Wednesday, 30 April 2025

'যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু...'

এই বিষাক্ত গহ্বর থেকে বেরতেই হবে

আবু সঈদ আহমেদ



একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ছেলে স্কুলের সরস্বতী পুজোয় খাজাঞ্চির দায়িত্ব পাচ্ছে, কারণ সে অঙ্কে ভালো, অতএব, হিসাব রাখার কাজ ভালো ভাবেই করবে। এরকম দৃশ্য আমাদের স্কুল জীবনে খুবই পরিচিত ছিল। কিংবা রমজান মাসে স্কুল বা কলেজ ছুটির পর হস্টেলে গিয়ে কোনও ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে জাঁকিয়ে বসে ঘুগনি রান্না করছে যাতে মুসলমান ছেলেদের সঙ্গে সেই ঘুগনি মুড়িতে মিশিয়ে জমিয়ে 'ইফতার পার্টি' হতে পারে। এ হেন ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন এরকম মানুষও আমাদের সমাজে খুব একটা বিরল নয়। কিন্তু আজ সেরকম কিছু যেন অনেক দূরের কল্পনা বলেই মনে হয়। কীভাবে হারিয়ে গেল সেইসব দিন?

এর কারণ খুঁজতে হলে অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া দরকার। আমরা জানি, আমাদের উপমহাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অধীন ছিল। বিদেশি শাসকদের নিজেদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য কিছু যুক্তির দরকার ছিল। তেমনই এক যুক্তি ছিল এই যে, ব্রিটিশ শাসন ভারতকে আগেকার অপশাসন থেকে মুক্ত করেছে। এই একই বয়ান ইংরেজ-শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিতদের মধ্যেও দেখা যায়। সৈয়দ মুজতবা আলি দুঃখ করে বলেছিলেন, বাঙালি ইউরোপ তথা দুনিয়াকে চিনেছে ইংরেজের চোখ দিয়ে। আরও দুঃখের হল, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ বাইরের দুনিয়া কিংবা ইতিহাস শুধু নয়, পড়শিকেও চিনলেন সেই ঔপনিবেশিকতার চোখ দিয়ে। কে না জানে, সাহিত্যসম্রাট ও ঋষি শিরোপা প্রাপ্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গসমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরেজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাঁহারা এই ভারতমণ্ডলে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন, এমত কুপরামর্শ আমরা ইংরেজদিগকে দিই না। যে দিন ইংরাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সেইদিন সে পরামর্শ দিব।' ('বঙ্গদেশের কৃষক')।

এমনকি যে উপন্যাসের জন্য তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সেই 'আনন্দমঠ' উপন্যাসেও বলেছেন, 'আর ফল যাহা হইবে ভালোই হইবে, ইংরাজ না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই।' বাংলার বাকি শিক্ষিত হিন্দু সমাজও, ঠিক ঠিক ভাবে বললে, এই বঙ্কিমী লাইন বা 'ইংরেজ তাঁদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছে'-- এই ভাবধারাতেই এগোতে পছন্দ করেছিলেন। অন্যদিকে, সরকারি কাজ থেকে ফার্সী ভাষা লোপ পাওয়ায় পরবর্তী প্রজন্ম আর জানতে পারেনি মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস, কারণ সেই ইতিহাসের এক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ফার্সী-আরবি'তেই লেখা। সে জন্য ইংরেজের লেখা ইতিহাসকেই ধ্রুবসত্য মেনে নিয়ে ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু আর মুসলমানের শত্রুতার আখ্যান হিসেবে প্রচার করে যাওয়া হল। এমনকি টড'এর 'Annals and Antiquities of Rajasthan' বই থেকেও সাহিত্য রচনাকালে রাজপুতদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বা মারাঠাদের সঙ্গে শত্রুতার অংশ বাদ রেখে প্রাধান্য পেয়েছে দিল্লি সুলতানি আর মুঘল আমলের ঘটনাগুলো। অন্যদিকে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের মনেও হিন্দু বিদ্বেষ বুনতে আসরে নামেন উইলিয়াম হান্টারের মতো লেখকেরা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের দাঁড় করাতেও চেষ্টার কসুর করেনি ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ। 

এইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দাবি জোরদার হয়ে উঠেছে, তখন দুই পক্ষের মনেই অন্য পক্ষ সম্বন্ধে সন্দেহ আর বিদ্বেষ বুনতে সফল হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তপন রায়চৌধুরী এই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন, 'মোট কথা, যার চোখ আছে সেই দেখতে পাচ্ছিল যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাঙালিকে এক অজানা সর্বনাশের পথে ঠেলে নিয়ে চলেছে। এই অশুভ সম্ভাবনা সম্পর্কে আমরা ছাত্ররা বিশেষ সচেতন ছিলাম।'

এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে স্বাধীনতা আসে। দেশভাগের ভয়াবহতা, তার আগের রাজনীতির অন্তসারশূন্যতা এবং সর্বোপরি হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ভারতের প্রধানতম রাজনীতিবিদ মহাত্মা গান্ধীর নিহত হওয়া ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশকে ধর্মান্ধতার বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে। তার জন্য ভারতের প্রধান দল মহাত্মা গান্ধীর কংগ্রেস কাজে যাই করুক, মূল রাজনৈতিক বক্তব্য ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পক্ষেই রাখত। কিন্তু গত শতকের সত্তরের দশক থেকে বিশেষত জরুরি অবস্থার পরে কংগ্রেসের মৌরসীপাট্টা অনেকটাই জখম হয়ে যায়। প্রথমে আঞ্চলিক ও বাম দলগুলো মাথা তোলে। এইরকম সময়ে আমরা যারা বড় হয়েছি তাদের কাছে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের সহাবস্থানটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হত। কিন্তু আশির দশকের সময় থেকে দক্ষিণপন্থী বিজেপি ভারতের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হতে শুরু করে। রথযাত্রা, দূরদর্শনে রামায়ণ-মহাভারত, সর্বোপরি বাবরি ধ্বংসের মধ্যে দিয়েও এই অসহিষ্ণু মতবাদ ততটা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারেনি যতটা হয়েছে বামপন্থী শক্তিগুলোর দুর্বল হয়ে পড়া আর প্রচারমাধ্যমের নতুন রূপ তথ্যপ্রযুক্তির আমূল অগ্রগতির মধ্যে দিয়ে যার ফাঁক দিয়ে গড়ে উঠল গুজব ও মিথ্যাচারের ফানুস। 

এখন কোনও তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের অনেক আগেই সেই তথ্য বহু মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক আমলের মতোই ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে গেছে শাসকের মর্জির ওপর নির্ভরশীল হয়েই। ফলে, আমাদের ইতিহাস চেতনায় মনে হতে থাকে বাংলায় কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল তেভাগার সময় থেকে। তার আগে ফজলুল হক সরকারের আমলের পাট অধ্যাদেশ, ঋণ সালিশি সভা ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞই থেকে গেছে। এমনকি 'লাঙল যার জমি তার' স্লোগানের আগে কৃষক প্রজা পার্টি 'ঘাম যার দাম তার' অংশটিও বলত, সে কথাও অনেক প্রগতিশীলদের অজানা। একই ঘটনা ঘটে গেছে সুলতানি-মুঘল আমল থেকে শুরু করে দেশভাগের চেনা বয়ানে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আয়না, মুসলমানরা সাধারণভাবে না হলেও মুসলমান নেতৃত্বকে, তা রাজা-উজির থেকে হাল আমলের রাজনীতিবিদ সকলকেই একতরফাভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। অন্যপক্ষের কণ্ঠস্বর প্রায় অনুপস্থিত অথবা বিকৃতভাবে প্রদর্শিত। যে শিক্ষাব্যবস্থার আড়ালে আবডালে ঔপনিবেশিক বিদ্বেষ ও সামাজিক ধর্মান্ধতা বাসা বেঁধেছিল সেই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষদের মন ফলে বিষিয়ে দেওয়া অত্যন্ত সহজ হয়ে যাচ্ছে এখন। ফলাফল আমরা সামনেই দেখতে পাচ্ছি। 

শিক্ষা-কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা সমাজ, তা সে জঙ্গলমহলের আদিবাসীই হোক বা মধ্যবঙ্গের মুসলমান, সকলের ক্ষেত্রেই এক 'অপরায়ন' অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। এই কারণেই কাতার বিশ্বকাপের সময়কার কোরান তিলাওয়াত যতটা চোখে লাগে, দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসের সময় স্তোত্রপাঠ অতটা আপত্তিকর মনে হয় না। এভাবেই প্রায় প্রতিদিন ঘটে চলা মুসলমান-লিঞ্চিং এখন প্রায় গা-সওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে কোনও সন্ত্রাস ঘটলেই তার দায় পাড়ার মুসলমান বিরিয়ানিওয়ালা থেকে অফিসের সহকর্মী সকলের ঘাড়েই পড়তে থাকে। এতে করে যে শুধু আক্রান্ত সম্প্রদায়ের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, ক্রমাগত ঘৃণার চাষে চাপা পড়ে যাচ্ছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-দুর্নীতি-কর্মসংস্থান প্রভৃতি জীবনধারণের জরুরি ইস্যুগুলো। বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ সংকটের মধ্যেও পরিবেশ ইস্যু প্রায় অদৃশ্যই হয়ে পড়েছে। এমনকি ঘৃণার কারবারীরা পরিবেশ ইস্যুকে বানোয়াট দাবি করতেও পিছপা হচ্ছে না। এর ক্ষতি তো সবধর্মজাতির লোকেরই হচ্ছে। 

যে সকল মুসলমান শিক্ষার আলো পেয়ে এগিয়ে এসেছেন, তাঁরা তাঁদের যে মেধা-মনন ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিয়ে সমাজকে ঋদ্ধ করতে পারতেন, তাঁদের চিন্তাশক্তিকে ব্যয় করতে হচ্ছে আশেপাশে ঘটে চলা ইসলামোফোবিয়াকে মোকাবিলার কাজে। এর ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সমাজই। আর এর থেকে বের হয়ে আসার দায় সমাজেরই, রাজনীতির কারবারীদের নয়। অতএব, সমাজের সকলকেই এই গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসার দায়িত্ব নিতে হবে। নইলে গায়ক নচিকেতার ভাষায় চলতেই থাকবে, 'ঐ ধর্মের বাঘ হেসে, আবার উঠোনে এসে,/ আশ্রয় চেয়ে যায় মানুষেরই কাছে!'


Friday, 25 April 2025

'ধর্মের বিকার'

পহেলগাঁও'এ সুরক্ষা ছিল না কেন?

তরুণ লালা



আসুন, আমরা কথা বলি এই ভয়ঙ্কর, বর্বর, নিষ্ঠুর ও অমানবিক হামলার বিষয়ে— যা পহেলগাঁও'এ ঘটে গেল। এটা সম্ভবত পূর্ব-পরিকল্পিত, রীতিমতো আতঙ্কজনক, নির্মম, অসভ্য এবং স্পষ্টভাবে হিন্দুদের লক্ষ্য করেই করা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, আততায়ীরা এক দম্পতিকে ইসলামী কিছু আয়াত বলতে বলেছিল, তারপর সঙ্গী পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং স্ত্রীকে বলে দেয় যেন সে সবাইকে জানিয়ে দেয় তারা কী করেছে।

কে দায়ী? হতে পারে সেই বন্দুকধারীরা, বা তাদের পেছনের মদতদাতা, অথবা উগ্র মৌলবাদী মোল্লারা, অথবা কিছু অসন্তুষ্ট বা চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধ তরুণ, বা হয়তো কিছু একাকী উগ্রপন্থী (lone wolf) যারা একত্রিত হয়েছিল। 

সত্যিকারের দায় কার: তা হয়তো কখনই জানা যাবে না। ইসলামাবাদ সরকার এতে সক্রিয় বা নীরবভাবে জড়িত থাকতে পারে। পৃষ্ঠপোষক কারা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবে সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দিকেই সাধারণত অভিযোগ ওঠে।

কিন্তু কে দায়ী নয়? অধিকাংশ (৯৯ শতাংশ) ভারতীয় মুসলমানরা, যাঁদের এই জঘন্য সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই, অথচ এখন তাঁরাই ভীত হয়ে থাকবেন কারণ আমরা তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করব, শুধুমাত্র তাঁরা একটি নির্দিষ্ট ধর্মে জন্মেছেন বলে।

সেই ভয়াল দিনে, আদিল হুসেন শাহ নামে এক টাট্টু ঘোড়ার চালক আততায়ীদের থামাতে গিয়ে মারা যান। সব কিছু সত্ত্বেও বিদ্বেষের ঢেউয়ে যেন এক মরুভূমির মরুদ্যান, এক আশার দ্বীপ— একজন মুসলমান এক জনৈক হিন্দুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁকেও রেহাই দেয়নি ওই বর্বর আক্রমণকারীরা। তিনি কিন্তু অনায়াসেই পালিয়ে যেতে পারতেন।

কী করা বুদ্ধিমানের কাজ? এই মুহূর্তে সরকারের পাশে দাঁড়ানো, যাতে তারা উপযুক্তভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। বলা সহজ, করা কঠিন— একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা জানি না আসলে কী করা উচিত। আমাদের সর্বোচ্চ কর্তব্য হতে পারে নৈতিক সমর্থন দেওয়া, যদিও তা স্পর্শাতীত। আমরা এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় খুবই ছোট মানুষ।

যা একদমই বুদ্ধিমানের কাজ নয়: ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলমানদের উপর রাগ ঝাড়া, যাঁদের এই হামলার সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগ নেই। নাথুরাম গডসে, যিনি আমাদের জাতির জনককে হত্যা করেছিলেন, তিনি মুসলমান ছিলেন না। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকারীরাও মুসলমান ছিলেন না। এমনকি রাজীব গান্ধীকেও হত্যা করেছিলেন একজন অ-মুসলমান, যাঁকে পরবর্তীকালে তাঁর সন্তানরাই ক্ষমা করে দিয়েছেন। উল্টে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে স্বজাতির হাতেই নিজেদের বহু মুসলমান নেতা আত্মঘাতী হয়েছেন। ১৯৮৪-র দাঙ্গায় নিরীহ শিখদের টার্গেট করেছিল কংগ্রেসি 'হিন্দু দুষ্কৃতীরা' (এখন তাও নাকি তর্ক সাপেক্ষ), যা আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। ২০০২ সালে গোধরা কাণ্ডের পরে গুজরাত রাজ্য প্রশাসনের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদতে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অসংখ্য নিরীহ নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। সেই হত্যাযজ্ঞে বেছে বেছে মুসলমান নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছিল। আমরা সুরক্ষিত জায়গায় বসে হয়তো সেই হাজার হাজার নিরীহ প্রাণের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করতে পারব না, যারা স্রেফ রাজ্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও নীরব সমর্থনের কারণে প্রাণ হারিয়েছিলেন।

বৈদ্যুতিন মিডিয়ার কাণ্ডকারখানা 

এবিপি আনন্দ'র সুমনকে কেন বিভাজন সৃষ্টি করার জন্য গ্রেফতার করা হবে না সেটাই আমার কাছে আশ্চর্যজনক। 

দেখা যাচ্ছে, পহেলগাঁও'এ হামলার পর ভারত রাস্তায় নামিয়েছে তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধবাহিনীকে-- টিভি স্টুডিও র‍্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্স (TSRRF)। এই বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন আর কেউ নন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল অর্ণব গোস্বামী, GOC-নর্দার্ন কমান্ড (রিপাবলিক সদর দফতর); মেজর জেনারেল অঞ্জনা ওম কাশ্যপ, অভিজাত ১৭ মাউন্টেন স্ট্রাইক কর্পস (নয়ডা ডিভিশন) থেকে, তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছেন নয়ডা ফরোয়ার্ড অপারেটিং বেস (নিউজরুম) থেকে। তাদের কৌশলগত নীতি: 'আগে চিৎকার করো, পরে নাটকীয় হও'। এই সাহসী যোদ্ধারা হাতে হ্যান্ডহেল্ড মাইক্রোফোন আর নাইট ভিশন টেলিপ্রম্পটার নিয়ে প্রতি ঘণ্টায় হাজারখানেক অভিযোগ ছুঁড়ে শত্রুদের নির্মূল করে চলেছেন। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর শোকপ্রকাশ শব্দতরঙ্গে চাপা পড়ে যাচ্ছে। সূত্র জানাচ্ছে, 'যুদ্ধক্ষেত্র' এখন পূর্ণ হয়ে আছে গর্জন করা হ্যাশট্যাগ, ধোঁয়ায় মোড়া TRP চার্ট আর অশ্রুসজল হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডে।

বৈদ্যুতিন মিডিয়া এবং তাদের কর্মকাণ্ডের কি প্রভাব?

দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত অঞ্চলের একটি বহুতলে আমি থাকি। এইসব উপরোক্ত বিভিন্ন মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত সত্য-অর্ধসত্য-মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে আমাদের বহুতলের একজন বলে বসল, আমাদের দেশে এখন একজন হিটলারকে দরকার !!! সে নাকি সবচেয়ে বড় হিন্দু। হিন্দু বলে গর্বিত। আর তার চেয়ে বড় হিন্দু কেউ নেই। পার্শ্ববর্তী আরেকটি বহুতলের এক ব্যক্তি অকাতরে উস্কানিমূলক ও বিচ্ছেদকামী পোস্ট দিয়ে চলেছে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে এবং দাবি করছে তার চেয়ে বড় দেশভক্ত আর কেউ নেই! অথচ, তাদের ছেলেমেয়েরা কিন্তু ভারতীয় সেনা কেন, অর্ধসেনা বা সরকারি চাকরিতেও পর্যন্ত নেই। কেউ যদি ভুলক্রমে 'সেকুলার' কথাটা উল্লেখ করে তাহলেই সে হচ্ছে দেশদ্রোহী এবং সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এদের মধ্যে 'উচ্চশিক্ষিত' বলে গর্বিত ডক্টরেট, সিএ, এমবিএ, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার সকলে আছেন। এরাই নাকি বাঙালির গর্ব। এদের নাকি একজন গোপাল পাঁঠাকে দরকার। কিন্তু রাস্তায় নেমে গোপাল পাঁঠা হতে কেউ চায় না। নিদেনপক্ষে ঠাণ্ডা ঘর ছেড়ে যোগ্য শিক্ষকদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোও দূরের কথা। 

তাহলে এই মুহূর্তে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে কাকে? অবশ্যই তাদের যাদের এখন বুকে বল বেরিয়েছে (তাও তর্ক সাপেক্ষ, কারণ, কিছু করে দেখানোটা (শুধু দেখানোই) কর্তব্যের মধ্যে পড়ে)। বুঝতে হবে যে পহেলগাঁও কিন্তু সীমান্ত এলাকা নয়। উপরন্তু, বৈসারন যেতে গেলে হয় হেঁটে বা টাট্টু ঘোড়ায় যেতে হয়। সুতরাং, আতঙ্কবাদীরাও গাড়ি নিয়ে আসেনি। এতটা রাস্তা যদি কিছু সাধারণ মানুষের সাহায্য তারা পেয়েও থাকে তবুও BSF, IB, সেনা ও JKP কেউ কিছু জানতে পারল না? এখন গোদি মিডিয়া জম্মু-কাশ্মীরে আগেভাগে নির্বাচন করানোর জন্য দায়ী করছে সুপ্রিম কোর্টকে আর রাজ্য সরকারকে নিরাপত্তার গাফিলতির জন্য। জম্মু ও কাশ্মীর কি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নয়? কাশ্মীরে শান্তি ফেরা নিয়ে গৃহমন্ত্রীর এতদিনকার বড় বড় কথা ও স্তোকবাক্য আর দায়িত্বের দায়টা কি লোপাট করে দেওয়া হল? ওনার দেওয়া নিরাপত্তার আশ্বাসকে বিশ্বাস করেই তো পর্যটকেরা দলে দলে কাশ্মীরে এসেছিলেন! অথচ, ২০ মিনিট ধরে সন্ত্রাসীরা হত্যালীলা চালালো, একজন নিরাপত্তা রক্ষী সেখানে নেই! ঘটনা ঘটে যাওয়ার দেড়-দু ঘন্টা পর তাদের দেখা মিলল। স্থানীয় কাশ্মীরীরা কাঁধে-পিঠে করে গুলিবিদ্ধ ও আহত মানুষদের হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, নিজেদের বাড়িতে অসহায় মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন। আর আজ সেই উদ্ধারকর্তা কাশ্মীরীদের ওপরই ঘৃণাবর্ষণ? সেনার প্রাক্তন অধ্যক্ষরা পর্যন্ত বলছেন যে সেনাবাহিনীতে প্রায় ২ লক্ষ পদাতিক সৈন্য কম এবং যে পরিমাণ সৈন্য দু-এক বছর আগেও একটা মাত্র সেক্টর দেখত তাদের এখন দুটো সেক্টর দেখতে দেওয়া হয়েছে। এটা গাফিলতি নয়?

এই সন্ত্রাসবাদীদের কাজকে লঘু করে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা সবাই ক্ষুব্ধ, শোকাহত এবং এই ঘটনা আমাদের সকলের হৃদয় বিদীর্ণ করে। কিন্তু তাই বলে, ঠিক যেমন আমরা কাবাব-বিরিয়ানি খাওয়া বন্ধ করব না, বা শাহরুখ, আমির, সলমান খান'দের সিনেমা দেখা বা তালাত মাহমুদের গান শোনাও বন্ধ করব না, তেমনই এই ঘটনায় কষ্ট পাওয়া বা আতঙ্কে থাকা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বর্ষণ আরও ঘৃণ্য কাজ, যাঁরা নিজেরাও এই ঘটনার ফলে আরও বেশি আতঙ্কিত। কারণ, সন্ত্রাসবাদীরা চায়, যাতে আপনি নিজের দেশবাসীর বিরুদ্ধেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং এক ভয়ানক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আগুন ছড়িয়ে পড়ে যার শেষ গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, আজকের অনেক সংবাদমাধ্যম এই ঘৃণা ও বিভাজনকে আরও উসকে দিচ্ছে, যেন আগামীকাল বলে কিছু নেই‌। 

আমাদের কঠিন লড়াইটা আজ ঠিক এই জায়গাতেই। আমরা যেন মনে রাখি, 'ধর্মের বিকারেই গ্রিস মরিয়াছে, ধর্মের বিকারেই রোম লুপ্ত হইয়াছে এবং আমাদের দুর্গতির কারণ ধর্মের মধ্যে ছাড়া আর কোথাও নাই।' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

Saturday, 19 April 2025

ট্রাম্প বনাম হার্ভার্ড

বোতলটা কে ঝাঁকাচ্ছে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

আমেরিকার উন্মাদ রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত নিজেও জানেন না, তিনি ঠিক কী চাইছেন। অনুমান, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এলন মাস্ক’ও সে বিষয়ে সবিশেষ অবগত নন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে ও দেশের অনেকের মনে হয়েছে, বিশ্ব জুড়ে যা চলছে তা ক্রমেই আমেরিকার প্রতিকূলে বহমান এবং এ যাবৎ দেশেও যা হয়েছে তাও তেমন সুখকর কিছু নয়, বরং প্রভূত ভাবে আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী। বাস্তবিক, ঘরে-বাইরে ধসে যাওয়া মার্কিনী অর্থনীতি ও গত এক দশকে প্রায়-আমূল পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির আবহে, খুব স্বাভাবিক, তারা নিজেদের নগ্নরূপ দর্শনে অতিশয় কাতর ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে, অনেকেই মনে করেছিল, ট্রাম্পের MAGA বা ‘Make America Great Again’ রণধ্বনি বোধহয় তাদের সুসময় ও মাস্তানির দিনগুলি আবার ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু কথায় বলে, পাগলকে সাঁকো নাড়াতে দিতে নেই।

রাতারাতি ক্ষমতা পেয়েই ট্রাম্পের চূড়ান্ত পাগলামো গোটা বিশ্বকে শুধু হতবাক করেনি, নিজের দেশেও এখন তাঁর রণে ভঙ্গ ধ্বজভঙ্গ অবস্থা। ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের’ প্লেনে তুলে (ভারতীয়দের শিকল পরিয়ে) প্রত্যাবর্তন থেকে শুরু করে উদ্ভট শুল্ক যুদ্ধ (পরে আবার আচম্বিতে তা ৯০ দিনের জন্য রদ), ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতিকে ডেকে এনে মশকরা, দু’ দিন আগে হোয়াইট হাউজে ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কিছুটা ফষ্টিনষ্টি, চীনের ওপর অভাবনীয় ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ ইত্যাদি ছাপিয়ে এখন দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে তিনি কামান দেগেছেন। সে বড় মজার বিষয়। বিশেষ করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যেন এবার বোমা বর্ষণ শুরু হয়েছে। তাঁর উপরাষ্ট্রপতি জে ডি ভান্স তো কবেই বলে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হল গণশত্রু। আর ট্রাম্প স্বয়ং এই দু’ দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘সকলেই জানে, হার্ভার্ড তার পথ হারিয়েছে। হার্ভার্ড এক রসিকতা মাত্র; এরা ঘৃণা ও মূর্খামি শেখায়, এদের ফেডারেল ফান্ড পাওয়া উচিত নয়।’ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও ছেড়ে কথা বলেনি। তাদের প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্বার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে একটি চিঠি পোস্ট করে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ‘কোনও সরকার, তা যে পার্টিরই হোক না কেন, কখনই নির্দেশ দিয়ে বলতে পারে না যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কী শিক্ষা দেবে।’ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কি এসব বলার হিম্মত আছে?

ইতিমধ্যেই মার্কিন সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (DHS)’এর সচিব ক্রিস্টি নোয়েম স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন, মোট ২.৭ বিলিয়ন ডলারের যে DHS অনুদান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পেত, তা আর তারা পাবে না। কারণ, তাঁদের মতে, এই অনুদানের অর্থে নাকি ‘আমেরিকার মূল্যবোধ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে’। শুধুমাত্র হার্ভার্ড নয়, ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর (যার মধ্যে অনেকগুলিই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও মার্কিনী গৌরবের অংশভাক) এমনতর হুমকি নেমে এসেছে। উপরন্তু, হার্ভার্ডের কাছে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে তাদের ক্যাম্পাসে যে সমস্ত বিদেশি গবেষক, ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকেরা কাজে এসেছেন তাঁদের বিশদ তথ্যের তালিকা সরকারের কাছে জমা করতে হবে ও প্রতিজনের বর্তমান বসবাসের ঠিকানাও জানাতে হবে। তদুপরি, মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো প্রশাসন থেকে হুমকি এসেছে, এতদিন হার্ভার্ড তাদের বিনিয়োগ ও সম্পত্তির উপর যে কর ছাড় পেত, সে সুযোগও প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। একেই বলে, ভাতে মারা। আশ্চর্য হলেও সত্যি, যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলিকে মনে করা হত মুক্তচিন্তা ও উন্নত গবেষণার আঁতুড়ঘর, যারা বিদেশি মেধাকে মর্যাদা ও সম্মান দিয়ে নিজেদের একাডেমিক মানকে খ্যাত করেছে, সেখানে এবার কণ্ঠরোধের পালা! কিন্তু কেন? আদতে কী চাইছে এই সরকার ও মার্কিনী প্রশাসন? তথ্য বলছে, মার্কিনী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষ, যার মধ্যে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাই ৩ লক্ষ ৩১ হাজার (প্রায় ২৮ শতাংশ)। সবচেয়ে বড় কথা, NAFSA (Association of International Educators) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মার্কিন দেশে পড়তে আসা বিদেশি ছাত্ররা মার্কিন অর্থনীতিতে ৪৩.৮ বিলিয়ন ডলার অর্থ জুগিয়েছে (টিউশন ফি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ) যার মধ্যে ভারতীয়দের অর্থের ভাগ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৮ শতাংশ)। তাহলে কি বলতে হয়, পরের ধনে পোদ্দারি করে আমেরিকার যে বৈভব ও ঠাঁটবাট, তার দিন এবার সমাগত?

বলাই বাহুল্য, মুক্ত বাণিজ্যের ধ্বজা উড়িয়ে এবং নিজেদের ম্যানুফ্যাকচারিং ও তথ্য প্রযুক্তির সুবিশাল কর্মযজ্ঞকে বৃহৎ পুঁজির জোরে মূলত চীন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতে (তথ্য প্রযুক্তি) পাঠিয়ে, সেখানকার সস্তা শ্রম ও শ্রম আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পরদেশে বিপুল শিল্প হাব গড়ে যে বাণিজ্য-লাভ আমেরিকা এতদিন ঘরে তুলেছে, তা আজ গুরুমারা বিদ্যায় সম্পূর্ণ ফেঁসে গেছে। বিশেষ করে চীন, এই গুরুমারা বিদ্যেয় হাত পাকিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে পরিষেবা এবং তথ্য প্রযুক্তি থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা— সবেতেই বিশ্ব ওস্তাদ হয়ে উঠে আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। আজ আমেরিকার বাজারও ছেয়ে গেছে ‘মেইড ইন চায়না’ ট্যাগ লাগানো পণ্যরাশিতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যোগাযোগ প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর আধুনিকতায় চীন এত দূর এগিয়ে গেছে যে আজ তারা ক্রমেই বিশ্ব বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে। ফলে, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলার ভয়ানক বিপদে পড়ে যেতে পারে এবং চীনের ইউয়ান হয়তো সে জায়গায় চলে আসতে সক্ষম। এই আশঙ্কা আজ আমেরিকার শিল্প মহলকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এই আশঙ্কা থেকেই বিপুল কর্পোরেট ফান্ডিং’এর মদতে Jingoism বা উদগ্র দেশপ্রেমের জিগির তুলে ট্রাম্পের নির্বাচনী জয়। অতএব, রাষ্ট্রপতি পদে বসেই সহানুভূতি কুড়োতে ট্রাম্প নিজের দেশকে ‘বলির পাঁঠা’ সাজিয়ে শুল্ক যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে শেষমেশ বর্শামুখটাকে চীনের দিকেই তাক করেছেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে ট্রাম্পকে এত নানারকমের পাগলামো করতে হল ও তিনি নিজেও তালকানা হয়ে গেলেন যে, মার্কিনী শিল্পমহল গেল ক্ষেপে, এমনকি বন্ধুবর মাস্ক’ও আপত্তি জানালেন; তার ওপর দেশ জুড়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল জনতা।

কিন্তু হার্ভার্ড সহ নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর তিনি বা তাঁর প্রশাসনের এই ক্ষেপে যাওয়া কেন?

