Sunday, 10 August 2025

এক পরিকল্পিত ডিজাইন

ভদ্দরজনেরা মজা পাচ্ছেন গরিব বাঙালির লাঞ্ছনায়?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

এক ধরনের বামপন্থীরা বলছেন, অমিত মালব্যকে তাঁরা পঞ্চম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বই পাঠিয়ে দেবেন; কারণ, বিজেপি’র লোকজনেরা নাকি বাংলা ভাষাটাই জানে না। অপর এক পক্ষ, যারা ড্রয়িং-রুম বামপন্থী, মূলত ‘আহা আনন্দ’ টিভি চ্যানেল দেখে ও ‘বাজার আনন্দ’ খবরের কাগজ পড়ে দেশ ও দশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হন, তাঁরা আরও মজার কথা বলছেন: কই, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের তো পেটাচ্ছে না, যারা মার খাচ্ছেন তাঁরা আসলে ওইসব রাজ্যে লেবরদের কাজে ভাগ বসাচ্ছেন, তাই। এঁদেরই একজন বললেন, ‘labour rate’ নিয়ে ঝামেলা, মানে মজুরি-টজুরি নিয়ে দরাদরি করছে, ফলে, মারধোর খাচ্ছে।

ভাগ্যিস, আপামর বাঙালি আর এদের কথা কেউ শোনেন না। কিন্তু সেই বাসি, পচা কথাগুলি পাড়তে হল, কারণ, কতকগুলি বিষয় আজ স্পষ্ট করে নেওয়ার সময় হয়েছে। দেশ ও রাজ্য এক নতুন বিভাজন-বিন্যাসের কবলে পড়েছে, সেখানে নতুন করে এক রাজনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণি বিন্যাস নির্মিত হচ্ছে; সেই নবতর বিন্যাসে আজ নিজ নিজ উপলব্ধিতে অবস্থিত হওয়ার পালা।

প্রথমত, এ কথাটা খুব স্পষ্ট করে জেনে নিতে হবে যে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে যে সমস্ত বাঙালি শ্রমজীবী মানুষদের উপরে হামলা ও সন্ত্রাস চলেছে তারা মূলত গরিব এবং প্রধানত নিম্নবর্ণ হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের। দ্বিতীয়ত, এই হামলাগুলি সেই সেই রাজ্যের বসবাসকারী শ্রমজীবী বা অন্যান্য মানুষেরা করছেন না; করছে পুলিশ, প্রশাসন ও কতিপয় বানর সেনার দল। অতএব, এমন ভাবার কোনও কারণই নেই যে, বহিরাগত ও স্থানীয়দের মধ্যকার অর্থনৈতিক রেষারেষি থেকে এই আক্রমণ। এই হামলা সংগঠিত হচ্ছে এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ডিজাইন থেকে। সেই ডিজাইনকে বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও এনডিএ জোটের বিপুল জয়ের পরে অমিত শাহের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে, যেখানে তিনি বলছেন, সেই সাংঘাতিক জয়েও তাঁদের ভারত বিজয় সম্পন্ন হয়নি, তা হবে যখন তাঁরা বঙ্গভূমিকে দখলে নিতে পারবেন। কথাটা খেয়ালে রাখবেন। ঠিক যে ভাবে যুদ্ধের শেষ দিনগুলিতে যখন হিটলার তাঁর গোপন বাঙ্কারে প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখনও তিনি তাঁর সেনাপতিদের আদেশ দিচ্ছেন, এখনও যে কজন ইহুদী অউশভিৎস কনসেন্ট্রশন ক্যাম্প অথবা এদিক-ওদিক বেঁচেবর্তে আছে তাদের নিকেশ করে দাও। অর্থাৎ, টার্গেট একটা জাতি বা মতাদর্শ, যাকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করতে পারলে হিংস্র একমাত্রিক ফ্যাসিস্ট শাসনকে কায়েম রাখা যায় না। কারণ, ফ্যাসিবাদের মূল চরিত্রই হল এক বর্ণ, এক রঙ, এক ভাবনা, এক ঢঙ।

বাংলা ও বাঙালি তাহলে কীভাবে অমিত শাহের দলের মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে? হচ্ছে বৈকী! আর সে কারণেই গেরুয়া দলবলকে বারবার পিছুও হঠতে হচ্ছে। বঙ্গদেশ হল এমন এক শস্য-শ্যামলা ছয় ঋতুর দেবভূমি যেখানে উদারতাবাদ এর জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে প্রবহমান। তা চৈতন্যদেব ও সুফিতন্ত্রের ভাব-মতাদর্শই হোক কি রামপ্রসাদের ভক্তিসায়রে ডুব, স্বাধীন বাংলা রক্ষায় পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের নেতৃত্বে আত্মবলিদান কিংবা আধুনিক সময়ে রামকৃষ্ণদেব-বিবেকানন্দের সর্বধর্ম সমন্বয়, অথবা রবীন্দ্র-নজরুলের বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বোধ বা নেতাজী-ক্ষুদিরাম-মাস্টারদার স্বাধীনতার লড়াই ও বিভূতি-মানিক-সত্যজিতের সৃষ্টিকর্ম— এমন এক ব্যাপ্ত পরিধিতে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত জয়গান তো বাঙালির ঐতিহ্যেই রয়েছে। সে বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য মোদী-শাহের দলবলের একবগগা উগ্র হিন্দুয়ানির ঘোর পরিপন্থী। এই ঐতিহ্য যতদিন তার সুললিত ভাষ্যে প্রবহমান থাকবে, ততদিন কোনও উগ্র পাষণ্ড মতাদর্শ এ দেশে সার্বিক ভাবে জায়গা করে নিতে পারবে না, বাংলাতে তো নয়ই। বাংলা ও বাঙালি হল কাউন্টার-পয়েন্ট, এক অপ্রতিরোধ্য ভাষ্য। তাই, বাংলাকে নিশানা।

