সকলেরই নিজ নিজ সীমা আছে!
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
'Most Governors do not become the Centre's agent; only the Centre's agents get appointed as Governors.'
স্বনামখ্যাত সাংবাদিক ও সম্পাদক ভি এন নারায়ণন সেই কবে (১৯৮৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর) 'দ্য ট্রিবিউন' পত্রিকায় তাঁর 'পাপেট শোজ ইন রাজভবন' শীর্ষক প্রবন্ধে উপরের এই মন্তব্যটি করেছিলেন। তারপরও রাজ্যপালদের ভূমিকা দলপালের। এখন পদ্মপালের। তাঁরা থেবড়ে বসে থাকেন ঔপনিবেশিক সিংহাসনে আর বাঁশ দিতে সক্রিয় থাকেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে। এতসবে লজ্জা হয় না রাষ্ট্রপতিরও।
শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির সই ছাড়াই ১০টি আইন চালু হয়ে গেল তামিলনাড়ুতে। দেশে এই প্রথম। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা যে ১০টি বিল আইনে পরিণত হল দাক্ষিণাত্যের এই প্রদেশে, তার মধ্যে রয়েছে তামিলনাডু বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধিত) আইন ২০২২, তামিলনাডু ফিশারিস বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধিত) আইন ২০২০, তামিলনাডু বিশ্ববিদ্যালয় আইন (দ্বিতীয় সংশোধিত) ২০২২। এই আইনগুলি পাশ হওয়ার ফলে এম কে স্ট্যালিন সরকার এখন রাজ্য সরকারি ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করতে পারবে। আগে এই ক্ষমতা ছিল রাজ্যপাল তথা আচার্য'র হাতে।
তবে এখনও সে রাজ্যের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য মনোনীত করতে পারবেন রাজ্যপাল। প্রসঙ্গত, রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে টানাপড়েন চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের মধ্যেও। তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী শুধু একবার বলেছেন, 'কর দেওয়া বন্ধ করতে আমাদের এক মিনিট লাগবে!' তার এক সপ্তাহের মধ্যে বিধানসভায় পাশ হওয়া সব বিল রাজ্যের আইনি স্বীকৃতি পেল সে রাজ্যে! বহু দশক ধরে দ্রাবিড়রা আর্যদের চোখে চোখ রেখে নিজেদের কৃষ্টি রক্ষা করেছে। হিন্দির সাথে ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনও রুখেছে!
এই বিলগুলিতে তামিলনাডু বিধানসভা দু'-দু'বার ছাড়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সাল থেকে সে রাজ্যের রাজ্যপাল আরএন রবি তাতে সম্মতি দেননি। ফলে, বিলগুলি আইনে পরিণত করা যায়নি। তামিলনাডুর রাজ্যপালকে বিধি স্মরণ করিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। পর্যবেক্ষণে জানিয়েছিল, বিধানসভায় পাশ হওয়ার পরও সেই বিল আটকে রাখা বৈধ কাজ নয়। বিচারপতি জে বি পারদিওয়াল ও বিচারপতি আর মহাদেবনের বেঞ্চ গত ৮ এপ্রিল জানায়, বিলের কোনও আইনি বিষয়ে আপত্তি থাকলে তা পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন রাজ্যপাল। তবে বিলটি পুরনো আকারেই আবার বিধানসভায় পাশ করানো হলে তাতে রাজ্যপাল সম্মতি দিতে বাধ্য। আর বিলে সাংবিধানিক বিচ্যুতি ঘটেছে, এমনটা মনে করলেই কেবল সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারেন রাজ্যপাল। এ ক্ষেত্রে রাজ্যপালকে যে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত মন্ত্রীসভার সদস্যদের পরামর্শ মেনেই চলতে হবে, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। এমনকী আদালত এ কথাও বলে, বিল আটকে রাজ্যপাল রবি অবৈধ কাজ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণকে 'ঐতিহাসিক' বলে উল্লেখ করেন তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন। তিনি এও বলেন, 'ভারতের সব রাজ্যের জন্য এটা বড় জয়।' সেই পর্যবেক্ষণের পরে এবার তামিলনাডু সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, যে ১০টি বিলে সম্মতি দেননি