আসলে, আমেরিকার এখন মোড় ঘোরানোর খেলা। এতদিন যারা মুক্ত বাণিজ্য, উদার গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে এসেছে, তারাই এখন বাণিজ্যের রক্ষাকবচ চাইছে, রাষ্ট্রীয় একাধিপত্যের জয়গান গাইছে, অভিবাসীদের অধিকারচ্যুতিতে ব্যস্ত, ব্যক্তি পরাধীনতা ও দৃশ্যত আমেরিকার স্বার্থবাহী পুঁজিবাদের পক্ষে ওকালতি করছে। কারণ, আদ্যোপান্ত মোড় ঘোরাতে হলে এইসব ভাবনা ও কার্যক্রমকে নির্বিঘ্নে সমাধা করতে হবে আর তার জন্য মুক্ত চিন্তার সমস্ত পরিসরকে আজ ভেঙে ফেলতে হবে। এতদিন আমেরিকার নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির যে এক আপেক্ষিক স্বাধিকার গড়ে উঠেছিল, দুনিয়ার নানান ধারার মানুষেরা এখানে এসে ভীড় করে চিন্তার বি-নির্মাণ ও ব্যাপ্তিতে রসদ জুগিয়েছেন, উদার গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকেরা একযোগে গলা মিলিয়েছেন (৬০’এর দশকে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষেই হোক কি ২০০৮-০৯ সালে সাব-ক্রাইম সংকটের সময়ে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনে কিংবা আজ প্যালেস্টাইনের স্বাধিকারের প্রশ্নে), সেই সমগ্র পরিসরটাকে ভেঙে ফেলতে হবে। নয়তো, যে jingoism’এর প্রবর্তন করে ট্রাম্প আজ আমেরিকাকে যুদ্ধাভিমুখি করে তুলতে চাইছে, সে চেষ্টা সফল হবে না। তাই, আজ হার্ভার্ড, কলম্বিয়া’র মতো পরিপুষ্ট ও ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিশানা। ট্রাম্প প্রশাসনের নিদান, সমস্ত তর্কমূলক ও বিরোধী স্বর ওঠার জায়গাগুলিকে কলুষিত ও অবদমিত করো। উল্লেখ্য, আমাদের দেশেও এই প্রবণতা সতত বহমান।

আমেরিকার প্রখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, ‘আপনি ১০০টা লাল ও কালো পিঁপড়ে এনে একটা বোতলে বন্দী করে রাখুন। কিচ্ছুটি হবে না। কিন্তু যদি একবার খুব জোরে বোতলটাকে ঝাঁকিয়ে দেন, দেখবেন, লাল ও কালো পিঁপড়েগুলো ভয়ঙ্কর ভাবে দু’ দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে ও পরস্পরকে হত্যা করছে। তাই সমস্যা লাল ও কালো পিঁপড়েদের নিয়ে নয়, বরং প্রশ্নটা হল, কে বোতলটা ঝাঁকাল?’ আজ আমেরিকাবাসীর মনেও হয়তো এ প্রশ্ন উঠছে— তাদের সমাজটাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে কে বা কারা?


Wednesday, 16 April 2025

কাঠপুতলিদের সবক শেখালো আদালত

সকলেরই নিজ নিজ সীমা আছে! 

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



'Most Governors do not become the Centre's agent; only the Centre's agents get appointed as Governors.' 

স্বনামখ্যাত সাংবাদিক ও সম্পাদক ভি এন নারায়ণন সেই কবে (১৯৮৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর) 'দ্য ট্রিবিউন' পত্রিকায় তাঁর 'পাপেট শোজ ইন রাজভবন' শীর্ষক প্রবন্ধে উপরের এই মন্তব্যটি করেছিলেন। তারপরও রাজ্যপালদের ভূমিকা দলপালের। এখন পদ্মপালের। তাঁরা থেবড়ে বসে থাকেন ঔপনিবেশিক সিংহাসনে আর বাঁশ দিতে সক্রিয় থাকেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে। এতসবে লজ্জা হয় না রাষ্ট্রপতিরও। 

শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির সই ছাড়াই ১০টি আইন চালু হয়ে গেল তামিলনাড়ুতে। দেশে এই প্রথম। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা যে ১০টি বিল আইনে পরিণত হল দাক্ষিণাত্যের এই প্রদেশে, তার মধ্যে রয়েছে তামিলনাডু বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধিত) আইন ২০২২, তামিলনাডু ফিশারিস বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধিত) আইন ২০২০, তামিলনাডু বিশ্ববিদ্যালয় আইন (দ্বিতীয় সংশোধিত) ২০২২। এই আইনগুলি পাশ হওয়ার ফলে এম কে স্ট্যালিন সরকার এখন রাজ্য সরকারি ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করতে পারবে। আগে এই ক্ষমতা ছিল রাজ্যপাল তথা আচার্য'র হাতে।

তবে এখনও সে রাজ্যের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য মনোনীত করতে পারবেন রাজ্যপাল। প্রসঙ্গত, রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে টানাপড়েন চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের মধ্যেও। তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী শুধু একবার  বলেছেন, 'কর দেওয়া বন্ধ করতে আমাদের এক মিনিট লাগবে!' তার এক সপ্তাহের মধ্যে বিধানসভায় পাশ হওয়া সব বিল রাজ্যের আইনি স্বীকৃতি পেল সে রাজ্যে! বহু দশক ধরে দ্রাবিড়রা আর্যদের চোখে চোখ রেখে নিজেদের কৃষ্টি রক্ষা করেছে। হিন্দির সাথে ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনও রুখেছে! 

এই বিলগুলিতে তামিলনাডু বিধানসভা দু'-দু'বার ছাড়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সাল থেকে সে রাজ্যের রাজ্যপাল আরএন রবি তাতে সম্মতি দেননি। ফলে, বিলগুলি আইনে পরিণত করা যায়নি। তামিলনাডুর রাজ্যপালকে বিধি স্মরণ করিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। পর্যবেক্ষণে জানিয়েছিল, বিধানসভায় পাশ হওয়ার পরও সেই বিল আটকে রাখা বৈধ কাজ নয়। বিচারপতি জে বি পারদিওয়াল ও বিচারপতি আর মহাদেবনের বেঞ্চ গত ৮ এপ্রিল জানায়, বিলের কোনও আইনি বিষয়ে আপত্তি থাকলে তা পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন রাজ্যপাল। তবে বিলটি পুরনো আকারেই আবার বিধানসভায় পাশ করানো হলে তাতে রাজ্যপাল সম্মতি দিতে বাধ্য। আর বিলে সাংবিধানিক বিচ্যুতি ঘটেছে, এমনটা মনে করলেই কেবল সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারেন রাজ্যপাল। এ ক্ষেত্রে রাজ্যপালকে যে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত মন্ত্রীসভার সদস্যদের পরামর্শ মেনেই চলতে হবে, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। এমনকী আদালত এ কথাও বলে, বিল আটকে রাজ্যপাল রবি অবৈধ কাজ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণকে 'ঐতিহাসিক' বলে উল্লেখ করেন তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন। তিনি এও বলেন, 'ভারতের সব রাজ্যের জন্য এটা বড় জয়।' সেই পর্যবেক্ষণের পরে এবার তামিলনাডু সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, যে ১০টি বিলে সম্মতি দেননি রাজ্যপাল, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে তাঁর সেই সিদ্ধান্ত অবৈধ। এর ফলে ১০টি বিল আইনে পরিণত হয়েছে। 

সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ শুধু রাজ্যপাল নিয়েই নয়, খোদ রাষ্ট্রপতি সম্পর্কেও। বেনজির সেই রায়। এই প্রথম সুপ্রিম কোর্ট সময় বেঁধে দিল দেশের সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতিরও। আইনসভায় পাশ হওয়া বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ৩ মাসের মধ্যে, না-হলে জানাতে হবে কারণ। তামিলনাডুর রাজ্যপালের বিচারাধীন বিলগুলিতে সম্মতি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত বাতিল করে শীর্ষ আদালত এই বেনজির রায় দিয়েছে। সেই রায়ের আদেশ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। তামিলনাডু মামলার রায় প্রদানের সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা ও আর মহাদেবনের বেঞ্চ জানিয়েছে, সংবিধানের ২০১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন বিচার বিভাগের পর্যালোচনার আওতাধীন। ভারতীয় সংবিধানের ২০১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির কাছে কোনও বিল গেলে তিনি দু'টি কাজ করতে পারেন; হয় ওই বিলে সম্মতি জানানো অথবা তা নাকচ করে দেওয়া। কিন্তু সংবিধানে রাষ্ট্রপতির এই কাজের জন্য কোনও সময়সীমা জানানো হয়নি। এর ফলে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বার বার সংঘাতের আবহ তৈরি হয়। আদালত জানিয়েছে, রাজ্যপাল যদি রাষ্ট্রপতির কাছে কোনও বিল পাঠান আর রাষ্ট্রপতি যদি তা অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখেন, রাজ্য সরকার চাইলে তার বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারবে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, রাষ্ট্রপতির কোনও বিল আটকে রাখার ক্ষমতা নেই। হয় তাঁকে সম্মতি দিতে হবে অথবা জানাতে হবে কোথায় সংশোধন প্রয়োজন। শীর্ষ আদালত আরও বলেছে, 'আইনের অধীনে কোনও ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য কোনও সময়সীমা নির্ধারিত করা নেই। তবুও একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে তা প্রয়োগ করা উচিত। ২০১ অনুচ্ছেদের অধীনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগকে আইনের এই সাধারণ নীতি থেকে মুক্ত বলে বলা যাবে না।' 

কোনও যুক্তি বা ব্যাখ্যা ছাড়া বিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বিলম্ব সাংবিধানিক নীতি লঙ্ঘনের সমান। একে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য ক্ষতিকারক বলেও স্পষ্ট উল্লেখ করেছে শীর্ষ আদালত। বলা হয়েছে, অকারণে দেরি করার কোনও জায়গা থাকতে পারে না রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও। সাধারণত, কোনও রাজ্যের আইনসভায় বিল পাশ হলে তা সম্মতির জন্য রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হয়। রাজ্যপাল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেন। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, রাজ্যপালের কাছ থেকে এই ধরনের বিল এলে রাষ্ট্রপতি অনির্দিষ্টকালের জন্য তা ফেলে রাখতে পারবেন না। বিল হাতে পাওয়ার ৩ মাসের মধ্যে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। যদি বেশি সময় লাগে, সে ক্ষেত্রে তার কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। রাষ্ট্রপতিকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার এই রায় দেশে প্রথম, আর এর ফলে রাজ্যগুলোও একটা মর্যাদার জায়গা পেল। আদালতের মন্তব্য, 'এটা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া দরকার, কোনও সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনও কাজ না করলে আদালত সেখানে হস্তক্ষেপে বিরত থাকবে না।' শুধু তাই নয়, শীর্ষ আদালতের আদেশ, তাদের এই পর্যবেক্ষণের প্রতিলিপি দেশের সকল হাই কোর্ট আর সব রাজ্যের রাজ্যপালের প্রিন্সিপাল সচিবকেও পাঠাতে হবে। এর অর্থ, এই পর্যবেক্ষণ সি ভি আনন্দ বোসের প্রিন্সিপাল সচিবের কাছে আসবে বা এসে গিয়েছে।  

আমাদের রাজ্যে ২৩টি পাশ হওয়া বিল আজও রাজ্যপালের মর্জির ওপর নির্ভরশীল! শুধু বোসের কারণেই তা আলো দেখতে পারছে না। সি ভি বোস এখানে কোনও ব্যক্তি নন, একটা পদ। যে পদটি নিয়ে ভারতের সংবিধান তৈরির সময়ই প্রশ্ন উঠেছিল। গণপরিষদে রাজ্যপালের পদটিকে নির্বাচিত করার জন্য একটা জোরালো মতামত গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যর মত ছিল এই যে, যদি রাজ্যপাল নির্বাচিত হন, তবে তাঁর সুযোগ জন্মাবে নির্বাচিত রাজ্য সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করার। অতএব, যাতে তিনি সেই সুযোগ না পান তার জন্য এই পদটিকে মনোনীত করে রাখা প্রয়োজন। অর্থাৎ, সেই অর্থে রাজ্যপালের পদটি আলংকারিক। রাজ্যের তরফে একটি সাদা হাতি পোষার মতো। 

এই 'সাদা হাতি' কারা? কী করে তাঁরা পোস্টিং পান? আমার মনে পড়ছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণা আইয়ার তাঁর 'দ্য ইন্ডিয়ান প্রেসিডেন্সি' বইয়ে বলছেন, 'As the Constitution now stands stripped of healthy political conventions and constitutional insights...  the President (in fact Prime Minister) may remove the Governor if he does not like his or her face or food habits.'। রসিকতার আধারে এর চেয়ে  চরম সত্য আর কী হতে পারে! ফলে, কেন্দ্রীয় সরকারকে খুশি করা ছাড়া রাজকীয় পদটির আর কী কাজ আছে? কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার, মানে আজকের মোদীর লব্জে 'ডাবল ইঞ্জিন' সরকার না থাকলে রাজ্যপাল বনাম মন্ত্রীসভার বিরোধ বার বার দেখা দেয়। রাজ্যপাল বেরিয়ে আসেন রাজভবন থেকে আর রাজভবনটা আসলে হয়ে ওঠে কেন্দ্রের শাসক দলের প্রাদেশিক হেড কোয়ার্টার। এমনটা যে ঘটতে পারে, স্বাধীনতার পর কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে বিতর্কে যোগ দিয়ে অনেকেই সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তখন তাঁদের মন্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। 

পশ্চিমবঙ্গে এই চেহারাটা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬৭ সালে যখন এ রাজ্যে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার গঠিত হল। আর রাজ্যপাল দিয়ে বিরোধী দলের সরকারকে কোণঠাসা করার সুচারু শিল্পী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তবে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তাঁর বোধহয় কিছু শিক্ষা হয়েছিল। রাজ্য ও কেন্দ্রের ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস নিয়ে তখন জোর বিতর্ক। সেই সময় বোঝাপড়ায় আসতে ১৯৮৩ সালে ইন্দিরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিৎ সিং সরকারিয়াকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিশন করেন। এই কমিশন আটের দশকের শেষে এক রিপোর্টে বলে, রাজ্যপাল নিয়োগ করার আগে সরকার তথা রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নেবেন। বলতে দ্বিধা নেই, কংগ্রেস বা বিজেপি নেতৃত্বাধীন কোনও সরকারই তা করেনি। শুধু তাই নয়, ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কী হওয়া উচিত সরকারিয়া কমিশনে ব্যাখ্যা করা আছে-- ইউপিএ বা এনডিএ সরকার কেউই তা রূপায়িত করেনি। এ ব্যাপারে ভারতীয় সংবিধানের ব্যাখ্যাকাররাই বলে গিয়েছেন, আমাদের যুক্তরাষ্ট্র 'quasi federal'।  আর এই যুক্তরাষ্ট্রীয় আধারটিকে বারবার ধাক্কা দেওয়া হয় রাজ্যপালকে দিয়ে। এতদিনে সুপ্রিম কোর্ট সেই রাজ্যপালকে একটু সমঝে দিল। একইসঙ্গে 'ঝিকে মেরে বউকে শেখানো'র মতো রাষ্ট্রপতিকেও সময়সীমা বেঁধে দিল।

জয় হোক স্ট্যালিনের লড়াইয়ের। জয় হোক জনগণমনের।


Sunday, 13 April 2025

ডায়ার উলফ: বিজ্ঞানের কামাল?

নাকি পুঁজির ভাঁওতা?

আবু সঈদ আহমেদ



বিশ্ব জুড়ে অশান্তি, দেশ জুড়ে অনাচার আর রাজ্য জুড়ে হতাশার বাতাবরণ যখন আমাদের জীবনকে বিষাক্ত করে তুলেছে, তখনই কানে এল এমন একটা খবর যা শুধু অদ্ভুতই না বেশ লোমহর্ষক। দশ হাজারেরও বেশি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া একটা অতিকায় নেকড়েকে নাকি বিজ্ঞানীরা ফিরিয়ে এনেছেন। এই অতি নেকড়ে'রা তুষার যুগের পরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হলেও বহু উপকথাতেই জায়গা করে নিয়েছিল; এছাড়াও Games of Thrones নামে এক জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজের কল্যাণে বিশ্ব জুড়ে পরিচিতি পেয়েছে। যখন চারিদিকে একের পর এক পরিবেশহানির খবর আসে, যখন চোখের সামনে একের পর এক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, মুছে যায় ছোটবেলার একের পর এক খেলার মাঠ, পাড়ার গাছ, তখন এ হেন খবরে একটু পুলকিত হওয়া যায় বইকি। কিন্তু সত্যিই কি এটা কোনও সুখবর?

