বাস ছিল। আর এই মরালী নদীর মৃত্যুর ফলে যমুনা নদীরও মৃত্যু ঘটেছে। যমুনা নদী ভাগীরথী থেকে বিরহীর পাশ দিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক পার হয়ে হরিণঘাটা হয়ে গোবরডাঙা রেল স্টেশনের তলা দিয়ে ইছামতীতে গিয়ে মিশেছে।



২০০০ সালের প্রবল বন্যার পর এলাকার মানুষ মরালী নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। বুড়িগঙ্গার মতো হেজে যাওয়া নদী যদি প্রাণ ফিরে পায় তবে মরালীতে কেন প্রাণসঞ্চার হবে না? প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর পাড়ে অন্তত ২ লক্ষ মানুষের বসবাস। এখনও প্রচুর মৎস্যজীবী ও কৃষিজীবী মানুষ মরালী নদীর ওপর নির্ভরশীল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয় এই মরালী নদী। তিনি এই নদীপথেই সপ্তগ্রাম পর্যন্ত যাতায়াত করতেন। মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস এই নদীর উভয় পার্শ্বস্থ গ্রামগুলোতে। মরালী নদী সংস্কার হলে যমুনার জল বৃদ্ধি পাবে। ফাঁসতলা, খেদাইতলা, সাতশলাকি গ্রামের মানুষ ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মরালী নদীর সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন।

দীর্ঘ দশ বছর নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে চাকদহ বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা এবং দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম'এর উদ্যোগ ও আন্দোলনে বুড়িগঙ্গাতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। এই অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে তাই এবার মরালী নদীর পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা। ২০২৪'এর সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে একাধিকবার সরেজমিন পর্যবেক্ষণে ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মরালী নদীর ছয়টি অবস্থা দেখা গেছে:

১) মহানালা, মসরা ও মথুরাপুর এলাকায় নদী অত্যন্ত সংকীর্ণ অবস্থায় হিউম পাইপ বা কালভার্ট'এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত;

২) ইছাপুর এলাকায় নদীর বুকে বাঁধ দেওয়া হয়েছে;

৩) পারাই গ্রামে নদীতে কোথাও শৈবাল দাম আবার কোথাও কালচে জল;

৪) মথুরাগাছি এলাকায় নদী অন্তঃসলিলা;

৫) সাতসলাকি, খেদাইতলা এলাকায় নদী দিগন্ত বিস্তৃত বিলের মধ্যে হারিয়ে গেছে;

৬) সাতাশী ও নহাটা এলাকার কয়েকটি জায়গায় নদীর খাত দখল হয়ে গেছে।

বস্তুতপক্ষে, মরালী নদী তিনটি ব্লকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত-- চাকদহ, হরিণঘাটা ও বনগ্রাম। ফলে, এই নদীর পুনরুজ্জীবনের জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রামের মানুষের উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন। আমাদের ধারণা, ১০০ দিনের কাজের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এই কাজ সম্ভব। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবিত হবে, মৎস্য চাষের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, মানুষ খেয়েপরে বাঁচবে এবং এলাকার মানুষের অন্যত্র কাজের খোঁজে চলে যাওয়া হ্রাস পাবে।


Sunday, 13 July 2025

আরও এক অগ্নীশ্বরের কথা

স্বপ্ন জমাট বাঁধা

মালবিকা মিত্র



কোথাও একটা সংঘর্ষ হয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছে। তাদের আনা হয়েছে ডাক্তারখানায়। ডাক্তারবাবু একে একে সব রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা করছেন, প্রয়োজন মতো পরামর্শ দিচ্ছেন। সমবেত ও উত্তেজিত ছোকরার দল ডাক্তারবাবুকে বলছেন, 'আপনি আগে আপনার ছেলেটাকে দেখুন, ওর অবস্থা খুব খারাপ। আপনার ছেলেটা মরে যাবে, ওকে আগে দেখুন।' গল্পের ক্লাইম্যাক্স'এ ডাক্তারবাবু বলছেন, ও তো আগেই মারা গেছে। ওকে দেখে আর কী হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট গল্প 'রক্ত নোনতা'। স্মৃতি থেকে উল্লেখ করলাম। ছেলের দল বলল, 'দেখছেন না, এখনও রক্ত পড়ছে।' ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, 'মৃত্যুতেই রক্তপাত শেষ হয়ে যায় না।' 

গল্পটা মনে পড়ছে, কারণ দুটি: 

১) চুঁচুড়া থেকে এক পেশেন্টকে রেফার করা হয়েছে কলকাতা মেডিকেল কলেজ। যথেষ্ট পরিমাণ ওষুধ ইনজেকশন দিয়ে, যাতে এই দীর্ঘ পথ চলতে পারে। কলকাতার ডাক্তার নানা চেষ্টা করে পেশেন্টের সাড়া পেলেন না। তিনি জানালেন, পেশেন্ট কোমায় চলে গেছে। সেই রাতে খবর পেয়ে বাড়ির লোকজন পড়িমরি ছুটল হাসপাতালে। কোথায় কী? বেড ফাঁকা, পেশেন্ট নেই। কোথায় গেল? কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, বাথরুম থেকে স্নান করে পেশেন্ট বেরিয়ে আসছে। আসলে চুঁচুড়া থেকে যে সব ওষুধ দেওয়া হয়েছিল তার ফলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। ডাক্তার সেটাকেই ভেবেছে কোমা। মাত্র দিন দশ আগের কথা। 

২) আজই (১২ জুলাই ২০২৫) সংবাদে প্রকাশ, ঘরের ভিতরে বাবার মৃতদেহ। বাইরের ঘরে একের পর এক রোগী দেখে চলেছেন চিকিৎসক ছেলে। দুর্যোগের দিনে বৃষ্টি মাথায় করে রোগীরা এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে। তাদের দেখে চিকিৎসা করে তারপরেই বাবার শেষকৃত্যে সামিল হলেন ডাক্তারবাবু। এমনই ব্যতিক্রমী ঘটনাটি ঘটেছে চুঁচুড়ার ইমামবাজার অঞ্চলে। চিকিৎসকের নাম ডাক্তার শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। চুঁচুড়া পুরসভার কাউন্সিলার ইন্দ্রজিৎ দত্ত (বটা) বলেন, অনেক গরিব মানুষ ডাক্তারবাবুর কাছে আসেন। রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত বসে ডাক্তারবাবু রোগী দেখেন। কোনও নির্দিষ্ট ভিজিট নেই, যে যা সামর্থ্য দেয়। তাঁর কোনও চাহিদা নেই। এমন ডাক্তারবাবুর জন্য গর্ববোধ করি আমরাও। 



এই সংবাদ পাঠ করে ভেতর থেকেই খুব তাগিদ অনুভব করি কিছু লিখবার। প্রথমত বলে রাখি, আমার বাড়ি ভদ্রেশ্বরে। স্কুলের শিক্ষকতা করতে যেতাম চুঁচুড়ায়। আমার বহু ছাত্র, অভিভাবক এমনকি সহকর্মীরা প্রায় সকলেই এক বাক্যে ডাক্তার শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা সকলেই ওনার পেশেন্ট। দূরের রোগীদের ট্রেন বাস লঞ্চ পাওয়ার সমস্যা থাকে, তাই তাদের আগে ছেড়ে দেন। বেশি রাতে দেখেন স্থানীয় রোগীদের। আমি নিজে রাত্রি দুটোয় ডাক্তারবাবুকে ফোন করে সমস্যার কথা জানিয়েছি। পরদিন সটান স্কুলে ওষুধ হাজির। কারণ, ওই সময় আমার স্কুলের এক অভিভাবক ডাক্তারবাবুর সামনে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর হাত মারফত পরদিন ওষুধ পৌঁছে গেল আমার হাতে। 

