Sunday 11 April 2021

শীতলকুচির নির্মল প্রাণ

বাংলা বাঁচানোর লড়াই

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আজ (১১ এপ্রিল ২০২১) বরানগরের প্রকাশ্য নির্বাচনী সভায় হুমকি দিয়েছে- জায়গায় জায়গায় শীতলকুচি করে দেব। অর্থাৎ, শীতলকুচিতে ১০ এপ্রিল সিআইএসএফ বাহিনী যে গণহত্যা সংগঠিত করেছে তার দায় দিলীপ ও তার দলবলের। এটা প্রকারান্তরে সে স্বীকার করে নিয়েছে। এবং স্বীকার করে এই হুঙ্কার ছেড়েছে যে আরও এমন ঘটনা তারা ঘটাবে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী, বিহার-ইউপি থেকে আসা উর্দি পরা আরএসএস ক্যাডার বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন- প্রত্যকের ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে দিলীপ-মোদি-শাহ আপাতত বাংলার বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমেছে। তাই আরও গণহত্যা প্রত্যক্ষ করার জন্য আমরা বাংলার অধিবাসীরা কি ত্রস্ত চোখে বিনিদ্র রাত কাটাব?

কিন্তু কেন এই হিংসাশ্রয়ী রণহুঙ্কার? কেন এই সর্বগ্রাসী যুদ্ধ? প্রথম তিন দফা ভোটে বিজেপি’র যে প্রায় ভরাডুবি হয়েছে তা রাজনীতিতে আনকোরা লোকেরাও এখন বলে দিতে পারছেন। অতএব, এই মোদ্দা কথাটা দিলীপ ও তার দলবলের না বোঝার কোনও কারণ নেই। তাই চতুর্থ দফা (১০ এপ্রিল) থেকেই তারা এক প্রকার অস্ত্র সজ্জিত হয়ে মাঠে নেমেছে। ওইদিন প্রায় সারা রাজ্য জুড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী সন্ত্রাস তৈরি করেছে, জায়গায় জায়গায় ভোটারদের বিজেপি’কে ভোটে দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছে এবং যে সব অঞ্চলে অ-বিজেপি ভোট বেশি বলে অনুমান, সেখানে সেখানে তারা ভোটারদের ভোট দিতে নানারকম বাধা-বিপত্তি ও অবরোধ সৃষ্টি করেছে। এসব করেও যখন দেখা যাচ্ছে, ভোটারদের ঢল বাঁধনছাড়া, তাঁরা দলে দলে বেরিয়ে এসে সুস্পষ্ট রায় মনে গেঁথে নিজ নিজ ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন বিজেপি’র উন্মত্ত প্রার্থীরা কোথাও গাড়িতে বসে ভেতর থেকে ভারী জিনিস দিয়ে নিজেরই গাড়ির কাঁচ ভাঙছে, তো কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনী সঙ্গে করে বুথের বাইরে সন্ত্রাস তৈরি করে এলাকায় ভয়ের পরিবেশ নির্মাণ করছে। ইতিমধ্যে ওইদিন দুপুরেই খবর এসেছে, ত্রিপুরার উপজাতি পরিষদের নির্বাচনে বিজেপি’র একেবারে ভরাডুবি হয়েছে। তাদের বহু কথিত ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার বেমালুম বিকল হয়ে মাঝপথে বসে গেছে। এবং তারা জানে, ত্রিপুরার ভোটের ফলাফলের প্রভাব এ রাজ্যেও বেশ কিছুটা পড়বে। পরিশেষে, উত্তরবঙ্গে যেখানে গত লোকসভায় প্রায় সব আসন দখল করে তাদের মৌরসিপাট্টাটি বেশ কায়েম হয়েছিল, অন্তত সেটুকুও যদি না থাকে, তাহলে তো সারা দেশে মুখ দেখানোই দায়। শুধু কি মুখ দেখানো? ২০১৯’এর পর থেকেই তাদের পরাজয়ের যে ধারা শুরু হয়েছে ও চলেছে, তাতে করে এ রাজ্যে অমন সলিল সমাধি হলে তো দলটার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে; যখন ঘাড়ের ওপর দিল্লি সীমান্তে লক্ষ লক্ষ কৃষক আজও পথে বসে আছেন একটা হেস্তনেস্ত’র আশায়।

