Wednesday 7 April 2021

বাংলা জয়ের খোয়াব

সোনার শ্মশানের নীল নকশা

শোভনলাল চক্রবর্তী


দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সব কাজ ছেড়ে এখন মাটি কামড়ে পড়ে আছেন বাংলায়। বাংলাকে সোনার বাংলা বানানোর জন্য এই গুজরাটি বানিয়াদের এত দরদ কেন? প্রশ্ন উঠছে মানুষের মনে। প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর ঘিরেও উঠছে প্রশ্ন। সেখানে মতুয়াদের স্থানে গিয়ে পুজো দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, আর বাংলায় ওই মতুয়াদের জন্য থাকবে নাগরিকত্বের খুড়োর কল। এই দ্বিচারিতা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অভিজ্ঞান। বাংলাতেও তার অন্যথা হওয়ার নয়। সত্যিই কি সোনার বাংলার জন্য প্রাণপণ করছেন দেশের শীর্ষ দুই নেতা, নাকি এর পেছনে আছে অন্য কোনও উদ্দেশ্য? 

ভুললে হবে না সারা দেশে গত মার্চ মাসে বেকারত্বের হার যখন ছিল ৮.৮ শতাংশ তখন পশ্চিমবঙ্গে তা ছিল ৬.৯ শতাংশ। কোভিডের পর তা রাজ্যে বেড়ে হয়েছে ১৭ শতাংশ, আর দেশে ২৩.৫ শতাংশ। মানুষের আস্থা অর্জনে প্রচার মঞ্চে দাঁড়িয়ে কুৎসা ছড়ানো সঠিক তথ্যের বিকল্প নয় নিশ্চয়ই। সুতরাং, তথ্যের অপলাপ এবং অসম্পূর্ণতার কারণে এ রাজ্যের মানুষ বরং আশঙ্কিত হতে পারেন যে গত দশকে যেটুকু উন্নতি ঘটেছে পরিকাঠামো ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে, সেই সুফল হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে পট পরিবর্তন ঘটলে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার নিয়ে আসার যে গল্প শোনানো হচ্ছে তার ভিত্তি কী? সোনার বাংলার দাবি নিয়ে যাঁরা আসছেন তাঁদের নিজেদের শাসনে থাকা গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, বিহারের মতো রাজ্যগুলি আজও মাঝারি ও ছোট শিল্পের কর্মসংস্থানের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক পিছিয়ে। রিজার্ভ ব্যাংক, এনএসএসও-র হিসেব অনুসারে ২০১৮ সালেও পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যা গুজরাটে মাত্র ৬১ লক্ষ, রাজস্থানে ৪৬ লক্ষ আর কর্ণাটকে ৭১ লক্ষ। 

দেশের অন্যতম সেরা বাসযোগ্য শহরের মধ্যে কলকাতা আছে উপরের দিকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ প্রচুর এবং প্রয়োজনও বটে, কিন্তু তা কোন নতুন পদ্ধতিতে হবে সে বিষয়ে পরিবর্তনকামী প্রচার বিশেষ আলোকপাত করতে পারছে কী? উন্নয়নের ধারণাটি ঠিক কীরকম? এখানে একটু নজর দিলেই দেখা যাবে যে আসলে সোনার বাংলা নয়, সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার নীল নকশা তৈরি করছে বিজেপি। তাঁদের লক্ষ এখন পশ্চিমবঙ্গের খনিজ সম্পদ, অপরিশোধিত তেলের ভাণ্ডার লুট করা। এখানকার বন্দরগুলো তাঁদের তাঁবেদার ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া। যে সরকারের ঘোষিত নীতি হল বিলগ্নিকরণ আর বেসরকারিকরণ, তাঁরা কী করে বলেন যে সিঙ্গুরে শিল্প আনবেন? এ তো ভূতের মুখে রামনাম হয়ে গেল! 

