Monday 19 April 2021

মতুয়া ভাইদের বলছি

কর্পোরেট পুঁজির জালে ধরা দেবেন না 

শিবশংকর পাল 


মনোবিজ্ঞানের অন্যতম বিদ্যায়তনিক পাঠবস্তু হল সমাজ মনোবিজ্ঞান। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক চার্লস স্টেনগার তাঁর অন্যতম গ্রন্থ 'সোসাল সাইকোলজি প্রিন্সিপলস'-এ সমাজের মানসিক বিন্যাসের উপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। এই গবেষণার জন্য তিনি আমেরিকার সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির চার্টার ফেলো নির্বাচিত হন। তাঁর তত্ত্ব বিশ্ব জুড়ে মান্যতা পেয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, সমাজের মনকে নানাভাবে গড়েপিটে নেওয়া যায়, ভেঙেচুরে দেওয়া যায় পছন্দমাফিক। প্রয়োজনে নানা প্রলোভন ও মিথ্যা দিয়ে প্রভাবিত করে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অনুকূলে তা ব্যবহারযোগ্য করেও গড়ে তুলতে পারে। 

বৃহত্তর সমাজের গভীরতর প্রদেশে এতদিন সাধারণত দু' ভাবে প্রভাব বিস্তার করা হত: ১) তীব্র দেশপ্রেমের নামে উগ্র রাষ্ট্রপ্রেমের জন্ম দেওয়া ও ২) ক্রমাগত অনৃতভাষণের সাহায্যে সফেদ ঝুটকে ‘আসল’ সত্যে পরিণত করা। এর ধ্রপদী ব্যবহার একদা হিটলার করেছিলেন। এখনও এই অস্ত্রের বহুল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে। পাশাপাশি তার থেকেও উন্নত শস্ত্রাদির জন্ম দিয়ে চলেছে বিভিন্ন দেশের শাসকের দল। তার অন্যতম কয়েকটি হল- প্রায় অবাস্তব অথচ জনমনোরঞ্জনী প্রতিশ্রুতির বিতরণ; কাটা ঘা-কে উসকে দেওয়া; কাল্পনিক শত্রু তৈরি করা; যেহেতু হিংসা আরও হিংসার জন্ম দেয়, তাই হিংসার চাষ করা; এবং সমাজের ঐক্য ভাঙার জন্য পরস্পরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। প্রায় সব দেশের শাসকরা নিজেদের সিংহাসন অটুট রাখতে সমাজ মনোবিজ্ঞানের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলি করে চলেছে এবং সফলও হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ এ ব্যাপারে পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছে। সদ্য প্রাক্তন ট্রাম্প-শাসিত আমেরিকা ও মোদী-শাসিত ভারত এর উজ্জ্বল উদাহরণ।  

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের চলমান বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকালে চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্বগুলির প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ স্পষ্টভাবে চোখে পড়বে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন বহু কারণে জাতীয় স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রধান বাধা পশ্চিমবঙ্গ। কারণ, ভারতের যে অংশকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আর্যাবর্ত বা গো-বলয় অথবা হিন্দিবলয় হিসেবে গণ্য করে থাকেন সেখানকার সাধারণের মানসিকতা প্রায় বিজেপির অনুকূল। দীর্ঘকাল ধরে এই অংশের রাজনীতিতে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দুত্ব’কে সারজল দিয়ে চাষ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও আরএসএস দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু নামধারী নানা সংগঠনের নামে তাদের প্রচার চালিয়ে গিয়েছে। তবু বাঙালির মেধা-মনন ও দ্রোহাত্মক ভাবধারা সেই প্রচারের একটা বড় বাধা। আরএসএস বুঝেছে, হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের এটাই তাদের শেষ সুযোগ। 

প্রায় একশো বছরের ‘সংগ্রাম’ শেষে এই প্রথমবার তারা কেন্দ্রীয় সরকারে একক দল হিসেবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই গরিষ্ঠতার বাহানায় করোনার মতো অতিমারির ‘সুযোগ’ নিয়ে তারা একের পর এক এমন সব বিল পাশ করিয়েছে, যার সাহায্যে একদিকে দেশের যাবতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ সহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ কতিপয় পুঁজিপতির হাতে তুলে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে আরও অধিক মুনাফার জন্য প্রয়োজন সস্তা শ্রমিকমজুর; তাই প্রায় রাতারাতি অতি তৎপরতার সঙ্গে আনা হয়েছে এনআরসি। অন্যদিকে কৃষি আইন ও শ্রমকোড আইন আনা হয়েছে এবং নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করা হয়েছে। কেবল আইন তৈরি করাই নয়, হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের অত্যুগ্র উৎসাহে এনআরসি ও এনপিআর প্রয়োগ করার সুযোগ খুঁজছে তারা।