রাজ্যপাল, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে তাঁর সেই সিদ্ধান্ত অবৈধ। এর ফলে ১০টি বিল আইনে পরিণত হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ শুধু রাজ্যপাল নিয়েই নয়, খোদ রাষ্ট্রপতি সম্পর্কেও। বেনজির সেই রায়। এই প্রথম সুপ্রিম কোর্ট সময় বেঁধে দিল দেশের সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতিরও। আইনসভায় পাশ হওয়া বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ৩ মাসের মধ্যে, না-হলে জানাতে হবে কারণ। তামিলনাডুর রাজ্যপালের বিচারাধীন বিলগুলিতে সম্মতি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত বাতিল করে শীর্ষ আদালত এই বেনজির রায় দিয়েছে। সেই রায়ের আদেশ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। তামিলনাডু মামলার রায় প্রদানের সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা ও আর মহাদেবনের বেঞ্চ জানিয়েছে, সংবিধানের ২০১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন বিচার বিভাগের পর্যালোচনার আওতাধীন। ভারতীয় সংবিধানের ২০১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে কোনও বিল গেলে তিনি দু'টি কাজ করতে পারেন; হয় ওই বিলে সম্মতি জানানো অথবা তা নাকচ করে দেওয়া। কিন্তু সংবিধানে রাষ্ট্রপতির এই কাজের জন্য কোনও সময়সীমা জানানো হয়নি। এর ফলে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বার বার সংঘাতের আবহ তৈরি হয়। আদালত জানিয়েছে, রাজ্যপাল যদি রাষ্ট্রপতির কাছে কোনও বিল পাঠান আর রাষ্ট্রপতি যদি তা অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখেন, রাজ্য সরকার চাইলে তার বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারবে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, রাষ্ট্রপতির কোনও বিল আটকে রাখার ক্ষমতা নেই। হয় তাঁকে সম্মতি দিতে হবে অথবা জানাতে হবে কোথায় সংশোধন প্রয়োজন। শীর্ষ আদালত আরও বলেছে, 'আইনের অধীনে কোনও ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য কোনও সময়সীমা নির্ধারিত করা নেই। তবুও একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে তা প্রয়োগ করা উচিত। ২০১ অনুচ্ছেদের অধীনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগকে আইনের এই সাধারণ নীতি থেকে মুক্ত বলে বলা যাবে না।'
কোনও যুক্তি বা ব্যাখ্যা ছাড়া বিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বিলম্ব সাংবিধানিক নীতি লঙ্ঘনের সমান। একে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য ক্ষতিকারক বলেও স্পষ্ট উল্লেখ করেছে শীর্ষ আদালত। বলা হয়েছে, অকারণে দেরি করার কোনও জায়গা থাকতে পারে না রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও। সাধারণত, কোনও রাজ্যের আইনসভায় বিল পাশ হলে তা সম্মতির জন্য রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হয়। রাজ্যপাল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেন। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, রাজ্যপালের কাছ থেকে এই ধরনের বিল এলে রাষ্ট্রপতি অনির্দিষ্টকালের জন্য তা ফেলে রাখতে পারবেন না। বিল হাতে পাওয়ার ৩ মাসের মধ্যে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। যদি বেশি সময় লাগে, সে ক্ষেত্রে তার কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। রাষ্ট্রপতিকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার এই রায় দেশে প্রথম, আর এর ফলে রাজ্যগুলোও একটা মর্যাদার জায়গা পেল। আদালতের মন্তব্য, 'এটা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া দরকার, কোনও সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনও কাজ না করলে আদালত সেখানে হস্তক্ষেপে বিরত থাকবে না।' শুধু তাই নয়, শীর্ষ আদালতের আদেশ, তাদের এই পর্যবেক্ষণের প্রতিলিপি দেশের সকল হাই কোর্ট আর সব রাজ্যের রাজ্যপালের প্রিন্সিপাল সচিবকেও পাঠাতে হবে। এর অর্থ, এই পর্যবেক্ষণ সি ভি আনন্দ বোসের প্রিন্সিপাল সচিবের কাছে আসবে বা এসে গিয়েছে।
