Monday, 30 June 2025

কলেজ চত্বরে কাদের মাস্তানি

কলুষিত শিক্ষা অঙ্গন

আবু সঈদ আহমেদ



স্কুল জীবন থেকে কলেজ জীবনে পা রাখার সময়টা ছাত্রছাত্রীদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ এবং রোমাঞ্চকর মোড়। তবে একে ঘিরে মানসিক অস্থিরতাও একেবারে কম নয়। এই সময় তারা একাধিক মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে-- একইসঙ্গে পায় উত্তেজনা ও স্বাধীনতার অনুভব, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ, নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা— এসব এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। কেউ কেউ হোস্টেল বা বাড়ির বাইরে থাকতে শুরু করে, জীবনের প্রথম স্বাধীনতা অনুভব করে। তবুও সব কিছু এত রঙিন নয়। যেমন, মনে আসে নানা উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। নতুন পরিবেশ, অপরিচিত বন্ধু-বান্ধব, কঠিন একাডেমিক চ্যালেঞ্জ— সবই একটা উদ্বেগ তৈরি করে। ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার নিয়ে চাপ তৈরি হয়, 'ঠিক পথে হাঁটছি তো?', এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে।

কেউ কেউ আবার হতাশায় ভোগে, নিজের জায়গাটা খুঁজে পেতে সময় নেয়। আর জীবনের এই সময়েই নারী জীবনের সব থেকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হল কসবার আইন কলেজের এক ছাত্রী। যেখানে অপরাধী হিসেবে নাম উঠে এসেছে সেই কলেজেরই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের, যাদের মধ্যে মূল অভিযুক্ত ওই কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র, যে কলেজের পঠনপাঠনের সঙ্গে আর যুক্ত না থাকলেও কলেজ চত্বরে দিনের পর দিন অবাধে মাস্তানি চালিয়ে গেছে। 

আমরা জানি, ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠস্বর ছাত্র ইউনিয়ন মারফত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিফলিত হওয়াটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গণতান্ত্রিক ও সচেতন শিক্ষাব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। এখানেই ছাত্ররা সরাসরি জানাতে পারে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে তারা পড়ছে— হোক তা একাডেমিক, প্রশাসনিক কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়। নীতিমালায় পরিবর্তনের আগে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক মতামত উঠে আসে। যখন ছাত্রছাত্রীরা নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার অংশ হয়, তখন তারা সিদ্ধান্তগুলিকে আরও দায়িত্ব নিয়ে গ্রহণ করে। এতে দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্বের গুণাবলী গড়ে ওঠে। একজন ছাত্রনেতা হয়ে ওঠা মানে সমস্যার সমাধান, জনসংযোগ ও সময় ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা অর্জন। ছাত্রছাত্রীদের ইউনিয়ন কার্যকলাপে যুক্ত করা মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আরও স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও শোধনযোগ্য হয়। এতে শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল পরীক্ষায় ভালো ফল করা নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত হয়। অতএব, একজন ছাত্র প্রতিনিধি হওয়াটা শুধু একটা পদ নয়, বরং এটাও শেখা, কীভাবে নিজের কথা বলা এবং অন্যের কণ্ঠস্বরকেও গুরুত্ব দেওয়া যায়।

অথচ, পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলোতে বহুদিন ছাত্র সংসদের নির্বাচন নেই। সর্বত্র একদলীয় তৃণমূলি রাজনৈতিক দাপট। যার ফল হয়েছে, ক্লাসরুম, গ্রন্থাগার বা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের চলাফেরার জায়গাগুলো রাজনৈতিক দখলদারিতে পরিণত। পড়াশোনা ও গবেষণার পরিবেশে ভয়, চাপ ও হুমকির ছায়া। আগের শাসনামলগুলোতেও এসবের অভাব ছিল না। কিন্তু এখন সবই মাত্রাছাড়া চলছে। হঠাৎ হুমকি, মারপিট বা সংঘাতের মাঝে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা মানসিক উদ্বেগে ভুগছে। কেউ কেউ ক্যাম্পাসে আসতে ভয় পাচ্ছে বা শিক্ষাজীবন অসম্পূর্ণ রেখেই সরে দাঁড়াচ্ছে। কলেজে ছাত্র ভর্তিও কমে যাচ্ছে। 

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিছু গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে অস্ত্রও ব্যবহার করছে। এইভাবে তারা টাকাও তোলে।ফলে, 'ছাত্রনেতা' শব্দটা নেতিবাচক অর্থ পেতে শুরু করেছে। যখন দুর্বৃত্তরা বিচারহীনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তখন ছাত্রদের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। নৈতিক শিক্ষার জায়গা দখল করে নেয় ক্ষমতার রাজনীতি। প্রকৃত নেতৃত্ব গুণ থাকা ছাত্ররা পেছনে পড়ে যাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে, অথবা দূরে সরে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চিন্তাশীল সমাজনেতারা হারিয়ে যাচ্ছে সহিংসতার কোলাহলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। দেশের বাইরে পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার তৈরির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। দেশে বা বিশ্বে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে।

যখন ছাত্র রাজনীতি আদর্শ, নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক চর্চার বদলে দুর্বৃত্তায়নের পথে হাঁটে, তখন তা গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিতে পারে। ছাত্র রাজনীতি যদি আদর্শভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে তা সমাজ পরিবর্তনের এক মহৎ মাধ্যম হতে পারে। কিন্তু যখন সেটাই দুর্বৃত্তদের হাতে পড়ে যায়, তখন স্বপ্নের ক্যাম্পাস রূপ নেয় আতঙ্কের প্রান্তরে। এই চক্র থেকে বেরনো উচিত।

সঠিক ছাত্র প্রতিনিধিত্ব না থাকলে আরেকটি ব্যাধি অবাধে চলতে থাকে। তা হল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষপাতিত্ব। কিছু তোষামোদকারী ছাত্রছাত্রীদের সামনে রেখে তৈরি করা হয় এক ক্লেদাক্ত পরিবেশ। এখানে শিক্ষককে আর 'নিরপেক্ষ' গাইড বা মেন্টর হিসেবে দেখা যায় না। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে ভাঁটার টান পড়ে, ফলে ক্লাসের নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা দেখা দেয়। পক্ষপাত শিক্ষাকে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও জটিল খেলায় পরিণত করে, যেখানে গুণ নয়, পরিচয় বা প্রভাব প্রাধান্য পায়। এখানে যারা পক্ষপাতের বাইরে থাকে, তারা নিজেদের অবমূল্যায়িত বা অবহেলিত মনে করে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে 'পছন্দের' ও 'অপছন্দের' গোষ্ঠী তৈরি  হয়। বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। পক্ষপাতিত্ব'র ফলে ছাত্রছাত্রীরা অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে নিজের প্রকৃত উন্নতির চেষ্টা কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে, অবহেলিত ছাত্ররা নিজের দক্ষতা প্রমাণের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে।

রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় ক্ষমতা ধরে রাখা যে কোনও মূল্যে, তাহলে তা মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের আত্মাকে আঘাত করে। অপরাধীরা যখন রাজনৈতিক আশ্রয় পায়, তখন তারা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। বিচারব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং সাধারণ মানুষ 'ন্যায় পাব কি না' সেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। নীতিনির্ধারকরা দুর্বৃত্তদের স্বার্থরক্ষার জন্য নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করে ফেলতে পারে, সে সবও মানুষ দেখছে। দেশ জুড়েই প্রশাসনের মধ্যেও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী মত দমন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিও বাড়ছে।