অতএব, রাস্তা একটাই: গণহত্যা। হাতে যখন কেন্দ্রীয় বাহিনী মজুত, নির্বাচিত শাসকের হাতে রাজ্যের শাসনভার নেই, নির্বাচন কমিশনই সর্বেসর্বা, তখন এই তো সুযোগ বাংলা ও বাঙালিকে উপযুক্ত শিক্ষাটি দেওয়ার। তবুও যদি প্রথম তিন দফায় ভোটগুলি এন্তারসে ‘পদ্মফুলে’ পড়ত, না হয় ক্ষমাঘেন্না করে ছেড়ে দেওয়া যেত। কিন্তু তা যখন পড়েনি আর পাঁচ দফা আরও বাকী আছে, তখন তো তা ষোলআনা উশুল করতে যা করার তা চতুর্থ দফা থেকেই শুরু করতে হবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। এতদিন কলটা ছিল, গোদি মিডিয়াকে দিয়ে বিজেপি’র পক্ষে হাইপ তুলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ লক্ষ ফেক খবর ও ভিডিও ছেড়ে, সর্বত্র কোটি কোটি টাকা ছড়িয়ে, হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, আদিবাসী-আদিবাসী এইসব বিভেদকে সাশ্রয় করে ও উস্কানি দিয়ে এবং এনআইএ-ইডি-সিবিআই লেলিয়ে বিরোধীদের নাজেহাল করে বা জেলে পুড়ে কাজ হাসিল করা। একই ফর্মূলা বাংলাতেও চালানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল, শীর্ষ নেতাদের এ রাজ্যে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করিয়ে সভা-সমাবেশ, রোডশো করানো, বেকার ছেলেদের ভুরি ভুরি টাকা দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পোস্টার, ব্যানার, ফ্লেক্স সাঁটানো, অনামী শিল্পী থেকে শুরু করে সমাজে অল্পস্বল্প মান্যি আছে এমন ব্যক্তিদের ফোন করে প্রায়-হুমকি দিয়ে তুলে এনে প্রধানমন্ত্রী অথবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ডিনার করিয়ে বিজেপি’র পক্ষে নামানো- একেবারে বানিয়া স্টাইলে এই প্রক্রিয়াটিও যুক্ত হয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল মোদি-শাহ’এর তুমুল চিৎকার (নাকি আর্তনাদ?)- ‘দিদি গেল’ ‘দিদি গেল’; এতটাই নাটকীয় ও রঙ্গভরা যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাওয়া বিধানসভা এলাকার আধিকারিকদের মোদি স্বয়ং এমনকি নির্দেশও দিয়ে দিলেন যে তাঁরা যেন ‘কিষাণ নিধি’ প্রকল্পের জন্য এখুনি তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে দেন।

তবুও চিড়ে ভিজল না। দেখা গেল, এইসব হম্বিতম্বি করে ও প্রবল স্নায়ুর চাপ দিয়েও তিন দফা ভোট শেষে তাদের হাতে পেন্সিলটুকুও থাকছে না। ইতিমধ্যে মোদি-দিলীপের নিযুক্ত পেশাদাররা বলতে শুরু করেছে, যেমনটা আশা করা গিয়েছিল তেমনটা হয়নি। সব মিলিয়ে কিছু কিছু বিভ্রান্তি ঘটানো গেলেও সামগ্রিক ভাবে তাদের নাচনকোঁদনের তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি। বিজেপি’র বাংলা জয় তো দূরস্থান, পঞ্চাশটা আসনের কোটা পেরোয় কিনা তাই নাকি এখন দেখার। আর সময়ও বেশি নেই। হাতে মাত্র পাঁচ দফা। পুলওয়ামার স্মৃতিও টাটকা। অতএব, প্ল্যান বি: আড়ং ধোলাই, সন্ত্রাস ও গণহত্যা।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী লড়াইকে এবার ওরা টেনে নিয়ে এসেছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ময়দানে। একদিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও প্যাঁচপয়জার, বিপরীত দিকে ভোটার কার্ড হাতে শান্তিপ্রিয় আমজনতা। ওদের শত প্রচেষ্টাতেও এখনও পর্যন্ত দাঙ্গা লাগানো যায়নি, বাইরে থেকে বড় বড় নেতাদের এনেও মাঠ ভরানো যায়নি, কোটি কোটি টাকা বিলি করে বাংলার ভোটারদেরও প্রভাবিত করা যায়নি। ওরা যতই ‘দিদ্দি ও দিদ্দি’ বলে অসভ্যের মতো টিটকিরি দিক না কেন, বাংলার মানুষ এটা বুঝে গেছেন যে এই লড়াইটা নিছক ‘মোদি বনাম দিদি’ নয়, বাংলা ও বাঙালি এবং তাদের সাধের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের যা কিছু অর্জনের সঙ্গে বানিয়া-হিন্দি-হিন্দুস্থানী বর্গীদের লড়াই। এ লড়াই বর্গীদের বিরুদ্ধে বাংলা ও বাঙালির আত্মমর্যাদা ও আত্মোন্নয়নের লড়াই। বাংলার অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার লড়াই। এই লড়াইয়ে যারাই ওই বানিয়াদের বিপক্ষে বাংলার মানুষ তাদেরই পক্ষে। তাই সারা বাংলা জুড়ে একুশের ডাক: নো ভোট টু বিজেপি।