কথা হল, এই আইনগুলি এত কর্কশ ও তীব্রভাবে জনবিরোধী বলে এর একটাও বিজেপির দলীয় ইশতাহারে ঘোষণা না করে বরং কিছু আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে, যার অধিকাংশই তৃণমূলের ইশতেহার থেকে ফেলু ছাত্রের মতো টুকে নেওয়া। বিজেপি খুব ভালো করেই জানে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটে জিততে হলে যা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে ৭০ শতাংশের উপর। এই ৭০ শতাংশের একটা বড় অংশ তফশিলি জাতি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ; এঁদের অধিকাংশ মতুয়া ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের। এঁদের আবার সকলেই ৭১-পূর্ব ও পরে ভারতে এসেছেন। দীর্ঘকাল ভারতে বাস করে রেশন কার্ড থেকে শুরু করে ভোটের পরিচিতিপত্র প্রায় সবই হস্তগত হয়েছে। অনেকেই সরকারি চাকরিবাকরি করছেন। প্রায় বছর বছর নানা কিসিমের ভোটে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করে সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। তারপরেও নাগরিকত্বের জন্য এঁদের হীনম্মন্য আবদার আর সেই বাঞ্ছা মেটানোর জন্য অমিত শাহের প্রতিশ্রুতি বিলোনো দেখে চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্বগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।  

বাংলা জেতার জন্য মোদী-শাহ্‌ কেন্দ্রীয় সরকারের সব কাজ ফেলে প্রায় গোটা ক্যাবিনেট নিয়ে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছেন। পাশাপাশি নিয়ম করে প্রায় প্রতিটি সভায় একজন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ও তাঁর দলের এক সাংসদকে নজিরবিহীনভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে চলেছেন। আর অন্যজন ক্রমাগত মিথ্যে কথা বলে চলেছেন এবং অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন; যার অধিকাংশ সভায় তৃণমূলের ব্লক লেবেলের নেতার করা জনসভার চেয়েও কম জমায়েত হচ্ছে। তিনি হুমকি দিচ্ছেন, একজনও ঘুসপেটিয়াকে (বাঙালিকে এঁরা উইপোকা বলেই মনে করেন) ভারতে থাকতে দেওয়া হবে না। ভোটে জিতলে সমস্ত মতুয়া ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে উক্ত সম্প্রদায়ের বেশ কিছু নেতৃস্থানীয় মানুষ যাঁদের হাতে ভোটব্যাঙ্ক মজুদ আছে বলে মনে করা হয়, তাঁরা ধেই ধেই করে নাচছেন। 

সাধারণ মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে আমার কয়েকটি প্রশ্ন-

প্রশ্ন ১) বঙ্গ বিজয়ের পর কেন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে? কেন হারলে নয়? কেন না নাগরিকত্ব দেওয়ার অধিকারী কেন্দ্র, রাজ্য নয়। 

প্রশ্ন ২) ঘুসপেটিয়া বলতে অমিত শাহ্‌ কাদের বোঝাচ্ছেন? হিন্দুদের, নাকি মুসলমানদের? মুক্তিযুদ্ধের পরে ওপার বাংলা থেকে আসা মুসলমানদের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। ওপার থেকে আসা ৯৮ শতাংশই হিন্দু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি ‘ঘুসপেটিয়া’ বলে হিন্দুদেরই অপমান করছেন না? মতুয়ারা কেন সেই অপমান সহ্য করছেন? 

প্রশ্ন ৩) দেশভাগের জন্য মূলত দায়ী স্বাধীনতা পূর্বকালের নেতৃবৃন্দ, বিশেষত জনসংঘের জনক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। বিজেপি দলটির পিতৃদেব তিনিই। তাঁর কৃতকর্মের দায় কেন মতুয়ারা নেবেন? আসলে অমিত শাহ্‌ প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পুরনো ঘা-কে খুঁচিয়ে সংকীর্ণ ভোট রাজনীতি করছেন না? আর সেই রাজনীতি কেন মতুয়ারা হজম করছেন প্রায় বিনা প্রশ্নে, বিনা বিচারে? 

প্রশ্ন ৪) রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কই হল নাগরিকত্ব। খুব স্বাভাবিক কারণে কোনও সভ্য রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিশেষ কিছু সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি বিশেষ পরিচিতিও দিয়ে থাকে। এই অধিকার থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন নাগরিকগণ। প্রায় সকল মতুয়াই বিগত নির্বাচনগুলিতে অংশ নিয়ে নাগরিকের দায়িত্ব পালন করেছেন; পাশাপাশি রেশন ও নানা সরকারি সুযোগসুবিধা পেয়ে নাগরিকত্ব পাকা করেছেন। যদি তাঁরা নাগরিক না-ই হন তাহলে তাঁদের দেওয়া ভোটে নির্বাচিত কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই কি অবৈধ হয়ে যায় না? সেই ‘অবৈধ’ সরকারের ফরমান কেন একজন স্বাধীন নাগরিক মানবেন? 