ফলে, যতক্ষণ না প্রাণচঞ্চল বাংলার জীবনবোধকে উৎপাটিত করা যাচ্ছে, ততক্ষণ বর্ণবাদী বিদ্বেষমূলক ধর্মব্যবস্থাকে কোনওভাবেই জয়ী করানো যাচ্ছে না। তাই, নেতা, দল ও মিডিয়া কিনে, পয়সা ছড়িয়ে, ফেক রিল ও ভিডিও’র রগরগে রমরমায়, গল্পের গরুকে গাছে তুলে নিত্য নতুন বিকৃত ন্যারেটিভ নির্মাণে ও উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তদের একটা অংশকে কাছে টেনে উদোম চেষ্টা চলেছে বাংলাকে ক্ষতবিক্ষত করে এর দখল নেওয়ার। তবুও সে কাজে যখন সফলতা আসছে না, প্রভূত হিন্দু-উল্লাস চাগিয়ে হিন্দু বাঙালিদের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নামানো যাচ্ছে না, তখন ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধ করে, প্রায় সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের টাকা আটকে ‘শালে বাঙালি লোগো কো’ ভাতে মারো আর আক্রমণ হানো অন্য রাজ্যে বাঙালি গরিবদের উপর যারা কিনা কিছুতেই অমিত শাহের দলকে ভোট দেয় না।

তাই, বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালি শ্রমজীবী মানুষের ওপর আক্রমণ একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক ডিজাইন। ‘অনুপ্রবেশের’ সেই পুরাতন গল্প ছড়িয়ে একে যতই যাথার্থ্য দেওয়ার চেষ্টা চলুক না কেন, মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। প্রথমত মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে কোনও লব্জ নেই। কারণ, কোনও ব্যক্তির বিদেশে প্রবেশ আইনগত ভাবে অনিয়মিত হতে পারে, কাগজপত্রহীন হতে পারে, কিন্তু তিনি কখনই ‘অনুপ্রবেশকারী’ নন যা অত্যন্ত অমর্যাদাকর একটি শব্দ, এবং বহু দেশে এই ধরনের প্রবেশকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেও দেখা হয় না; তাই, ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটির মধ্যেই অভিবাসীদের মর্যাদা লঙ্ঘনের মাত্রা লুকিয়ে আছে, যা অমানবিক। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রসংঘ নীতি হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে, প্রত্যেক মানুষের ‘has a right to have rights.’। তথাপি, তর্কের খাতিরে আমরা যদি বাংলাদেশ থেকে আগত ‘কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের’ও গণ্য করি, তাহলেও নির্দ্বিধায় বলতে হয়, এ বিষয়ে কোনও প্রামাণ্য পরিসংখ্যান তো নেইই, উপরন্তু বাংলার শহর ও গ্রামকে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও কিছুই মিলবে না। কারণ, ১৯৭১-৭২’এর পর বড়সড় কোনও কাগজপত্রহীন অভিবাসন বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশে হয়নি। তবে হতে পারে, অথবা সীমান্তবর্তী দেশ হিসেবে কেউ কেউ কাগজ ছাড়াই সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন। তাদের সংখ্যা নগণ্যই। আসলে, ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ’এর গুজব হল সেই পরিকল্পিত রাজনৈতিক ডিজাইনের একটি উপাদান মাত্র। এর কোনও বাস্তব তথ্যগত ভিত্তি নেই।

ফলে, বিজেপি শাসিত বহির্রাজ্যে এ দেশিয় গরিব শ্রমজীবী বাঙালিদের উপর এই যে একতরফা আক্রমণ নেমে এসেছে, তার এক সুদূরপ্রসারী অভিঘাত তৈরি হতে চলেছে। বাংলার রাজনীতি এ তাবৎকাল উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্তদের নেতৃত্বেই প্রবাহিত হয়েছে, যদিচ, এখানে বাম রাজনীতির বহু ইতিবাচকতা সেই বর্ণ ও বিত্তের প্রাবল্যকে কিছুটা খাটো করলেও, সে গন্ধ ও দম্ভকে মুছতে পারেনি। যে ভাবে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ুতে নিম্নবর্ণের উত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের নিজস্ব দল তৈরি হয়েছে, তারা ক্ষমতায় এসেছে, অনুরূপ ঘটনা এ রাজ্যে ঘটেনি। একমাত্র ১৯৩৭ সালে ভারত আইন অনুসারে অবিভক্ত বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে যে কোয়ালিশন সরকার তৈরি হয়েছিল তা বাংলার নিম্নবর্গীয় মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের এক প্রতীক ছিল। সেই ধারা আজ অবলুপ্ত।

