Monday, 30 June 2025

কলেজ চত্বরে কাদের মাস্তানি

কলুষিত শিক্ষা অঙ্গন

আবু সঈদ আহমেদ



স্কুল জীবন থেকে কলেজ জীবনে পা রাখার সময়টা ছাত্রছাত্রীদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর মোড়। তবে একে ঘিরে মানসিক অস্থিরতাও একেবারে কম নয়। এই সময় তারা একাধিক মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে-- একইসঙ্গে পায় উত্তেজনা ও স্বাধীনতার অনুভব, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ, নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা— এসব এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। কেউ কেউ হোস্টেল বা বাড়ির বাইরে থাকতে শুরু করে, জীবনের প্রথম স্বাধীনতা অনুভব করে। তবুও সব কিছু এত রঙিন নয়। যেমন, মনে আসে নানা উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। নতুন পরিবেশ, অপরিচিত বন্ধু-বান্ধব, কঠিন একাডেমিক চ্যালেঞ্জ— সবই একটা উদ্বেগ তৈরি করে। ভবিষ্যতের কেরিয়ার নিয়ে চাপ তৈরি হয়, 'ঠিক পথে হাঁটছি তো?', এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে।

কেউ কেউ আবার হতাশায় ভোগে, নিজের জায়গাটা খুঁজে পেতে সময় নেয়। আর জীবনের এই সময়েই নারী জীবনের সব থেকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হল কসবার আইন কলেজের এক ছাত্রী। যেখানে অপরাধী হিসেবে নাম উঠে এসেছে সেই কলেজেরই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের, যাদের মধ্যে মূল অভিযুক্ত ওই কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র, যে কলেজের পঠনপাঠনের সঙ্গে আর যুক্ত না থাকলেও কলেজ চত্বরে দিনের পর দিন অবাধে মাস্তানি চালিয়ে গেছে। 

আমরা জানি, ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠস্বর ছাত্র ইউনিয়ন মারফত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিফলিত হওয়াটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গণতান্ত্রিক ও সচেতন শিক্ষাব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। এখানেই ছাত্ররা সরাসরি জানাতে পারে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে তারা পড়ছে— হোক তা একাডেমিক, প্রশাসনিক কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়। নীতিমালায় পরিবর্তনের আগে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক মতামত উঠে আসে। যখন ছাত্রছাত্রীরা নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার অংশ হয়, তখন তারা সিদ্ধান্তগুলিকে আরও দায়িত্ব নিয়ে গ্রহণ করে। এতে দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্বের গুণাবলী গড়ে ওঠে। একজন ছাত্রনেতা হয়ে ওঠা মানে সমস্যার সমাধান, জনসংযোগ ও সময় ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা অর্জন। ছাত্রছাত্রীদের ইউনিয়ন কার্যকলাপে যুক্ত করা মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আরও স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও শোধনযোগ্য হয়। এতে শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল পরীক্ষায় ভালো ফল করা নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত হয়। অতএব, একজন ছাত্র প্রতিনিধি হওয়াটা শুধু একটা পদ নয়, বরং এটাও শেখা, কীভাবে নিজের কথা বলা এবং অন্যের কণ্ঠস্বরকেও গুরুত্ব দেওয়া যায়।

অথচ, পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলোতে বহুদিন ছাত্র সংসদের নির্বাচন নেই। সর্বত্র একদলীয় তৃণমূলি রাজনৈতিক দাপট। যার ফল হয়েছে, ক্লাসরুম, গ্রন্থাগার বা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের চলাফেরার জায়গাগুলো রাজনৈতিক দখলদারিতে পরিণত। পড়াশোনা ও গবেষণার পরিবেশে ভয়, চাপ ও হুমকির ছায়া। আগের শাসনামলগুলোতেও এসবের অভাব ছিল না। কিন্তু এখন সবই মাত্রাছাড়া চলছে। হঠাৎ হুমকি, মারপিট বা সংঘাতের মাঝে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা মানসিক উদ্বেগে ভুগছে। কেউ কেউ ক্যাম্পাসে আসতে ভয় পাচ্ছে বা শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ রেখেই সরে দাঁড়াচ্ছে। কলেজে ছাত্র ভর্তিও কমে যাচ্ছে। 

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিছু গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে অস্ত্রও ব্যবহার করছে। এইভাবে তারা টাকাও তোলে।ফলে, 'ছাত্রনেতা' শব্দটা নেতিবাচক অর্থ পেতে শুরু করেছে। যখন দুর্বৃত্তরা বিচারহীনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তখন ছাত্রদের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। নৈতিক শিক্ষার জায়গা দখল করে নেয় ক্ষমতার রাজনীতি। প্রকৃত নেতৃত্ব গুণ থাকা ছাত্ররা পেছনে পড়ে যাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে, অথবা দূরে সরে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চিন্তাশীল সমাজনেতারা হারিয়ে যাচ্ছে সহিংসতার কোলাহলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। দেশের বাইরে পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উচ্চশিক্ষা ও কেরিয়ার তৈরির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। দেশে বা বিশ্বে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে।

