Wednesday, 30 April 2025

'যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু...'

এই বিষাক্ত গহ্বর থেকে বেরতেই হবে

আবু সঈদ আহমেদ



একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ছেলে স্কুলের সরস্বতী পুজোয় খাজাঞ্চির দায়িত্ব পাচ্ছে, কারণ সে অঙ্কে ভালো, অতএব, হিসাব রাখার কাজ ভালো ভাবেই করবে। এরকম দৃশ্য আমাদের স্কুল জীবনে খুবই পরিচিত ছিল। কিংবা রমজান মাসে স্কুল বা কলেজ ছুটির পর হস্টেলে গিয়ে কোনও ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে জাঁকিয়ে বসে ঘুগনি রান্না করছে যাতে মুসলমান ছেলেদের সঙ্গে সেই ঘুগনি মুড়িতে মিশিয়ে জমিয়ে 'ইফতার পার্টি' হতে পারে। এ হেন ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন এরকম মানুষও আমাদের সমাজে খুব একটা বিরল নয়। কিন্তু আজ সেরকম কিছু যেন অনেক দূরের কল্পনা বলেই মনে হয়। কীভাবে হারিয়ে গেল সেইসব দিন?

এর কারণ খুঁজতে হলে অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া দরকার। আমরা জানি, আমাদের উপমহাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অধীন ছিল। বিদেশি শাসকদের নিজেদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য কিছু যুক্তির দরকার ছিল। তেমনই এক যুক্তি ছিল এই যে, ব্রিটিশ শাসন ভারতকে আগেকার অপশাসন থেকে মুক্ত করেছে। এই একই বয়ান ইংরেজ-শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিতদের মধ্যেও দেখা যায়। সৈয়দ মুজতবা আলি দুঃখ করে বলেছিলেন, বাঙালি ইউরোপ তথা দুনিয়াকে চিনেছে ইংরেজের চোখ দিয়ে। আরও দুঃখের হল, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ বাইরের দুনিয়া কিংবা ইতিহাস শুধু নয়, পড়শিকেও চিনলেন সেই ঔপনিবেশিকতার চোখ দিয়ে। কে না জানে, সাহিত্যসম্রাট ও ঋষি শিরোপা প্রাপ্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গসমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরেজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাঁহারা এই ভারতমণ্ডলে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন, এমত কুপরামর্শ আমরা ইংরেজদিগকে দিই না। যে দিন ইংরাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সেইদিন সে পরামর্শ দিব।' ('বঙ্গদেশের কৃষক')।

এমনকি যে উপন্যাসের জন্য তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সেই 'আনন্দমঠ' উপন্যাসেও বলেছেন, 'আর ফল যাহা হইবে ভালোই হইবে, ইংরাজ না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।' বাংলার বাকি শিক্ষিত হিন্দু সমাজও, ঠিক ঠিক ভাবে বললে, এই বঙ্কিমী লাইন বা 'ইংরেজ তাঁদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছে'-- এই ভাবধারাতেই এগোতে পছন্দ করেছিলেন। অন্যদিকে, সরকারি কাজ থেকে ফার্সী ভাষা লোপ পাওয়ায় পরবর্তী প্রজন্ম আর জানতে পারেনি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস, কারণ সেই ইতিহাসের এক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ফার্সী-আরবি'তেই লেখা। সে জন্য ইংরেজের লেখা ইতিহাসকেই ধ্রুবসত্য মেনে নিয়ে ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু আর মুসলমানের শত্রুতার আখ্যান হিসেবে প্রচার করে যাওয়া হল। এমনকি টড'এর 'Annals and Antiquities of Rajasthan' বই থেকেও সাহিত্য রচনাকালে রাজপুতদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বা মারাঠাদের সঙ্গে শত্রুতার অংশ বাদ রেখে প্রাধান্য পেয়েছে দিল্লি সুলতানি আর মুঘল আমলের ঘটনাগুলো। অন্যদিকে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের মনেও হিন্দু বিদ্বেষ বুনতে আসরে নামেন উইলিয়াম হান্টারের মতো লেখকেরা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের দাঁড় করাতেও চেষ্টার কসুর করেনি ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ। 

এইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দাবি জোরদার হয়ে উঠেছে, তখন দুই পক্ষের মনেই অন্য পক্ষ সম্বন্ধে সন্দেহ আর বিদ্বেষ বুনতে সফল হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তপন রায়চৌধুরী এই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন, 'মোট কথা, যার চোখ আছে সেই দেখতে পাচ্ছিল যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাঙালিকে এক অজানা সর্বনাশের পথে ঠেলে নিয়ে চলেছে। এই অশুভ সম্ভাবনা সম্পর্কে আমরা ছাত্ররা বিশেষ সচেতন ছিলাম।'

এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে স্বাধীনতা আসে। দেশভাগের ভয়াবহতা, তার আগের রাজনীতির অন্তসারশূন্যতা এবং সর্বোপরি হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ভারতের প্রধানতম রাজনীতিবিদ মহাত্মা গান্ধীর নিহত হওয়া ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশকে ধর্মান্ধতার বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে। তার জন্য ভারতের প্রধান দল মহাত্মা গান্ধীর কংগ্রেস কাজে যাই করুক, মূল রাজনৈতিক বক্তব্য ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পক্ষেই রাখত। কিন্তু গত শতকের সত্তরের দশক থেকে বিশেষত জরুরি অবস্থার পরে কংগ্রেসের মৌরসীপাট্টা অনেকটাই জখম হয়ে যায়। প্রথমে আঞ্চলিক ও বাম দলগুলো মাথা তোলে। এইরকম সময়ে আমরা যারা বড় হয়েছি তাদের কাছে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের সহাবস্থানটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হত। কিন্তু আশির দশকের সময় থেকে দক্ষিণপন্থী বিজেপি ভারতের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হতে শুরু করে। রথযাত্রা, দূরদর্শনে রামায়ণ-মহাভারত, সর্বোপরি বাবরি ধ্বংসের মধ্যে দিয়েও এই অসহিষ্ণু মতবাদ ততটা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারেনি যতটা হয়েছে বামপন্থী শক্তিগুলোর দুর্বল হয়ে পড়া আর প্রচারমাধ্যমের নতুন রূপ তথ্যপ্রযুক্তির আমূল অগ্রগতির মধ্যে দিয়ে যার ফাঁক দিয়ে গড়ে উঠল গুজব ও মিথ্যাচারের ফানুস। 

এখন কোনও তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের অনেক আগেই সেই তথ্য বহু মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক আমলের মতোই ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে গেছে শাসকের মর্জির ওপর নির্ভরশীল হয়েই। ফলে, আমাদের ইতিহাস চেতনায় মনে হতে থাকে বাংলায় কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল তেভাগার সময় থেকে। তার আগে ফজলুল হক সরকারের আমলের পাট অধ্যাদেশ, ঋণ সালিশি সভা ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞই থেকে গেছে। এমনকি 'লাঙল যার জমি তার' স্লোগানের আগে কৃষক প্রজা পার্টি 'ঘাম যার দাম তার' অংশটিও বলত, সে কথাও অনেক প্রগতিশীলদের অজানা। একই ঘটনা ঘটে গেছে সুলতানি-মুঘল আমল থেকে শুরু করে দেশভাগের চেনা বয়ানে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আয়না, মুসলমানরা সাধারণভাবে না হলেও মুসলমান নেতৃত্বকে, তা রাজা-উজির থেকে হাল আমলের রাজনীতিবিদ সকলকেই একতরফাভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। অন্যপক্ষের কণ্ঠস্বর প্রায় অনুপস্থিত অথবা বিকৃতভাবে প্রদর্শিত। যে শিক্ষাব্যবস্থার আড়ালে আবডালে ঔপনিবেশিক বিদ্বেষ ও সামাজিক ধর্মান্ধতা বাসা বেঁধেছিল সেই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষদের মন ফলে বিষিয়ে দেওয়া অত্যন্ত সহজ হয়ে যাচ্ছে এখন। ফলাফল আমরা সামনেই দেখতে পাচ্ছি। 

শিক্ষা-কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা সমাজ, তা সে জঙ্গলমহলের আদিবাসীই হোক বা মধ্যবঙ্গের মুসলমান, সকলের ক্ষেত্রেই এক 'অপরায়ন' অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। এই কারণেই কাতার বিশ্বকাপের সময়কার কোরান তিলাওয়াত যতটা চোখে লাগে, দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসের সময় স্তোত্রপাঠ অতটা আপত্তিকর মনে হয় না। এভাবেই প্রায় প্রতিদিন ঘটে চলা মুসলমান-লিঞ্চিং এখন প্রায় গা-সওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে কোনও সন্ত্রাস ঘটলেই তার দায় পাড়ার মুসলমান বিরিয়ানিওয়ালা থেকে অফিসের সহকর্মী সকলের ঘাড়েই পড়তে থাকে। এতে করে যে শুধু আক্রান্ত সম্প্রদায়ের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, ক্রমাগত ঘৃণার চাষে চাপা পড়ে যাচ্ছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-দুর্নীতি-কর্মসংস্থান প্রভৃতি জীবনধারণের জরুরি ইস্যুগুলো। বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ সংকটের মধ্যেও পরিবেশ ইস্যু প্রায় অদৃশ্যই হয়ে পড়েছে। এমনকি ঘৃণার কারবারীরা পরিবেশ ইস্যুকে বানোয়াট দাবি করতেও পিছপা হচ্ছে না। এর ক্ষতি তো সবধর্মজাতির লোকেরই হচ্ছে। 

যে সকল মুসলমান শিক্ষার আলো পেয়ে এগিয়ে এসেছেন, তাঁরা তাঁদের যে মেধা-মনন ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিয়ে সমাজকে ঋদ্ধ করতে পারতেন, তাঁদের চিন্তাশক্তিকে ব্যয় করতে হচ্ছে আশেপাশে ঘটে চলা ইসলামোফোবিয়াকে মোকাবিলার কাজে। এর ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সমাজই। আর এর থেকে বের হয়ে আসার দায় সমাজেরই, রাজনীতির কারবারীদের নয়। অতএব, সমাজের সকলকেই এই গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসার দায়িত্ব নিতে হবে। নইলে গায়ক নচিকেতার ভাষায় চলতেই থাকবে, 'ঐ ধর্মের বাঘ হেসে, আবার উঠোনে এসে,/ আশ্রয় চেয়ে যায় মানুষেরই কাছে!'


1 comment:

  1. বেশ ভালোই লিখেছেন।
    শেয়ার করলাম।

    হিন্দু-মুসলমান বিবাদ প্রশমিত করার বিষয়ে আমি আমার বক্তব্য রেখেছি।
    অনিল বাবুর হোয়াটসঅ্যাপে তা আবার শেয়ার করলাম।

    ReplyDelete