কিন্তু প্রতিরোধে-প্রতিশোধে নিম্নবর্গীয় রাজনীতির পুনরুত্থান আবারও বাস্তব। বাংলার সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত-উচ্চবর্ণ শ্রেণি যে ভাবে গরিব মানুষের উপর আক্রমণে নীরবতা পালন করছে, শুধু তাই নয়, ভাবছে অমিত মালব্য বাংলা ভাষা সম্পর্কে না জেনেই যা খুশি বলছে, অথবা, তারা এইসব কথাবার্তার জবাব দেওয়ার তেমন গুরুত্বই খুঁজে পাচ্ছে না, তারা আসলে বুঝতেই অপারগ যে রাজনৈতিক ঝড়টা এবার কোনদিক থেকে আসছে। যারা টিভি’র টক’শোতে বসে বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে দু-চার বাণী বিতরণ করেন, তাঁরা জানেনই না যে বাংলার নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবী মানুষ কীভাবে গড়ে তুলতে পারেন নিজেদের আত্মরক্ষার ঢাল ও মনন, কীভাবে তাঁরা টেনে নিয়ে চলেন জীবনের রথ, কীভাবে তাঁরা ভালোবাসেন পরস্পরকে ও গড়ে তোলেন উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত অধরা এক ধাত্রীভূমিকে। সাবেক বাম বুলি আওড়ানো ভদ্দরলোকেরা আসলে বুঝেই উঠতে পারছে না যে তাদের মাতব্বরির দিন প্রায় শেষ। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর খিস্তি করে, মিম ছড়িয়ে, বক্রোক্তিতে দিনাতিপাত করতে পারে, কলেজ স্ট্রিটে দু-চার নিষ্ফলা চর্বিতচর্বণ বক্তিমে ঝেড়ে ঘরে ফিরতে পারে, কিন্তু মুশকিল হল, তাদের দিকে আপামর বাংলার মানুষ যে কেউ আর ফিরেও তাকাচ্ছে না, সেটা যখনই তারা ধরতে পারছে, তাদের সে পাগলদশায় তাদেরই আরও বিপদ বাড়ছে।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'নূতন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙল ধরে, চাষের কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনা ওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক ঝোপ জঙ্গল, পাহাড় পর্বত থেকে।' নতুন বাংলার স্বপ্ন এইভাবেও হতে পারে। হয়তো হচ্ছে। ভদ্দরজনেদের নজরে আসছে না, তাই পিছু হঠছে উচ্চবিত্ত-উচ্চবর্ণেরা, তাদের ছড়ি ঘোরানো ও কর্তামশাইয়ের চিরায়ত ভূমিকা থেকে। হয়তো তাই কোণে দাঁড়িয়ে অতীব গোসায় তারা মজাও পাচ্ছে নিম্নবর্ণীয় বাঙালির লাঞ্ছনায়।


Sunday, 3 August 2025

বিকল্প অর্থনীতির এক ভাবনা

মৌমাছি সহযোগে চাষই হোক আগামী লক্ষ্য

অর্ণব চক্রবর্তী



চারিদিকে ইদানীং এত রেস্তোরাঁ, নানা পদের লোভনীয় খাবার, কৃষি সংক্রান্ত এত আলোচনা, নানা দেশি-বিদেশি হাইব্রিড কৃষি পণ্যের সমাহার, ঠিক তখনই ততটাই অবহেলিত তাঁরা, যারা নিঃস্বার্থ ভাবে এই কৃষিপণ্য উৎপাদন করছে। এই আলোচনায় কৃষক তো বটেই, তবে বেশি মনোযোগে থাকবে নিবিড় পরাগমিলনকারী ও উপকারী পতঙ্গ মৌমাছিরা।

আইনস্টাইন বলেছিলেন, 'মৌমাছি না থাকলে পৃথিবীর আয়ু মাত্র চার বছর।' এ কথা হয়তো সকলে জানলেও মনে রাখে কজন?