গোটা দেশেই দেখা যাচ্ছে, কখনও ধর্ষণকে সাজানো ঘটনা বলা হচ্ছে, কখনও ধর্ষকদের গলায় মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, কখনও ধর্ষকদের পক্ষে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল বেরচ্ছে। দুষ্কৃতিপূর্ণ আচরণ যদি রাজনৈতিক ছায়ায় সুরক্ষা পায়, তাহলে তা সমাজ, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ন্যায়ের প্রতি আস্থা— সবকিছুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। নারী নির্যাতন যদি সমাজে 'নিয়মিত', 'সহনীয়' কিংবা 'সংস্কৃতির অংশ' হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তাহলে তা শুধুই একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং পুরো সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধেই ফাটল ধরায়। নির্যাতনকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা মানে অপরাধী আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, নারীর আত্মসম্মান ও মানসিক স্বাস্থ্য ধ্বংস হয়। নির্যাতনে আক্রান্তরা মনে করেন, নালিশ করেও কিছু হবে না। ফলে, তাঁরা চুপ করে যান আর অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। নির্যাতনের শিকার নারী নিজেই নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করে। উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, হীনম্মন্যতা এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। এসবের ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে— 'এমনই তো সবসময় হয়' ধরনের ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে। যখন অন্যের কষ্টকে 'নিয়মিত ব্যাপার' হিসেবে দেখা হয়, তখন সামগ্রিকভাবে সমাজের সহানুভূতি হারিয়ে যায়। যখন দেখা যায় অপরাধীরা পুরস্কৃত হচ্ছে, আর সৎরা বঞ্চিত, তখন তরুণ প্রজন্ম মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্যগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়। পাশাপাশি, আইনের শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর আন্তর্জাতিক মহলে যাওয়াতে দেশের আর্থিক বিনিয়োগ, শিক্ষা বিনিময় বা পর্যটন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সহিংসতার চক্র আরও গভীর ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে। 

নির্যাতনের ঘটনা যতই 'নর্মাল' করার চেষ্টা হোক না কেন, সচেতন কণ্ঠই পারে সেই অস্বাভাবিকতাকে দৃঢ়ভাবে চিহ্নিত করতে। সচেতনতা ও প্রতিবাদই পাল্টে দিতে পারে এই সংস্কৃতি।


Sunday, 22 June 2025

নিছক দুর্ঘটনা?

বিপর্যয়ের অতল খাদে দেশ

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



রাজনৈতিক সমাজে কোনও দুর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা থাকে না। ঠিক মতো কাটাছেঁড়া করলে দেখা যায়, প্রতিটি দুর্ঘটনার পিছনে রাজনীতির লোকজনদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা আছে। ঘটনার যখন কারণ আপাত প্রত্যক্ষ করতে পারি না, তখনই তো তাকে আমরা দুর্ঘটনা বলি। তাই তো আহমেদাবাদে সাধের এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার ফ্লাইট নম্বর ১৭১ ভেঙে পড়লে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলে দেন, দুর্ঘটনাকে তো কেউ আটকাতে পারে না! বাহ! বাত খতম পয়সা হজম। ফলে, দুর্ঘটনা নানান প্রলেপে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তো এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান ভেঙে পড়া নয়, প্রতিদিনই সড়ক পথে, রেলপথে, জলপথে দুর্ঘটনা ঘটছেই। তার সঙ্গে আছে সেতু ভেঙে পড়ার গপ্পো। 

দিল্লি পুলিশের একটি হিসেব বলছে, এ বছরের মে মাসের মধ্যেই দিল্লিতে ২২৩৫টি পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৫৭৭ জন মারা গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হিসেবে, এই বছরের মে মাসের মধ্যে ১৩ হাজারের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৭৭০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের মধ্যে একটা নিহিত বাতিক, আমরা নথিভুক্ত করি না। ফলে, সর্বগ্রাহ্য পরিসংখ্যান পাওয়া রীতিমতো কঠিন। অর্থাৎ, সেকেন্ড হ্যান্ড উপাত্ত নিয়ে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। আর প্রাথমিক উপাত্ত সংগ্রহ করার মতো টিম আমাদের হাতে নেই। তাই শুধু দিল্লি আর উত্তরপ্রদেশের হিসেবটাই রাখতে পারলাম। আর মজার, এই দুটো রাজ্যেই মোদীর অতিপ্রিয় ডাবল ইঞ্জিন সরকার। আর ভারতীয় রেল! 

আমাদের মনে রাখতে হবে, রেলে দুর্ঘটনা যেন এক বাঞ্ছিত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও দুটি ট্রেন মুখোমুখি একই লাইনে এসে পড়ছে, কোথাও লাইনচ্যুত হচ্ছে, কোথাও ২টি ট্রেনের বীভৎস ধরনের সংঘর্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষ আকস্মিক প্রাণ হারাচ্ছেন। এমনকী, রেল কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো হিসেবটাও দেয় না। তবু রেলের পুনে ডিভিশন জানাচ্ছে, এ বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৫১ জন রেল দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে যার মধ্যে দুজন মারা গিয়েছে। 

আর সেতু! একটা করে সেতু ভাঙে আর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার তোড়জোড় শুরু হয়। ২০২৫ সালের চলতি মাস অর্থাৎ জুন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সেতু ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মহারাষ্ট্রর পুনেতে ইন্দ্রায়ণী নদীর ওপর একটি সেতু ভেঙে পড়া, যেখানে বেশ কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। কারও মতে সংখ্যাটা ১৫-২০, কারও মতে ৩০ জন। পুরনো লোহার সেতু দিয়ে যান চলাচল আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্ষার সময় নদী ও এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা ছবি বা নিজস্বী তুলতে অনেকেই সেতুতে জড়ো হন। আগেই স্থানীয় বাসিন্দারা সেতুর হাল নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ৪-৫ বছর আগে সেতুটির মেরামতি হয়। উদ্ধারকারীদের মতে, বর্ষার সময় নদী ছিল খরস্রোতা। জলস্তর বেড়েছিল, তাই বহু মানুষ ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

ঘটনা ঘটে গেলে রাজনীতিকরা আসবেন না, তা হয় নাকি? ফলে, অকুস্থলে যান শরদ পাওয়ারের মেয়ে তথা এনসিপি (শরদ পাওয়ার গোষ্ঠীর) সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে। ওদিকে এক্স হ্যান্ডেলে মুখ্যমন্ত্রী  দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। এসব তো ঘটে যাওয়ার পরের কাহিনি ও বাকতাল্লা! কথা হচ্ছে যে এমন একটা লবেজান সেতু না মেরামত করে বা ভেঙে না ফেলে মৃত্যুসেতু সাজিয়ে রাখার মানেটা কী? এরপরও কি বলতে হবে, 'দুর্ঘটনা কেউ আটকে রাখতে পারে না'। আসলে এগুলো apolitical disaster নয়, হাইলি political।  

এছাড়াও, কদিন আগে মধ্যপ্রদেশের শিবপুরীতে একটি নির্মীয়মাণ সেতু ভেঙে পড়ে, যাতে কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। একইসঙ্গে অসমেও গত ১৮ জুন বুধবার একটি সেতু ভেঙে পড়ে। অসমের কাছাড় জেলায় হারাং নদীর উপর ব্রিজটি ভেঙে পড়ায় ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুরের সঙ্গে সড়কপথে বাকি দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৷ ব্রিজ ভেঙে নদীর জলে তলিয়ে যায় পাথরবোঝাই ডাম্পার ৷ তবে ঘটনায় কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি ৷ তবে আশ্চর্যের, মেরামতির এক মাসের মধ্যেই ভেঙে পড়ে এই সেতুটি। এই ঘটনাগুলি থেকে বোঝা যায়, সেতুগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং নির্মাণের গুণগত মান কোন স্তরের। বিশেষ করে, পুরনো সেতুগুলির ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি প্রকট। ভঙ্গরপারের সঙ্গে শিলচর-কালাইনের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় হারাং নদীর ওপর এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ৷  অসমের বরাক উপত্যকার দুই প্রধান শহর গুয়াহাটি ও শ্রীভূমির (করিমগঞ্জ) মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল এই ব্রিজ ৷ এই দুর্ঘটনার ফলে বরাক উপত্যকা-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের তিনটি রাজ্য— ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুরের সঙ্গে সড়কপথে বাকি দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৷ ১ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা খরচ করে মেরামতির ১ মাসের মধ্যে সেতুর ভবলীলা সাঙ্গ! কই এবার তো মোদী বা শাহ হিমন্ত বিশ্বশর্মা বা মোহন যাদবকে বলছেন না, 'ইয়ে অ্যাক্ট অফ গড নেহি অ্যাক্ট অফ ফ্রড হ্যায়'। কেন বলছেন না? কারণ মধ্যপ্রদেশ ও অসম, দুটোতেই ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। 