প্রথমত, আমাদের জানা দরকার এই Dire Wolf বা অতি নেকড়েকে ফিরিয়ে এনেছে Colossal Bioscience নামে একটি বেসরকারি সংস্থা, কোনও জাতীয় প্রতিষ্ঠান নয়। বিজ্ঞানের বিকাশ এবং পুঁজির অবদান দুইই হাত ধরাধরি করে চলেছে বহুদিন ধরে। এতে কোনও অভিনবত্ব নেই। কিন্তু পুঁজি থাকলেই থাকে স্বার্থ এবং কিছু অস্বচ্ছতা। এই প্রকল্পটা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে হলেও স্বার্থ আর স্বচ্ছতার প্রশ্ন উঠত। তবে রাষ্ট্রকে এখনও সাংসদ, আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থা এসবের ঝক্কি পোহাতে হয়, সওদাগরি ক্ষেত্রে সে সবের বালাই তুলনায় কম। ফলে, এখানে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কতটা হচ্ছে এসব অনেকটাই অজানা থেকে যাবে। হস্তক্ষেপ করা তো দূর অস্ত।

দ্বিতীয়ত, এর আগেও বিলুপ্ত প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলেছে। পীরানিয় আইবেক্স নামে একপ্রকারের বুনো ভেড়াকে কিছু সময়ের জন্য ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। যদিও সেই ছানাটি বেশিক্ষণ বাঁচেনি। ফলে, বিলুপ্ত জীবকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রথম হওয়ার দাবিটা এ ক্ষেত্রে খাটে না। এছাড়াও গত শতাব্দীতেই ক্লোনিং'এর মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল ডলি নামের ভেড়া। সেই পদ্ধতির উন্নত রূপ এখন চর্চিত হচ্ছে ইরানের মতো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কবলিত দেশগুলিতেও। আর উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এসবের প্রয়োগ তো দীর্ঘদিনের।

তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে বড় গ্যাঁড়াকলটি আছে এই মুদ্দাতে যে এই অতি নেকড়ে বা Dire Wolf আজকের নেকড়ের থেকে species বা প্রজাতিগত ভাবে তো বটেই, genus বা গণগত ভাবেও আলাদা। যেখানে সাধারণ কিংবা বড় আকারের ধূসর নেকড়ের genus বা গণ সাধারণ কুকুরের মতই Canis, কেবল প্রজাতি আলাদা হয়ে lupus। সেখানে এই অতি নেকড়ে বা Dire Wolf'এর genus বা গণ হল Aenocyon। ফলে, কেবলমাত্র জিনগত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে Dire Wolf'এর জীবাশ্ম বা ভাঙাচোরা কঙ্কাল থেকে কিছু জিন তুলে নিয়ে ধূসর নেকড়ের কোষে বসিয়ে surrogate পদ্ধতিতে একটা ভিন্ন দর্শন ভ্রুণ বার করে যদি দাবি করা হয় এর সঙ্গে সেই বিলুপ্ত অতি নেকড়ের এতই সাদৃশ্য আছে যে একে আপনারা বিলুপ্ত অতি নেকড়ে বলে মেনে নিন, তাহলে সেই দাবির প্রতি প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এটাকে নিশ্চিতভাবেই একটা Genetically Modified নেকড়ে বলা যায় যাতে বিলুপ্ত প্রাণীর জিন রয়েছে।

কিন্তু গবেষণাতে এও প্রমাণিত হয়েছে, অকৃষ্ণাঙ্গ মানুষের শরীরে কিছু পরিমাণে বিলুপ্ত নিয়েন্ডারথাল মানবের জিন রয়েছে। অকৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে অনেক ফর্সা, অন্যান্য শারীরিক পরিবর্তনও আছে। তাহলে কি অকৃষ্ণাঙ্গরা নিজেদের বিলুপ্ত নিয়েন্ডারথাল বলবেন? যে সব বেগুনে BT ব্যাকটেরিয়ার cry1Ac জিন থাকে সেগুলো বেগুন না ব্যাকটেরিয়া?

এই কোম্পানির দাবির সততার প্রশ্ন ছেড়ে বেশ কিছু আশঙ্কার জায়গা দেখা যাক। কিছুদিন আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেশের অন্যতম ধনী-পুত্রের পশুশালায় যেতে দেখা গেছে, যার পোশাকী নাম 'বনতারা প্রাণী পুনর্বাসন কেন্দ্র' জাতীয় কিছু। এই পশুশালায় জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে পশুপাখিদের জোগাড় করা, সবেতেই ব্যাপকভাবে স্বচ্ছতা রক্ষিত হয়েছে তা বলা যায় না। এবার এই অতি নেকড়ের পরে যদি ভারতীয় হাতির সাথে মেরু অঞ্চলের বিলুপ্ত ম্যামথের জিন মিলিয়ে কোনও কুন্তলীয় মাতঙ্গ এনে কোনওদিন ম্যামথের প্রত্যাবর্তনও দাবি করা হয়, যেমনটা এই কোম্পানির কর্ণধারেরা তাঁদের লক্ষ্য নিয়ে বলেছেন, তাহলে কেমন দাঁড়ায়! এইভাবে একে একে বেশ কিছু বিলুপ্ত জীবের এ হেন ‘প্রত্যাবর্তন’ ঘটিয়ে এক বেসরকারি পশুশালাও খুলে দেওয়া যেতে পারে। 'জুরাসিক পার্ক' ফ্র্যাঞ্চাইজির ছায়াছবির মতো দলে দলে সেগুলো দেখতেও লোকে যাবে। এভাবে চলবে Money begets money পন্থায় পুঁজির বিকাশ। এবং পুঁজি যেখানে খাটবে সেখানে সব কিছু স্বচ্ছভাবে হবে তা বলা যায় না। আর পুঁজির জোর খাটিয়ে অন্যান্য মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন করা হবে কিনা সেই প্রশ্নও থেকে যায়।

সংকর জীব প্রসঙ্গে বলা যায় যে, বিশ্ব জুড়ে এ ধরনের জীবের চাষ হয়ে এসেছে। আমাদের ছোটবেলাতেও আলিপুর চিড়িয়াখানায় টাইগন, লিটিগন দেখার স্মৃতি এখনও অমলিন। কিন্তু এই সংকর জীবেদের সকলেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের সঙ্গে ছেলেখেলা সামলে উঠতে পারে না। অনেককেই অকালে চলে যেতে হয়। তাছাড়াও, একটা বিলুপ্ত জীবের জিন সম্বলিত অন্য একটি জীবের শরীর, দীর্ঘদিন ধরে চেপে থাকা বা একেবারেই নতুন কোনও রোগ-জীবাণুর আঁতুড়ঘর হয়ে উঠবে কিনা সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। আরেকটি বড় প্রশ্ন, এই পশুর জিন প্রকল্পের আড়ালে কোনও নিষিদ্ধ কিংবা বিতর্কিত গবেষণা চলছে না তো?

ফলে, প্রশ্ন আর আশঙ্কা কেবল একটা নয়, অনেকগুলো।


Thursday, 10 April 2025

কর্পোরেট স্বার্থে নতুন ওয়াকফ আইন

ধর্মীয় মেরুকরণও আরেক উদ্দেশ্য 

নজরুল আহমেদ জমাদার



সংসদের দুই কক্ষেই ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস করিয়ে তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শগত এজেন্ডার সাফল্যের জন্য আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল আরএসএস-বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। হিন্দু রাষ্ট্র রূপায়ণের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রাথমিকভাবে তিনটি এজেন্ডা নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে নেমেছিল গেরুয়া বাহিনী। প্রথমটি হল, বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির তৈরি করা। দ্বিতীয় এজেন্ডা, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করা। এই দুটি এজেন্ডা ইতিমধ্যেই সফল হয়েছে। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হল ইউনিফর্ম সিভিল কোড (অভিন্ন দেওয়ানী বিধি) চালু করা। সেটা এখনও বাস্তবিক সফল হয়নি। সংবিধান বিরোধী ওয়াকফ বিল পাস করিয়ে তৃতীয় রাজনৈতিক এজেন্ডার সাফল্যের প্রাথমিক কাজটা সম্পূর্ণ করল তারা। সার্বিক ভাবে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার উপর এটা একটা বড় আঘাত। শুধু তাই নয়, ওয়াকফ সম্পত্তির উপর কর্পোরেট লুট চালানোর উদ্দেশ্যও এই বিল আনার অন্যতম কারণ।

আসলে, ওয়াকফ বিষয়টা নিয়ে আমাদের সমাজের বিরাট অংশের মানুষ সেই অর্থে ওয়াকিবহাল নয়। এতটুকুই জানে যে এটা মুসলমানদের ব্যাপার। বৃহত্তর সমাজের মানুষের অজ্ঞতার কারণেই বিজেপি ও আরএসএস'এর সুবিধা হয়ে যায় অসাংবিধানিক বিল পাস করিয়ে নিতে, আর সংসদের দুই কক্ষেই যখন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। বৃহত্তর সমাজের মানুষ যদি বিজেপি'র রাজনৈতিক অভিসন্ধি জানত তাহলে একটা প্রতিবাদ আগে থেকেই আসত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদের বাইরে বৃহত্তর সমাজের মতামতও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

ওয়াকফ বিষয়টা কী? এটার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তিটাই বা কী? পৃথিবীতে ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াকফের ধারণাটি চালু হয়েছিল। যদিও এই লেখার মধ্যে মূলত ভারতবর্ষে ওয়াকফের ইতিহাসটি বলা হবে। 'মুসলিম পার্সোনাল ল' অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি যখন নগদ বা দান হিসেবে নিজের স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পদের আংশিক বা পুরো অংশটি দলিলের মাধ্যমে আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে দান করেন সেটাকেই  ওয়াকফ বলা হয়। এটা মাথায় রাখতে হবে, যারা অমুসলিম তারাও এই দান করতে পারেন। কিন্তু ওয়াকফ সম্পত্তি শুধু মুসলমানদের উন্নয়নেই কাজে লাগাতে হবে। এই দান  অপরিবর্তনীয় এবং স্থায়ী। একবার যদি কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ হিসাবে ধার্য হয় সেটা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। যিনি ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে 'ওয়াকফ' তৈরি করেন তাকে 'ওয়াকিফ' বলা হয়। যেহেতু আল্লাহ দৃশ্যমান নয়, আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে দান করা এই সম্পত্তি পরিচালনার জন্য একজনকে নিয়োগ করা হয়, যাকে বলা হয় 'মুতাওয়াল্লি'। 

আল্লাহ'র উদ্দেশ্যে দান করা সম্পত্তিগুলি কোন কোন কাজে ব্যবহার করা হবে বা কোনগুলোকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে বিবেচনা করা হবে? মসজিদ, ঈদগাহ, খানকাহ, দরগা, কবরস্থান, এতিমখানা-- এইগুলির কাজে  ওয়াকফ সম্পত্তিকে ব্যবহার করা হবে। এছাড়াও মুসলমানদের অন্যান্য উন্নয়নের বিভিন্ন কাজেও ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহার করার বিধান আছে। প্রতিটি রাজ্যে ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। এটি একটা আইনগত প্রতিষ্ঠান। ওয়াকফ সম্পত্তি অর্জন, ধারণ এবং হস্তান্তরের ক্ষমতা একমাত্র বোর্ডের হাতেই থাকে। ভারতে ওয়াকফের ইতিহাস জানতে হলে সুলতানি যুগে ফিরে যেতে হবে। সুলতান মইজুদ্দিন সাম তৎকালীন জামে মসজিদকে দুটো গ্রাম উৎসর্গ করেছিলেন। ইতিহাসের ওই ঘটনাটিকেই ওয়াকফের প্রথম ধারণা ধরে নেওয়া হয়। সুলতানি ও মুঘল যুগ ধরে যত ইসলামী রাজবংশ ভারতে বিস্তার লাভ করেছে তার সঙ্গে সমানভাবে ওয়াকফ সম্পত্তিও বেড়েছে।

এবার দেখে নেওয়া যাক স্বাধীন ভারতে ওয়াকফের ইতিহাস। স্বাধীন ভারতে প্রথম ওয়াকফের কেন্দ্রীকরণ হয় ১৯৫৪ সালের আইনে। এই আইনের ভিত্তিতেই ১৯৬৪ সালে প্রথম কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল (Central Waqf Council) নামে একটি আইনগত সংস্থা তৈরি করা হয়। এই কাউন্সিল বিভিন্ন রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ডগুলির অধীনে থেকে কাজ তদারকি করে। এরপর ১৯৯৫ সালের আইনে বিভিন্ন রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ড, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও মুতাওয়াল্লিদের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আরও বিশদে ঠিক করে দেওয়া হয়। এই আইনের দ্বারা ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতাও ঠিক করে দেওয়া হয়। ওয়াকফ বিষয়ে কোনও বিবাদ এবং গণ্ডগোল হলে এই ট্রাইব্যুনাল তার বিচার করবে। এরপর ওয়াকফ ব্যবস্থাকে আরও দৃঢ় ও সুষ্ঠু করার জন্য ২০১৩ সালে আরেকটি সংশোধনী আনা হয়। কিন্তু কখনই ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ধারণ ও পরিচালনার ব্যাপারে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি। 

বিজেপি সরকার যে বিলটি সংসদে পাস করল তাতে এই প্রথম ওয়াকফের বিষয়ে সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকছে। এই বিল অনুযায়ী ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য রাখার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওয়াকফের বিষয়ে কোনও গণ্ডগোলের মামলা হলে তার বিচার আগে ট্রাইব্যুনাল করত। কিন্তু নতুন বিলে ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের বদলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা কালেক্টরের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে, যে ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য তৈরি হয়েছিল সেখানে সরাসরি এবার সরকার হস্তক্ষেপ করবে। এটা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করছে। এই বিলে এটাও বলে দেওয়া আছে, কেউ যদি তার সম্পত্তি ওয়াকফ হিসাবে দান করতে চায় তাহলে তাকে পাঁচ বছর ইসলাম ধর্ম পালন করতে হবে। এটাও ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ধর্মীয় স্বাধীনতার যে মৌলিক অধিকার তার পরিপন্থী। ভারতীয় সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ অনুচ্ছেদে ধর্মের অধিকারের কথা বলা আছে। এখানে হিন্দু ধর্মীয় ট্রাস্ট, শিখদের গুরুদুয়ারা ও চার্চের ওপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু নতুন ওয়াকফ সংশোধনী বিল সরাসরি মুসলমানদের নিজস্ব অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ।‌ 

বিজেপি সরকারের এই ওয়াকফ বিল আনার রাজনৈতিক অভিসন্ধিটা কী? দুটি কারণে এই বিল আনা হয়েছে। একটা হল, চিরাচরিত ভাবে সমাজে হিন্দু-মুসলমান ভাগ করে নির্বাচনের ময়দান থেকে ফসল তোলা। আর তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে হিন্দু রাষ্ট্র রূপায়ণের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। দ্বিতীয় অভিসন্ধিটা হল, ওয়াকফের জমির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ধীরে ধীরে এই জমিগুলি কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়া, যে সংস্থাগুলি গত এক দশকের উপর মোদি সরকারকে ভারতের ক্ষমতায় থাকতে সহযোগিতা করেছে। বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণ ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর আরএসএস'এর তৃতীয় বড় এজেন্ডা হল ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করা। ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালুর সঙ্গে  হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের গভীর যোগ রয়েছে। অর্থাৎ, মুসলিমদের যে নিজস্ব আইন রয়েছে যেটা ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত সেটাকে তুলে দেওয়া বিজেপির অন্যতম লক্ষ্য। ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করার প্রাথমিক পদক্ষেপই হল নতুন ওয়াকফ বিল। 