এক অবিচ্ছেদ্য ২৩ বছরের সম্পর্ক আমার সঙ্গে। প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সকল রোগীর সঙ্গে আমিও অপেক্ষমান। সেখানে চেয়ারে বসে আছেন এক অশীতিপর বৃদ্ধা। সমস্ত রোগীদের সঙ্গে তিনি গল্প করছেন। দেখলাম অনেকের সঙ্গেই তাঁর গভীর পরিচিতির সম্পর্ক। পরিবারের লোকজনের খবরাখবর নিচ্ছেন। একটি উনিশ শতকীয় বাড়ির একতলায় আমরা বসে আছি। এরই মধ্যে ডাক্তারবাবু রোগী ডেকে নিচ্ছেন একে একে। প্রায় সবসময়ই জনা ত্রিশ রোগী থেকে যাচ্ছে। আমি অন্যদের কাছ থেকে জানলাম, ওই বৃদ্ধা ডাক্তারবাবুর পিতামহী। একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, ডাক্তারবাবু খেতে যান কখন? ওপরেই তো ওনার ঘর। বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, 'খাওয়া-দাওয়ার কোনও সময়ের ঠিক নেই। ছেলেটা এই করেই অসুস্থ হয়ে যাবে। কোনওদিন চারটে, কোনওদিন পাঁচটা, কখনও বা সাতটায় দুপুরের খাওয়া।' ডাক্তারবাবু আমার ছাত্র না হলেও আমার স্কুলের প্রাক্তনী। তাই, একটু অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতার দাবিতে বলতাম, নাতির একটা বিয়ে দিয়ে দিন, তাহলেই একটু নিয়মে বাঁধা যাবে।

একদিন দেখলাম, রোগীদের বসার ঘরে ঠাকুমার সেই চেয়ারটা শূন্য। দেয়ালে ফ্রেমবন্দী হয়েছেন ঠাকুমা। এছাড়া দেখতাম, ফর্সা ধবধবে দীর্ঘকায় ডাক্তারবাবুর বাবা। কখনও উপর থেকে নামছেন, বাইরে যাচ্ছেন। কখনও বা বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকছেন। মুচকি হাসি, অল্পসল্প কথা বিনিময় হত। তিনি একবার দাঁড়িয়ে বলতেন, 'কতক্ষণ?' হয়তো বললাম, প্রায় তিন ঘন্টা। উনি বলতেন, কে জানে আরও কত ঘন্টা! ও নিজেও কি জানে ও কখন খায়, কখন ঘুমায়। এভাবে চললে ও বেশিদিন চালাতে পারবে না। আজ (১২ জুলাই ২০২৫) খবরের কাগজে দেখলাম, সেই দীর্ঘদেহী সুবর্ণকান্তি ভোলেভালা মানুষটা বিদায় নিয়েছেন। এতটুকু আড়ম্বর নেই বাড়িটাতে, মধ্যবিত্ত ছাপ স্পষ্ট। ডাক্তারবাবু আর তাঁর বাবা, ঠাকুমা, যাদের দেখলাম তাঁরা প্রত্যেকেই খুব সাদামাটা আটপৌরে। 

জানেন, ছয় ঘন্টাও হয়তো বসতে হয়, লোকাল হলে সাত আট ঘন্টাও হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, ডাক্তার দেখাতে এসে তো রোগী আরও বেশি অসুস্থ হবে। এখানেই আমার বলার বিষয়। 

প্রথম দিন আমি গিয়েছিলাম আমার একটা এলার্জি দেখাতে। সারা গায়ে মশার কামড়ের মতো অসংখ্য ফুলে ফুলে যায় ক্রমে সেগুলো একটার সঙ্গে আর একটা জুড়ে যায় ধীরে ধীরে, সারা শরীর ফুলে যায়। চর্ম বিশেষজ্ঞ বললেন, দু' বেলা লেভোসেটরিজিন খেতে। খাই ভালো থাকি। ১৫ দিন খাওয়ার পর যেদিন বন্ধ করলাম, সেদিন আবার যথাপূর্বং। আবার আমি বিশেষজ্ঞকে দেখালাম। বললেন, ওটাই দু' বেলা চলুক। আমার তখন খুব বাড়াবাড়ি। সারা গায়ে ল্যাকটোক্যালামাইন লাগাই, বরফ লাগাই, ডাক্তারবাবু দিলেন এলার্জিক্স লোশন। আমি বললাম, কতদিন? ডাক্তারবাবু বললেন এলার্জি যতদিন থাকবে ততদিন এটা খেয়ে যেতে হবে। আর ওটা লাগাতে হবে। আমার কাছে বিষয়টা খুব যুক্তিপূর্ণ মনে হল না। তখনই প্রথম আমি গেলাম ডাক্তার শিবাশিসের কাছে। ডাক্তার শিবাশিস বললেন, এটা কমাতে পারব, অনেক কমিয়েছি। কিন্তু সারাতে পারব না। এখন আপনি দৈনিক দুটো লিভোসেটরিজিন খান, সেটাকে কমিয়ে সপ্তাহে দুটো করা সম্ভব। আরও ভালো সাড়া পেলে, সপ্তাহে বা দু' সপ্তাহে একটা। শুধু ধৈর্য ধরে ওষুধটা খেয়ে যাবেন। শুরু হল চিকিৎসা। বিশ্বাস করুন, বছর খানেক ওষুধ খাওয়ার পর লেভোসেটরিজিন কমতে কমতে সারা বছরে একটাও লাগেনি। এটা ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। 

আমি একদিন দেখাতে গিয়ে বসে আছি, ডাক্তারবাবু নিজেই আমাকে জানতে চাইলেন, কোনও সমস্যা হচ্ছে? আমি জানালাম, অনেকক্ষণ ধরে একটা মৃদু চেস্ট পেইন হচ্ছে। তখন ডাক্তারবাবু অসম্ভব তৎপরতার সঙ্গে স্টেথো লাগালেন, এক ডোজ ওষুধ দিলেন। পাশের একটি ঘরে আমাকে শুতে বললেন। আধঘণ্টা অন্তর খোঁজ নিলেন। এক ডোজ করে ওষুধ দিলেন। ঘন্টা দুই পর বললেন, এবার একটু ভালো বোধ করছেন? এবার একটা ECG করিয়ে নিয়ে একজন মেডিসিনের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। দেরি করবেন না। এক্ষুনি। কথামতো সবকিছু করলাম। ওই রাতেই আইসিইউ'তে ভর্তি করা হল আমাকে। পরে শুনেছি, আইসিইউ'র ডাক্তার বলেছেন, খুব ভালোভাবে লোডিং ডোজ দিয়ে পেশেন্টকে যেভাবে পাঠানো হয়েছে তার জন্য এতটা পথ আসতে পেরেছেন। সিভিয়ার এমআই। তার সঙ্গে পেশেন্টের রোগা পাতলা চেহারা একটু বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। সেই দিন দেখেছিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা নয়; ডাক্তার শিবাশিস ব্যানার্জি কুড়ি মিনিট-আধঘণ্টা অন্তর দেখতে আসছেন, ওষুধ দিচ্ছেন। এরপর আমার হার্টের বাইপাস সার্জারি হল। 