শুধু কি এই? গত রবিবার সকালে কেদারনাথ মন্দির থেকে তীর্থযাত্রী বহনকারী একটি কপ্টার গুপ্তকাশির কাছে বিধ্বস্ত হয়, এতে পাইলট এবং দুই বছরের একটি শিশু সহ সাতজনই নিহত হন। দুর্ঘটনাগ্রস্ত কপ্টারটি আরিয়ান সংস্থার। পুলিশ ও দমকল সূত্রের খবর, রবিবার উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার গৌরীকুণ্ডর কাছে গৌরী মাঈ খার্ক এলাকায় জঙ্গলের ওপর ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ ভেঙে পড়ে চপারটি। দুর্ঘটনাস্থলের কাছে স্থানীয় মহিলারা  ঘাস কাটছিলেন, তাঁরাই প্রথম দুর্ঘটনার খবর পান। এক্স হ্যান্ডেলে উত্তরাখণ্ড'র মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি শোকপ্রকাশ করেছেন, 'রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার ভয়াবহ খবর পেয়েছি। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্ধারকারী দল ব্যস্ত উদ্ধারকাজে। কপ্টারের সওয়ারিদের সুস্থতার জন্য বাবা কেদারের কাছে কামনা করি।' দেখুন, গোটা ব্যাপারটা কেদারের হাতে ছেড়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিরুদ্দেশ। অথচ ৩০ এপ্রিল তীর্থযাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে উত্তরাখণ্ডে ছয় সপ্তাহে চারধাম যাত্রা রুটে এটি পঞ্চম হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা এবং দ্বিতীয় দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা। ৮ মে উত্তরকাশীতে একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ছয়জন নিহত হন। ১২ মে বদ্রীনাথে একটি দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। ১৭ মে ঋষিকেশের এইমস'এর একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কেদারনাথে বিধ্বস্ত হয় তবে দুর্ঘটনায় কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ৭ জুন কেদারনাথ যাওয়ার পথে একটি হেলিকপ্টার উড়ানের সময় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ার পরে হাইওয়েতে জরুরি অবতরণ করে, যেখানে পাইলট আহত হন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে প্রাথমিকভাবে  দুর্ঘটনাটি কন্ট্রোলড ফ্লাইট ইনটু টেরেন (সিএফআইটি)'এর ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে, যেখানে দৃশ্যমানতা কম এবং উপত্যকার প্রবেশ এলাকায় বিস্তৃত মেঘ থাকা সত্ত্বেও হেলিকপ্টারটি আকাশে উড়েছিল। বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো (এএআইবি) কর্তৃক বিস্তারিত তদন্তর মাধ্যমে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ নির্ধারণ করা হবে। মজার ব্যাপার, উত্তরাখণ্ডেও চলছে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার।  

এখন আহমেদাবাদে জমে উঠেছে নানান কিসিমের তরজা। একদিকে এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণ প্রসঙ্গ, অন্যদিকে দুর্ঘটনার পিছনে কোনও গভীর রহস্য আছে কিনা। বিতর্ক শুরু হয়েছে একটি ভিডিও-কে ঘিরেও। ১২ জুন যেদিন এয়ার ইন্ডিয়ার ওই বিমানটি ভেঙে পড়ল, সেদিন ভেঙে পড়ার দৃশ্য সেকেন্ড কয়েক ক্যামেরাবন্দি করেছিল এক ১৭ বছরের তরুণ। বহু মানুষ সেই ভিডিওটি তাঁদের সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছিলেন। সব টিভি চ্যানেল, ডিজিটাল মিডিয়া ওই ভিডিওটিই সম্প্রচার করেছিল-- কীভাবে এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার ফ্লাইট নম্বর ১৭১ উড়ানটি ওড়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই বি জে মেডিক্যাল কলেজ ও সিভিল হাসপাতালের ছাত্রাবাসের ওপর ভেঙে পড়ে। ওই আঁখে দেখো হাল ভিডিওটি করে ১৭ বছরের তরুণটি পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। শনিবারের বারবেলায় রীতিমতো বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে যায় গুজরাতের পুলিশ। জানি না কেন গুজরাত পুলিশের এই সক্রিয়তা! কেন তরুণকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাকে কি গ্রেফতার করেছে না আটক করেছে, এসব নিয়ে কোনও কথাই বলেনি। হয়তো তাঁদের মনে হয়েছে, ওই  তরুণটির জন্যই এই বিমানটি ভেঙে পড়েছে। বিমানের যন্ত্র সংক্রান্ত কোনও সমস্যার জন্য ওই তরুণ দায়ী। গুজরাতের পুলিশ মোদী-শাহ'র বড় ভক্ত। তবে পুলিশ পরে জানিয়েছে, ওরা তরুণটিকে গ্রেফতার বা ডিটেইন করেনি, বয়ান রেকর্ড করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল, তা করে ছেড়ে দিয়েছে। 

১৭ বছর বয়সি ওই তরুণটি উত্তর গুজরাতের সবরকণ্ঠ জেলার ইদারের বাসিন্দা। নাম আরিয়ান আসারি। প্রথমবারের জন্য আহমেদাবাদ এসেছিল বই কিনতে। সেখানেই নিজের বাবার ভাড়া বাড়ির ছাদ থেকে হঠাৎ একটি বিমানকে খুব কাছ দিয়ে যেতে দেখে মোবাইলে ভিডিও করা শুরু করে। তখন সে বুঝতেও পারেনি যে এরপরেই ঘটে যাবে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ভিডিও তোলার মাত্র ২৪ সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানটি আগুনের গোলায় পরিণত হয়। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আরিয়ান ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ভিডিওটা প্রথমে তার দিদিকে দেখায়। আরিয়ানের পরিবার সম্পর্কে জানা যায়, সে তার মা ও দিদির সঙ্গে ইদারে থাকে। তার বাবা আহমেদাবাদে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। আগে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন। এই প্রাক্তন সেনা জওয়ান এখন নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। যাক, গেরুয়া শিবিরের সুদূর প্রভাবশালী আইটি সেল এখনও পর্যন্ত আরিয়ানকে বিঁধতে পারেনি। 