ওয়াকফ বিষয়টি 'মুসলিম পার্সোনাল ল'এর সঙ্গে যুক্ত। ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ মানে 'মুসলিম পার্সোনাল ল'তেই হস্তক্ষেপ করা। এটা করা মানে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালুর দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। ইতিমধ্যেই নতুন বিলকে সাফাই দিতে বিজেপি যুক্তি দেখিয়েছে, ট্রাইব্যুনাল হল আলাদা বিচার ব্যবস্থা যা অসাংবিধানিক এবং একটা সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা তৈরি করে। ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালকে তারা খাপ পঞ্চায়েত বলেও বর্ণনা করেছে। নতুন ওয়াকফ বিল যে ইউনিফর্ম সিভিল কোডেরই প্রাথমিক পদক্ষেপ, বিজেপির এই কথা থেকে সেটা পরিষ্কার। বিজেপি'র এই বক্তব্য অত্যন্ত অযৌক্তিক এবং ভারতের সংবিধান বিরোধী। তাছাড়া ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাধারণত হাই কোর্ট বা জেলা জজ পদমর্যাদার একজন মানুষ হন। আসলে, ওয়াকফ সম্পত্তিকে বিশেষ সুবিধা হিসেবে দেখিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে একত্রিত করার কৌশলই হল এই বিলের অন্তর্নিহিত রাজনীতি। ওয়াকফ বোর্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ আসলে মুসলিম সম্প্রদায়কে 'অন্যান্য' (Other) হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটানোর প্রয়াস। আর অন্যদিকে, এর বিরোধিতা করতে গিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ যদি কোনও ভাবেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সেটা দেখিয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের মেরুকরণ ঘটাতেই বিজেপি'র সুবিধা হবে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনে মেরুকরণের রাজনীতি হবে বিজেপির হাতিয়ার। ঠিক সেই যুক্তিতে ওয়াকফ বিলকে সামনে এনে সমাজকে বিভাজনের একটা চেষ্টা  তারা করছে।

গোটা পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই সব থেকে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। সেনাবাহিনী ও ভারতীয় রেলের পরেই সব থেকে বেশি সম্পত্তি ওয়াকফের। ভারতে প্রায় ৯ লক্ষ একর জমি নিয়ন্ত্রণ করে ওয়াকফ বোর্ড  যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। বোঝাই যাচ্ছে, এই বিশাল পরিমাণ সম্পত্তির প্রতি কর্পোরেটের একটা নজর আছে। এই ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেটের স্বার্থসিদ্ধি করবে। আরও পরিষ্কার করে বললে, আদানি, আম্বানিদের হাতে এই সম্পত্তি তুলে দেওয়ার একটা কৌশলও হতে পারে এই বিল। বিজেপি সরকারের নিও-লিবারাল অর্থনীতি নির্ভর শাসনব্যবস্থা কর্পোরেট স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, যেখানে ধর্মীয় বা জনকল্যাণমূলক জমির ব্যবহারকে 'আর্থিক লাভ'এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। ফলে, ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা খর্ব করে সরকার এই জমিগুলি কর্পোরেট বা উন্নয়ন প্রকল্পে হস্তান্তরের রাস্তা তৈরি করছে বলে মনে হয়।

এই  বিলকে হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খুব সাধারণ ভাবেই দেখবে। তাদের মনে হতেই পারে, ওটা আর এমন কী? সরকার তো কতই বিল পাস করে এইরকম। ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির বানানো, ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার মতোই নতুন ওয়াকফ বিল হল বিজেপি পরিচালিত রাষ্ট্রের একটা উগ্র আধিপত্যের  প্রকাশ। ইতালীয় মার্কসীয় চিন্তক অ্যান্টোনিও গ্রামসির মতে, রাষ্ট্র শুধু বলপ্রয়োগ করে না, বরং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে নিজেদের আদর্শ চাপিয়ে দেয়। এই নতুন ওয়াকফ বিলের মাধ্যমে বিজেপি সরকার মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ করছে, যা সংখ্যাগুরুবাদী (হিন্দুত্ববাদী) সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি কৌশল। ওয়াকফ বোর্ড এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয়, সামাজিক কল্যাণ ও সংহতির বাহক। এই প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা হ্রাস করে সরকার গণতান্ত্রিক চর্চার পরিসরকেও (যেটাকে জার্মান দার্শনিক জারগন হেবারমাস  বলেছেন 'পাবলিক স্ফিয়ার') সংকুচিত করছে। ভারতবর্ষে মুসলমানরা শুধু ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু নয়, তারা আর্থ-সামাজিক ভাবেও অত্যন্ত পিছিয়ে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বলতে গেলে পুঁজিবাদ যখন স্বাভাবিকভাবে (উৎপাদনের মাধ্যমে) মুনাফা করতে ব্যর্থ হয়, তখন রাষ্ট্র ও বাজার একত্র হয়ে দরিদ্র, প্রান্তিক জনগণের সম্পদ, জমি, বসতি বা প্রাকৃতিক সম্পদ কেড়ে নেয় এবং তা পুঁজির আওতায় নিয়ে আসে। ব্রিটিশ মার্কসীয় দার্শনিক ডেভিড হার্ভের  'Accumulation by Dispossession' তত্ত্ব অনুসারে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র দুর্বল গোষ্ঠীর সম্পদ কেড়ে নিয়ে ধনীদের হাতে তুলে দেয়। বিজেপি পরিচালিত সরকার একইভাবে মুসলমানদের হাত থেকে ওয়াকফ সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে আদানি-আম্বানিদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। যে ভাবে গোটা ভারত জুড়ে দলিত, আদিবাসীদের জমি এবং জঙ্গল কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট স্বার্থে, ঠিক একই কায়দায় ওয়াকফ সম্পত্তিও মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিতে চাইছে সরকার।

বিজেপি সরকারের এই নতুন বিলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও বাম দল সহ বিরোধী দলগুলি সোচ্চার হয়েছে। এই বিলের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দিয়েছে তারা। কিন্তু বিজেপির দুই জোট শরিক নীতিশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর দল এই বিলকে সমর্থন করা নিয়ে প্রথম দিকে ধন্দে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা জোট রক্ষার স্বার্থে এই বিলে সমর্থন দিয়েছে। যদিও এটা নিয়ে নীতিশ কুমারের দলের মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। এই বিলের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই কোর্টে মামলা হয়েছে। যদিও সম্প্রতি অতীত বলে, আদালতের রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পক্ষেই গেছে। বিজেপি সরকারের আমলে আদালত সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলি কার্যত নিজেদের মতো করে তাদের কাজ পরিচালনা করতে পারছে না বলে অভিযোগ। এমতাবস্থায় আদালতের কাছ থেকে ওয়াকফ বিল নিয়ে আশাজনক রায় কতটা পাওয়া যাবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কেননা, সমস্ত গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলোর ইতিমধ্যে রাজনীতিকরণ ঘটে গেছে। এটা বুঝতে হবে, ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শুধু মুসলমানদের অধিকারের ওপর আঘাত নয়, এটি সার্বিক ভাবে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের উপর একটা বড় ধাক্কা।


Wednesday, 9 April 2025

জাল ওষুধের কারবার (২)

সরকারের সঙ্গে অশুভ আঁতাত

প্রদীপ রায়



দ্বিতীয় কিস্তি

স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনে গঠিত 'সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন' জাতীয় স্তরে ওষুধ শিল্পের নিয়ন্ত্রক। রাজ্য স্তরে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার নাম 'রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল'। উভয়ের কাজ নতুন দোকানের লাইসেন্স দেওয়া, লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করা, ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠানো যেখানে ওষুধের কার্যকারিতা ও গুণমান বিচার করা হয়। এছাড়াও, আইন মোতাবেক ওষুধের বিপণন হচ্ছে কিনা, তা দেখা। উভয়েই পরীক্ষার জন্য ওষুধ পাঠায় যথাক্রমে সেন্ট্রাল ড্রাগ ল্যাবরেটরি ও রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে। সিডিএসসিও'র পূর্বাঞ্চলের শাখা অফিস কলকাতায়, যার অধীনে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও রয়েছে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, সিকিম ও আন্দামান নিকোবর। বর্তমানে এই অফিসে চারজন পরিদর্শক রয়েছেন যাদের নজরদারির এলাকা উপরোক্ত সব রাজ্যে। আবার রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল'এর পরিদর্শকের ৫২টি পদ খালি, দীর্ঘদিন কোনও পূর্ণ সময়ের অধিকর্তা নেই। ২০১৮'র পর কোনও নতুন নিয়োগও হয়নি। উপরন্তু, পরীক্ষাগারের চেহারাটা ভয়াবহ। উন্নত প্রযুক্তির অভাবে মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি দিয়েই ওষুধের গুণমান পরীক্ষা করতে হয়। টেকনিশিয়ানের সংখ্যা মাত্র ১২। ফলে, পরীক্ষার ফল আসতে অনেক সময় লাগে। দেরিতে রিপোর্ট আসার দরুণ জাল ওষুধের কারবারীরা তথ্য লোপাটের সুযোগ পায়। জেলার প্রান্তিক এলাকায় যে ওষুধ বিক্রি হয় তার ওপর নজরদারি সম্ভবপর নয়, ফলে, জাল ওষুধের রমরমাও ওই এলাকাগুলিতে। কেন্দ্র বা রাজ্য স্তরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমূহের পরিকাঠামোর কঙ্কালসার চেহারাই জাল ওষুধ কারবারীদের ব্যবসার পুঁজি।  

ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ ও রোগীর স্বার্থের সংঘাত বহু আলোচিত একটি সমস্যা, যেখানে রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে হয় নাগরিকদের কাছে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার তাগিদে। এই সমস্যাকে মান্যতা দিতে ১৯৭০ সালে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের অধীনে চালু হয়েছিল ড্রাগ প্রাইস কন্ট্রোল অর্ডার (ডিপিসিও)। কিন্তু অস্বচ্ছতা ও দিকনির্দেশের অভাবে 'ডিপিসিও ১৯৭০' কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এরপর হাতি কমিটির সুপারিশ মাথায় রেখে 'ডিপিসিও ১৯৭৯' চালু হয়। ৩৭৪টি আকরিক ওষুধ দ্বারা নির্মিত দেশের ৯০ শতাংশ ওষুধকে মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ওষুধগুলিকে চারটি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগের ওষুধের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেওয়া হয়-- 

প্রথম ভাগ: জীবনদায়ী ওষুধ। দাম নির্ধারণ হয় উৎপাদন মূল্যের ওপর ৪০ শতাংশ মুনাফার হার যুক্ত করে; 

দ্বিতীয় ভাগ: অত্যাবশ্যক ওষুধ। দাম নির্ধারণ করা হয় উৎপাদন মূল্যের ওপর ৫৫ শতাংশ মুনাফার হার যুক্ত করে;

তৃতীয় ভাগ: স্বল্প প্রয়োজনীয় ওষুধ। দাম নির্ধারণ করা হয় উৎপাদন মূল্যের ওপর ১০০ শতাংশ মুনাফার হার যুক্ত করে;

চতুর্থ ভাগ: মূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এর জন্য নির্দিষ্ট ফর্মূলা তৈরি হয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয় আদালতে এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলির তরফে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। এমনকি জীবনদায়ী ওষুধের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলি ছিল দুর্বল ও অসংগঠিত। 

এরপর চালু হয় 'ডিপিসিও ১৯৮৭', যেখানে ৩৭৪টি আকরিক ওষুধের পরিবর্তে ১৪২টি আকরিক ওষুধকে মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ফলে, পূর্বের ৯০ শতাংশের পরিবর্তে ৭০ শতাংশ ওষুধ মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসে। চারটি বিভাগের পরিবর্তে দুটি বিভাগে ওষুধ নিয়ে এসে ওষুধের দামের মুনাফার হার স্থির হয় যথাক্রমে ৭৫ ও ১০০ শতাংশ হারে। 

বাজার অর্থনীতিকে মূলমন্ত্র করে গত শতাব্দীর নয়ের দশকে শুরু হয়েছিল আর্থিক সংস্কার। পেটেন্ট আইনের পরিবর্তন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদান, ওষুধ নীতির পরিবর্তন সবই ঘটতে থাকে বাজার অর্থনীতির চাহিদা পূরণে। এরপর তৈরি হয় 'ডিপিসিও ১৯৯৫'। এতে মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা হয় ১৪২টির পরিবর্তে ৭৪টি আকরিক ওষুধকে এবং তার দ্বারা নির্মিত ওষুধগুলিকেও। ফলে, মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত হয় দেশের ৩০ শতাংশ ওষুধ। ওষুধের বাজারে প্রতিযোগিতার দোহাই দিয়ে বেশির ভাগ ওষুধের মুল্যকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে আসা হয়। ওষুধের মূল্যের বিনিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি শুরু হল জোরকদমে। 

এরপর জারি হয় 'ডিপিসিও ২০১৩'। এই আদেশের বৈশিষ্ট্য হল, ৩৪৮টি মৌল বা আকরিক ওষুধ ও তার দ্বারা প্রস্তুত ৬৫০টি ব্র্যান্ডকে অত্যাবশ্যক জাতীয় তালিকাভুক্ত (ন্যাশনাল লিস্ট অফ এসেন্সিয়াল মেডিসিন বা এনএলইএম) করা। সিদ্ধান্ত হল, এই তালিকাভুক্ত ওষুধ ও তার নির্দিষ্ট  মাত্রার (ডোজেজ ফর্ম) ওষুধের দাম নির্ধারিত হবে এই ওষুধে যে ব্র্যান্ডগুলো ১ শতাংশ বা তার অধিক বাজার দখল করেছে তাদের সাধারণ গড় মূল্য ধরে। অপর একটি শর্তে বলা হয়, সরকারি অনুমতি ব্যতিরেকেই উৎপাদক সংস্থাগুলো পাইকারি দরের সূচককে ভিত্তি করে প্রতি বছর নিয়ন্ত্রিত ওষুধের সর্বোচ্চ দর পুনর্নির্মাণ করতে পারবে। বর্তমানে তা স্থির হয়েছে ১০ শতাংশে এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও ১.৭৪ শতাংশ। ফলে, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ নীতির ক্রমবিবর্তন শুরু হয়। উৎপাদন-ব্যয় ভিত্তিক দাম নির্ধারণের বদলে বাজারের শক্তিকে ভিত্তি করে নতুন নীতি চালু হয়। বলা হয়, বাজার সর্বশক্তিমান এবং বাজারই পারে ক্রেতা ও বিক্রেতার উভয়ের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে। নিম্নোক্ত উদাহরণে ব্যাপারটা বোঝা যাবে, যদিও তুলনাটা 'ডিপিসিও ১৯৯৫' এবং 'ডিপিসিও ২০১৩'কে ধরে। 


বর্তমানে এই ওষুধগুলোর দাম অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।

যে পণ্য নির্বাচনে ক্রেতার অধিকার সামান্যই এবং যে বাজার ক্রেতার অগম্য, তথ্যের অসমতার দরুণ সেখানে বাজারের শক্তি ক্রেতার স্বার্থ কতটা সুরক্ষিত করে তা সহজেই অনুমেয়। এতদসত্ত্বেও গত কয়েক বছরে বহু প্রচলিত ৪১টি ফর্মূলার ওষুধের দাম তিন দফায় প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ওষুধ কোম্পানির মালিকদের দাবি, আকরিক ওষুধের দাম বেড়েছে তাই ওষুধের দাম বাড়ানোয় সরকারি হস্তক্ষেপ চলবে না। অথচ, এই মালিকরাই কোম্পানির কর্মচারীদের মজুরি বৃদ্ধির প্রশমনে মহার্ঘ্য ভাতা বা উপযুক্ত বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দেন না।

বর্তমান বাজারে মোট বিক্রিত ওষুধের মূল্যের বিচারে মাত্র ১৪ শতাংশ বা আয়তনের বিচারে ২৫ শতাংশ ওষুধের দামে নিয়ন্ত্রণ কার্যকরী। অর্থাৎ, চালু ওষুধের এক বিশাল অংশই বিনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা জোগানের উৎস হিসাবে বিদ্যমান। এর সঙ্গে ১৮-২৮ শতাংশ জিএসটি ওষুধ বিশেষের ওপর যুক্ত হওয়ায় ওষুধ আরও মহার্ঘ্য হয়েছে। 

এমন একটা শক্তিশালী শিল্পকে ঘিরে চলেছে বিস্তর অনৈতিক কর্মকাণ্ড। একদিকে শিল্প মালিকদের সঙ্গে সরকারের অশুভ আঁতাত, যা নগ্ন হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত নির্বাচনী ফান্ডে শাসক দলকে দেওয়া অঢেল টাকার বন্ড কেনায়। প্রতিদানে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য নিয়ন্ত্রণের বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে। অপরদিকে নজরদারির অভাবে এই শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক বিশাল ব্যবসার কারবার। জাল বা নকল অথবা নিম্নমানের ওষুধ চিহ্নিত করা চিকিৎসক বা ক্রেতা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়, যতক্ষণ না কোনও তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। 

সরকারের দ্বারা ওষুধ নামক পণ্যটিকে যদি অন্যান্য পণ্যের চাইতে আলাদা ভাবে দেখার প্রয়োজনীয়তা না অনুভূত হয়, তবে এই দুষ্টচক্র চলতেই থাকবে, যার মূল্য জীবনের বিনিময়ে নাগরিককে দিতে হবে।

শেষ...