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যেই মুহূর্তে ‘গোলাপি কাগজে’ কেউ লিখিত আবেদন জানাবেন সেই মুহূর্তে সিএএ অনুযায়ী তাঁর নাগরিকত্ব ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাবে। তাঁর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও চাকরি-ব্যবসা ‘সিজ’ করা হবে। এবং তাঁকে লিখিত প্রমাণ দিতে হবে তিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে এ দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের পুলিশ কি আজ আপনাকে উক্ত মর্মে জেনারেল ডায়েরি বা এফআইআর দেবে? যদি দেয়ও তবু আপনার মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে এক দশক থেকে দেড় দশক কেটে যাবে। ঐ সময় আপনি জেলে অন্তরীণ থাকবেন। সিএএ-তে কোনও নিঃশর্ত নাগরিকতা দেওয়ার কথা নেই। সর্বোপরি ৩২ হাজার জন আবেদনকারী উপরোক্ত বয়ানে ভারতের নাগরিক হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন; এর সঙ্গে মতুয়াদের কোনও সম্পর্ক নেই। সিএএ আসলে খুঁড়োর কলের একটি গাজর। যা কোনওদিন আপনার নাগালে আসবে না।

এই পর্যন্ত পড়ে হয়ত ভাবছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি এত বড় ‘ঢপ’ দিতে পারে? এ যে দিন দহারে সমুদ্রসমান মিথ্যা প্রতিশ্রতি। এইখানে চার্লস স্টেনগার-কে স্মরণ করব। তিনি জানিয়েছেন, যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব সেই প্রতিশ্রুতি বারবার দিলে সাধারণের মনে একটা ইতিবাচক আগ্রহ তৈরি হয়। এই মনোভাব আরও গভীর হয় গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের উদ্দেশে পুনঃপ্রচারিত হলে। খেয়াল করে দেখুন, চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্ব অনুযায়ী বিজেপি পাকিস্তানকে আপনার কল্পিত শত্রু বানিয়ে রেখেছে, মাঝে মাঝে কিছু জওয়ানকে ‘বলি’ দিয়ে সীমান্তে যুদ্ধজিগির জাগিয়ে রেখে।  দ্বিতীয়ত, হিন্দুদের বিকাশের পথে প্রধান বাধা হিসেবে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে। সরকারি তথ্য পরিসংখ্যানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ওঁরা দিনের পর দিন প্রচার করে চলেছে, মুসলমানরা চারটে পাঁচটা করে বিয়ে করে, চোদ্দ-পনেরোটা করে কাচ্চাবাচ্চা। আগামী দশ-বিশ বছরেই ওঁরা নাকি ভারতের দখল নিয়ে নেবে। ১৪ শতাংশ ৮৬ শতাংশকে এইভাবে নাকি গিলে নেবে। বিজেপি-আরএসএস এবং ওদের আইটি সেল নিরন্তর এই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শীতলকুচিতে ঠাণ্ডা মাথায় বিনা প্ররোচনায় চারজন সংখ্যালঘু মানুষ খুন করে এবং সেই খুনের পক্ষে সাফাই দিয়ে জঘন্য হিংসাকে সামাজিক মান্যতা দিচ্ছে। এমন কি দেগঙ্গাতেও গুলি চালিয়ে সংখ্যালঘু এলাকায় সৃষ্টি করে চলেছে হাড়হিম করা ত্রাসের রাজত্ব। 

ভোটের এই হিংসাত্মক আবহে অমিত শাহের মিথ্যা প্রচারের ফাঁদে পা দিয়ে মতুয়ারা বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন অসমের হাতেগরম অভিজ্ঞতার কথা। বিজেপিকে ভোট দিয়ে আপনারা যদি জেতান, তবে সবার আগে আপনারাই কিন্তু ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন। মাকড়সার জাল যত সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত হোক না কেন, খাদ্য সংগ্রহই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। কয়েক লক্ষ মতুয়া বাঙালিকে বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হয়নি। জেনে রাখুন, সিএএ আম্বানি-আদানিদের সস্তার মজুর সাপ্লাই দেওয়ার জন্য নির্মিত একটি ছলনাজাল মাত্র।


3 comments:

  1. It's a tragedy that the saffron brigade has been able to fool the Matua community people.

    ReplyDelete
  2. এটা সত্যিই খুব আশ্চর্যের বিষয় যে একজন অনাগরিক কী করে ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন? আর নির্বাচিত জনপ্রতিণিধি তাদেরই ডি-ভোটার করে দেন যাদের দ্বারা তিনি নির্বাচিত। সারা ভারত জুড়ে আওয়াজ উঠুক “কাগজ দেখাব না। আমি এই দেশেই থাকব, অন্য কোথাও যাব না”।

    ReplyDelete
  3. ভাল লিখেছেন @ প্রবুদ্ধ বাগচী

    ReplyDelete