বিমান ভেঙে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার কিছু পরই সমাজমাধ্যমে পোস্ট: 'প্রাইভেটাইজেশন মৃত্যুকে আহ্বান করে।' মানে গোড়া ধরে টান। ২০১৭ সালের ২৮ জুন মোদী সরকার এয়ার ইন্ডিয়া বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া সরকারিভাবে সম্পন্ন হয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে একেবারে জলের দরে মাত্র ১৮,০০০ কোটি টাকায় এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটার কাছে বেচে দিয়েছিল মোদী সরকার। আক্ষরিক অর্থেই ছিল ‘ফ্রি গিফট’! আর এটা বেচে কেন্দ্রীয় কোষাগারে এসেছিল মাত্র ২,৭০০ কোটি টাকা! বাকি ১৫,৩০০ কোটি টাকার ঋণের দায় নিয়েছিলেন 'টাটাবাবুরা'। অথচ এয়ার ইন্ডিয়ার মোট ঋণ ছিল ৬১,৫৬২ কোটি টাকা। তাহলে বকেয়া ৪৬,২৬২ কোটি টাকা কে মেটাবে? কেন গৌরী সেন কেন্দ্রীয় সরকার! ফলে, বছর-বছর এয়ার ইন্ডিয়ার দেনা শোধ করবে কেন্দ্র। আর মুনাফা যাবে টাটার ঘরে। প্রায় মুফতে সেই সঙ্গেই টাটা পেয়েছিল একশোরও বেশি বিমান, হাজার হাজার প্রশিক্ষিত পাইলট ও ক্রু, দেশের বিমানবন্দরগুলিতে ৪,৪৪০টি অন্তর্দেশীয় আর ১,৮০০টি আন্তর্জাতিক অবতরণ ও পার্কিং স্লট ব্যবহারের সুযোগ; এখানেই শেষ নয়, এর পাশাপাশি পেয়েছিল, হিথরো, নিউ ইয়র্ক, সিঙ্গাপুর, দুবাই, হংকং'এর মতো বিদেশের বিমানবন্দরগুলোতে এমন ৯০০টি স্লট ব্যবহারের সুযোগ। একে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ লুঠ ছাড়া আর কী বলা যায়! সরকার পক্ষের যুক্তি, ওসব ছাড় না দিলে শিল্পপতিরা নেবে কেন? আর দুর্ঘটনা? সরকারি সংস্থা হলেও দুর্ঘটনা ঘটতেই পারত, যেমন রেলে ঘটে। তবে রেলের দুর্ঘটনার মূল কারণও রাজনৈতিক। সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রেলে কর্মী সঙ্কোচন, জনসংখ্যার অনুপাত ও যাত্রী পরিষেবার বিচারে পরিকাঠামো উন্নত না করা।  

উড়ান দুর্ঘটনার সন্ধেতে মোদী তাঁর ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট অমিত শাহকে পাঠিয়ে দিলেন অকুস্থলে। প্রাথমিক ভাবে শাহ সবটা সালটে দেওয়ার পর শুক্রবার মোদীর পা পড়ল মেঘানিনগরে। লোকটার ফটোগ্রাফি সেন্সটা দারুণ! আর সঙ্গে করে যে সব ফটোগ্ৰাফারদের নিয়ে ঘোরেন তাঁরা প্রচণ্ড পরিশ্রমীও বটে। প্রয়োজনে তাঁরা রাস্তার ওপর শুয়ে পড়েও ওঁকে সঠিক অ্যাঙ্গেল থেকে ধরেন। কারণ, ছবিতে ওঁর উপস্থিতির যে প্রয়োজনীয়তা, সেটাও বোঝাতে হয়। নিন্দুকরা বলছেন, উনিজী কোনও বড় ঘটনা ঘটলে সেখানে ক্যামেরা নিয়ে যান, নিজের ছবি তুলিয়ে তা ফেসবুক, এক্স'এ পোস্ট করে নিজের প্রচার করেন। তবে নিন্দুকরা এ প্রশ্নও তুলছেন, কই মোদীমশাই তো মণিপুরে যাননি এখনও? লে হালুয়া! মণিপুরে তো পলিটিক্যাল ক্রাইসিস, বিজেপি তার স্পনসর, ফলে সেখানে যাবেন কেন? উনি সন্দেশখালিতে আসবেন সন্দেশ দিতে। সব ছেড়ে আলিপুরদুয়ারে আসবেন জঙ্গি তাড়াতে! এসবই ওঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি, যেমন গেলেন আহমেদাবাদ। 

বলি শাহজী, এই বিমানটা যদি পশ্চিমবঙ্গে ভেঙে পড়ত তবে আপনি কী বলতেন? বলতেন, 'দিদি কা সরকার খতম হোনে কি সন্দেশ অ্যা রেহি হে। আপ বহুমত ভাজপা সরকার গঠন কর দিজিয়ে।' পাল্লা দিয়ে শুভেন্দু অধিকারী বলতেন, 'এর জন্য দায়ী তোলাবাজ ভাইপো ও চটি পিসি। বিমানবন্দর চত্বরে তোলামূলের জামাত বাহিনীদের বসিয়ে রেখেছে। সময় এসেছে হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই।'


Friday, 13 June 2025

গাজার পাশে বিশ্ববাসী

ইজরায়েলের পৈশাচিক ধ্বংসলীলা

সোমা চ্যাটার্জি



গাজায় ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকটের মধ্যেই ১৩ জুন ইজরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার কেন্দ্রস্থল ও অন্যান্য অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং পশ্চিম এশিয়ায় আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইজরায়েল'এর যে একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে তার মূল উদ্দেশ্য, পশ্চিম এশিয়ার সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলিকে দমন করে লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া ও অন্যান্য দেশগুলিতে সংঘাত সম্প্রসারিত করা। 

ইজরায়েল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ মদতে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে একটি দুঃশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী গাজা উপত্যকা। গত কয়েক দশক ধরে  ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সংঘর্ষে এক সময়ের সবুজ উপত্যকা আজ একটি মৃত্যুপুরী, একদা কোলাহল মুখর জনপদ আজ এক ধ্বংসস্তূপ। এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে গাজায় নিহতের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি, আহত লক্ষাধিক। প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু ১৪৮ জনের। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ নারী ও শিশু এবং ১০০ জনেরও বেশি সাংবাদিক। বিশ্বের বাকি অংশ থেকে গাজা কার্যত বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তারা সব কিছুর জন্যই ইজরায়েলের উপর নির্ভরশীল। তাই, ইজরায়েল গাজার জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় গাজার জনজীবন কার্যত বিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তার উপর গত আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় কারও কোনও ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে দিচ্ছে না ইজরায়েলি সেনারা। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গত ৯ জুন সারা বিশ্বে আমানবিকতার চূড়ান্ত নজির সৃষ্টি করেছে ইজরায়েলের বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহুর সরকার।

আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা 'ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন'এর 'ম্যাডেলিন' নামে একটি ত্রাণ সরবরাহকারী জাহাজকে ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় আটকে দেয় ইজরায়েলি সেনারা। ওই জাহাজটিতে সুইডেনের বিখ্যাত পরিবেশবাদী গ্রেটা থানবার্গ সহ আরও ১২ জন মানবাধিকার কর্মী ছিলেন, যাদের মধ্যে ফ্রান্সের বিখ্যাত আইনজীবী ও ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয় সংসদের ফরাসি সদস্য রিমা হাসান, দুই ফরাসি নাগরিক এবং স্পেন, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, ব্রাজিল ও জার্মানির আরও অনেকে ছিলেন যারা সবাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বা পরিবেশবিদ হিসেবে পরিচিত। গ্রেটা থানবার্গ একজন জলবায়ু রক্ষার প্রচারক কিন্তু গাজার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে ত্রাণ পৌঁছনোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে তিনি ৩ জুন শিশুর ফর্মুলা, খাদ্য ও জীবন রক্ষাকারী পণ্যসম্ভার নিয়ে 'ম্যাডেলিন'এ যাত্রা করেন। জাহাজটি ইজরায়েল সীমানার কাছাকাছি আসতেই ইজরায়েলি সেনারা ড্রোনের মাধ্যমে কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক নিক্ষেপ করে গাজা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজটিকে আটক করে। সেই সময়ে গ্রেটা থানবার্গের একটি ভিডিও রয়টার্সের মাধ্যমে এক্স হ্যান্ডেলে দেখা যায়, যেখানে লাইফ জ্যাকেট পরিহিত জাহাজের যাত্রীরা রয়েছেন এবং গ্রেটা বলছেন যে তাঁদের জাহাজটি ইজরায়েলের সেনারা অপহরণ করতে চলেছে। তিনি সুইডিশ সরকার, তার নিজের পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাদের কাছে অনুরোধ জানান তাদের মুক্ত করার জন্য। ইজরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রক এটিকে স্টান্টবাজি ও লোকদেখানো হিসেবে অভিহিত করলে বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত ইজরায়েলি সরকার গ্রেটা সহ অন্যান্যদের  ফ্রান্সে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে কথা সামাজিক মাধ্যমে বার্তা দিয়ে প্রকাশ করে। রিমা হাসানকেও ইজরায়েলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, কারণ, তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইজরায়েলি নীতির বিরোধিতা করেছিলেন।