প্রথম কিস্তির লিঙ্কhttps://www.ekakmatra.in/ekak-matra-spurious-drug-1/


Tuesday, 8 April 2025

জাল ওষুধের কারবার (১)

কীভাবে তৈরি হয় জাল ওষুধ

প্রদীপ রায়



প্রথম কিস্তি

কথায় আছে, ব্যয় করে আরাম/ তারই নাম ব্যারাম। বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবা কিনতে গিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি হচ্ছে। ২০২১-২২ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রকের দেওয়া হিসেবে, জনপ্রতি চিকিৎসা খরচের ৩৯.৪ শতাংশ খরচ হয় রোগীর পকেট থেকে এবং পশ্চিমবঙ্গবাসীর ক্ষেত্রে এই খরচ ৫৮.৩ শতাংশ। এই খরচের সিংহভাগই ওষুধ ক্রয়ের জন্য। একটি সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওষুধ ক্রয়ের দরুণ হাসপাতালে ভর্তি থাকলে ২৯.১ শতাংশ ও বহির্বিভাগে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৬০.২ শতাংশ খরচ হয়। কারণ, উচ্চহারে ওষুধের দাম। 

স্বাধীনতার সময় দেশের ওষুধের ব্যবসা ছিল ১০ কোটি টাকা। বর্তমানে সেই ব্যবসার পরিমাণ ৫ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাজারের ব্যবসার পরিমাণ আড়াই লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল ব্যবসা গড়ে উঠেছে প্রায় ১০,৫০০টি উৎপাদক ও প্রায় ৩০০০ ওষুধ ব্যবসায়ীর হাত ধরে। বিগত শতকের শেষ দিকে সরকারি নীতিকে আশ্রয় করে হিমাচল প্রদেশে ৫৫৫টি ও উত্তরাখণ্ডে ২২০টি ওষুধ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে ওঠার কারণ, ওই এলাকায় দেওয়া শুল্ক, বিদ্যুৎ, জল ও জমির ওপর বিশাল ছাড়। স্বাধীনতাত্তোরকালে কেমিক্যাল শিল্পের হাত ধরে ঐতিহ্যগত ভাবে ওষুধ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছিল গুজরাত (৩৩৩২), মহারাষ্ট্র (৭২৯) ইত্যাদি রাজ্যে, পরিণামে এই শিল্পের পরিকাঠামো উন্নত হয়েছে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে। শুল্কগত ভাবে ও অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তির দিক থেকে এই পরিকাঠামোর সঙ্গে বিস্তর ফারাক রয়েছে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলিতে। দেশের প্রথম সারির কোম্পানিগুলোর অনেক ওষুধ আজ তৈরি হয় তৃতীয় পক্ষের উৎপাদন কেন্দ্র থেকে। এই উৎপাদন কেন্দ্রগুলো রয়েছে বাড্ডি, সোলান (হিমাচল প্রদেশ), হরিদ্বার, দেরাদুন, উত্তরাখণ্ড ইত্যাদি জায়গায়। নয়া উদার অর্থনীতি চালু হওয়ার আগে কোম্পানিগুলোর নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র থেকে যে ওষুধ তৈরি হত তার নজরদারি ছিল কোম্পানির হাতে। বর্তমানে সেই নজরদারি তৃতীয় পক্ষের হাতে চলে যাওয়ায় দুটি সমস্যা তৈরি হয়েছে-- 

১) অনেক ওষুধের গুণমানে আপস করা হচ্ছে; 

২) বৃহৎ কোম্পানির দেওয়া নিজস্ব ওষুধ তৈরির কৌশল ও প্রযুক্তি বাইরে পাচার হচ্ছে, যার বেশিরভাগ করায়ত্ত করছে জাল ওষুধ কারবারীর দল। 

বিশ্বের ২০ শতাংশ জেনেরিক ওষুধের বাজার ভারতের দখলে এবং এর সিংহভাগ রফতানি হয় আমেরিকা সহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে। শুধুমাত্র আমেরিকার ৬০ শতাংশ জেনেরিক ওষুধের প্রস্তুতকারক ভারতীয় সংস্থা। এই ওষুধ উৎপাদিত হয় দেশের প্রথম সারির কোম্পানিগুলোর নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্রে। উৎপাদনে নজরদারির জন্য আমেরিকার ওষুধ নিয়ামক সংস্থা এফডিএ রাজধানী দিল্লিতে স্থায়ী অফিস তৈরি করেছে, যেখানে অনধিক ৭০ জন পরিদর্শক কর্মরত। লাইসেন্স প্রাপ্ত উৎপাদন কেন্দ্রে প্রতিটি ওষুধ এফডিএ প্রদত্ত পদ্ধতি মেনে উৎপাদন করতে হয়। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে সেই ব্যাচের সমস্ত ওষুধ বাতিল বলে গণ্য হয়। খবরের কাগজে প্রায়শই নামজাদা কোম্পানির তৈরি জেনেরিক ওষুধ আমেরিকার বাজার থেকে ফেরত আসার খবর পরিবেশিত হয়। মজার কথা এই, নামজাদা ভারতীয় ওষুধ কোম্পনিগুলো দেশের অভ্যন্তরে যে ওষুধ বিপণন করে তার ক্ষেত্রে নজরদারি অনেকটাই শিথিল। অর্থাৎ, উন্নত দেশের মানুষের জন্য তৈরি ওষুধের গুণমান যতটা উচ্চস্তরের, নিজের দেশের রোগীর জন্য সেই গুণমান ততটাই নিম্নস্তরের। 

এখন দেশীয় ওষুধ বাজারে জাল ওষুধ ধরা পড়ায় পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। সংসদে সমস্যাটি উত্থাপিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ শঙ্কিত। অথচ, সমস্যাটি একাধারে বৈশ্বিক ও প্রাচীন। সমস্যার ব্যাপ্তি অনুধাবন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৩ সালে তৈরি করে গ্লোবাল সারভাইলেন্স অ্যান্ড মনিটারিং সিস্টেম। ওষুধের বাজার সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাল বা নকল ওষুধের ব্যবসা বেড়েছে দুনিয়া জুড়ে। তবে উন্নত দেশগুলোতে যেখানে নজরদারি অত্যন্ত কঠোর, সেখানে নকল বা জাল ওষুধের উপস্থিতি কম। আমাদের দেশে এই জাল ওষুধের বাজারের যথাযথ পরিমাণ কত, সে বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য নেই। ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকদের মতে, এই বাজার ২০-২২ শতাংশ। আবার ফার্মা এক্সপার্ট কাউন্সিলের উপদেষ্টার মতে, এই জাল ওষুধের পরিমাণ ১০-১২ শতাংশ। ২০১১-১২ সালে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ামক সংস্থা ৪৮,০৮২টি ওষুধের স্যাম্পল পরীক্ষার হিসেব সংসদে পেশ করে জানিয়েছিল যে এর মধ্যে ২১৮৬টি ওষুধ অর্থাৎ ৪.৫ শতাংশ জাল বলে চিহ্নিত করা গেছে। তথ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক জানায়, ২০০৯-১০ সালে ৪.৯ শতাংশ, ২০১০-১১ সালে ৪.৭ শতাংশ ওষুধ নির্ধারিত মানে পৌঁছতে পারেনি এবং ৬ শতাংশ আক্ষরিক অর্থে জাল ওষুধ। 

Spurious ড্রাগের রকমফের আছে। যেমন, জাল-নকল বা নিম্নমানের ওষুধ। নিম্নমানের ওষুধে সক্রিয় উপাদানের পরিমাণ যা দাবি করা হয় তার চাইতেও কম থাকতে পারে অথবা ওষুধের অন্যান্য গুণমান যথা দেহের অভ্যন্তরে প্রবশের পর সক্রিয় উপাদানে নির্দিষ্ট সময়ে কার্যকরী না হওয়া অথবা সহযোগী উপাদানের গুণমান ঠিক না থাকা। এছাড়া সিরাপ বা শরীরে দেওয়া ফ্লুইডের মধ্যে অপ্রত্যাশিত অবাঞ্ছিত পদার্থ থাকা। সম্প্রতি দেশে তৈরি রফতানি যোগ্য কাশির সিরাপে বেশি মাত্রায় সহযোগী উপাদান ডাই ইথিলিন গ্লাইকল বা ইথিলিনের মাত্রা বেশি থাকায় ওই ওষুধ ব্যবহারে গাম্বিয়া, উজবেকিস্তানে ব্যাপক শিশু মৃত্যু ঘটেছে।

 নকল ওষুধ সাধারণত নামজাদা কোম্পানির সব চাইতে চালু ব্র্যান্ডের নামে তৈরি করা হয়, যাতে ওষুধের সক্রিয় উপাদান থাকে না অথবা থাকলেও কম থাকে। এর দরুণ ওষুধ কার্যকরী হয় না। অ্যাসিড কমানোর ওষুধ প্যান্টেপ্রাজল'এর আমাদের দেশের বাজারে বিক্রির পরিমাণ ৬৯২৩ কোটি টাকা। রক্তচাপ কমানোর ওষুধ টেলমেসার্টন'এর বিক্রির পরিমাণ ৩৫০০ কোটি টাকা। ফলে, এই ধরনের বিশাল বিক্রির ওষুধের অবিকল নকল ওষুধ তৈরি হতে পারে অথবা বানানোর সামান্য তারতম্য করে (যা রোগীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়) ওষুধের মোড়কের চেহারার প্রভেদ ঘটিয়ে বাজারে ছাড়া হয়। এই ওষুধের উৎপাদনের উৎস, তৈরি করার লাইসেন্স বা কোম্পানির অস্তিত্ব সর্বদা ভুয়ো প্রমাণিত হয়। এই নকলের ক্ষেত্রে QR কোড পর্যন্ত নকল হচ্ছে। যদিও বারকোডের ক্ষেত্রে এখনও তা করা সম্ভব হয়নি। নকল ওষুধের বৃহৎ বাজার গ্রামগঞ্জে, যেখানে নজরদারি কম। 

জাল ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়: 

১) ওষুধের মধ্যে সক্রিয় উপাদানের বদলে নিষ্ক্রিয় পদার্থ যথা স্টার্চ, ক্যালসিয়াম ল্যাক্টেট বা কার্বনেট থাকতে পারে; 

২) মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধের তারিখ পালটে তাকে পুনরায় বাজারজাত করা হয়। এই ধরনের ওষুধ সংগ্রহের ক্ষেত্রটি বেশ জটিল ও অভিনব। খুচরো দোকান বা পাইকারি ওষুধ ব্যবসায়ীর কাছে অবিক্রিত মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া ওষুধ ফেরত নেওয়ার জন্য সেই কোম্পানির নির্দিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কাছে জমা দেওয়ার কথা। এই পথচক্রের মধ্যেই তা হাতবদল হয়ে পৌঁছে যায় জাল ওষুধ কারবারীদের হাতে; 

৩) উৎপন্ন ওষুধের মধ্যে ক্ষতিকারক, অর্থাৎ, ভেজাল পদার্থ (Adulterated) মেশানো হয়, যা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে যে যে পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যিক সেখানেই ঘাটতি থাকে। বিভিন্ন ধরনের ফ্লুইড যা রক্তে সরাসরি দেওয়া হয়, তাতে ছত্রাক বা অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি প্রায়ই খবর হয়। হার্বাল ওষুধের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও উদ্বেগজনক। 

জাল ওষুধের কারবার দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ওষুধের ব্যবসা যতটা প্রসারিত হচ্ছে, ততটাই বাড়ছে জাল ওষুধের রমরমা। ওষুধের ভেজাল রুখতে, গুণমান বজায় রাখতে, উৎপাদনের শর্ত মানা ও সমস্ত দেশে নজরদারির জন্য স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। এদের কাজ উৎপাদিত ওষুধের গুণমান ও শুদ্ধতা বিচার করা এবং নকল বা জাল অথবা নিম্নমানের ওষুধ ধরা পড়লে আইন মোতাবেক শাস্তি দেওয়া। 'ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস'এর নামে ওষুধ উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরগুলোর অল্পস্বল্প বিচ্যুতি ঘটলে তার দরুণ শাস্তি কেবলমাত্র জরিমানা। ফলে, ওষুধ কোম্পানিগুলো এই  সুযোগ নিয়ে উৎপাদন খরচ কমায় গুণমানের সঙ্গে আপস করে।

ক্রমশ...

দ্বিতীয় কিস্তির লিঙ্ক: https://www.ekakmatra.in/ekak-matra-spurious-drug-2/




Friday, 4 April 2025

আগুন দিলি পরের ঘরে

'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে...'

মালবিকা মিত্র



প্রাথমিক স্তরে অঙ্কের প্রশ্ন করেছি, একটি ঝুড়িতে ৫০০টি আম ছিল, তার মধ্যে ২০টি আম পচা। তাহলে ঝুড়িতে ভালো আম কটা রইল? সহজ গণিতের বুদ্ধিতে এর উত্তর মিলবে না। যদি ফলওয়ালার হিসেবে ধরেন, সে হিসেবও মিলবে না। বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, ঝুড়িতে চার-পাঁচটি পচা আম থাকলে ঝুড়ি সমেত আম ফেলে দিতে হয়। অঙ্ক বা ব্যবসার বুদ্ধিতে এর থই পাওয়া যায় না। অবশ্য, কিছু পচা আমের সঙ্গে থাকা বাকী সকল ভালো আম ফেলে দেওয়া আর কিছু পচা মানুষের সঙ্গে একই গণ্ডির ভিতরে থাকা বাকী সব ভালো মানুষদের ভাতে মারা তুল্যমূল্য কিনা সে প্রশ্ন তিনি তোলেননি। কারণ, জনগণ তো বিকাশবাবুদের গোটা ঝুড়িটাকেই ফেলে দিয়েছে। 

ঝুড়িতে যে পচা আম ছিল সেটা বোঝা গেছে। নিয়োগ দুর্নীতি হয়েছে এটা প্রমাণিত। তার জন্য এসএসসি ও রাজ্য সরকার দায় এড়াতে পারে না। সেও মান্য। ফলে, তাদের মন্ত্রী ও কর্তাব্যক্তিরা গ্রেফতারও হয়েছেন। অনেককে সিবিআই হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। আবার অনেককেই জামিনে মুক্ত রাখা হয়েছে। মামলা এখনও বিচারাধীন। কিন্তু দুর্নীতি প্রক্রিয়ার সর্বনিম্ন স্তরে এক ধাক্কায় ২৫,৭৫২ জনের নিয়োগ বাতিল করে দেওয়া হল যাদের অধিকাংশের সঙ্গেই দুর্নীতির কোনও নামগন্ধই ছিল না। বিচার হবে, কারা দোষী তা চিহ্নিত হবে, তাদের শাস্তি হবে-- এগুলোই তো আশা করেছিলাম। না সে সব কিছুই হয়নি। ঝুড়ির কিছু পচা আমের সঙ্গে বাকী সব ভালো আমকে বিসর্জন দেওয়ার মতোই ২০১৬ সালের সমগ্র শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগকেই বাতিল করা হল। অথচ কোর্ট বলল, যোগ্য প্রার্থীদের মাইনে ফেরত দিতে হবে না এবং তিন মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাঁরা আবেদন করতে পারবেন। অর্থাৎ, যোগ্য কারা কোর্ট জানে; এবং জানে বলেই তাঁদের আরেক দফা সুযোগও দিল চাকরি ফেরত পেতে। এ তো হাত ঘুরিয়ে নাক দেখানো! এই অযাচিত কসরত কেন? 