আমার মুখে জিভের দুপাশে খুব খারাপ রকমের ঘা আছে। কলকাতায় ওরাল স্পেশালিস্ট দেখে, বায়োপসি করে জানিয়েছেন ওটা ইরোসিভ লাইকেন প্লানাস। সমস্ত অ্যালোপ্যাথি ডাক্তাররাই বললেন, এর কোনও রেমেডি নেই, সবই অস্থায়ী। প্রধান চিকিৎসা আইসোট্রেটিনন ক্যাপসুল। কিন্তু সমস্যা হল, ওই ওষুধে লিভার ফাংশন সম্পূর্ণ ঘেঁটে ঘ, লিপিড প্রোফাইল তথৈবচ। আমি পোস্ট-কার্ডিয়াক বাইপাস সার্জারি পেশেন্ট, এসব চলবে না। এদিকে আমার জিভ থেকে রক্তপাত হচ্ছে। লিকুইড খাবার ছাড়া খেতে পারি না। অগত্যা ডাক্তার শিবাশিস ব্যানার্জি। বললেন, সেরে যাবে, সম্পূর্ণ না হলেও ৯০ শতাংশ সারবে। এখন আমি আখ চিবোতে পারি না। লঙ্কা বা টক জিনিস খেতে পারি না। কিন্তু ডাল ভাত তরকারি মাছ মাংস মুড়ি ছোলা বাদাম সব খেতে পারি। এক সময় তো ঝাল টক এমনকি কাঁচা লঙ্কা পর্যন্ত খেতে পারছিলাম। কিন্তু প্রাণঘাতী মারাত্মক কোভিড হওয়ার পর ওগুলো আর পারি না। কিন্তু জিভের কষ্টটা সত্যিই নব্বই শতাংশ কমে গেছে।

ছ' ঘন্টা আট ঘন্টা বসে থাকলে পেশেন্ট বিরক্ত হবেই। কিন্তু পেশেন্ট বিরক্ত হয় না। কারণ, ডাক্তারবাবু নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে অক্লান্ত, রোগী দেখে চলেছেন। এখানেই আসল প্রশ্ন। পেশেন্ট পার্টি যদি দেখে তার রোগী কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু ডাক্তারের দেখা নেই, তখন ভিন্নতর প্রতিক্রিয়া হয়। আর পেশেন্ট পার্টি যখন দেখে ডাক্তার নিজেই নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে অক্লান্ত রোগী দেখে চলেছেন, বিরক্তি বোধ হয় না। আবার এর মধ্যেই এমার্জেন্সি, কোলে বাচ্চা কাঁদছে, মা কাজ ফেলে এসেছে, তাদের নিজে ডেকে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এক ডোজ ওষুধ খাইয়ে দিয়ে বলেন, সন্ধ্যায় এসে বাকি ওষুধ নিয়ে যেও। ডাক্তারবাবুর এত দীর্ঘ সময় লাগার কারণ হল, সব পেশেন্টের ওষুধ ডাক্তারবাবু নিজের হাতে তৈরি করে দেন। অতএব, সময় লাগবেই। আমার বান্ধবী বলে, নিজের হাতে ওষুধ দেওয়ার একটা ভিন্ন তাৎপর্য আছে। বাড়ির মা মাসি কাকিমা রান্না করে রণে ভঙ্গ দেন না। তাঁরা বসে থেকে নিজের হাতে বেড়ে খাওয়ান এবং সবার শেষে নিজে খান। ডাক্তারবাবুও কাগজের ওপর খসখস করে কলম চালিয়ে দেন না। অত্যন্ত সংবেদনের সঙ্গে নিজের হাতে ওষুধ বানিয়ে দেন। এখানেই একটা বাড়তি মাত্রা যোগ হয় ওষুধের সঙ্গে। 

ঠাকুমা চলে গেছেন, বাবা তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ও চলে গেলেন। হোয়াটসঅ্যাপের ডিপিতে ডাক্তারবাবুর স্ত্রী ও কন্যার ছবি দেখেছি। আশা করি, এদের তত্ত্বাবধানে আমার প্রিয় ডাক্তার শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই দায়িত্বশীল ভাবে আরও দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন।


Wednesday, 9 July 2025

উত্তাল বিহার

বিহার কি আবারও পথ দেখাবে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 


গত দু’ শতকের ইতিহাসে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবিভক্ত বিহার বার বার রুখে দাঁড়িয়েছে, বিদ্রোহের ধ্বজা হাতে নিয়েছে। তা ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহই হোক কি ১৮৯৯'এর মুণ্ডা অভ্যুত্থান, কিংবা ১৯১৭ সালের ঐতিহাসিক চম্পারণ সত্যাগ্রহ বা ১৯২০’র দশকের কিষাণ সভার সংগ্রাম, অথবা ১৯৪২’এর ভারত-ছোড়ো আন্দোলন— জন অংশগ্রহণে বিহার সবসময়েই সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছে, স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে পরিণত করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৪’এ জেপি’র ডাকে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’ আন্দোলনই হোক কিংবা ১৯৮০’র দশকের গোড়ায় মধ্য বিহার জুড়ে অভূতপূর্ব কৃষক জাগরণ, পারতপক্ষে একেকটা সময়ে স্থবির হয়ে পড়া মানুষের চৈতন্যের দিশারী হয়েছে বিহার।

আজ আবারও কি এই বিপন্ন সময়ে বিহারের উঠে দাঁড়াবার পালা? গোটা দেশ যখন উত্থিত ফ্যাসিবাদের থাবার সামনে কতকটা অসহায়, ছত্রভঙ্গ বা অন্তর্কলহেও দীর্ণ, তখনই বিহারের জনতা এক উপযুক্ত মুহূর্তে— যখন ফ্যাসিবাদ এমনকী গরিব জনতার নির্বাচনী অধিকারকেও কেড়ে নিতে নির্বাচন কমিশনকে হাতের পুতুল বানিয়ে একবগগা আক্রমণে মত্ত— রুখে দাঁড়িয়েছে। আজ ৯ জুলাই (২০২৫) বিহারের হাজারও মানুষ পথে নেমে এসেছেন। এই জনসমাবেশ এক সর্বাত্মক বনধের রূপ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, পাটনায় ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতৃত্বে হাজার হাজার জনতা ঘেরাও করেছে নির্বাচন কমিশনের দফতর— তাদের দাবি, অবিলম্বে SIR (Special Intensive Revision)’এর নামে কোটি কোটি গরিব, পরিযায়ী, দলিত ও আদিবাসীদের নাম ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।

আমরা দেখেছি, গত মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন রাতারাতি ভোটার তালিকায় জল মিশিয়ে রাজ্যে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা থেকে ভোটারের সংখ্যাকে বাড়িয়ে এক অসাধু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এনডিএ জোটকে ক্ষমতায় আনে। এবারে তারাই বিহারে ভোটার লিস্ট থেকে রাতারাতি লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দিয়ে আগামী বিধানসভা নির্বাচন তড়িঘড়ি সেরে ফেলতে উলটো কৌশল নিয়েছে। বলাই বাহুল্য, এই প্রক্রিয়াটি ভোটারদের, বিশেষত প্রান্তিক এবং দুর্বল শ্রেণির মানুষকে, ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।

 

১) সময় নিয়ে প্রশ্ন ও উদ্দেশ্যমূলক

নির্বাচনের এত কাছাকাছি সময়ে এই ধরনের ব্যাপক সংশোধন প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। নির্বাচন কমিশন হঠাৎ করে প্রায় ২২ বছর পর এই ধরনের নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যেখানে ২০০৩ সালের পর আর এমন ব্যাপক সংশোধন হয়নি। স্পষ্ট যে, এই প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে ব্যাহত করতে এবং একটি নির্দিষ্ট দলকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই করা হচ্ছে। বিহারে যেহেতু আর কয়েক মাসের মধ্যেই নির্বাচন, তাই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যে সময়সীমা দেওয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবাস্তব। এত কম সময়ে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তথ্য যাচাই করা অসম্ভব।