রাষ্ট্রসংঘের মতে, আজ পর্যন্ত ২ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে যা গাজার মোট জনসংখ্যার এক-দশমাংশ। গত দু' মাসে শুধু আনাহারেই মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫০০ জনের। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্কগ্রস্ত গাজার শিশু ও নারীদের করুণ আর্তনাদের ভিডিও। চতুর্দিকে উঠেছে নিন্দার রব। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হয়ে ইজরায়েল মে মাসের শেষের দিকে সামান্য সাহায্যের অনুমতি দিতে শুরু করে। সম্প্রতি ঈদের দিন ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও'তে গাজায় এক মাকে তার সন্তানের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মাটি থেকে ময়দার গুড়ো কুড়িয়ে নিতে দেখা যায়। ক্ষুধা, অনাহার আর মৃত্যুতে যখন প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির জীবন বিপর্যস্ত, ঠিক সেই সময়েই জুনের প্রথম সপ্তাহে খাবার, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় ত্রাণ সরবরাহ নিয়ে ইতালির সিসিলির কাতানিয়া থেকে রওনা দেয় থুনবার্গ'দের জাহাজ, কিন্তু প্রথম থেকেই এই প্রশ্ন ছিল যে তা আদৌ গাজায় ত্রাণ পৌঁছতে সফল হবে কিনা! কারণ, মাত্র এক মাস আগে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের আরেকটি সাহায্যকারী জাহাজকে ইজরায়েল ড্রোন দিয়ে আঘাত করার ফলে জাহাজটিতে আগুন লেগে যায় এবং চারজন বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক আহত হন। 

আমরা জানি, ২০০৬ সালে নির্বাচনের পর হামাস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ২০০৭ সালে ফাতা'র সঙ্গে গৃহযুদ্ধের পর থেকে গাজা উপত্যকা ও ইজরায়েলের মধ্যকার সংঘাত জটিল হতে শুরু করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত গাজায় ৫০০'রও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন, ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে এখন মাত্র ১০টি আংশিকভাবে কার্যকর; এলাকার ৮৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত। এছাড়াও, ইজরায়েল সাংস্কৃতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য ভবন ধ্বংস করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৩টি গ্রন্থাগার যেখানে হাজার হাজার বই ছিল; ছিল গাজার ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৮০ শতাংশ স্কুল, বেশ কয়েকটি মসজিদ, তিনটি গির্জা এবং দুটি জাদুঘর। রাষ্ট্রসংঘের মতানুযায়ী, গাজা উপত্যকা পুনর্গঠনের জন্য ৫৩০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন।

১৯৪৮ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ দিয়ে ফিলিস্তিনে যুদ্ধ শুরু হলেও আজ ৭৫ বছরেও তা শেষ হয়নি, বরং দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিয়ে বেড়েছে। ১৯৯৩ সালে নরওয়ের ওসলো'তে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন দুই পক্ষ শান্তি চুক্তিতে সম্মত হলেও ইজরায়েলের পাশে আরেকটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য ইজরায়েল রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। তাছাড়া এই দুই রাষ্ট্রের সীমান্ত জেরুসালেম কার অধীনে থাকবে, বা ফিলিস্তিনের মধ্যে বসবাসকারী ইজরায়েলি ইহুদিরা কোথায় যাবে, এবং ফিলিস্তিনে শরণার্থীদের জন্য নতুন বাসস্থান কোথায় হবে প্রভৃতি বিষয়গুলিও পরে আলোচনায় ঠিক করা হবে বলে কথা হলেও ভবিষ্যতেও অনালোচিতই থেকে গেছে। এরপর জেরুসালেমে ইজরায়েলি রাজধানী প্রতিষ্ঠার পর এবং পশ্চিম তীরে ইহুদী বসতি দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় ইজরায়েল সরকার স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নেয়। বস্তুত, এই কারণই জন্ম দেয় হামাস বা ফাতা'র মতো গোষ্ঠী যাদের দাবি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন।

বর্তমান ইজরায়েল সরকার চায় পশ্চিম তীরকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে, যাতে ফিলিস্তিনিরা দুর্বল হিসেবে সবসময়ই ইজরায়েলের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। তাই, এই দখলদারি রাজনীতির জন্য গাজা থেকে সাময়িক ভাবে ইজরায়েল সরে আসলেও তারা পশ্চিম তীর ছাড়েনি বরং আমেরিকার মদতপুষ্ট হয়ে শান্তি চুক্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে লাগাতার বোমা বর্ষণ ও নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে গাজার উপর। ঘৃণা এতদূর ছড়িয়েছে যে ইহুদি বিদ্বেষী হিটলারও যে কথা প্রকাশ্যে বলেনি তা সাম্প্রতিককালে একজন ইহুদি ইজরায়েলি রাজনীতিবিদ মশে ফেলিন বলে ফেলেছে-- 'গাজায় বসবাসকারী প্রতিটি শিশুর মৃত্যুই কাম্য', কারণ, তারা সবাই ইজরায়েলের শত্রু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে বেশি  বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত ও রাজনৈতিক ভাবে আলোচিত হলেও গাজা নিয়ে পৃথিবীর কোনও দেশই আজ পর্যন্ত কোনও একটি সঠিক ও পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গাজাবাসীদের পাশে দাঁড়ায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ সহিংসতার জন্য ফিলিস্তিনের নিন্দা করেছে, যদিও  কিছু আরব ও মুসলমান দেশ সহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের সমর্থনে ইজরায়েলি দখলদারিত্বকে দায়ী করেছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ইজরায়েলের বন্ধু’ হিসেবে পাশে থেকে ইজরায়েলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে সামরিক খাতকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে যাচ্ছে, অন্যদিকে সম্প্রতি ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে ভারত, বিশেষ করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে। ইজরায়েলের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে মোদির কিছু অনুসারীরা অনুপ্রেরণা হিসেবেও গ্রহণ করেছে। মস্কোর পর ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে ইজরায়েল ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমি কতটা বদলে গেছে এবং পরাশক্তিগুলোর পারস্পরিক রশি টানাটানি কতটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে উঠেছে, তা চলমান গাজা-ইজরায়েল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুদ্ধটি শুধু দুই দেশের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।  সারা পৃথিবীর রাজনীতিবিদরা যখন জাতিসংঘে তীব্র কূটনৈতিক ঝগড়া এবং ইহুদি, মুসলিম বা আরবদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়াতে ব্যস্ত তখন গ্রেটা থানবার্গের মতো মাত্র ২২ বছর বয়সী এক তরুণীর গাজার অবরুদ্ধ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার এবং ত্রাণের দাবিতে লড়াই করার মানসিকতা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ এবং এই রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

কিন্তু হামাস নিধনের নামে যে পৈশাচিক ধ্বংসলীলা ইজরায়েল  চালাচ্ছে, সেই মানবাধিকারের কলঙ্ক  মোছার জন্য অন্য দেশ এবং নেতারা কি দায়িত্বশীল হবে নাকি এখনও চুপ করে এই সশস্ত্র সন্ত্রাসকে আরও  ভয়াবহতার দিকে ঠেলে দেবে সেটাই দেখার বিষয়।



Tuesday, 10 June 2025

'প্রধান শত্রু' কে?