বিজেপির পাখির চোখ এখন আমাদের রাজ্যের বীরভূম জেলার ১০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দেউচা পাঁচামি কয়লা খনি। এই কয়লা খনিটি বীরভূম জেলার মহম্মদ বাজার সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের অন্তর্গত। দেউচায় প্রায় ২১০ কোটি ২০ লক্ষ টন কয়লা মজুত রয়েছে। এর পুরোটাই উন্নত মানের বিটুমিনাস কয়লা। যার বাজার দর এই মুহূর্তে আকাশছোঁয়া। মজুতের পরিমাণের হিসেবে এই কয়লা খনিটি ভারত ও এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। এই কয়লা খনি থেকে কয়লা তোলা শুরু হলে কমপক্ষে ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে, প্রায় এক লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে এই কাজে। কয়লানীতি ও খনি থেকে কয়লা তোলা সংক্রান্ত নতুন যে সব আইন তৈরি করেছে কেন্দ্র, তাতে কোনও নিয়মরীতির ধার ধারেনি তারা। পরিবেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশের একের পর এক কয়লা ব্লক। উদ্বাস্তু হতে হয়েছে অসংখ্য জনজাতিকে। আগে নিয়ম ছিল ওপেন কাস্ট মাইন হলে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র ছাড়া, সঠিক পুনর্বাসন প্রকল্প ছাড়া কয়লা তোলার অনুমতি দেওয়া হত না বেসরকারি সংস্থাকে। করোনার কালবেলায় অর্থনীতির দোহাই দিয়ে সে সব আইনকে বাতিল করে ২০ বছরের লিজ দেওয়া শুরু হয়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। ফলে, ওই সংস্থাগুলি ইচ্ছামতো খনন চালাচ্ছে খনিগুলোতে। ঘর, জমি, জঙ্গল হারাচ্ছেন অধিবাসীরা। কেন্দ্রের বড় সাধ দেউচার এই বিরাট কয়লা ভাণ্ডার বিক্রি করে কোষাগার ভর্তি করা। সেটা করার জন্যই এই ডবল ইঞ্জিনের গল্প। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রাণপাত আসলে ওই কর্পোরেট মালিকদের জন্য যাঁদের কাছে তাঁরা খনি হাত বদলের মুচলেকা দিয়ে বসে আছেন। বাংলার মানুষের জন্য ভারী বয়েই গেছে তাঁদের! 

ওএনজিসি ২০১৮ সালে কলকাতা থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরে আবিষ্কার করে তেল ও গ্যাসের উৎস। মহানদী- বাংলা - আন্দামান বেসিনের এই তেলের খনি বর্তমানে লাভজনক ভাবে চলছে। এই খনির অপরিশোধিত তেল হলদিয়ার ইন্ডিয়ান অয়েলের কারখানায় পরিশোধিত হচ্ছে। ৩,৪০০ কোটি টাকা লগ্নি হয়েছে এই খনিতে। অপরিশোধিত তেলের সমস্ত খনি বেসরকারি আম্বানিদের হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত মোদি সরকার। পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে আম্বানিদের তেলের ভাণ্ডারের মানচিত্রে যে পরিমাণ উপস্থিতি, পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে ঠিক সেই পরিমাণ উপস্থিতি আজও তৈরি হয়নি। তাই অশোকনগর তেলের খনি এখন বিজেপির পাখির চোখ। যদি একবার পা রাখা যায় বঙ্গে তবে সোনায় সোহাগা, সেটা বিজেপির থেকে ভালো কেউ জানে না। কয়লা, তেল বেচে বেশ কয়েক হাজার কোটি পকেটে ঢুকবে। তার সঙ্গে রয়েছে কলকাতা, হলদিয়া বন্দর এবং পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুরে প্রস্তাবিত সমুদ্র বন্দর। মোদি সরকার পরিকল্পনামাফিক বিমানবন্দর এবং সমুদ্র ও নদী বন্দর বেসরকারিকরণের পথে নেমেছে, এ ক্ষেত্রে তাঁদের স্যাঙ্গাত আদানি। পূর্ব উপকূলের বেশ কয়েকটি বন্দরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে, সেগুলি যাবেই বেসরকারি হাতে। তাজপুর নিয়ে বিজেপি বিশেষভাবে উৎসাহী। চিনের সঙ্গে পূর্ব ভারতের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাজপুর বন্দর এক বড় ভূমিকা নিতে পারে। সেই উদ্দেশ্যেই তাজপুর বন্দরটি প্রস্তাবিত হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি এখন বন্দরটি থেকে লাভের গুড় খেতে নেমেছে। যদি বেচে দেওয়া যায় বন্দরটি! বাংলায় একবার ঢুকলে, তেল, কয়লা, বন্দর নিয়ে লোফালুফি খেলা যাবে বলে বিজেপির এখন গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল গোছের ব্যাপার। 