 

২) বিপুল সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা

বিহারের মোট ভোটারের প্রায় ৩৭ শতাংশই পরিযায়ী শ্রমিক, যারা রাজ্যের বাইরে কাজ করেন। উৎসবের সময় তাঁরা বাড়িতে আসেন। বর্তমান নির্দেশিকা অনুযায়ী, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে জন্ম শংসাপত্র বা অন্যান্য কঠিন নথি জমা দিতে হচ্ছে। অনেক পরিযায়ী শ্রমিক, দলিত, মহাদলিত এবং অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের কাছে এই ধরনের নথি না থাকায় তাঁরা ভোটাধিকার হারাতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা আবেদনগুলিতেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রায় ৩ কোটি ভোটারের নাম বাদ পড়তে পারে।

 

৩) নথিপত্র নিয়ে সমস্যা এবং প্রান্তিক মানুষের উপর প্রভাব

আধার কার্ড, রেশন কার্ড, বা মনরেগা কার্ডের মতো সহজলভ্য নথিগুলিকে বৈধ প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। বিহারের গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র মানুষের কাছে জন্মের শংসাপত্র বা ১৯৮৭ সালের আগেকার সরকারি পরিচয়পত্রের মতো নথি থাকা অত্যন্ত বিরল। এমন বহু মানুষ আছেন যারা বহু বছর আগেই তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে বাবা-মায়ের জন্ম শংসাপত্র বা অন্যান্য নথি জোগাড় করা অসম্ভব। এর ফলে এই প্রক্রিয়াটি প্রান্তিক ও অশিক্ষিত মানুষদের জন্য বিরাট সমস্যা তৈরি করবে এবং তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে পারে।

 

৪) প্রক্রিয়াগত ত্রুটি ও আইনের লঙ্ঘন

এই সংশোধন প্রক্রিয়াটি জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০-কে লঙ্ঘন করছে। ভোটার তালিকা থেকে কোনও নাম বাদ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নোটিশ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শোনার সুযোগ দিতে হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে সেই আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে এই কাজটি করায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলেও ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে।

 

৫) এনআরসি’র ছায়া

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অনেক বিরোধী নেতা এই প্রক্রিয়াতে এনআরসি’র ছায়া দেখছেন। বোঝাই যাচ্ছে, এর মাধ্যমে অ-ভারতীয়দের নাম বাদ দেওয়ার অজুহাতে বহু ভারতীয় নাগরিককে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বাধ্য করা হবে, যা পরবর্তীতে পুরো প্রক্রিয়াটাকেই ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জী’র দিকে নিয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রক্রিয়ায় ভোটারদের নাগরিকত্বের প্রমাণ এইভাবে আদায় করা অত্যন্ত অনৈতিক ও সংবিধান বিরোধী। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে শীর্ষ আদালতে কয়েকটি মামলা দাখিল হয়েছে।


এই আলোকে অন্তত বিহারে দেখা গেল, ইন্ডিয়া জোট ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একযোগে পথে নেমেছে। সিপিআই(এমএল) নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এই SIR প্রক্রিয়াকে ‘ভোটবন্দী’ আখ্যা দিয়ে পরিষ্কার জানিয়েছেন, এটি ২০১৬ সালের নোটবন্দীর মতো সাধারণ মানুষের জন্য ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে। তাঁর মূল প্রশ্ন, কেন ২২ বছর পর হঠাৎ করে এই ধরনের ব্যাপক সংশোধন করা হচ্ছে এবং কেন কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করেই এটি শুরু করা হল? তাঁর মত, ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে এমন নথিপত্র চাওয়া হচ্ছে যা বহু সাধারণ মানুষের কাছে নেই, বিশেষ করে জন্ম শংসাপত্রের মতো নথি (এমনকী প্রধানমন্ত্রী মোদিজীরও যা নেই)।


লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী SIR প্রক্রিয়াকে ‘গরিবদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বিহারের বন্যা পরিস্থিতি এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন, যারা এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে অক্ষম।


আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব SIR প্রক্রিয়াকে ‘অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ২৫ দিনের মধ্যে ৮ কোটি ভোটারের যাচাই হওয়া অসম্ভব, বিশেষ করে যখন প্রায় ৪ কোটি বিহারী রাজ্যের বাইরে থাকেন। তিনি নির্বাচন কমিশনের কাছে আধার কার্ড, রেশন কার্ড ও মনরেগা কার্ডকে বৈধ নথি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের কোনও স্পষ্টতা নেই এবং তাদের জারি করা বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তিতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁরও আশঙ্কা, প্রয়োজনীয় ১১টি নথি না থাকায় বহু দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়বে।


দিনের শেষে এই লেখা যখন প্রকাশের মুখে তখন গোটা বিহার জনজোয়ারে অচল হয়ে পড়েছে। নির্বাচন দফতরের অদূরে দাঁড়িয়ে বিরোধী নেতারা তীব্র ভাষায় নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, নির্বাচন কমিশন 'একটি রাজনৈতিক দলের শাখা' হিসেবে কাজ করছে এবং 'গুজরাতের দুই ব্যক্তি' বিহারের ভোটারদের ভোটাধিকার নির্ধারণ করছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়লে পরবর্তীতে তাদের রেশন ও পেনশনও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।


অবশ্য, সমস্ত জড়তাকে ছিন্ন করে বিহারের জেহানাবাদ থেকে দ্বারভাঙ্গা, আরাড়িয়া থেকে মুজাফফরপুর, নওয়াদা থেকে অরওয়াল— সর্বত্র পথে নেমেছেন মানুষ। চাক্কা জ্যাম’এর ডাক দিয়ে যে আন্দোলনের শুরু তা আজ বিহার বনধ’এ রূপান্তরিত হয়েছে। আগামী দিনে এই আন্দোলন সারা ভারতে প্রভাব ফেলে কিনা, অথবা, নির্বাচন কমিশন কিছুটা নরম হওয়া থেকে শেষমেশ পিছু হঠে কিনা, এসব দেখার রইল। সব থেকে বড় কথা, এই প্রক্রিয়া যদি চালু থাকে, তার অন্তিমে কতজন ভোটারের নাম বাদ গেল, সেও দেখার। তারপর বিহার আবারও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে কিনা, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।


তবে সাধু সাবধান! বিহারের পর এবারে লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ! আপনার-আমার ভোটাধিকার থাকবে তো?