পৃথিবীতে সপুষ্পক উদ্ভিদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তার বংশ বিস্তারের জন্য মৌমাছি এসেছে। মানব সভ্যতার বহু আগে থেকেই মৌমাছি এই পরিবেশে রয়েছে। পরে মানুষ ধীরে ধীরে সমস্ত পশু-পাখির মতো মৌমাছিকে পালন শুরু করে মধু সংগ্রহের জন্য। যে কাজ আজও চলেছে আরও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে দেশ-বিদেশ সর্বত্র। তবে ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে আজও কেবল মধুর জন্য মৌমাছি পালন করা হয়। অন্যদিকে এগিয়ে থাকা দেশগুলো কৃষি ক্ষেত্রে মৌমাছি পালনের মাধ্যমে ব্যাপক উন্নতি করেছে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌমাছির পরাগমিলনের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের বাজার মূল্য বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ₹১.২৫ লক্ষ কোটি থেকে ₹১.৬৫ লক্ষ কোটি)। (সূত্র: USDA (United States Department of Agriculture), Pollinator Partnership, National Honey Board)।

ফসল ভিত্তিক আর্থিক মূল্য:

ফসলের নাম                        আর্থিক মূল্য

১) বাদাম (Almonds)              $৭ বিলিয়ন+  

(১০০ শতাংশ মৌমাছি নির্ভর)        

২) আপেল                             $২ বিলিয়ন+    

(৯০ শতাংশ মৌমাছি নির্ভর)

৩) ব্লুবেরি                            $৫০০ মিলিয়ন+

(উচ্চ পরাগমিলন নির্ভর)

৪) সূর্যমুখী                             $৪০০ মিলিয়ন+

 (উচ্চ পরাগমিলন নির্ভর)

৫) তরমুজ, খিরা, স্কোয়াশ     $১ বিলিয়ন 

(৯০ শতাংশ পরাগমিলন নির্ভর)

অন্যদিকে, মধু ছাড়াও মৌ বিষ থেকে ক্যানসার সহ নার্ভের নানা রোগের ঔষধ তৈরি হচ্ছে, প্রপোলিস অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, রয়েল জেলি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি ও যৌবন রক্ষার্থে, বি পোলেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ও পুষ্টি বৃদ্ধিতে ও মোম বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী প্রস্তুতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া মধুর উপকারিতা তো আমাদের সকলেরই জানা।

মধুর সেবন যারা নিয়মিত করেন তাঁদের করোনা সহ নানা রোগব্যাধি থেকে মুক্তি মিলেছে। এছাড়াও বহু ভিটামিন ও মিনারেল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে বছরে গড়ে মাত্র ১০০-১৫০ গ্রাম মধু ব্যবহৃত হয়। অথচ, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সচেতনতা নেই আমাদের দেশে। যদিও হিমাচল সহ উত্তরাখণ্ড ও কাশ্মীরের কিছু আপেল বাগানে মৌমাছির ব্যবহারে আপেলের ফলন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সেখানে মৌমাছি পালকরা সমাদৃত।

এছাড়া জৈবচাষে মৌমাছির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক। মৌমাছি শুধু মধু উৎপাদনের জন্যই নয়, বরং ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম প্রাকৃতিক মাধ্যম।

পরাগমিলন (Pollination):

মৌমাছিরা বিভিন্ন ফুলে ফুলে গিয়ে পরাগরেণু (pollen) এক ফুল থেকে অন্য ফুলে স্থানান্তর করে;

এর ফলে, ফল, সবজি, তেলবীজ, ডাল জাতীয় ফসল সহ বহু গাছের ফলন বৃদ্ধি পায়;

পরাগমিলন ছাড়া অনেক ফসলই যথাযথভাবে ফল ধরতে পারে না।

পরাগমিলন-নির্ভর কিছু ফসল:

টমেটো, বেগুন, কুমড়ো, তিল, সরিষা, আম, আপেল, আঙুর, সূর্যমুখী, বাদাম ইত্যাদি।

জৈবচাষে ফল ও বীজের গুণগত মান উন্নত করে:

মৌমাছির সাহায্যে গঠিত ফল বা বীজ আকারে বড়, ভারী ও রোগমুক্ত হয়;

হরমোন ও কৃত্রিম রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়াই ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা:

পরাগমিলনের মাধ্যমে জৈব ফার্মে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ও গুণগত মান উভয়ই উন্নত হয়;

গবেষণায় দেখা গেছে, মৌচাষ যুক্ত ফলন ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হতে পারে।

পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা:

মৌমাছি প্রাকৃতিক পরাগমিলনের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সাহায্য করে;

গাছপালা ও বনজ উদ্ভিদদের বংশ বৃদ্ধি মৌমাছির মাধ্যমে সহজ হয়, যা একটি টেকসই বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলে।

রাসায়নিক মুক্ত চাষে সহায়ক: 

ফলে, মৌচাষ ও জৈবচাষ একে অপরের পরিপূরক;

জৈব কৃষিতে কীটনাশক, হরমোন বা কৃত্রিম সার ব্যবহারের পরিবর্তে মৌমাছির মতো প্রাকৃতিক উপাদান নির্ভরতা বেশি যা মৌমাছির জন্য নিরাপদ;

মৌমাছির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে জমি নিষ্কলুষ ও পরিবেশবান্ধব।

ফসলের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করে:

মৌমাছির সক্রিয় পরাগমিলন ফসলের ফুল থেকে ফল হওয়ার সময়কে দ্রুততর করে তোলে;

এর ফলে এক জমিতে বছরে দুই থেকে তিনবার ফসল তোলা সম্ভব হতে পারে।

অতিরিক্ত আয় ও জীবিকা:

চাষিরা জৈবচাষের পাশাপাশি মৌচাষ করলে মধু, মোম ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করে অতিরিক্ত আয় করতে পারেন;

গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৌচাষ একটি টেকসই বিকল্প জীবিকা।

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরে অনেক কৃষক এখন জৈবচাষের সঙ্গে সঙ্গে Apis cerana indica বা Apis mellifera প্রজাতির মৌমাছি পালন করছেন। জৈবচাষে মৌমাছির ভূমিকা শুধু কৃষি উৎপাদন বাড়ানো নয়, বরং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই, জৈব কৃষি নীতি পরিকল্পনায় মৌচাষকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এছাড়াও বিকল্প জীবিকা হিসাবে মৌমাছি পালন একটি লাভজনক দিক হয়ে উঠতে পারে আগামী প্রজন্মের কাছে। 

মৌমাছি পালন শিখে বাড়িতে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে বা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ যেমন একটি পেশা হতে পারে, তেমনি মধু বা মধুজাত সামগ্রী ক্রয় করে বিক্রি বা জোগান আরেকটি লাভজনক পেশা হয়ে উঠতে পারে। প্রয়োজন শুধু একটি যুক্তিপূর্ণ পরিবেশবান্ধব ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির।

এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সকল চাষী, প্রকৃতিপ্রেমী, সমাজসেবী সংগঠন ও সকল স্তরের চিন্তাশীল মানুষের কাছে আবেদন, সমাজের নানা স্তরে মৌমাছি পালনে উৎসাহ প্রদান করুন। যে কেউ নিজের বাড়িতে খুব সহজেই মৌমাছি পালন করতে পারেন-- এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিন চারিদিকে। সরকার বিভিন্ন চাষে যেমন উৎসাহ প্রদান করে তেমনি সচেতনতা তৈরি হোক মৌমাছি পালন নিয়ে। বিশেষ করে সকল চাষী ভাইদের কাছে আবেদন, আপনারা আপনাদের চাষের জমিতে কোম্পানির চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন দেখে কোনও প্রকার বিষ বা রাসায়নিক ব্যবহার করবেন না এবং চাষের জমিতে প্রতি বিঘাতে ৪-৬টি সেরেনা মৌমাছির বাক্স রাখুন। বছরের শেষে দেখবেন, আপনার জৈব চাষের ফলন কয়েক গুণ বাড়বে, বিষমুক্ত ফসল ব্যবহার করার ফলে শরীর সুস্থ থাকবে, সঙ্গে ব্যবসায় লাভ বাড়বে। এছাড়া পরিবারের প্রয়োজনীয় খাঁটি মধু পাবেন সারা বছর। কৃষি ক্ষেত্রে 'মৌমাছি সহযোগে চাষ' এটাই হোক আমাদের আগামীর লক্ষ্য।

এই বার্তা যে সকল সরকারি কৃষি বিভাগের আধিকারিক, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি গবেষক, ছাত্র-ছাত্রী, কৃষি বিশেষজ্ঞ, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের আধিকারিকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, তাঁদের অনুরোধ, এছাড়াও মৌমাছি পালক, কীটপতঙ্গ গবেষক ও মৌমাছি প্রেমী মানুষজন তাদের সকলের কাছেই অনুরোধ, আসুন, সকলে মিলে পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগী হয়ে মৌমাছি পালন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে সমাজ সংরক্ষণের কাজে এগিয়ে আসি আগামী প্রজন্মের জন্য।


Saturday, 2 August 2025

মাননীয় ভদ্দরলোকীয় কৃতিরা

ওদের ভাষা আমাদের ভাষা

মালবিকা মিত্র



ভদ্রেশ্বর পৌরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আমি। তার পাশের ওয়ার্ড ২০ নম্বরে, আমাদের রাস্তার ঠিক ওপারে, রক্তদান শিবির। মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। যেতে গিয়ে পুরনো অভ্যাস মতো চায়ের দোকানে একটু আড্ডা দিয়ে গেলাম। ওখানেই শুনছিলাম, এক ভদ্রলোক পুরী বেড়াতে গিয়ে চরম হেনস্থার শিকার। একে তো বাংলায় কথা বলে, তায় আবার নাম অনীশ। অনীশ নামটা অনায়াসেই আনিস, আনিসুর হয়ে যায়। আর আধার কার্ড, প্যানকার্ড বা ভোটার কার্ড ওগুলো তো কোনও পরিচয়পত্রই নয় বিজেপি শাসিত রাজ্যে। সর্বোপরি, ভদ্রলোক পুরীর মাছের বাজারে গিয়ে, মাছের বাজারটা ছোট হয়ে গেছে, সমুদ্র সৈকতের শহরে মানুষ মাছ-মাংস খাবে না তা কি হয় ইত্যাদি মন্তব্য করে ট্যুইট করেছে। বহু রেস্তোরাঁয় নন-ভেজ বন্ধ হয়ে গেছে, পাননি বলে সরস মন্তব্য করেছেন। এসবই হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত ঠিকাদারদের বানর বাহিনীর কর্ণগোচর হয়েছে। এমনকি এক রাত তাকে থানা লক-আপে আটকে রাখা হয়। ফলত, পাঁচ দিন পুরী থাকার প্রোগ্রাম থাকলেও মাত্র দুদিনেই তা সমাপ্ত করে ফিরে আসেন। তার সকরুণ নির্মম অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনছিলাম।

