Saturday, 19 April 2025

ট্রাম্প বনাম হার্ভার্ড

বোতলটা কে ঝাঁকাচ্ছে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

আমেরিকার উন্মাদ রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত নিজেও জানেন না, তিনি ঠিক কী চাইছেন। অনুমান, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এলন মাস্ক’ও সে বিষয়ে সবিশেষ অবগত নন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে ও দেশের অনেকের মনে হয়েছে, বিশ্ব জুড়ে যা চলছে তা ক্রমেই আমেরিকার প্রতিকূলে বহমান এবং এ যাবৎ দেশেও যা হয়েছে তাও তেমন সুখকর কিছু নয়, বরং প্রভূত ভাবে আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী। বাস্তবিক, ঘরে-বাইরে ধসে যাওয়া মার্কিনী অর্থনীতি ও গত এক দশকে প্রায়-আমূল পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির আবহে, খুব স্বাভাবিক, তারা নিজেদের নগ্নরূপ দর্শনে অতিশয় কাতর ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে, অনেকেই মনে করেছিল, ট্রাম্পের MAGA বা ‘Make America Great Again’ রণধ্বনি বোধহয় তাদের সুসময় ও মাস্তানির দিনগুলি আবার ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু কথায় বলে, পাগলকে সাঁকো নাড়াতে দিতে নেই।

রাতারাতি ক্ষমতা পেয়েই ট্রাম্পের চূড়ান্ত পাগলামো গোটা বিশ্বকে শুধু হতবাক করেনি, নিজের দেশেও এখন তাঁর রণে ভঙ্গ ধ্বজভঙ্গ অবস্থা। ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের’ প্লেনে তুলে (ভারতীয়দের শিকল পরিয়ে) প্রত্যাবর্তন থেকে শুরু করে উদ্ভট শুল্ক যুদ্ধ (পরে আবার আচম্বিতে তা ৯০ দিনের জন্য রদ), ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতিকে ডেকে এনে মশকরা, দু’ দিন আগে হোয়াইট হাউজে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কিছুটা ফষ্টিনষ্টি, চীনের ওপর অভাবনীয় ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ ইত্যাদি ছাপিয়ে এখন দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে তিনি কামান দেগেছেন। সে বড় মজার বিষয়। বিশেষ করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যেন এবার বোমা বর্ষণ শুরু হয়েছে। তাঁর উপরাষ্ট্রপতি জে ডি ভান্স তো কবেই বলে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হল গণশত্রু। আর ট্রাম্প স্বয়ং এই দু’ দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘সকলেই জানে, হার্ভার্ড তার পথ হারিয়েছে। হার্ভার্ড এক রসিকতা মাত্র; এরা ঘৃণা ও মূর্খামি শেখায়, এদের ফেডারেল ফান্ড পাওয়া উচিত নয়।’ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও ছেড়ে কথা বলেনি। তাদের প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্বার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে একটি চিঠি পোস্ট করে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ‘কোনও সরকার, তা যে পার্টিরই হোক না কেন, কখনই নির্দেশ দিয়ে বলতে পারে না যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কী শিক্ষা দেবে।’ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কি এসব বলার হিম্মত আছে?

ইতিমধ্যেই মার্কিন সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (DHS)’এর সচিব ক্রিস্টি নোয়েম স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন, মোট ২.৭ বিলিয়ন ডলারের যে DHS অনুদান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পেত, তা আর তারা পাবে না। কারণ, তাঁদের মতে, এই অনুদানের অর্থে নাকি ‘আমেরিকার মূল্যবোধ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে’। শুধুমাত্র হার্ভার্ড নয়, ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর (যার মধ্যে অনেকগুলিই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও মার্কিনী গৌরবের অংশভাক) এমনতর হুমকি নেমে এসেছে। উপরন্তু, হার্ভার্ডের কাছে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে তাদের ক্যাম্পাসে যে সমস্ত বিদেশি গবেষক, ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকেরা কাজে এসেছেন তাঁদের বিশদ তথ্যের তালিকা সরকারের কাছে জমা করতে হবে ও প্রতিজনের বর্তমান বসবাসের ঠিকানাও জানাতে হবে। তদুপরি, মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো প্রশাসন থেকে হুমকি এসেছে, এতদিন হার্ভার্ড তাদের বিনিয়োগ ও সম্পত্তির উপর যে কর ছাড় পেত, সে সুযোগও প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। একেই বলে, ভাতে মারা। আশ্চর্য হলেও সত্যি, যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলিকে মনে করা হত মুক্তচিন্তা ও উন্নত গবেষণার আঁতুড়ঘর, যারা বিদেশি মেধাকে মর্যাদা ও সম্মান দিয়ে নিজেদের একাডেমিক মানকে খ্যাত করেছে, সেখানে এবার কণ্ঠরোধের পালা! কিন্তু কেন? আদতে কী চাইছে এই সরকার ও মার্কিনী প্রশাসন? তথ্য বলছে, মার্কিনী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষ, যার মধ্যে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাই ৩ লক্ষ ৩১ হাজার (প্রায় ২৮ শতাংশ)। সবচেয়ে বড় কথা, NAFSA (Association of International Educators) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মার্কিন দেশে পড়তে আসা বিদেশি ছাত্ররা মার্কিন অর্থনীতিতে ৪৩.৮ বিলিয়ন ডলার অর্থ জুগিয়েছে (টিউশন ফি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ) যার মধ্যে ভারতীয়দের অর্থের ভাগ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৮ শতাংশ)। তাহলে কি বলতে হয়, পরের ধনে পোদ্দারি করে আমেরিকার যে বৈভব ও ঠাঁটবাট, তার দিন এবার সমাগত?