অতএব, আমজনতার মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠল:

১) ২০২৪'এর নীট পরীক্ষায় হরিয়ানা, গুজরাত, বিহার ইত্যাদি রাজ্যের বহু কেন্দ্রে শোনা গেল প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এ সম্পর্কিত রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দফতরের জানা ছিল। এমনকি পরীক্ষা পরিচালকমণ্ডলী (এনটিএ) সে কথা কবুল করেছে। তথাপি, সুপ্রিম কোর্ট পরীক্ষা বাতিল করেনি বা কাউন্সেলিং বন্ধ রাখেনি। যুক্তি ছিল, কিছু অনিয়মের জন্য এত বিপুল সংখ্যক ছাত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করা যায় না। সাধু সাধু! কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ। কিন্তু, ২৫,৭৫২ জনের চাকরি বাতিল করবার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, গোটা প্রক্রিয়া বাতিলের মাপকাঠি হল sanctity of the process যদি প্রশ্নের মুখে পড়ে এবং কোর্ট মনে করেছে এ ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে। নীট ২০২৪'এর ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্ট মনে করেছিল যে sanctity of the process লঙ্ঘিত হয়েছে। দুটি মামলার ক্ষেত্রে কোর্টের মনে হওয়াটা একই। কিন্তু রায় পৃথক হল কেন? 

২) মহারাষ্ট্রে গত বিধানসভা নির্বাচনে ভোট শেষ হবার পর, এমনকি প্রদত্ত ভোটের শতকরা হার ঘোষণা হবার পরও দেখা গেল, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত হিসেবে ভোটের হার ৩ থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছিল দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের পরেও। লোকসভা নির্বাচনের পরেও একই ঘটনা ঘটেছিল। এ নিয়ে বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য ছিল, এই সুবিপুল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এটুকু সামান্য হিসেবের হেরফের বা ভ্রান্তি হতেই পারে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিব্রত করা উচিত হবে না; 

৩) আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার নির্যাস হিসেবে এমনটা বলা হয়ে থাকে যে, দশজন দোষী ব্যক্তি যদি ছাড়াও পেয়ে যায়, একজনও নিরপরাধ ব্যক্তি যেন কখনই সাজা না পায়। অথচ, ঝুড়িতে কিছু পচা আম পাওয়া গেছে এই অজুহাতে সেই মৌলিক নীতিকে অস্বীকার করেই ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল করা হয়েছে। কেন? 

৪) ২০১৭ সালে 'অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম' (এডিআর)'এর পক্ষ থেকে ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলার শুনানি তখন স্থগিত রাখে। বলা হয়, আপাতত এটা চলতে থাকুক, পরে ভাবা যাবে। অতঃপর ২০১৯ সালে লোকসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট শুনানি শুরু করে, তারপর ঘোষণা করে ইলেক্টোরাল বন্ড অসাংবিধানিক। অথচ, এই অসাংবিধানিক বন্ড নিয়েই ২০১৯'এ বিজেপি ৩০৩টি আসন জিতে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেই অসাংবিধানিক সরকারটিকে কোনওভাবে শাস্তি দিতে পেরেছিল কী?

৫) একটি প্যানেল তৈরিতে বেশ বড়সড় আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এসএসসি'র কাছে পুরনো ওএমআর শিট না পাওয়া গেলেও নয়ডায় জনৈক বনশলের বাড়ি থেকে সিবিআই যে হার্ড ডিস্ক উদ্ধার করেছিল সেখানে ওএমআর শিটের মিরর কপি পাওয়া যায় এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় তা যথাযথ বলে কোর্টে জমাও করে। সেখানে দেখা যায়, ফাঁকা বা অসম্পূর্ণ ওএমআর শিট জমা পড়েছে, প্রার্থীর নামও আছে, ফলে কারা অভিযুক্ত তাও বোঝা যাচ্ছে। অতএব, অভিযুক্ত ৮ কি ৬ হাজারকে বাদ দিয়ে এই প্যানেলকে ত্রুটিমুক্ত করে বাকীদের নিয়োগের যাথার্থ্য দেখানোই যেত। এটাই তো তদন্তকারী সংস্থার কাজ ও বিচার-প্রত্যাশা। তার ওপর সেই প্যানেলের নিয়োগ কবেই হয়ে গেছে, তাঁরা ছ' বছরের বেশি চাকরিও করেছেন, এই সময়টায় এসে আম সুদ্ধু ঝুড়ি ফেলে দিয়ে কার বা কাদের সুবিধা করা হল? এই চাকুরিরতা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা পাঠদান, মূল্যায়ন, গৃহঋণ, চিকিৎসা ঋণ, বিবাহ, সন্তান, অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা জীবন পার করে ফেলেছেন। এ কেমন ন্যায় যা নির্দোষের বাঁচার অধিকারকে হরণ করে? 

৬) অতীতে সংঘটিত কোনও অন্যায় নিয়ে তদন্ত হতেই পারে। সেই তদন্তে যুক্ত অপরাধীর শাস্তিও হতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমন বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে যায় যেগুলোকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। অবশ্য যে বিচারে দ্বাদশ শতকের 'মন্দির' ফিরিয়ে আনা যায়, সেখানে সবই সম্ভব। যে ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হল, তাঁদের সাহচর্যে যে কয়েক লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী এই ছয় সাড়ে ছয় বছরে পাঠ লাভ করল, সহযোগিতা পেল, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত হল, তার কী হবে? যদি গোড়ায় গলদ হয়, নিয়োগটিই অবৈধ হয়, তাহলে এদের দ্বারা যে মূল্যায়ন ও পাঠদান সম্পন্ন হয়েছে তা কী করে বৈধ হয়? সেগুলোকে কি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব? বিগত ছয় বছরের প্রদত্ত শ্রমের সবটাই বেগার? বেগার শ্রম তো আইনত অপরাধ। এই শিক্ষকরা অনেকেই চলতি বছরে সদ্য সমাপ্ত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরীক্ষক। তাহলে এ বছর পরীক্ষার মূল্যায়ন সম্পন্ন হবে কীভাবে? যে সমস্ত স্কুলে পাঁচজন, ছয়জন, ন'জন করে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বাতিল হল, সেই স্কুলগুলির পঠন-পাঠনের কী হবে? আসলে, আড়ালে থেকে কেউ কি একটা সামগ্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইল? 

৭) আচ্ছা, এই যে দুর্নীতি ধরার সংস্থা সিবিআই/ ইডি/ আয়কর ইত্যাদি, এরা ছাড়াও এক নতুন সংস্থার কথা জানলাম; বিচারপতিদের বাড়িতে আগুন লাগলে দমকল বাহিনী আগুন নেভাতে গিয়ে উদ্ধার করে আনে আগুনে আধ পোড়া কোটি কোটি টাকা। এখন ওই বিচারপতির কী হবে? কোনও শাস্তি হবে? যদি শাস্তি হয় তাহলে প্রশ্ন উঠবে, নিশ্চয়ই কোনও বিচারের রায়দান কেনাবেচার ফলেই এই উপার্জন, তাই না? সেই সমস্ত রায়গুলোকে কি পুনরায় বিচার করা হবে? যদি কোনও মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়ে থাকে তাহলে কী হবে? ন্যায়বিচার কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

৮) যে বিচারপতি কালো গাউন গায়ে চাপিয়ে নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় রায় দিলেন, ক্যালেন্ডার'এর পাতা ওলটানোর আগেই গেরুয়া আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হয়ে সাংসদ হয়ে গেলেন। এক্কেবারে ব্রেখটের নাটকের দৃশ্য। জমিদার পুলিশের ডায়ালগ বলছে, আর পুলিশ জমিদারের ডায়লগ বলছে। এই বিচারপতির দেওয়া সমস্ত রায়কে নিরপেক্ষ বলা যায় কী? তাহলে কি সেগুলোর পুনরায় বিচার হবে? 

৯) বামফ্রন্ট সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল বলাই রায় Judicial excess বা Judicial overreach সংক্রান্ত আলোচনায় হুগলি মহসিন কলেজে এক সেমিনারে বলেছিলেন, মাঝেমধ্যেই বিচারকরা কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো রায় দান করে থাকেন। হাওড়ার রেল স্টেশন গঙ্গা দূষণের একটি প্রধান উৎস। হাওড়ার জনস্বাস্থ্যের ওপর হাওড়া স্টেশনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এসবই সত্য হতে পারে। প্রত্যহ কোটি কোটি মানুষের মলমূত্র বর্জ্য খাবার-দাবারের প্যাকেট পাতা ঠোঙা ইত্যাদি সেখানে জমা হয়। কিন্তু তাই বলে বিচার বিভাগ বলতে পারে না হাওড়া স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হোক। অবশ্য, ইদানীং বিচারপতিদের এই ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। হয়তো কোনদিন তারা গঙ্গা দূষণ ও জনস্বাস্থ্যের কারণে হাওড়া স্টেশন বন্ধ করতে বলবেন। বিচারপতি সহজেই বলে দিতে পারেন, রামনবমীর মিছিলের অনুমতি দেওয়া হল। তবে, এক হাজারের বেশি মানুষ থাকবে না, অস্ত্রশস্ত্র বহন করা যাবে না, এ কথাও বলে দেন। কারণ, জমায়েতের নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সংখ্যা হাজার ছাড়াল কিনা, অস্ত্র বহন করা হল কিনা, উত্তেজনা ছড়াল কিনা, এগুলো তো দেখার দায়িত্ব বিচারপতির নয়। এই দায়িত্বহীন ক্ষমতা কি এক বিপজ্জনক দিক নয়? 

আমাদের নজর থাকবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে। আগ্রহ থাকবে ৭ এপ্রিল নেতাজি ইন্ডোরে চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের জমায়েত ও সিদ্ধান্তে। নজর থাকবে সরকারের পদক্ষেপেও। আইনি কোনও সুযোগ আর আছে কিনা সে কৌতূহলও থাকবে। একজন সহ-নাগরিক হিসেবে এতগুলি পরিবারের অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আশঙ্কিত। স্পষ্টতই এ রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দল সমূহ আহ্লাদিত; তারা ভাবছে কিছু মানুষের চাকরি গেলে যেটুকু ক্ষোভ অসন্তোষ হত, সমগ্র প্যানেল বাতিল হওয়ার ফলে অসন্তোষের আকার অনেক বাড়বে। কম্বলটা যত ভিজবে ততই ভারী হবে। সমাজ মাধ্যমে অসংখ্য পোস্ট দেখতে পাচ্ছি। আন্তরিকভাবে এতগুলি পরিবারের ভয়ঙ্কর দুরবস্থার কথা কেউ বলছেন না। খুব স্বাভাবিক, সরকার কোনও ভুল করলে, তদুপরি সেই ভুলের কারণে বিচার ব্যবস্থা বিরূপ হলে, বিরোধীরা ঝড় তুলবেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ক্ষমতালাভের তড়িঘড়ি বাসনায় অসহায় মানুষের লাশের ওপর দিয়ে সে ফায়দা তুলতে হবে, অথবা, গুজবের মধুভাণ্ড নিয়ে মাঠে নামতে হবে। প্রতিটি ঝড়েই 'অতি ভোরে উঠে তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম'। কিন্তু শেষাবধি ঝুলি ফাঁকাই থেকে যায়, বেলা ফন্ট'এর সেই গানই সত্য হয়, 'There is a hole in the bucket.'। 

চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা কী ভাবছেন বা কোন পথে নিজেদের জীবন-জীবিকার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, সহমর্মিতার দৃষ্টি নিয়ে সেদিক পানেই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম। 


Thursday, 3 April 2025

'পরিপূরক শুল্কের' গুঁতোয়

ভারত কি শুধু দেখবে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল ২০২৫’কে ‘মুক্তির দিন’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। অস্যার্থ, ওইদিন তিনি মার্কিন জনগণকে বিশ্বের অর্থনৈতিক জাঁতাকল থেকে মুক্তি দেবেন। ‘আমেরিকাকে আবার সেরা বানানো’র অভিলাষে তিনি ওইদিন নিজ দেশে বিদেশি আমদানির ওপর এমন শুল্ক চাপাবেন যে বাকী দেশ সব হাহাকার রবে পিষ্ট হবে এবং ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলে তাঁর চরণতলে আছাড়িবিছাড়ি খাবে! বিশেষ করে চীন, কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ভারতকে (প্রিয় বন্ধুবর মোদীজীর কথা ভুলে মেরে) এমন শিক্ষা দেবেন যে এরপর আর আমেরিকাকে তার চলার পথে কেউ রুখতে পারবে না।

ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প যে ভাবে গ্রিনল্যান্ড ও কানাডা’কে নিজের দেশে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের তামাম আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে প্যারিস চুক্তি থেকে সটান পিঠটান দিয়েছিলেন, ধরে ধরে ‘বেআইনি’ অভিবাসীদের প্লেনে তুলে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছিলেন (ভারতীয়দের হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে), সরকারি কর্মচারীদের লাটে ছাঁটাই করছিলেন, এমনকী বিচারকদের ‘মার্কিনী স্বার্থ’ বিষয়ে সবক শেখাচ্ছিলেন, এলন মাস্কের বাচ্চা ছেলে নাক খুঁটে তাঁর টেবিলে হাত রাখলে সেই ১৫০ বছরের পুরনো রাষ্ট্রপতির টেবিলটাকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন, সর্বত্র প্রত্যাখ্যাত এলন মাস্ক’এর টেসলা গাড়ি এক পিস কিনে বন্ধুকৃত্য অবধি করেছিলেন, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে এমন এক ‘ম্যানিয়াক’ লোককে আমেরিকার মানুষজন এমনি এমনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করেননি (অনেকটা ঠিক হিটলারের নির্বাচনের মতো)। আমেরিকার অর্থনীতি যে ধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, ভেতরটা একেবারে ছিবড়ে, দেশে হু হু করে বাড়ছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, বিশ্ব জুড়ে জোগান-শৃঙ্খলে আমেরিকান ব্র্যান্ড বলে আর কিছুই নাই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নবরঙে আমেরিকা ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে, তখন খুব স্বাভাবিক যে অতি-জাতীয়তার শীৎকারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়া ছাড়া তাদের আর তেমন কিছু করারও ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই একই ঘটনা জার্মানিতেও ঘটেছিল ‘ভার্সাই চুক্তি’ পরবর্তী হিটলারের অভ্যুদয়ে। বাকীটা ইতিহাস। তবে, ইতিহাসের নাকি পুনরাবৃত্তি হয় না বলে বলা হয়ে থাকে, তথাপি যদি হয়, তাহলে তা কেমনতর সে বিষয়েও মহাজনেদের মতামত সুবিদিত।

তবুও, ২ এপ্রিল ট্রাম্প সাহেব সত্যি সত্যিই ‘reciprocal tariff’ বা ‘পরিপূরক শুল্ক’ সম্পর্কে বেশ এক বড় ঘোষণা দিলেন! হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে সাংবাদিকদের সামনে হাতে একটি বোর্ড তুলে ধরে সেখান থেকে পড়ে পড়ে তিনি কয়েকটি দেশের নাম করে তাদের ওপর চাপানো শুল্কের হার বেশ সদর্পে ঘোষণা করলেন। যেমন, প্রথমেই বললেন চীনের নাম এবং তাদের ওপর শুল্ক চাপানোর হার ৩৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি শুল্ক চাপানো হল কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের ওপর যথাক্রমে ৪৯, ৪৬ ও ৩৬ শতাংশ হারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইংল্যান্ড’ও বাদ যায়নি, তাদের ওপর চাপানো হার যথাক্রমে ২০ ও ১০ শতাংশ। আর ভারত? ভারতের ওপর মোদীজীর অতি প্রিয় বন্ধু ট্রাম্পের শুল্ক হার চাপলো ২৬ শতাংশ। এবং এই প্রতিটি শুল্কই নাকি ‘ডিসকাউন্ট’এ দেওয়া, আসল হার আরও বেশি (উনি সে সব কমিয়ে দিয়েছেন)। ভারতের কথা বলতে গিয়ে তিনি অবলীলায় বললেন, ‘very tough, very tough’। অর্থাৎ, তিনি বোঝালেন যে, তাদের দেশের পণ্য যদি অন্য দেশে উচ্চ শুল্ক হারের কোপে পড়ে দুর্মূল্য হয়, তাহলে তিনিও সে দেশের পণ্যকে উচ্চ শুল্ক হারের গুঁতো দিয়েই সবক শেখাবেন। একদা মুক্ত বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের ধ্বজা ওড়ানো দেশ আমেরিকা কি সত্যিই কোনও বিপদে পড়ল যে উলটো পথে হেঁটে এখন দুয়ার আঁটা ছাড়া তার সামনে আর কোনও উপায় নেই?