ডুবন্ত মানুষ যাকে ধরবে তাকেই ডোবাবে

মালবিকা মিত্র



'হাত আছে কাজ দাও, নইলে বেকার ভাতা দাও'-- এই স্লোগান একসময়ে ছিল সিপিআইএমের ছাত্র-যুব আন্দোলনের অন্যতম মূল স্লোগান। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ভাবে বক্তৃতার সময় বলা হত, বেকার ভাতা দেওয়া কোনও স্থায়ী সমাধান নয়, কিন্তু এই ভাতা দেওয়ার অর্থ বেকারের কাজের অধিকারকে আইনগত ভাবে মেনে নেওয়া। এর ফলে কাজের দাবিটা অধিকার হিসেবে অনেক বেশি জোরালো হয়ে ওঠে। এরপর ১৯৭৭ সালে দল ক্ষমতায় এলে বেকার ভাতা চালু করা হয় (যদিও বছর কয়েক যেতে না যেতেই তা নিঃশব্দে অপসৃত হয়)। বলা হত, বেকার যুবক-যুবতীদের এই স্বীকৃতি রাজ্যের বাইরে সারা দেশের ছাত্র-যুব আন্দোলনে এক ঐতিহাসিক জোয়ার নিয়ে আসবে। মানে আমি বলতে চাইছি, ভাতাকে ভিক্ষাই বলি অথবা নাকের বদলে নরুণ, এই ভাতার দাবিটা সিপিআইএম দলের ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল। 

বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের মাসিক রিলিফ বা ভাতা প্রদান, বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের মাসিক ভাতা প্রদান, বার্ধক্যকালীন ভাতা, বিধবা ভাতা, এসব তো কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে অঙ্গীভূত ছিল। আমি যতক্ষণ না তোমার সমস্যার কোনও নির্দিষ্ট সমাধান করতে পারছি, ততক্ষণ আপৎকালীন হিসেবে এই ভাতা প্রদান করব। সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও নতুন পে-কমিশন গঠনের পর রিপোর্ট প্রকাশের আগে পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ভাতা দেওয়া হয়। ঠিক সেই যুক্তি থেকেই এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা ও কর্মচ্যুতির আইনি প্রক্রিয়া চলাকালীন গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মচারীদের আপৎকালীন একটি ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেলে তখন নিশ্চিতভাবে এই ভাতার প্রশ্ন আর থাকবে না। কারণ, মনে রাখতে হবে, এই কর্মচারীরা কেউ ছ' বছর কেউ সাত বছর চাকরি করেছেন, নতুন ছকে জীবনযাপন করেছেন, গৃহঋণ নিয়েছেন, কেউ শিক্ষা ঋণ নিয়েছেন সন্তানের জন্য। তাদের জীবনযাত্রায় এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। আজ হঠাৎ করে 'তোমার আর চাকরি নেই' বলে দেওয়াটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। তাদের জীবনের সঙ্গে এখন বহু কিছু প্রশ্ন জড়িয়ে গেছে। সেই কারণেই এই আপৎকালীন ভাতার মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। একটি সরকার কখনও দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে বলতে পারে না, আজ থেকে তোমার চাকরি শেষ, এবার তুমি যাও, সপরিবারে রেললাইনে গলা দাও। 

সিপিআইএমের পণ্ডিত ও আইনজীবী নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, জনস্বার্থের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ক্ষেত্রে এ ধরনের ভাতা দেওয়া যায় না। আসলে এনারা নিজেদের অতীত বিস্মৃত হয়েছেন। সিঙ্গুরে বড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে এক প্রধান শিক্ষক (কৃষক নেতা) দীর্ঘদিন ধরে জেনেশুনে অন্যায় ভাবে উচ্চ হারে হায়ার স্কেলে বেতন ভোগ করলেন। অতঃপর অবসরের সময় তাঁর ঘাড়ে বিপুল পরিমাণ ওভারড্রয়ালের বোঝা। তিনি তৎকালীন নেতা বিধায়ক মলিন ঘোষ, মণীন্দ্র জানা, বলাই ব্যানার্জি এদের সুপারিশ সহ একটি মার্জনার আবেদনপত্র পাঠালেন রাজ্যপালের কাছে। রাজ্যপাল প্রায় দেড় লক্ষ টাকার ওভারড্রয়াল ক্ষমা করে দিলেন মাত্র এক টাকার বিনিময়। হ্যাঁ, এটা বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনকালের ঘটনা। পার্থক্য একটাই, কোনও একজন ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থে নয়, বর্তমান সরকার একটি সমগ্র প্যানেলের গ্রুপ সি-গ্রুপ ডি কর্মচারীদের সকলের জন্য সমভাবে এই আপৎকালীন ভাতা দিয়েছে। অথচ, সেই ভাতা বন্ধ করার জন্য আদালতে এখন সেই বাম নেতারাই উকিলের পোশাকে সরগরম। প্রকৃত প্রস্তাবে, এনারা যে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার অধিকারের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নেমে গেছেন, সে বোধটুকু কি বাকী বাম নেতাদেরও লোপ পেয়েছে? চোখে আঙুলদাদা হলে বলতেন, আরে বাপু, এরপরে ওই পড়ে থাকা ৬-৭ শতাংশ ভোটও কি আর আপনাদের জুটবে? 

অথচ, সিপিআইএম দলের কর্মসূচি ও কর্মনীতি এই রিলিফকে অনুমোদন করেছে। কর্মনীতির ১১২ নম্বর অনুচ্ছেদটি লক্ষ করুন-- 'Paragraph 112 of the CPIM's party programme outlines the party's approach to forming governments, emphasizing the importance of using all opportunities to bring into existence governments that implement a modest program of immediate relief for the people.'। এরপরে অবশ্য বিপ্লবীয়ানা বজায় রাখতে বলা হয়েছে যে 'such governments can strengthen the revolutionary movement of the working people and aid in building a democratic front. Essentially, it's about strategically using state power to advance the cause of the working class and broader democratic movements.'। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রাম কতটা প্রবলভাবে শক্তিশালী হয়েছে তার বিচার করবেন জনগণ। সেই আলোচনায় যাব না। কিন্তু যাদের পার্টি কর্মসূচিতে 'ইমিডিয়েট রিলিফ' একটি ঘোষিত নীতি, তারা কী করে ৫-৬ হাজার গ্রুপ সি-গ্রুপ ডি কর্মীর পেটে অনায়াসে লাথি মারে! আর শুধু তো ৫-৬ হাজার নয়, এদের পরিবারগুলিকে হিসেব করলে সংখ্যাটি ২৫ হাজার হতে পারে। আর এই ২৫ হাজারের সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মে যুক্ত মানুষের সংখ্যাটি আরও হাজার খানেক হবে নিশ্চয়ই। এটাই কি আজকের সিপিআইএম? তবুও তাদের গায়ে এখনও 'বামপন্থী তকমা'?