মনে রাখতে হবে, বাংলা জয়ের মধ্য দিয়েই ওরা চাইছে ‘ভারত জয়’কে সার্থক করে তুলতে। কারণ, বাংলাই পথপ্রদর্শক। যুক্তি-তর্ক, বিদ্যা-বুদ্ধি, রাজনীতি-অর্থনীতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম-বিপ্লবী আন্দোলন, লোকশিল্প-আধুনিক সংস্কৃতি, সৃজন-প্রতিভা- সবেতেই বাংলা অগ্রদায়ক। আজও। এই বাংলাকে কব্জা করেই আরএসএস’এর দল আসলে চূর্ণ করতে চায় যা কিছু এ তাবৎকালের অর্জন ও সদর্থক ভাবনা, উদারবাদী ও তর্কপ্রিয় মনন। বাংলার অফুরন্ত সম্পদের দিকে ওই বানিয়াদের কঠিন দৃষ্টি। তাই এই নির্বাচন কঠিন-কঠোর আত্মরক্ষার লড়াই। বাকী চার দফায় উজাড় করে ভোট দিয়ে বিজেপিকে ‘সুপরা সাফ’ করে দেওয়ার লড়াই। ওরা গুলি চালাবে, হুমকি দেবে, হামলা করবে- কিন্তু একবার যদি দাঁতে দাঁত চেপে এ লড়াই আমরা জিতে যাই, তাহলে গোটা দেশ থেকেই নির্মুল হবে মতান্ধ, ঘৃণ্য ও সাম্প্রদায়িক বানিয়াদের ওই জঘন্য দলটি। কৃষকেরা অপেক্ষা করছেন। তাকিয়ে আছেন বাংলার দিকে। দিল্লি সীমান্তে নেতাজী সুভাষ ও ভগৎ সিং’এর ছবি পাশাপাশি রেখে শেষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন আমাদের অন্নদাতারা। আমাদের ভবিষ্যৎ থাকুক আমাদেরই হাতে। জয় বাংলা!

নো ভোট টু বিজেপি।


10 comments:

  1. জয় বাংলা। বিজেপি নিপাত যাক।

    ReplyDelete
  2. খুবই প্রাসঙ্গিক লেখা। অনেককেই পাঠিয়ে দিলাম।

    ReplyDelete
  3. ভালো লেখা । বিজেপির বিরুদ্ধে সমমনস্ক আমাদের সবাইকে একসাথে থাকতে হবে, লড়তে হবে ।

    ReplyDelete
  4. ভালো। সময়োপযোগী।

    ReplyDelete
  5. পাজ্ঞাব থেকে ত্রিপুরা হয়েছে সাফ,এবার বাংলা করবে রাজ্য ছাড়া তাই আতঙ্কিত। তা এই আক্রমণ।

    ReplyDelete
  6. লেখাটা মনোবল বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট। ভরসা পেলাম।

    ReplyDelete
  7. একদম হক কথা লিখেছেন, আমাদের ভবিষ্যৎ থাক আমাদেরই হাতে। সাবাস

    ReplyDelete
  8. খুব ভাল লেখা। সঠিক বিশ্লেষণ। হত্যার পুরো দায় মমতা ব্যানার্জির ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। সেইমত প্রচারও শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়ে গেছে আস্ফালন। পরোক্ষে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বিজেপিকে ভোট না দিলে “শীতলকুচি” করে দেব। ওদিকে জোটের দায়সারা সাফাই। প্রতিবাদের অভিমুখটা নির্বাচন কমিশনের দিকেও তাক করা উচিত। এমন মেরুদন্ডহীন কমিশন আগে দেখি নি।

    ReplyDelete
  9. লড়তে হবে, শেষপর্য্যন্ত হারাতে হবে বিজেপিকে।
    ভালো লিখেছিস।
    মানুষ জাগবে আশা রাখি।

    ReplyDelete
  10. খুব ভালো লাগলো লেখাটি,বিজেপি আর এস এস এর এই বাংলা জয় এর স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়,বাংলার জাগ্রত বিবেকবান মানুষ যেন প্রতিহত করে বিজেপিকে। " বিজেপি কে হারাও ভোটে,বিজেপিকে হারাও পথে।'

    ReplyDelete