আমাদের রাজ্যে ২৩টি পাশ হওয়া বিল আজও রাজ্যপালের মর্জির ওপর নির্ভরশীল! শুধু বোসের কারণেই তা আলো দেখতে পারছে না। সি ভি বোস এখানে কোনও ব্যক্তি নন, একটা পদ। যে পদটি নিয়ে ভারতের সংবিধান তৈরির সময়ই প্রশ্ন উঠেছিল। গণপরিষদে রাজ্যপালের পদটিকে নির্বাচিত করার জন্য একটা জোরালো মতামত গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যর মত ছিল এই যে, যদি রাজ্যপাল নির্বাচিত হন, তবে তাঁর সুযোগ জন্মাবে নির্বাচিত রাজ্য সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করার। অতএব, যাতে তিনি সেই সুযোগ না পান তার জন্য এই পদটিকে মনোনীত করে রাখা প্রয়োজন। অর্থাৎ, সেই অর্থে রাজ্যপালের পদটি আলংকারিক। রাজ্যের তরফে একটি সাদা হাতি পোষার মতো।
এই 'সাদা হাতি' কারা? কী করে তাঁরা পোস্টিং পান? আমার মনে পড়ছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণা আইয়ার তাঁর 'দ্য ইন্ডিয়ান প্রেসিডেন্সি' বইয়ে বলছেন, 'As the Constitution now stands stripped of healthy political conventions and constitutional insights... the President (in fact Prime Minister) may remove the Governor if he does not like his or her face or food habits.'। রসিকতার আধারে এর চেয়ে চরম সত্য আর কী হতে পারে! ফলে, কেন্দ্রীয় সরকারকে খুশি করা ছাড়া রাজকীয় পদটির আর কী কাজ আছে? কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার, মানে আজকের মোদীর লব্জে 'ডাবল ইঞ্জিন' সরকার না থাকলে রাজ্যপাল বনাম মন্ত্রীসভার বিরোধ বার বার দেখা দেয়। রাজ্যপাল বেরিয়ে আসেন রাজভবন থেকে আর রাজভবনটা আসলে হয়ে ওঠে কেন্দ্রের শাসক দলের প্রাদেশিক হেড কোয়ার্টার। এমনটা যে ঘটতে পারে, স্বাধীনতার পর কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে বিতর্কে যোগ দিয়ে অনেকেই সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তখন তাঁদের মন্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গে এই চেহারাটা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬৭ সালে যখন এ রাজ্যে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার গঠিত হল। আর রাজ্যপাল দিয়ে বিরোধী দলের সরকারকে কোণঠাসা করার সুচারু শিল্পী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তবে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তাঁর বোধহয় কিছু শিক্ষা হয়েছিল। রাজ্য ও কেন্দ্রের ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস নিয়ে তখন জোর বিতর্ক। সেই সময় বোঝাপড়ায় আসতে ১৯৮৩ সালে ইন্দিরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিৎ সিং সরকারিয়াকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিশন করেন। এই কমিশন আটের দশকের শেষে এক রিপোর্টে বলে, রাজ্যপাল নিয়োগ করার আগে সরকার তথা রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নেবেন। বলতে দ্বিধা নেই, কংগ্রেস বা বিজেপি নেতৃত্বাধীন কোনও সরকারই তা করেনি। শুধু তাই নয়, ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কী হওয়া উচিত সরকারিয়া কমিশনে ব্যাখ্যা করা আছে-- ইউপিএ বা এনডিএ সরকার কেউই তা রূপায়িত করেনি। এ ব্যাপারে ভারতীয় সংবিধানের ব্যাখ্যাকাররাই বলে গিয়েছেন, আমাদের যুক্তরাষ্ট্র 'quasi federal'। আর এই যুক্তরাষ্ট্রীয় আধারটিকে বারবার ধাক্কা দেওয়া হয় রাজ্যপালকে দিয়ে। এতদিনে সুপ্রিম কোর্ট সেই রাজ্যপালকে একটু সমঝে দিল। একইসঙ্গে 'ঝিকে মেরে বউকে শেখানো'র মতো রাষ্ট্রপতিকেও সময়সীমা বেঁধে দিল।
জয় হোক স্ট্যালিনের লড়াইয়ের। জয় হোক জনগণমনের।
No comments:
Post a Comment