এই দলটিই এ রাজ্যে নাকি বাম ঐক্যের নেতৃত্বে আসীন, যারা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি-আরএসএস শক্তির চরিত্রকে গোপন করতে আপ্রাণ সচেষ্ট। 'মেইনস্ট্রিম' পত্রিকায় ঐতিহাসিক ও বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নলিনী তানেজা সিপিআইএমের পার্টি কংগ্রেসের দলিল সম্পর্কে বলেন, 'nowhere in the document does one get the sense of degree of suffering of people as a result of the actions of this regime, an idea of what the Muslims go through in their daily lives, attacks and lynchings, and threats to physical existence, the NRC and potential denial of citizenship, the detention camps, or the war on tribals and smaller nationalities: in short, the fascist conditions to which certain regions of the country and certain categories of our people are subjected.'। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট, সম্প্রতি পশ্চিমবাংলায় যে বৃহত্তর বাম জোটটি গড়ে উঠছে তার ভিত্তি আর যাই হোক ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা নয়। মৌলালি যুব কেন্দ্র থেকে আসন্ন কালীগঞ্জের উপনির্বাচন, দেখা যাচ্ছে সর্বত্রই এই জোট সক্রিয়। কিন্তু প্রধান প্রশ্নেই তো এরা ঐক্যবদ্ধ নয়– বিজেপি জোট পরিচালিত সরকারগুলির চরিত্র ফ্যাসিবাদী নাকি আধা-ফ্যাসিবাদী, নাকি তা নিছকই এক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা! শোনা যায়, এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ। তাহলে এই বাম ঐক্যের ভিত্তি কী? আর প্রধান শত্রুই বা কীভাবে একই সময়ে দুটি আলাদা রাজনৈতিক শক্তি হয়? 

দেখলাম, 'এই সময়' পত্রিকায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদারকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, 'বাংলার বুকে ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস যুদ্ধ উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচার করে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে ধ্বংস করতে চাইছে।' এ থেকে খুব স্পষ্ট মনে হয়, ঐক্যের ভিত্তি হল ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট চরিত্র নিয়েই তো বাম দলগুলির মধ্যে জোর বিতর্ক। তাহলে? তথাপি, কালীগঞ্জে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোটের কথা শুনে একটু পরিসংখ্যান দিতেই হচ্ছে। ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২১ সালে তৃণমূলের ভোট এখানে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮৩৮৯৮, ৯৯৮০৯ ও ১১১৬৯৬। উল্লিখিত তিনটি নির্বাচনে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ১০৩৭৩, ৬২৬১১ ও ৬৪৭০৯। অথচ, সিপিএম-কংগ্রেসের ওই তিন নির্বাচনে যুক্ত ভোট ছিল ৮৫১২৫, ২৫৪২৪ ও ২৫০৭৬। আমি বলতে চাইছি যে, কালীগঞ্জ আসনটিতে বিজেপি যথেষ্ট পিছিয়ে থাকা অবস্থায় আছে। এখানে বিজেপির যে বাড়বৃদ্ধি তার সমস্ত কৃতিত্বটাই সিপিএম ও বামফ্রন্টের, কারণ, তাদের ভোটগুলিই এক লপ্তে বিজেপির ঝুলিতে জমা হয়েছে। অতএব, এক কথায় বলতে গেলে, কালীগঞ্জ কেন্দ্রে বাম ঐক্যের সামনে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে হারানোর প্রশ্নই নেই, তদুপরি, ফ্যাসিবাদ প্রশ্নে তারা নিজেরাও ঐক্যবদ্ধ নয়। 

এবার তাহলে সিপিআইএমের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অভিমুখ সম্পর্কে কোনও দ্বিধা থাকতে পারে না। সবটাই লাইনে আছে, কোথাও বেলাইন হয়নি। শত্রু হিসেবে তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যের তৃণমূল সরকার। সমালোচনা হিসেবে তাদের মূল লক্ষ্য সরকারের নানাবিধ আর্থিক ভাতা, রিলিফ, যা তাদের ভাষায় 'ভিক্ষা'। নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের প্রধান লক্ষ্য দুর্নীতিগ্রস্তদের যথাযথ বিচার ও শাস্তি নয়, দুর্নীতির ফলে ভুক্তভোগী সাধারণ চাকুরিজীবী ও চাকুরী প্রার্থীদের আরও জটিলতর অসমাধানযোগ্য অন্ধগলিতে দিশাহীন করা, যার ফলে রাজ্য সরকার বিরোধী একটা গণ অসন্তোষ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি, যে বামপন্থী ভোটের ৬-৭ শতাংশ এখনও বামের ঝুলিতেই আছে এবং অন্তত এক শতাংশ বামপন্থী ভোট 'নো ভোট টু বিজেপি' সিদ্ধান্তের কারণে তৃণমূলের পক্ষে আছে, এই সমস্ত ভোটটাকে যদি একত্রিত করে অন্তত এর অর্ধেকটা বিজেপির ঝুলিতে হস্তান্তর করা যায়, তবে নিশ্চিত ভাবে এ রাজ্যে তৃণমূলের অপশাসন রোধ করা এবং বিজেপিকে ক্ষমতাসীন করা যাবে। আর সেই কারণেই গা বাঁচাতে বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী বলা যাচ্ছে না।

বিজেপি'র বাংলা-বিহার জয় সম্পূর্ণ হলে আরএসএস-বিজেপি'র চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হবে। তখন নিশ্চয়ই সিপিআইএম দল একটি বিশেষ প্লেনারি অধিবেশন আহবান করে বলতে পারবে– কমরেড, কমিউনিস্টরা ভুল করতে ও ভুল স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে না। সমস্যা হল, সিপিআইএমের এই চরিত্র সাধারণের কাছে স্পষ্ট। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কেন যে হঠাৎ এই ভুলের অংশীদার হতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট হচ্ছে না। 


Saturday, 7 June 2025

বাঙালি মানেই 'বাংলাদেশি'!

ভয়ঙ্কর এক রাজনৈতিক-সংস্কৃতির আক্রমণ  

সোমা চ্যাটার্জি



আজ বিশ্ব জুড়ে পরিচয়ের রাজনীতি আশ্চর্যজনকভাবে জোরদার হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ পুনরুত্থিত হয়েছে। আটলান্টিক জুড়ে পরিচয়বাদের ঢেউ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে উদ্বিগ্ন করছে। এই অবস্থায় এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই মনে আসে, বাঙালি বা বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী? কারণ, ভারতীয় জনতা পার্টি ‘হিন্দু’ পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে যে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি শুরু করেছে তাতে বাঙালি জাতি তথা পুরো বাংলা ভাষা আজ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে; ধর্মের গৈরিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে চলছে ভাষার গৈরিকীকরণ।

বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য 'হিন্দু ঐক্য', অর্থাৎ, ভারতের হিন্দুদের (যারা দেশের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ) তাদের দলের পতাকাতলে এনে যূথবদ্ধভাবে তাদের পক্ষে ভোট দেওয়ানো। সেই সঙ্গে 'ইসলাম বিদ্বেষকে' উস্কানি দেওয়া এবং হিন্দু ধর্মের ভেতর জাতপ্রথার বাস্তবতাকে চাপা দিয়ে প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রের গুরুত্ব প্রচার করা। আর এই সংকীর্ণ 'হিন্দু ঐক্যের' রাজনীতির চাপে ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়ছে বাঙালি এবং বাংলা ভাষায় কথা বলা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)-র সময় থেকে বাংলা ভাষী মুসলমানদের সবাইকে 'অনুপ্রবেশকারী' বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে, বাংলায় কথা বলা মানেই বাংলাদেশি, এই ধারণাকে তীব্রতর করা হচ্ছে দিনের পর দিন। বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলা ভাষী মুসলমানদের নির্বিচারে আটক ও অবৈধ নির্বাসন চলেছে, যার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি সরব হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের শ্রম মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলার বাইরে ভিন রাজ্যে বাংলার শ্রমিক রয়েছে প্রায় ২২ লক্ষ। অসংগঠিত ক্ষেত্র ধরলে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে এবং এদের প্রায় সবাই বাংলায় কথা বলেন। কিন্তু, মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য যদি তাদের অস্তিত্ব বিপর্যস্ত হয় তাহলে এটি কেবল অমানবিকই নয়, বেআইনি এবং সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে। এই মুহূর্তে ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার জন্য নানা ভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে। রাজস্থান, অসম, উত্তরপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড় জুড়ে দরিদ্র বাঙালি মুসলমান শ্রমিকদের (ভারতীয় নাগরিক) কেবল তাদের মাতৃভাষায় কথা বলা বা একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ের জন্য আটক, লাঞ্ছনা এবং অপমানিত করা হচ্ছে। অতি সম্প্রতি ২৯ মে হুগলি জেলা থেকে যাওয়া কুড়ি জনেরও বেশি বাংলা ভাষী মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকদের শুধুমাত্র 'বাংলাদেশি' সন্দেহে ছত্তিশগড়ের রায়পুরে পুলিশ আটক করে রাখে, কারণ, তাঁরা বাংলায় কথা বলছিলেন, যদিও সকলের বৈধ ভারতীয় পরিচয়-নথি ছিল। পরে যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলেও তাঁরা ইতিমধ্যে যথেষ্ট লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। প্রায় সর্বত্র, বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে পুলিস বাংলা ভাষী পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারকে আটকে রাখছে। কোথাও পুলিশ ঝুপড়ি ভেঙ্গে ফেলছে, কোথাও তাতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। চারিদিকে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। ফলে, তাঁরা সবাই নিজের রাজ্যে ফিরে আসতে চাইছেন, তাঁদের রুটি-রুজি বিপর্যস্ত হচ্ছে।