যথারীতি অন্য একজন খদ্দের তিনি সরব হলেন যে, এসব বাজে প্রচার। তার নিজের ছেলে ও বৌমা ভুবনেশ্বরে আইআইটি ও এইমস'এ কর্মরত। তাদের তো কোনও অসুবিধে শোনেননি। বললেন, তাদের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় পরিজনের কথা, যারা অনেকেই হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ বা দিল্লিতে কর্মরত। তারা কেউ ডাক্তারি করছেন, কেউ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, কেউ উচ্চপদস্থ আমলা বা ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক। কেউ তো অভিযোগ করেনি। ঠিকই, এখন পর্যন্ত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো থেকে এই শ্রেণির লোকজনের ওপর হেনস্থার কোনও অভিযোগ নেই। তারা বরং বাংলাভাষী, বাংলাদেশি, মুসলমান, এসব খুঁজছেন মূলত পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে; ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে নয়। ভদ্রলোক অভিযোগ করলেন, এ রাজ্য থেকে ভিন রাজ্যে শ্রমিকদের যেতে হয় কেন? এ রাজ্যে কাজ নেই কেন? 

আমার হাতে সময় নেই। না হলে তাকে জানানো যেত যে এ রাজ্য থেকে বছরে কুড়ি লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয়। আর প্রায় চল্লিশ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক এ রাজ্যে আসেন। চায়ের দোকানের তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনায় না জড়িয়ে আমি দ্রুত পায়ে রক্তদান শিবিরের পথে এগোলাম। শুধু রক্তদান নয় সঙ্গে আছে ওয়ার্ডের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের সম্বর্ধনা জ্ঞাপন অনুষ্ঠান। প্রচুর লোকসমাগম। লোকজনের বসার জন্য সুবন্দোবস্ত, প্রচুর চেয়ার। একটি কাউন্টার থেকে যারা রক্তদান করছেন তাঁদের রক্তদানের পর পুষ্টিকর খাদ্য পরিবেশন, একটি সুদৃশ্য স্মারক, এছাড়াও প্রাত্যহিক ব্যবহারযোগ্য ভালো ব্যাগ, লাঞ্চ বক্স ইত্যাদি উপহার দেওয়া হচ্ছে। 

একবার মাইক্রোফোনে ঘোষণা করা হল, দু' ঘণ্টার মধ্যেই ৬৫ জন রক্তদাতা তাঁদের মহামূল্যবান রক্ত দান করেছেন। আধুনিক কারিগরি দক্ষতার কারণে এই মহাদান শুধু ৬৫ জনকেই নয়, রক্তের উপাদান পৃথকীকরণের মাধ্যমে (প্লেটলেট, প্লাজমা, লোহিত রক্তকণিকা) তিন গুণ মানুষের উপকার সাধন করবে। শুনলাম, গত বছর এই শিবিরে বহু মানুষ রক্ত দিতে এসেও ফিরে যান। কারণ, ১০০ জনের বেশি রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। তাই এ বছর দুটি ব্লাড ব্যাংক থেকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। এ বছর কমপক্ষে দেড়শো জনের রক্ত সংগ্রহ করা যাবে। 

রক্তদান সম্পর্কে আমার একটা ভিন্নতর আবেগ আছে। আমি রক্তদাতা নই, আমি গ্রহীতা। আমার কার্ডিয়াক বাইপাস সার্জারির সময় ফ্রেশ ব্লাডের জন্য রক্তদাতা নিয়ে যেতে হয়েছিল ব্লাড ব্যাংকে। একজন হলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, বাকিরা ইমরান হক, রমেশ প্রসাদ, সমীর দত্ত, শিশির দোলুই; পাঁচজনের কম্বিনেশনটা ভাবুন। শুদ্ধ ব্রাহ্মণ কায়স্থ নিম্নবর্ণ হিন্দু আবার শিক্ষক ছাত্র শ্রমিক সবাই আছেন। আবার বাঙালি অবাঙালিও আছে। আবার হিন্দু মুসলমান আছে। এই সামগ্রিক মিশ্রণে রক্তদানের কথা শুনলেই আমার শরীরে শ্রদ্ধা জনিত আবেগের স্রোত বয়ে যায়। 