Thursday, 3 July 2025

যুদ্ধ যখন এক উত্তেজক নেশা

শত্রু কেবল অস্ত্রধারী বহিঃশত্রু নয়

শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী



এ লেখা যখন লিখছি, তন্মধ্যে ঘটে গেছে পাহেলগাঁও'এর নৃশংস উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে দু' দেশের মধ্যে সম্যক উত্তেজনা। ঘটমান বিশ্ব চর্চিত ইজরায়েল কর্তৃক গাজার হত্যালীলা ছাপিয়ে তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে যুক্ত হয়েছে একে একে ইরান, লেবানন ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্ৰিকার দেশগুলি এবং বঙ্গ-তথা দেশব্যাপী চিরপরিচিত 'পাকি-মুসলিম' ঘৃণার সঙ্গেই জন্ম নিয়েছে এক নব্য ইজরায়েল প্রেমীর দল। পরিবেশকর্মী গ্রেটা ও তাঁর সহচররা ত্রাণভর্তি (তাদের ভাষ্যে 'প্রতীকী') ম্যাডেলিন জাহাজটিকে নিয়ে গাজা অভিমুখে রওনা দিয়ে ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় খানিক অবধারিত ভাবেই ইজরায়েলি সেনার হাতে আটক হয়ে অবশেষে তিনি ও আরও তিন সমাজকর্মী অতি দ্রুত সুইডিশ সরকারের কোনওরকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই দেশে দেশে প্রত্যার্পিত হয়েছেন।

অধুনা আধুনিকতার মঞ্চে সুশীলতার ধ্বজাধারী বাদবাকি বিশ্বকে ন্যায়-অন্যায়ের পাঠ দেওয়া ইউরোপ ধর্মপ্রচার ও ব্যবসায়ে মুনাফা করার ধান্দায় স্রেফ গায়ের জোরে আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে আর নিজেদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিজভূমে অবাঞ্ছিত ইহুদিদের প্যালেস্টাইনের 'পুণ্যভূমি'তে বসিয়ে দিয়ে একদিকে ভেদনীতি ও যুদ্ধব্যবসাকে ধূমায়িত করে, অন্যদিকে ইহুদি-মুসলিমের শান্তিস্থাপনের নাটক করে চলেছে সুদীর্ঘকাল ধরে। প্রকৃতপক্ষে এই সাম্রাজ্যবাদী ও ভোগবাদী ইঙ্গ-মার্কিন তথা পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক (তেল ও বিশ্ব-বাণিজ্য) ঘাঁটি হিসাবেই ইজরায়েল রাষ্ট্রটি গঠিত হয়, যা তাদের মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা প্রদর্শন ও অর্থনৈতিক প্রভুত্বের প্রতীক।

অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব পর্বে, প্রধানত ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় উৎসারিত রেসিজম ও অ্যান্টি-সেমিটিসমের নির্মম বলি হয় ইহুদি জনগোষ্ঠী। পশ্চিমা শক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তারা তথাকথিত ‘পিতৃভূমি’র পুনরাধিকার লাভ করে। ফলস্বরূপ, সহস্রাব্দব্যাপী সেই ভূখণ্ডে বাসকারী আরব জনজাতির সঙ্গে তাদের এক অনিবার্য সাংঘর্ষিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে। ইসলামের প্রারম্ভ থেকেই আরব ভূখণ্ডে ইহুদিরা আরব জাতির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বর্তমান ছিল এবং আসমানী কিতাবে ইহুদিদের সৃষ্টির অন্তিমকাল পর্যন্ত একপ্রকার চিরশত্রু রূপেই উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলত, এই দ্বন্দ্ব এক পর্যায়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে ধর্ম-সংঘর্ষের অবয়ব গ্রহণ করে। এই প্রেক্ষাপটে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আঙ্গিককে আস্তিনে লুকিয়ে, পশ্চিমা পরাশক্তি সমূহ এই সংঘর্ষকে ধর্মযুদ্ধ তথা ‘গণতন্ত্র বনাম ধর্মীয় মৌলবাদ’— এই মোড়কে উপস্থাপন করতে থাকে; সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হলোকাস্ট, গণহত্যার মতো তাদের নিজস্ব কলঙ্কময় ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে একপ্রকার প্রতিসাম্য বা নৈতিক পরিশুদ্ধির আকাঙ্ক্ষাও এর অন্তর্লিখিত অভিসন্ধি ছিল।

ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই যুদ্ধ যেন তার ওপর আরোপিত বাস্তবতা হয়ে ওঠে, বিশেষত, আরব রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল সংঘাতের সূচনায়। পরবর্তীকালে ইজরায়েল-মার্কিন জোটের ভূকৌশলগত স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে ‘চিরস্থায়ী প্রতিরোধের’ ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। যদিও এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অন্তঃস্থ চালিকাশক্তি ধর্ম নয়, বরং অর্থনৈতিক, বিশেষত খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা। উদাহরণস্বরূপ, জর্ডনের যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার অন্যতম কারণ তার ভৌগোলিকভাবে অনুর্বরতা ও সম্পদহীনতা। এর বিপরীতে তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ— সিরিয়া, লেবানন, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন, ইরাক, ইরান দীর্ঘকাল ধরে সংঘাতে জর্জরিত। 

আশ্চর্যজনকভাবে, কেবলমাত্র ইজরায়েল পরিচালিত নিধনযজ্ঞকে কেন্দ্র করেই (আমাদের দেশেও বটে) তিনটি স্বতন্ত্র সমর্থক শ্রেণির স্পষ্ট উত্থান পরিলক্ষণ করি। প্রথম গোষ্ঠীটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের-- তারা দেশকাল এবং কিয়দংশে মনুষ্যত্বেরও ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের ধর্মীয় সত্তাতেই একমেবাদ্বিতীয়ম পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় এবং বিশেষ কিতাবানুসারে তারা ইহুদীদের ধ্বংসের এক অনৈতিক ও বর্ণবৈষম্যমূলক স্বপ্ন বুনে চলে প্রজন্মান্তরে। এই গোষ্ঠীর একাংশ তথাকথিত ‘ঐশী নির্দেশ’, অর্থাৎ, ধর্মরক্ষার দোহাই দিয়ে কোনও 'একের' আদেশপ্রাপ্তির দাবি তুলে মরণোত্তর পুরস্কার লাভের আশায় বোমা হয়ে ফেটে উঠে ফুটে যায় এ ধরাধামের কোনও না কোনও অংশে প্রায় নিত্যদিনই, অকাল বা ‘উপযুক্ত’ কালেই। অজ্ঞাত কারণে গোষ্ঠীটির অপরাংশ, সরাসরি হত্যাযজ্ঞের অংশ না হলেও, কদাপি এই নৃশংসতার বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয় না। বরং তারা পরম্পরাগত নিপীড়নের ইতিহাস থেকে ‘সমভাবে’ স্বধর্মী অথবা বিধর্মীদের দ্বারা সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘুর দেশে নিগৃহীত হবার অজুহাতে নিজেদের অবস্থানকে ন্যায্যতায় পরিণত করার প্রয়াসে আত্মরত। ক্ষমাপ্রার্থী না হয়ে করুণাপ্রার্থী হওয়ার এই প্রবণতাই তাদের নৈতিক দৈন্যকে উন্মোচিত করে। 

দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি উল্লিখিত প্রথম দলের এই উগ্রতা ও সহিংসতার দ্বারা ভীত-ফোবিয়াক ও মৌলিকভাবে বিরোধী। ফলত, ‘শত্রুর  শত্রু  আমার  বন্ধু’ এই তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ তারা ইজরায়েল তথা ইহুদী সমর্থনে নিজেদের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান সংহত করতে নিরন্তর সচেষ্ট এবং অতি সক্রিয়, বোধহয় প্রাণপাতেও আগ্রহী! যদিও  ইজরায়েল, বিশেষত ইজরায়েলবাসী ইহুদীরা তাদের এই অবস্থান সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়।