২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)-র বিষয়টি নিয়ে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ মন্তব্য করেছিলেন, 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা 'উইপোকা' এবং তারা আমাদের দেশকে কুরে কুরে খাচ্ছে।' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের নির্মূল করার জন্য নাৎসি জার্মানি ইহুদি সম্প্রদায়কে 'ইঁদুর' বলে অভিহিত করেছিল। একই অনুরণন এই শাসকের সুরে এবং তারই সুপরিকল্পিত প্রতিফলন এইভাবে বাংলা ভাষীদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার প্রচেষ্টায়।

বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিষয়টিকে মূল ইস্যু করেই বিজেপি ২০১৬ সালের অসম বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। ২০১৪ সালে নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর অসম সফরের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার ব্যবস্থা করবেন। ফলত, ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস (এনআরসি)'র প্রথম খসড়ায় অসমের ৪০ লক্ষ বাসিন্দাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এখানেও উল্লেখ্য যে, আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রের অনুপস্থিতি এবং পারিবারিক নথিতে ত্রুটি, আত্মীয়তার সম্পর্ক এবং দরিদ্র পরিবারগুলির মধ্যে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদ সহ আমলাতান্ত্রিক কৌশলে বহু প্রকৃত নাগরিককে 'অবৈধ অভিবাসী'তে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং শাসক দল তার ফায়দা নিয়েছে। এমনকি প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক এবং যাঁরা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বা উচ্চতর আদালতে আইনি আবেদনের অপেক্ষায় রয়েছেন, তাঁদেরও যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের কোনও আদালতে পর্যন্ত হাজির করা হচ্ছে না, ফলে তাঁদের আইনি সুরক্ষার মৌলিক অধিকারও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন 'সিটিজেনস অফ জাস্টিস অ্যান্ড পিস'এর তথ্য অনুযায়ী, সারা অসমে প্রায় ৩০০ জন এরকম নথিভুক্ত বাসিন্দা আছেন যাঁদের বিনা কারণে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং আজও পর্যন্ত  তাদের মধ্যে ১৫০ জন নিখোঁজ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি), বিচার বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে এবং বলেছে 'অনিবন্ধিত অভিবাসীদের মোকাবিলায় সরকারকে  ধর্মীয় পরিচয় নয়, আইনের শাসন মেনে চলতে হবে।'

গত ২৭ মে অসমে ১৪ জন ভারতীয় নাগরিককে বিএসএফ দ্বারা বাংলাদেশে নির্বাসিত করা হলে বিশিষ্ট আইনজীবী ও শিক্ষাবিদদের একটি দল সরকারের কাছে এই ধরনের বহিষ্কার বন্ধ করা এবং সীমান্তে পুশ-ইন করা ব্যক্তিদের ফিরে আসার অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি একটি খোলা চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে অসমে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিদেশি ঘোষিত বেশ কয়েকজনকে আটক ও বাংলাদেশে বহিষ্কারের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং কিছু ন্যায্য দাবি জানানো হয়, যেমন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নির্বাসন ও ভোটাধিকার বাতিলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে নির্বাসিতদের পরিবারকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করা, ডিটেনশন সেন্টার থেকে জামিনে মুক্তিপ্রাপ্তদের গ্রেফতার ও নির্বাসন দেওয়া বন্ধ করা এবং যে নাগরিকদের ইতিমধ্যে জোরপূর্বক বাংলাদেশে নির্বাসিত করা হয়েছে তাদের প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেওয়া যতক্ষণ না উক্ত ব্যক্তির জাতীয়তা ও ঠিকানা বাংলাদেশ দ্বারা যাচাই করা হয়।

গুজরাত ও অসমের মতো রাজ্যগুলি যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়াই বাঙালি মুসলমানদের আটক করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি তাদের অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার প্রায় ১২ জন বাঙালি শ্রমিককে গোলাঘাট জেলার নুমালিগড় এলাকায় দৈনিক মজুর হিসাবে কাজ করার সময় অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে অসম পুলিশ গ্রেফতার করে এবং আধার ও ভোটার আইডি যাচাইয়ের পরও পরিচয়পত্র এবং মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করে রাখে। প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী একাধিক হয়রানির ঘটনা সামনে আসার পরে ওড়িশা ও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখে বলেছেন, 'বাংলার দরিদ্র, নির্দোষ শ্রমিকদের আটক করা হচ্ছে, এমনকি নির্বাসনের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। এটি তাদের জীবন ও জীবিকার সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে।' সাম্প্রতিক এক জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাংলা ভাষী অভিবাসী শ্রমিকদের হয়রানির তীব্র নিন্দা করে তাকে 'বাংলার বাইরের বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক ও অপরাধীকরণের বিজেপি ষড়যন্ত্র' বলে অভিহিত করেছেন। 

বিজেপি'র 'হিন্দু ও হিন্দি' বলয়ে বাংলা তথা বাঙালি জাতিই আজ চাপের মধ্যে, কারণ, খোদ এ রাজ্যেই বাংলা মানুষের কথ্য ভাষায় সীমিত হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দির আগ্রাসনে বিপন্ন। বাঙালির এক অংশের রক্তে এখন সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ বিষ। রাষ্ট্র ও সমাজে ক্ষমতাবান শ্রেণি বাংলা চর্চা ত্যাগ করে ইংরেজি-হিন্দিমুখী হচ্ছে। সুপরিকল্পিত ভাবে মাতৃভাষার জায়গা দখল করছে হিন্দি ও ইংরেজি। টিভি, রেডিও, রাস্তাঘাট এমনকি সরকারি দফতরেও বিকৃত বাংলায় বিজ্ঞাপন। অন্যান্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যের ভাষাগত পরিচয়ের রাজনীতির কোনও ইতিহাস নেই, তাই তামিলনাড়ুর মতোই এ রাজ্যে এবং ভিন রাজ্যের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া চলেছে।

বাঙালি সংস্কৃতির মানবিক গুণগুলিই তার স্বাতন্ত্র্য; যেমন, সামাজিক প্রীতি, ধর্মে-বর্ণে অসাম্প্রদায়িকতা। কোনও মানুষই সাম্প্রদায়িক থাকতে চায় না। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আজ সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদী রাজনীতির সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে পড়ছে সংস্কৃতির আনাচে কানাচে। সাম্প্রদায়িক পরিচিতির উপর নির্ভরশীল বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্ল্যাটফর্মকে মোকাবিলা করার জন্য চাই সমাজের সব স্তরে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এবং তার সঙ্গেই রাষ্ট্রকে আঞ্চলিকতা মুক্ত রাজনীতির জন্য চাপে রাখা।