সে যাই হোক, প্রচুর লোকসমাগম আর কম বয়সীদের ভিড় জমেছে। উদ্যোক্তাদের দাবি ও অনুরোধ মতো আমিও কিছু কৃতি ছাত্র-ছাত্রীর হাতে সম্বর্ধনা তুলে দিলাম। খুব ভালো দামি পিঠ ব্যাগ, একটি স্মারক, কিছু ফুল মিস্টি আর মূল্যবান একটি পেন। প্রায় ৮৫ জনকে এই সম্বর্ধনা দেওয়া হল। এলাকার পৌরসভার কাউন্সিলর, পৌর প্রধান ও উপ পৌর প্রধান সকলেই হাজির। প্রত্যেকেই ভাগাভাগি করে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনে অংশ নিলেন। প্রত্যেকেই তাদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করে কিছু বক্তব্য রাখলেন। প্রাক্তন শিক্ষক হবার কারণে বোধ করি আমাকেও কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হল। বলতে পারেন, আমি ছিলাম শেষ বক্তা। 

রক্তদানের মহত্ত্ব জেনে বা না জেনে সকলেই রক্তদান করছেন। তাদের উদ্দেশ্যে কোনও জ্ঞান দানের অধিকার ও অভিপ্রায় কোনওটাই আমার নেই। আমি আগে এই রক্তদানে যোগদান করতে আসার সময় চায়ের দোকানের আড্ডার গল্পটা শোনালাম। এলাকায় একটা এত বড় মহতি কর্মযজ্ঞ চলছে অথচ দেখুন আমি এসে যে কয়েকশো মানুষের ভিড় দেখেছিলাম সেটা মুহূর্তে কত পাতলা হয়ে গেছে। কারণ, ৮৫ জন কৃতি ছাত্রের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিলেন কমপক্ষে দুজন বা আরও বেশি মানুষ, মা বাবা কাকা বা পিসি প্রমুখ। একজন করে সম্বর্ধনা নিয়েছে, আর সঙ্গে সঙ্গে তিন বা তার বেশি মানুষ জমায়েত থেকে বিদায় নিয়েছে। এভাবে ৮৫ জনের সম্বর্ধনার শেষে অঙ্কের নিয়মে প্রায় আড়াইশো তিনশো মানুষ একে একে বিদায় নিয়েছে। ফলে, এরপর যারা রইল তারা প্রধানত উদ্যোক্তা স্বেচ্ছাসেবক রক্তদাতা প্রমুখ। অথচ এই কৃতিরা নিজের চেয়ার ছেড়ে পাশের লম্বা হলে একবার উঁকি দিয়ে দেখতে গেল না কারা কীভাবে রক্ত দেয়, কীভাবে তা নেওয়া হয়, সংগ্রহ করা হয়, রক্তদানের আগের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এসব কিছুই জানলো না। 

এভাবেই এক বৃহত্তর সামাজিক পরিসর থেকে কৃতি ছাত্র-ছাত্রীরা ও তাদের অভিভাবকেরা বিযুক্ত হয়ে থাকছেন। বলা যায়, অভিভাবকরা বিযুক্ত করে রাখছেন। স্বপ্ন, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'। এই অভিভাবকই তো চায়ের দোকানে বসে চিৎকার করে গলা ফাটায়-- কই, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপক আইনজীবী কত সহস্র বাঙালি ভিন রাজ্যে আছেন, তাদের তো বাঙালি বলে হেনস্থা করা হচ্ছে না। আসলে এই শ্রেণিটি নিজেরা রক্তদান করে না। কিন্তু বেঙ্গালুরু বা পুনেতে বসে যখন খবর পায় অসুস্থ বাবা বা মায়ের রক্ত প্রয়োজন, সে সরাসরি ফোন করে ওই কাউন্সিলরকে। অমুক কাকু, তমুক দাদা, আমার মায়ের জন্য আমার বাবার জন্য দু' বোতল রক্তের ব্যবস্থা করে দাও।

এখানেই প্রশ্ন; যে ফোন করে অনুরোধ করল, সে কিন্তু কোনওদিন দাতা হয়নি, সে গ্রহীতা। এমনকি সে জানেও না কীভাবে এই রক্ত পাওয়া যায়। বেশ মনে পড়ছে, একটি শিশুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মাছ কোথায় থাকে? সে বলেছিল, মাছ খাবারে থাকে। আবার প্রশ্ন, খাবার আসে কোথা থেকে? সে বলল, রেস্তোরাঁ থেকে। কারা দিয়ে যায়? শুইগি, জোমাটো। কিছুতেই তাকে বলানো গেল না জেলে বা ধীবরদের কথা, যারা মাঝরাতে মাছ ধরতে বের হয়। ভোর রাতে মাছ ধরে ফিরে বাজারে পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে হোটেল রেস্তোরাঁয়, লোকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যায়। এই সমাজটাকে সে তো দেখেনি কখনও। এরাই কৃতি ছাত্র হবে, এরাই পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে, এরা জানবে ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত পাওয়া যায়। কিন্তু সে রক্ত সেখানে কোথা থেকে আসে, তা কখনও জানবে না। না জানলেও চলবে। 