তৃতীয় তথা সর্বাধিক চিত্তাকর্ষক গোষ্ঠীটি মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় প্রত্যয়ী এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমাজ পরিবর্তনের অলীক স্বপ্নে বিভোর। ফলে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের একমাত্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধারূপে তারা প্রথম গোষ্ঠীর প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থন প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ তথা ধর্মবিরোধী হওয়ায় প্রথম গোষ্ঠী যদিও তাদের এ আত্মীয়তা স্বীকার করে না, তবু প্রথম গোষ্ঠীর অনুগামীরা তাদের মধ্যেই বিপুল ভাবে সমাদৃত! কালান্তরে বাংলার ভূখণ্ডে এই দুই গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সহাবস্থানও ঘটেছে বৃহত্তর (দলীয়) স্বার্থে! উক্ত গোষ্ঠীটির যারপরনাই মিছিল প্রেমে ইত্যবসরে কলিকাতাবাসী বেশ কিছু যুদ্ধবিরোধী মিছিলে পা মেলাবার পুণ্যার্জন করেছে, যার স্লোগানে স্লোগানে ঢেকেছে সমাজ মাধ্যমের দেওয়াল, আর এভাবেই তারা সমাজ মাধ্যমকেই ব্রিগেড জ্ঞানে আপন মনের বাৎসল্যে জিতে ফেলেছে শত শত নির্বাচন। ভারতীয় এই সর্ব-(গণ)হারার দলের রাজনৈতিক অবস্থান হয় অন্তর্লীন ব্রাহ্মণ্যবাদে আস্থাশীলতা, অথবা প্রকাশ্যেই প্রথম গোষ্ঠীর ধর্মতত্ত্ব ও আচরণের প্রতি সমর্থন।

জার্মান রাজনৈতিক দার্শনিক Carl Schmitt একদা বলেছিলেন, 'The specific political distinction to which political actions and motives can be reduced is that between friend and enemy.'। অর্থাৎ, রাজনীতির মৌলিক ধারণা হল ‘মিত্র-শত্রু বিভাজন’। এ এমন এক ক্ষেত্র যেখানে সমাজ নিজেকে চিত্রায়িত করে 'আমরা' বনাম 'ওরা' রূপে। শত্রু এখানে ব্যক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে সংজ্ঞায়িত— যে আমাদের অস্তিত্বের বিপরীতে দাঁড়ায়। আদতে রাজনীতির জমিই প্রস্তুত হয় না অপর পক্ষটিকে চিহ্নিত করতে না পারার প্রাক-মুহূর্ত পর্যন্ত। আবার নীৎশে বলছেন, 'He who despises himself still respects himself as one who despises.'। তিনি শত্রুকে আত্ম-উৎপাদনশীল এক অবলম্বনরূপে চিহ্নিত করছেন। তাঁর মতে, আমাদের নৈতিকতাবোধের এক বৃহৎ অংশই শত্রুর উপস্থিতি ও তাকে ঘৃণা করার মাধ্যমে নির্মিত। যেমন, নৈতিকতার আঙ্গিকে তৃতীয় গোষ্ঠীটি ধর্মবাদকে বাদ দিতে চাইলেও, রাজনৈতিকভাবে তা করতে অপারগ, কারণ, তাদের লাল পুস্তিকা কোনও এক সুদূর অতীতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার যে ‘সুরা’ গ্রাহ্য করতে বলেছিল, তা অনুসরণ করতে গিয়েই তারা প্রথম গোষ্ঠীকে মিত্ররূপে বিবেচনা করেছে। এবং সেই নির্দিষ্ট ধর্মতত্ত্বের ‘আফিম’ তারা গিলতে বিন্দুমাত্র কসুর করে না তথাকথিত 'পুঁজিবাদী' বলয়ের বিরুদ্ধতায় প্রথম গোষ্ঠীটিকে এক বলিষ্ঠ প্রতিপক্ষ রূপে বিবেচনা করে। 

এরই বিপরীতে অবস্থিত দ্বিতীয় গোষ্ঠী যারা প্রথম গোষ্ঠীর বিরোধী, প্রতিস্পর্ধী ধর্মীয় মৌলবাদেই বিশ্বাসী—জন্মলগ্ন থেকেই এই তাদের পরিচয়। ফলত তারা দেখতে কিংবা দেখাতে চায় না কীভাবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও ভারতীয়দের হাফিয়া নামক শহরের বাঙ্কারে প্রবেশেই বাধা দেওয়া হয়েছে স্থানটি শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য সংরক্ষিত দাবিতে। অনুরূপে, তৃতীয় গোষ্ঠীর অনুসারীরা জানতে চায় না, যেভাবে গ্রেটা'রা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছতে ইজরায়েলের আগ্রাসনের কাছে, ঠিক সেভাবেই স্থলপথ রুদ্ধ করে ত্রাণকার্য প্রতিহত করেছিল লিবিয়া ও ইজিপ্ট (দুই ইসলামিক রিপাবলিক); কিংবা, জাফর পানাহি, নোবেলজয়ী শিরিন এবাদি সহ প্রায় জনা ত্রিশেক বিশিষ্টজন ইরান সরকারের উদ্দেশ্যে এক প্রকাশ্য পত্রে লেখেন, 'Iran and its people should not be sacrificed for uranium enrichment and the ambitions of the Islamic Republic.'। 

আর এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার বিভীষিকাময় প্রেক্ষাপটে গাজা পরিণত হয়েছে এক চলমান উপাখ্যানে— কখনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরিসংখ্যানপত্রে, কখনও গবেষকের তথ্য ভাণ্ডারে, আবার কখনও তথাকথিত মানবতাবাদীদের সমাজ ও ছায়া-সমাজের খণ্ডচিত্রে বিন্যস্ত বেদনায়। আমরা 'মানুষ' নামক জীবেরা তাতে প্রয়োজনানুসারে প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করেছি, করছি, তবে আদতে মনুষ্যত্ব রক্ষা করতে পারিনি, পারি না। যদিও আল্লাহ-উপাসকদের একাংশের কাছে গাজা এমন এক চিত্রপট যা অশ্রু ও  অভিশাপ বর্ষণের পাশাপাশি ধিক্কার ও প্রতিবাদেরও। এমনটা গোটা ইসলামী দুনিয়ায় বিরল, সেখানে বিধর্মী এমনকি স্বধর্মী নিধনের ফরমান সর্বদা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে। তাই সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন কিংবা কুর্দ অঞ্চলে আরবীয় আগ্রাসন হোক অথবা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে নিত্যনতুন দানবিক নীতিমন্ত্রের উদ্ভাবন ও প্রয়োগ, প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে ঘোর নৈঃশব্দ্যই দেখেছে সমগ্র বিশ্ব।

যুদ্ধ সর্বদাই অবধারিত বিপর্যয় ও মৃত্যু, গর্ভস্থ জীবনের অপূর্ণতা, আশ্রয়চ্যুত নাগরিক সমাজ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত আবাস এবং ক্ষতবিক্ষত উত্তর-প্রজন্মের অস্তিত্ব সংকট। তথাপি এই সর্বজনীন যুদ্ধ বিরোধিতার নৈতিক স্তম্ভে উপবিষ্ট হয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করি, ইজরায়েল যখন ইরানের ওপর আঘাত হানে কিংবা ভারত পাকিস্তানের ওপর, তখন ভারতীয়দের একাংশ উল্লাসধ্বনিতে মুখরিত হয়, অপরপক্ষ নিস্পন্দ স্তব্ধতায় নতজানু থাকে। ন্যায়চিন্তার মধ্যে বিপর্যয় আরও তীব্র হয়, যখন দেখা যায় তথাকথিত প্রগতিশীল বা মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত বুদ্ধিজীবী সমাজ ইজরায়েলের ধ্বংসস্তূপ বা রক্তস্নাত শিশু-দেহাবশেষে সেই একই পৈশাচিক পরিতোষ অনুভব করে। যেভাবে বামপন্থীরা প্রত্যেক ইজরায়েলিকে 'জায়নাবাদী' রূপে চিহ্নিতকরণ করছে, তা নেতানিয়াহুর সেই সর্বজনীনিকরণকেই স্মরণ করায়, যেখানে সমগ্র ফিলিস্তিন জাতিই হামাসের সহচর বলে প্রতিপন্ন হয়। এক জাতির মৃত্যুকে অপর জাতির ন্যায় বিজয়ের এই উদ্‌যাপন যেন মনুষ্যত্ব বর্জিত কোনও যুদ্ধদেবতার আরাধনায় অর্পিত নৈবেদ্যমাত্র।