সোনার বাংলা ছারখার করা যাঁদের উদ্দেশ্য, তাঁরা আবার বলছেন সোনার বাংলা বানাবেন। ত্রিপুরায় ঠিক এই কথা বলে ভুলিয়েছিল বিজেপি। সরকার গঠনের পর ভোটদাতারা বলেছে যে আগের দল যে খারাপ, অনৈতিক ছিল এমন নয়, কিন্তু রাজ্যে চমক আনবে 'ডবল ইঞ্জিন', সেই আশাতেই পরিবর্তন। 'চকচক করলেই সোনা হয় না' আর সোনার দেশ তৈরি হয় সুশাসন, সুপ্রতিষ্ঠান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মঙ্গল সাধনের মধ্য দিয়ে- এই আপ্তবাক্য মনে করিয়ে দেওয়া তাই জরুরি। কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির এ যাবৎ কার্যপ্ৰক্রিয়া যে বার্তা দিয়েছে তাতে কষ্টকল্পিত প্রচারে বঙ্গবাসীকে নতুন দিশা দেখানো সহজ হবে না। মুখস্থ বলা কিছু তথ্যের সাহায্যে ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত ফারাক যে অতিক্রম করা যায় না, বিজেপির প্রচারে তা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে ভাষার বাধা অতিক্রম করে পৌঁছনো হয়তো দক্ষিণ ভারতের থেকে কম দুরূহ, কিন্তু চিন্তাধারা আর মানসিক দূরত্ব? 

বাংলার মানুষ অতিথিপরায়ণ, প্রচারকদের জন্য বারবার কখনও দুপুরের খাবার, কখনও বিকেলের খাবার তৈরিও করছেন, কিন্তু অতিথিরা পাত পেড়ে খেয়ে চলে যাচ্ছেন, গৃহস্থের খবর নেওয়ার সৌজন্যটুকুও দেখাচ্ছেন না, এঁরা করবেন রাজ্যের ভালো? কোন কৌশলে মানবসম্পদে সমৃদ্ধ এই রাজ্যে বাজিমাত হবে তা ভেবে বার করে উঠতে পারেনি বিজেপি। যে ধর্মীয় বিদ্বেষ, সংকীর্ণতা ও প্রতিশ্রুতির অস্ত্রে বিজেপি উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানা ও বিহারের মতো গোবলয় অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলি জয় করেছে, বা জাতিদাঙ্গায় বিধস্ত উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিকে অধিকার করতে পেরেছে, তার কোনওটাই এই রাজ্যের ক্ষেত্রে আশানুরূপ প্রভাব ফেলতে পারবে না, বাঙালির আপন বৈশিষ্ট্য ও শিক্ষার জন্য। তাহলে সোনার বাংলা কী দিয়ে? বিবেকানন্দের বাণী আর রবি ঠাকুরের কবিতা? তাও যে মায়ের কাছে মাসির গল্প। নাকি জাতীয় নেতারা এঁদের নাম মনে রেখেছেন, এতেই বাংলার মানুষ আপ্লুত হয়ে যথাস্থানে ভোট দেবেন? 

সাধারণ ভাবে মনে হয় যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক আচরণের পিছনে কিছুটা বিচক্ষণতা এবং স্বাধিকারবোধ কাজ করে। কোথায় জাতীয় দল বেশি কার্যকরী আর কোথায় আঞ্চলিক দল- এ ব্যাপারে বঙ্গবাসী একেবারেই রাজনৈতিক সংশয়ে ভোগেন না। তদুপরি, বিজেপির কট্টর জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব বাংলায় মুক্ত চিন্তার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা নমনীয় জাতীয়তাবাদের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। অথচ, যথার্থ প্রয়োজনের সময়ে, অর্থাৎ, স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার অবদান তো কম পড়েনি। আন্দামানবাসী তামিলরাও মনে করেন যে পোর্ট ব্লেয়ার বিমানবন্দর বাঙালি বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের নামেই হওয়া উচিত ছিল। সুতরাং, পরিবর্তন যারা চাইছে তাদের হাতের তাস যেহেতু দেখাই আছে, তাই ভোটপ্রচারক এবং ভোটদাতাদের মধ্যে নতুন কোনও রাজনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।


1 comment:

  1. Very true and logical.
    One thing is certain that this duo will never do anything good for common people like us.

    ReplyDelete