এই না জানাটাই তো 'উচ্চ মেধা'র প্রমাণ। এই কৃতিরাই অথবা এদের মা-বাবা কাকা পিসিরা বুক ঠুকে বলতে পারবে-- কই, দিল্লি বোম্বাই গুজরাট রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ বিহার উড়িষ্যায় তো কোনও বাঙালি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপক আক্রান্ত হচ্ছে না। বাংলাভাষীর উপর আক্রমণ স্রেফ বাজে কথা। প্রাতঃস্মরণীয় বাঙালি পবিত্র সরকার, তিলোত্তমা মজুমদার'রা তো এমন কথাই বলে থাকেন। আর সত্যিই তো, এই শ্রেণি তো নিজের পরিবারেও নিজেরা পরস্পরে বাংলা ভাষায় কথা বলেন না। এদের অধিকাংশ কথাবার্তা জুড়ে থাকে ইংরেজি ও কিছুটা হিন্দি। এদের শিশু বাইরে রেইন দেখে। এরা লায়ন ডিয়ার টাইগার চেনে। এরা ঘরে মা বাবার কথাবার্তায় 'ফাক' শব্দের ব্যবহার শুনতে পায়। বাবা বলে, ফাক ইওর মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট। মা বলে, ফাক ইউর হিউম্যানিজম। এদের প্রত্যেকের কাছেই মাতৃভাষা বাংলাটা থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বাংলা-ফাংলা। ইংরেজি ভাষায় তো কোনও 'কুৎসিত খিস্তি গালাগালি হয়ই না'। 

আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ভাষা তো ভাবের বাহন। আমি যদি সঠিক ভাবে ভাবতে না পারি, বুঝতে না পারি, তাহলে সেটা প্রকাশ করব কী করে? ভাবটা এ ক্ষেত্রে মুখ্য, ভাষাটা অর্থাৎ প্রকাশ মাধ্যমটা গৌণ। আর ভাবনাটা তো সব সময় মাতৃভাষাতেই হয়। আমি খাই, আমি ভালোবাসি, আমি ঘুমবো, এগুলো কি ইংরেজিতে ভাবা যায়? শুনে একজন বলেছিল, কে বলেছে মাতৃভাষায় ভাবতে হবে! ছোট থেকে যদি ভাবনা শব্দটাই আমার মগজে না থাকে, পরিবর্তে থিঙ্ক শব্দটা স্থান করে নেয়, মিস্টি স্বাদ কি আমার না জানলেও চলে। সুইট সুইটনেস যদি মগজে স্থান নেয়, তাহলে মাতৃভাষা ছাড়াই চিন্তাভাবনা করা যায়। হয়তো বা ঠিক কথাই বলেছেন উনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কথাটা মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না:

'পূর্বে এমন দিন ছিল যখন ইংরেজি পাঠশালা হইতে আমাদের একেবারে ছুটি ছিল না। বাড়ি আসিতাম, সেখানেও পাঠশালা পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া আসিত। বন্ধুকেও সম্ভাষণ করিতাম ইংরেজিতে, পিতাকেও পত্র লিখিতাম ইংরেজিতে, প্রাণের কথা বলিতাম ইংরেজি কাব্যে, দেশের লোককে সভায় আহ্বান করিতাম ইংরেজি বক্তৃতায়। ...দিনের পড়া তো শেষ হইল, তার পরে ক্রিকেট খেলাতেও না হয় রণজিৎ হইয়া উঠিলাম। তার পরে? তার পরে গৃহবাতায়ন হইতে মাতার স্বহস্তজ্বালিত সন্ধ্যাদীপটি কি চোখে পড়িবে না? যদি পড়ে, তবে কি অবজ্ঞা করিয়া বলিব 'ওটা মাটির প্রদীপ?' ঐ মাটির প্রদীপের পশ্চাতে কি মাতার গৌরব নাই? যদি মাটির প্রদীপই হয় তো সে দোষ কার? মাতার কক্ষে সোনার প্রদীপ গড়িয়া দিতে কে বাধা দিয়াছে? যেমনই হউক না কেন, মাটিই হউক আর সোনাই হউক, ....যখন দুঃখের অন্ধকার ঘনাইয়া আসে তখন রাজপথে দাঁড়াইয়া চোখের জল ফেলা যায় না-- তখন ঐ গৃহ ছাড়া আর গতি নাই।'

বুবুন তার কনভেন্ট স্কুলে ঢুকতে বিলম্বের কারণে গেটে অনেক কান্নাকাটি করলেও দারোয়ান তাকে ছাড়েনি। সে বাড়ি ফিরে আসে। মাকে বলে, আমি ইংরেজিতে কাঁদতে পারিনি। তাই ঢুকতে দিল না। 

-- তাহলে তোর সঙ্গে তো অদিতি যায়, ও ঢুকল কী করে? বুবুনের মায়ের প্রশ্ন। 

বুবুন বলল, ও তো কি সব গড়গড় করে 'ইওর মেমোরেবল রেইনি ডে' প্যারাগ্রাফটা বলতে শুরু করল। দারোয়ান ওকে ছেড়ে দিল। 

অদিতি জানে, ইংরেজিতে কোনও ভুল বলা যায় না; কোনও খারাপ কথা বলা যায় না। পবিত্র ভাষা।