চলচ্চিত্রের দার্শনিক-বিদূষক উডি অ্যালেনের এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'I'm not afraid of death; I just don't want to be there when it happens.'। অনুমেয়, এই অত্যুৎসাহীরা কস্মিনকালেও মৃত্যুর বাস্তবতার আবহ সম্মুখে প্রত্যক্ষ করেনি, কেবল যুদ্ধকে একপ্রকার উত্তেজক নেশা হিসেবে কল্পনা করেছে। একমাত্র আত্মবিস্মৃত, প্রতিহিংসায় মোহাবিষ্ট জনতা, যারা জাতীয়তাবাদে অন্ধ, যুক্তিবোধে শূন্য এবং কেবলমাত্র স্লোগানের উত্তেজনায় নিমগ্ন, তাদের পক্ষেই এ ধরনের ‘আনন্দ’ উদযাপন সম্ভবপর। যেমন, পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান উচ্চারণ মাত্রেই অনেকে ভাবনাহীন, মননশূন্য দেশপ্রেমে আপ্লুত হয়ে ওঠেন।

জাঁ-পল সার্ত্র তাঁর 'The Look' তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেছেন, অন্য মানুষ (l’Autre)-এর দৃষ্টির ভিতর দিয়েই আমি ‘বস্তু’তে রূপান্তরিত হই; সেই ‘অপর সত্তা’(other)'ই হয়ে ওঠে অস্তিত্বগত শত্রু, কারণ সে আমাকে অপর রূপে চিহ্নিত করে তার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। সেই চাহনিই হয়ে পড়ে আমার অস্তিত্বের অনতিক্রম্য সীমারেখা। অন্যদিকে বিষ্ণুপুরাণ ও গীতার বর্ণনায় 'শত্রু' বহির্দেশীয় নয় বরং অনেকাংশে অন্তরীণ— অহং, কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি বিকার এ ক্ষেত্রে 'অন্তর্জাত শত্রু' হিসেবে চিহ্নিত। বৌদ্ধ দর্শনে ‘Māra’ সেই অন্তর্মুখী বিভ্রমের প্রতীক, যে নির্বাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। অতএব, শত্রু কেবল অস্ত্রধারী বহিঃশত্রু নয়, সে কখনও রাষ্ট্রীয়, কখনও নৈতিক, আবার কখনও অস্তিত্বগত ভ্রান্তি বা অপরের দৃষ্টিতেই নিহিত থাকে।

এই বৈপরীত্যের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে, দ্বন্দ্বে জীর্ণ হওয়ার আগে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন—অসহিষ্ণুতার প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করব, নাকি অসহিষ্ণুতাকেই ধ্বংসের শাস্তি দেব? এবং এই অন্তঃসঙ্গাতে জীর্ণ হবার পূর্বেই স্মরণ করিয়ে দিতে হয় নীৎশের সেই অনিবার্য সতর্কবাণী, 'He who fights with monsters should see to it that in the process he does not become a monster. And if you gaze long enough into an abyss, the abyss will gaze back into you.'। আমরা যেন প্রতিহিংসার উন্মাদনায় অচেতন হয়ে নিজেরাই এক এক দানবে পরিণত না হই। মানবতার রক্ষাকবচ হিসেবে আমাদের প্রয়োজন, বোধ, ভাবনা ও আত্মসমালোচনার নিরলস অনুশীলন।


Wednesday, 2 July 2025

অতঃপর?

রাজনৈতিক ভাবনা ও অনুশীলনকেই পাল্টাতে হবে

উত্তাল ঘোষ



কল্পনাও করতে পারিনি, এরকম দুর্দান্ত কিছু ঘটে গেলে আমরা আত্মহারা হয়ে পড়ি। যেমন, ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জেতার পর জুনের গরমেও অনেকে ক্রিকেট খেলতে নেমে পড়েছিলাম।

কল্পনাও করতে পারিনি, এরকম ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেলে স্নায়ু অবশ হয়ে যায়, রাগ হয়, চিৎকার করতে ইচ্ছে করে, সব ভেঙেচুরে ফেলার ইচ্ছে হয়। যেমন, সাউথ ক্যালকাটা ল' কলেজের মধ্যেই এক ছাত্রী গণধর্ষিতা হওয়ার খবর জানার পর হয়েছে। যেমন হয়েছিল আরজি কর মেডিক্যালের ভিতরেই ডাক্তারি ছাত্রীকে ধর্ষণ-খুনের কথা জানার পর। অথবা, কালীগঞ্জে বোমার আঘাতে ন' বছরের নাবালিকার মৃত্যুতে।

দেখবেন, আরজি করের ঘটনা যেমন রাস্তায় মানুষের ঢল নামিয়েছিল, কসবার ঘটনায় তা হয়নি। কারণ, আরজি কর আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়নি। যদিও ওই ঘটনার পর পরই কিন্তু দলে দলে মানুষ পথে নামেননি। নেমেছিলেন ৫ দিন পর জনৈক রিমঝিম সিনহার ডাকে আলোড়িত হয়ে। সে আলোড়ন ছিল নারী নিরাপত্তার দাবিতে। তারপর? বিজেপি ঠেক না পেয়ে সরে গেল। সিপিএম-সহ বামেরা রাশ হাতে নিয়ে নারী নিরাপত্তার বৃহত্তর আঙ্গিক থেকে আন্দোলনকে স্রেফ ঘটনার মধ্যে আটকে ফেলল। সিস্টেম সব সামলে নিল। 

যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খবর রাখেন, তাঁরা জানেন কসবার ঘটনা ঘটারই ছিল। কলকাতাতেই যদি এসব হয় তাহলে গ্রামের ছবিটা কেমন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সেরকম কয়েকটা ঘটনার কথা কানে এলেও তেমন আন্দোলিত হয় না মধ্যবিত্ত মন। দৈন্য আমাদের চিন্তার। আমরা সব কিছুকেই রাজনৈতিক দলের ছাঁচে দেখতে অভ্যস্ত। তার ফল কী হয়, তা আরজি করের ঘটনার পর দেখেছি। কসবার ঘটনাতে নির্যাতিতা ও অভিযুক্ত তিনজনই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্য। কষে তৃণমূলকে গালমন্দ শুরু হয়েছে। তৃণমূল বলছে, পুলিশ তো সবাইকে গ্রেফতার করেছে। তৃণমূল আঙুল তুলছে বিজেপি-সিপিএমের দিকে। রাশ কার হাতে থাকবে তা নিয়ে কসবার কলেজের সামনে 'রাত দখল' আন্দোলনকারীদের ওপর বিজেপি হামলা চালিয়েছে। নীতি-নৈতিকতার জন্য নয়, সবই ভোটের জন্য। সেখানে রাজনৈতিক দলের আওয়াজই শুধু শোনা যায়। আমজনতার কথা হারিয়ে যায়। আমজনতার অনেকে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষাতেই বলতে শুরু করে। দলীয় রাজনীতির সেই ভাষায় তর্কাতর্কি করতে করতেই রাগ সব বেরিয়ে যায়। আরজি কর, কালীগঞ্জ, কসবার মতো আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটার ভয় নিয়ে আমজনতার বড় অংশ বোবা হয়ে যায়। সিস্টেম দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকে।