বলাই বাহুল্য, মুক্ত বাণিজ্যের ধ্বজা উড়িয়ে এবং নিজেদের ম্যানুফ্যাকচারিং ও তথ্য প্রযুক্তির সুবিশাল কর্মযজ্ঞকে বৃহৎ পুঁজির জোরে মূলত চীন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতে (তথ্য প্রযুক্তি) পাঠিয়ে, সেখানকার সস্তা শ্রম ও শ্রম আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পরদেশে বিপুল শিল্প হাব গড়ে যে বাণিজ্য-লাভ আমেরিকা এতদিন ঘরে তুলেছে, তা আজ গুরুমারা বিদ্যায় সম্পূর্ণ ফেঁসে গেছে। বিশেষ করে চীন, এই গুরুমারা বিদ্যেয় হাত পাকিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে পরিষেবা এবং তথ্য প্রযুক্তি থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা— সবেতেই বিশ্ব ওস্তাদ হয়ে উঠে আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। আজ আমেরিকার বাজারও ছেয়ে গেছে ‘মেইড ইন চায়না’ ট্যাগ লাগানো পণ্যরাশিতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যোগাযোগ প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর আধুনিকতায় চীন এত দূর এগিয়ে গেছে যে আজ তারা ক্রমেই বিশ্ব বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে। ফলে, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলার ভয়ানক বিপদে পড়ে যেতে পারে এবং চীনের ইউয়ান হয়তো সে জায়গায় চলে আসতে সক্ষম। এই আশঙ্কা আজ আমেরিকার শিল্প মহলকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এই আশঙ্কা থেকেই বিপুল কর্পোরেট ফান্ডিং’এর মদতে Jingoism বা উদগ্র দেশপ্রেমের জিগির তুলে ট্রাম্পের নির্বাচনী জয়। অতএব, রাষ্ট্রপতি পদে বসেই সহানুভূতি কুড়োতে ট্রাম্প নিজের দেশকে ‘বলির পাঁঠা’ সাজিয়ে শুল্ক যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে শেষমেশ বর্শামুখটাকে চীনের দিকেই তাক করেছেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে ট্রাম্পকে এত নানারকমের পাগলামো করতে হল ও তিনি নিজেও তালকানা হয়ে গেলেন যে, মার্কিনী শিল্পমহল গেল ক্ষেপে, এমনকি বন্ধুবর মাস্ক’ও আপত্তি জানালেন; তার ওপর দেশ জুড়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল জনতা।

কিন্তু হার্ভার্ড সহ নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর তিনি বা তাঁর প্রশাসনের এই ক্ষেপে যাওয়া কেন?

আসলে, আমেরিকার এখন মোড় ঘোরানোর খেলা। এতদিন যারা মুক্ত বাণিজ্য, উদার গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে এসেছে, তারাই এখন বাণিজ্যের রক্ষাকবচ চাইছে, রাষ্ট্রীয় একাধিপত্যের জয়গান গাইছে, অভিবাসীদের অধিকারচ্যুতিতে ব্যস্ত, ব্যক্তি পরাধীনতা ও দৃশ্যত আমেরিকার স্বার্থবাহী পুঁজিবাদের পক্ষে ওকালতি করছে। কারণ, আদ্যোপান্ত মোড় ঘোরাতে হলে এইসব ভাবনা ও কার্যক্রমকে নির্বিঘ্নে সমাধা করতে হবে আর তার জন্য মুক্ত চিন্তার সমস্ত পরিসরকে আজ ভেঙে ফেলতে হবে। এতদিন আমেরিকার নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির যে এক আপেক্ষিক স্বাধিকার গড়ে উঠেছিল, দুনিয়ার নানান ধারার মানুষেরা এখানে এসে ভীড় করে চিন্তার বি-নির্মাণ ও ব্যাপ্তিতে রসদ জুগিয়েছেন, উদার গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকেরা একযোগে গলা মিলিয়েছেন (৬০’এর দশকে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষেই হোক কি ২০০৮-০৯ সালে সাব-ক্রাইম সংকটের সময়ে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনে কিংবা আজ প্যালেস্টাইনের স্বাধিকারের প্রশ্নে), সেই সমগ্র পরিসরটাকে ভেঙে ফেলতে হবে। নয়তো, যে jingoism’এর প্রবর্তন করে ট্রাম্প আজ আমেরিকাকে যুদ্ধাভিমুখি করে তুলতে চাইছে, সে চেষ্টা সফল হবে না। তাই, আজ হার্ভার্ড, কলম্বিয়া’র মতো পরিপুষ্ট ও ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিশানা। ট্রাম্প প্রশাসনের নিদান, সমস্ত তর্কমূলক ও বিরোধী স্বর ওঠার জায়গাগুলিকে কলুষিত ও অবদমিত করো। উল্লেখ্য, আমাদের দেশেও এই প্রবণতা সতত বহমান।

আমেরিকার প্রখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, ‘আপনি ১০০টা লাল ও কালো পিঁপড়ে এনে একটা বোতলে বন্দী করে রাখুন। কিচ্ছুটি হবে না। কিন্তু যদি একবার খুব জোরে বোতলটাকে ঝাঁকিয়ে দেন, দেখবেন, লাল ও কালো পিঁপড়েগুলো ভয়ঙ্কর ভাবে দু’ দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে ও পরস্পরকে হত্যা করছে। তাই সমস্যা লাল ও কালো পিঁপড়েদের নিয়ে নয়, বরং প্রশ্নটা হল, কে বোতলটা ঝাঁকাল?’ আজ আমেরিকাবাসীর মনেও হয়তো এ প্রশ্ন উঠছে— তাদের সমাজটাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে কে বা কারা?


1 comment:

  1. পুরো বিষয়টা খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, ভাল লাগল

    ReplyDelete