যখন ছাত্র রাজনীতি আদর্শ, নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক চর্চার বদলে দুর্বৃত্তায়নের পথে হাঁটে, তখন তা গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিতে পারে। ছাত্র রাজনীতি যদি আদর্শভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে তা সমাজ পরিবর্তনের এক মহৎ মাধ্যম হতে পারে। কিন্তু যখন সেটাই দুর্বৃত্তদের হাতে পড়ে যায়, তখন স্বপ্নের ক্যাম্পাস রূপ নেয় আতঙ্কের প্রান্তরে। এই চক্র থেকে বেরনো উচিত।

সঠিক ছাত্র প্রতিনিধিত্ব না থাকলে আরেকটি ব্যাধি অবাধে চলতে থাকে। তা হল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষপাতিত্ব। কিছু তোষামোদকারী ছাত্রছাত্রীদের সামনে রেখে তৈরি করা হয় এক ক্লেদাক্ত পরিবেশ। এখানে শিক্ষককে আর 'নিরপেক্ষ' গাইড বা মেন্টর হিসেবে দেখা যায় না। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে ভাঁটার টান পড়ে, ফলে ক্লাসের নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা দেখা দেয়। পক্ষপাত শিক্ষাকে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও জটিল খেলায় পরিণত করে, যেখানে গুণ নয়, পরিচয় বা প্রভাব প্রাধান্য পায়। এখানে যারা পক্ষপাতের বাইরে থাকে, তারা নিজেদের অবমূল্যায়িত বা অবহেলিত মনে করে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে 'পছন্দের' ও 'অপছন্দের' গোষ্ঠী তৈরি  হয়। বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। পক্ষপাতিত্ব'র ফলে ছাত্রছাত্রীরা অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে নিজের প্রকৃত উন্নতির চেষ্টা কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, অবহেলিত ছাত্ররা নিজের দক্ষতা প্রমাণের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে।

রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় ক্ষমতা ধরে রাখা যে কোনও মূল্যে, তাহলে তা মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের আত্মাকে আঘাত করে। অপরাধীরা যখন রাজনৈতিক আশ্রয় পায়, তখন তারা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। বিচারব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং সাধারণ মানুষ 'ন্যায় পাব কি না' সেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। নীতিনির্ধারকরা দুর্বৃত্তদের স্বার্থরক্ষার জন্য নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করে ফেলতে পারে, সে সবও মানুষ দেখছে। দেশ জুড়েই প্রশাসনের মধ্যেও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী মত দমন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিও বাড়ছে।

গোটা দেশেই দেখা যাচ্ছে, কখনও ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলা হচ্ছে, কখনও ধর্ষকদের গলায় মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, কখনও ধর্ষকদের পক্ষে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল বেরচ্ছে। দুষ্কৃতিপূর্ণ আচরণ যদি রাজনৈতিক ছায়ায় সুরক্ষা পায়, তাহলে তা সমাজ, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ন্যায়ের প্রতি আস্থা— সবকিছুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। নারী নির্যাতন যদি সমাজে 'নিয়মিত', 'সহনীয়' কিংবা 'সংস্কৃতির অংশ' হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তাহলে তা শুধুই একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং পুরো সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধেই ফাটল ধরায়। নির্যাতনকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা মানে অপরাধী আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, নারীর আত্মসম্মান ও মানসিক স্বাস্থ্য ধ্বংস হয়। নির্যাতনে আক্রান্তরা মনে করেন, নালিশ করেও কিছু হবে না। ফলে, তাঁরা চুপ করে যান আর অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। নির্যাতনের শিকার নারী নিজেই নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করে। উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, হীনম্মন্যতা এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। এসবের ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে— 'এমনই তো সবসময় হয়' ধরনের ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে। যখন অন্যের কষ্টকে 'নিয়মিত ব্যাপার' হিসেবে দেখা হয়, তখন সামগ্রিকভাবে সমাজের সহানুভূতি হারিয়ে যায়। যখন দেখা যায় অপরাধীরা পুরস্কৃত হচ্ছে, আর সৎরা বঞ্চিত, তখন তরুণ প্রজন্ম মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্যগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়। পাশাপাশি, আইনের শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর আন্তর্জাতিক মহলে যাওয়াতে দেশের আর্থিক বিনিয়োগ, শিক্ষা বিনিময় বা পর্যটন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সহিংসতার চক্র আরও গভীর ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে। 

নির্যাতনের ঘটনা যতই 'নর্মাল' করার চেষ্টা হোক না কেন, সচেতন কণ্ঠই পারে সেই অস্বাভাবিকতাকে দৃঢ়ভাবে চিহ্নিত করতে। সচেতনতা ও প্রতিবাদই পাল্টে দিতে পারে এই সংস্কৃতি।


2 comments:

  1. These mastans were there even in the sixties. Then they were Congress mastans but they were under check because of rise of radical student movement. The Congress mastans of yester years are today Trinamool Cingress mastans. What is needed is progressive student movement to get back healthy campus atmosphere . In the '60s Tariq Alis and Cohn Bendits used to sing Communist internationale from student platform. And today what they are doing?

    ReplyDelete
  2. লেখক খুব সুন্দর ও সাবলীল ভাবে বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন।

    ReplyDelete