রাজনীতি নির্ভর করে অর্থনীতির উপর। মূলত অর্থনীতির উপরই নির্ভর করে সমাজ ও রাজনীতির নীতি-নৈতিকতা বোধ। ১৯৯১ সালে আমাদের মতো দেশে বাজার অর্থনীতির দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে। বাজার অর্থনীতি মানে তো ভোগ-লোভ ও আরও মুনাফার আকাঙ্ক্ষা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাজার অর্থনীতির দরজা খোলার পর থেকেই ধীরে ধীরে সামাজিক মূল্যবোধ-নীতি-নৈতিকতা পাল্টে যাচ্ছে। রাজনীতিতেও তার ছাপ পড়তে বাধ্য। পড়ছেও। বাজার অর্থনীতি মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলোর কোনও সমাধান করতে পারে না। কিন্তু চকচকে প্রচার আমজনতার মনকে সে সব থেকে সরিয়ে ভোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভোগের সঙ্গেই তো জড়িয়ে থাকে লোভ-লালসা ও শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে বাঁচা। মনে থাকবে, আগে মাস্তানদের একটা রবিনহুড-মনোভাব ছিল। তারা কেউ মহিলাদের অসম্মান করেছে এরকম উদাহরণ প্রায় নেই। এখন আর মাস্তান নেই, এখন সব মাফিয়া ডন। তারা পারে না এমন কোনও কাজ নেই।

যে কোনও ভাবে ভোটে জিততে হবে, এটাও তো একটা লোভ। ভোগবাদী মুনাফাসর্বস্ব রাজনীতির অনিবার্য ফল। ভোটে জিততে হলে কী লাগবে? মানি পাওয়ার, মাসল পাওয়ার।

কসবার কলেজের ঘটনা সম্পর্কে অনেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কথা বলছেন। বাম জমানায় একটা সময়ের পর থেকে নির্বাচন হত? নাকি গায়ের জোরে প্রতিপক্ষকে ভোটে লড়তে না দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্র সংসদ দখল হত? টাকা নিয়ে ভর্তি হত না? ছাত্র সংসদের টাকা খরচে দুর্নীতি হত না?  সে সময় এসএফআই রাজ্য সম্মেলনের রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যাবে, নেতারা সব জানতেন। তবু সে সব অপকর্ম চলতেই থাকত। ক্ষমতা দখলে রাখতে হবে। তাই নেতারাও বদলের চেষ্টা করতেন না। 

বাম জমানায় নেতারা বুদ্ধি করে রেখেঢেকে চলতে পারতেন। সোশ্যাল মিডিয়া, অডিও ভিসুয়াল মিডিয়া না থাকায় জানাজানিও কম হত। তার চেয়েও বড় কথা, বাজার অর্থনীতির দর্শন রাজনীতিকে পুরোপুরি গিলে খেতে পারেনি। বামেরা যাওয়ার পর রাজনীতির রাশ বহু জায়গায় চলে গেল লুম্পেনদের হাতে। আগে নেতারা গুণ্ডাদের ব্যবহার করত। ভোটে জেতাটাই যত বেশি রাজনীতির মোক্ষ হল ততই গুণ্ডাদের হাতে চলে গেল রাজনীতির রাশ। এর শুরু সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানা থেকে হলেও বাম আমলে এর বিস্তার ঘটেছে, এখন বিষবৃক্ষ হয়ে গেছে। তার ফল ঝরে ঝরে পড়ছে। আরও পড়বে।

বলাই বাহুল্য, আমাদের রাজ্যে সমাজ জীবন পুরোপুরি রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রিত। এটা বাম জমানাতেই শুরু হয়েছে, তৃণমূল জমানায় এই পার্টিশিল্প আরও পোক্ত হয়েছে। পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমজনতার বাঁচা-মরা, বিশেষত গ্রামে। তার সঙ্গে যোগ করুন এই ভোগ-লোভের-ভোটসর্বস্ব রাজনীতি। তাহলেই বোঝা সম্ভব কসবার কলেজের মনোজিৎ মিশ্ররা জন্ম নেয় কী ভাবে। যে ছেলেটা অপকর্মের জন্য কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়, যে কথা টিএমসিপি ইউনিট সভাপতি দলের উচ্চতম নেতৃত্বকেও জানিয়েছিলেন, সেই ছেলেটিই আবার কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি ও পরবর্তীতে অস্থায়ী কর্মীর চাকরি পায় কী করে? সে জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি লাগে। হাত কতটা লম্বা সেটা পরিস্কার। এখন গ্রেফতারের পর হাত ধুয়ে ফেলার খেলা চলছে? 

রোগটা কোনও দলের নয়, রোগটা সিস্টেমের। সব রাজনৈতিক দলই এই সিস্টেমের অংশ। আপনি তৃণমূলের দিকে আঙুল তুললে তৃণমূল বলবে, হাথরাস-উন্নাও-কাঠুয়া-বিলকিস বানু-মনিপুর-কার্তিক মহারাজ-প্রজ্জ্বল রেভান্না-বানতলা-ধানতলা-মণীষা মুখার্জি-সুশান্ত ঘোষ-আরও কত কিছু। আসল কথা হারিয়ে যাবে। আসল কথা এই সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বিকল্প রাজনীতি, বিপক্ষকে গালাগাল করার নেতিবাচক রাজনীতির বদলে চাই ইতিবাচক রাজনীতি।

আমিও ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। আমাদের কলেজের শিক্ষাগত মান খুব একটা ভাল ছিল না। আমরা ঠিক করেছিলাম, ৬৫ শতাংশ উপস্থিতি না থাকলে কেউ পরীক্ষা দিতে পারবে না। একবার ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতি ৬৫ শতাংশ ছিল না। তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি। সব অধ্যাপকই জানতেন ছেলেটি নিয়মিত কলেজে যেত। ছাত্র সংসদের কাজ করতে গিয়ে ক্লাসে যেতে পারত না। আমরা তাঁকে ছাড় দিতে বলিনি। আমাদের কলেজের শিক্ষার মান ক্রমশ বাড়তে বাড়তে কলকাতার সামনের সারির কলেজে পরিণত হয়েছিল। সিপিএম-কংগ্রেস-নকশাল সব মনোভাবের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা এই কাজে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন। ছাত্র সংসদের ভোট হত। মারধর-মারামারি হত। কিন্তু ভোটের পর বিরুদ্ধ ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে কোনও তিক্ততা থাকত না।

এসএফআই দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় বেশ দুর্বল ছিল। আমি সম্পাদক থাকার সময় আমরা জেলার শিক্ষাগত উন্নয়নের দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। তৃণমূল কর্মী হিসেবে কাজ করা শিক্ষকরাও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সমাবেশে এসেছিলেন। দলীয় রাজনীতির গণ্ডী ভেঙে গিয়েছিল। এই ইতিবাচক মনোভাবের রাজনীতি চাই যা সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আমার মতে, কান্নাকাটি রাগারাগি করে অন্যকে দোষ দেওয়ার বদলে বিকল্প রাজনীতির ভাষ্য তৈরি করাটাই বেশি জরুরি। এই বিকল্প ভাবনার কেন্দ্রে থাকতে পারে প্রতিটি পরিবারের আয় বাড়ানো, স্বনির্ভর পরিবার গড়ে তোলার উদ্যোগ, প্রকৃতি-বন্যপ্রাণ-পরিবেশকে বাঁচিয়েই উন্নয়ন, বিষমুক্ত খাদ্যের দাবি। সঙ্গে স্বপ্ন। প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নানা মনোভাবের মানুষকে নিয়ে চলার মানসিকতা। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত বিশল্যকরণীর খোঁজ পেতে পারি আমরা। 

নয়তো থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।