বলাই বাহুল্য, এই নতুন ‘পরিপূরক শুল্ক’র দাপটে প্রায় প্রতিটি দেশই যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি রাজনৈতিক ভাবে ট্রাম্পের অত্যন্ত কাছের জন, ইতালির চরম দক্ষিণপন্থী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শুল্ক হারের কড়া ভাষায় নিন্দা করেছেন। চীনের বিদেশ মন্ত্রক তো তীব্র ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে যে, মার্কিন দেশের এই শুল্ক নীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রীতিকে লঙ্ঘন করছে এবং চীন নিজেদের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় এর বিরুদ্ধে পালটা ব্যবস্থা নিয়ে শেষ পর্যন্ত এই বাণিজ্য যুদ্ধে লড়ে যাবে। পাশাপাশি, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে জাপান, ইউকে থেকে অস্ট্রেলিয়া— প্রায় প্রত্যেকটি দেশই এই নীতির নিন্দা করেছে। অথচ, একমাত্র ভারতই এখনও পর্যন্ত গলা তুলে তেমন উচ্চবাচ্য কিছু বলেনি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরী আমতা আমতা করে জানিয়েছেন যে বিষয়টি ভেবে দেখার মতো(!)। অবশ্য, এর প্রকোপে ভারতীয় শেয়ার বাজার আজ (৩ এপ্রিল ২০২৫) দিনের শুরুতেই ভালই গোত্তা খেয়েছে এবং দিনের শেষে এসে সেনসেক্স’এর পতন ৩২২ পয়েন্ট। বোঝাই যাচ্ছে, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক হার ভারতীয় শিল্পের এক বড় অংশকে বেশ বিপদে ফেলে দিয়েছে। ভারত এখন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এলন মাস্ক’এর টেসলা গাড়ির ওপর ১১০ শতাংশের শুল্ক প্রত্যাহার করে তুষ্টিকরণের রাজনীতি করবে, নাকি, অন্যান্য দেশগুলির মতো চোখে চোখ রেখে আমেরিকার রক্ষণশীল অর্থনীতির সমালোচনা করার হিম্মত দেখাবে, তা ‘ডোলান’ ট্রাম্পের বিশ্বস্ত বন্ধু মোদীজীই জানেন।

তবে এ কথা অনস্বীকার্য, ট্রাম্পের নয়া শুল্ক নীতি বিশ্বের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলে এক আমূল পরিবর্তন আনবে এবং আমেরিকার পক্ষে তা অশনি সংকেত। আজ কোনও পণ্যের ওপরেই কোনও দেশের একচেটিয়া অধিকার আর মান্যতা পায় না, কারণ, বিশ্বায়নের ফলে যে অর্থনৈতিক জোগান-শৃঙ্খল তৈরি হয়েছে, সেখানে একেকটি দেশে একেকরকম পণ্যাংশ নির্মিত হয়ে আরেক দেশে গিয়ে assembled হয়। ফলে, কোনও পণ্যেরই আজ সে অর্থে নিজ দেশ নেই, কোনও পণ্যকেই বলা যাবে না যে তা অমুক দেশের। নিজে একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে ট্রাম্প কি আজকের অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের এই খবরটুকু রাখেন না? তা বিশ্বাস করা কঠিন। আসলে, বিশ্ব বাজারে আমেরিকা আজ ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তাঁর নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ সঙ্গীন। প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সঙ্গী করে অর্থনৈতিক বিজয় রথে চীন আজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। পাশাপাশি, আজকের বিশ্ব বাজারেও চীন নানান উপায়ে নিজেদের উপস্থিতিকে আরও গ্রহণীয়, লাভজনক ও সর্বজনীন করে তুলেছে। ইতিমধ্যেই ভিয়েতনাম ও চীনে প্রচুর পরিমাণে রফতানিমূলক ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্র গড়ে ওঠায় তারা বিশ্বকে বহুল পরিমাণে সস্তায় পণ্যের জোগান দিতে পারছে, যেখানে আমেরিকার পক্ষে নতুন করে সেই জায়গায় পৌঁছনো আর সম্ভব নয়; কারণ, তাদের দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলিও উক্ত দেশগুলিতে (এমনকি তাইওয়ান’এও) ম্যানুফ্যাকচারিং হাবকে রফতানি করে নিজ দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং অর্থনীতির সক্ষমতাকে ইতিমধ্যেই খুইয়ে বসে আছে। অথচ ট্রাম্পের মনে হয়েছে, এখন পথ বিদেশের পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক চাপিয়ে তাদের দুর্মূল্য করে তুলে নিজের দেশের উৎপন্ন পণ্যগুলিকে আপেক্ষিক সস্তা দরে ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন করে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব গড়ে তোলা ও আমেরিকাবাসীকে কাজ দেওয়া। কিন্তু পুঁজিবাদের আবহে এর ফলে যে মুদ্রাস্ফীতি ও অকর্মণ্যতা চেপে বসবে সে কথা তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এইভাবেই ভেবে থাকেন এবং শুরুতে জনতার বেশ বাহবাও পান, তারপর আমরা জানি, সে সব কল্পকথা কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে।

সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের মোট রফতানির ১৮ শতাংশ আমেরিকার সঙ্গে। ২৬ শতাংশ শুল্ক চেপে বসায় এই রফতানি নিশ্চিত ভাবে ধাক্কা খাবে। বিশেষ করে, আইটি, ওষুধ, পোশাক, গাড়ি ও অলঙ্কার— এইসব শিল্প  বেশ কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হবে বলে অনুমান। তবে বিশ্বায়নের আবহে আমেরিকা যদি সত্যি সত্যিই মুক্ত বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিকে অস্বীকার করে, তার বিপ্রতীপে আজ অনেকগুলি দেশ এক জায়গায় এসে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছে যে নতুন কোনও অর্থনৈতিক অক্ষরেখা গড়ে ওঠাটা অবান্তর কিছু নয় আর। হয়তো দেখা যাবে, ডলারের সে জোরও আর আগামী দিনে থাকবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারত এই জায়মান গতিশীলতাকে কতটা বুঝতে ও ধারণ করতে সক্ষম। কারণ, আমাদের বর্তমান শাসকও তো সমান ভাবেই উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী, যাদের বরং ট্রাম্পের অমূলক চিন্তার সঙ্গে ভালো মেলে।

           

Wednesday, 2 April 2025

নীল অর্থনীতি

সমুদ্র উপকূলে রাজ্যেরও অধিকার থাকা উচিত

দীপঙ্কর দে



আগামী দিনে যে বিষয়ে ভারতের সমুদ্র উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারত সরকারের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী, সেটি হল, 'কন্টিনেন্টাল শেলফ' বা মহীসোপানকে কেন্দ্র করে যে বিশাল অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে তার ভাগ-বাঁটোয়ারা কী ভাবে হবে তা নিয়ে! তবে আগে বোঝা উচিত, 'কন্টিনেন্টাল শেলফ' বা মহীসোপান কাকে বলে। 'কন্টিনেন্টাল শেলফ' বা মহীসোপান হচ্ছে সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর সমুদ্রের দিকে জলের নীচে যে ভূখণ্ড ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নেমে যায়; ভূগোলের ভাষায় 'মহীসোপান', যাকে উপকূলীয় ওই দেশের বর্ধিত অংশ বলে ধরা হয়ে থাকে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন কি বলে? ১৯৫৮ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর স্থলভাগের বেসলাইন থেকে লম্বালম্বিভাবে সমুদ্রের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকার মালিকানা সম্পূর্ণ ওই দেশের। একে বলা হয় Exclusive Economic Zone (EEZ) বা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে সমুদ্রের জল ও তলদেশের ওপর ওই দেশের একচ্ছত্র অধিকার থাকে। সেখানকার সমুদ্রে অন্য কোনও দেশ মাছ ধরতে পারে না। এরপর থেকে দেড়শো নটিক্যাল মাইল সীমা পর্যন্ত সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদের মালিক হবে ওই দেশ, তবে সমুদ্রের জলে থাকা মাছ ধরতে পারে অন্য দেশও। এই পুরো সাড়ে তিনশো নটিক্যাল মাইলকে ওই দেশের 'মহীসোপান' বলা হয়।

এই যে মহীসোপানকে কেন্দ্র করে ক্রম-নির্মিত বিশাল অর্থনীতি, তার সঙ্গে কীভাবে আমাদের দেশে কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ তৈরি হচ্ছে তা উদাহরণ দিয়ে বললে বুঝতে সহজ হবে! যেমন, এখন যেহেতু উপকূল সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্তের একচেটিয়া অধিকারী ভারত সরকার তাই বোম্বে হাই থেকে যে তেল ও গ্যাস উৎপাদন হয় তা থেকে মহারাষ্ট্র সরকার রয়্যালটি বাবদ এক কানাকড়িও পায় না! সবটাই যায় কেন্দ্রের পকেটে; যেমন, ২০১২-১৩ সালে ONGC সমুদ্রতল থেকে তোলা তেলের রয়্যালটি বাবদ ৩৯৪০ কোটি টাকা ভারত সরকারকে দিয়েছে। অথচ, অসম বা ত্রিপুরার স্থলভূমি থেকে উৎপাদিত তেল ও গ্যাসের রয়্যালটি কিন্তু পায় সংশ্লিষ্ট রাজ্য। কয়লার ক্ষেত্রেও রাজ্যগুলি রয়্যালটি পায়। তাহলে একইভাবে মহীসোপানে প্রাপ্ত সম্পদের ওপরেও রাজ্য সরকারের রয়্যালটি পাওয়ার ন্যায্যতা থাকবে না কেন? স্বভাবতই, বাংলার সমুদ্র উপকূলে যদি তেল ও গ্যাসের সন্ধান মেলে সেই সম্পদের উপর বাংলার কোনও অধিকার কি থাকা উচিত নয়? 

ভারতের নয়টি উপকূল রাজ্যগুলির সমুদ্রতটের দৈর্ঘ্য ৫৪২২.৬ কিমি। মনে রাখতে হবে, নয়টি উপকূলীয় রাজ্য ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জকে ঘিরেও যে মহীসোপান বিদ্যমান, সেগুলির মালিকানাও ভারত রাষ্ট্রের! এই সংখ্যাকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল দিয়ে গুন করলে যে বর্গ ক্ষেত্রটির আয়তন পাওয়া যাবে সেটি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ভারত রাষ্ট্রের অংশ। এই বিশাল মহীসোপান অঞ্চলের সম্পদের মালিক ভারত রাষ্ট্র। মোট মহীসোপান অঞ্চলের আয়তন ভারতের মোট স্থলভূমির (৩২,৮৭,২৬৩ বর্গ কিমি) প্রায় সমান।

কিন্তু অদ্ভূতুড়ে বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিশাল নীল অর্থব্যবস্থায় (Blue economy) বাংলার মতো উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির কোনও ভাগ নেই। ভারতের নয়টি রাজ্যের সবচেয়ে বড় উপকূল রয়েছে গুজরাতে (দৈর্ঘ্য ১২১৪.৭ কিমি)। সবচেয়ে ছোট উপকূল গোয়ার (দৈর্ঘ্য ১০১ কিমি)। আর পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের দৈর্ঘ্য ১৫৭.৫ কিমি। তাহলে বাংলার সামুদ্রিক অঞ্চলের (মহীসোপান) আয়তন কত? মনে রাখতে হবে, উপকূল থেকে মহীসোপানের ব্যাপ্তি ৩৫০ নটিক্যাল মাইল। এক নটিক্যাল মাইল সমান ১.৮৫২ কিমি। তাই অঙ্কের হিসেবে বাংলার সমুদ্র অঞ্চলের আয়তন হচ্ছে: ১৫৭.৬ x ৩৫০ x ১.৮৫২ বর্গ কিমি, মানে, ১০২০৯১.৫ বর্গ কিমি। আর বাংলার স্থলভাগের পরিমাণ মাত্র ৮৮,৭৫২ বর্গ কিমি। 

ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯৭ বলছে, (১) ভারতের আঞ্চলিক জলসীমা, মহাদেশীয় তাক অথবা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে সমুদ্রের নীচে অবস্থিত সমস্ত জমি, খনিজ ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র কেন্দ্রের অধীনে থাকবে এবং তাদের উদ্দেশ্যে অধিকৃত হবে; (২) ভারতের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্যান্য সমস্ত সম্পদও কেন্দ্রের উপর ন্যস্ত থাকবে এবং তাদের উদ্দেশ্যে ধারণ করা হবে। তাই বোঝাই যাচ্ছে, মহীসোপানের সব সম্পদের একচেটিয়া মালিক কেন্দ্রের সরকার। উপকূলবর্তী রাজ্যের কোনও অধিকার নেই। বলাই বাহুল্য, সংবিধান রচিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। গত ৭৫ বছরে সমুদ্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে সমুদ্রাঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বেড়েছে। আগেই বলেছি, ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি নামে তৈরি হয়েছে একটি স্বতন্ত্র অর্থনীতির পরিসর। এই বিশাল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র থেকে রাজ্যগুলিকে বঞ্চিত করা অনৈতিক। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় মতাদর্শের স্বার্থে সংবিধানের ২৯৭ অনুচ্ছেদ নতুন করে লিখতে হবে। এটা সময়ের দাবি !

আরও একটি কারণে মহীসোপানের সুস্থায়ী উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে উপকূলবাসী ও রাজ্য সরকারের অংশগ্রহণ খুব জরুরি। সেটি হল, সমুদ্রের গভীর বা তলদেশ থেকে যদি অত্যধিক মাত্রায় খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজ শুরু হয়, তাহলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে, যার ভয়াবহ প্রভাব মানবজাতিও এড়াতে পারবে না। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করতে শুরু করেছেন। বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলনও চলছে। ইতিমধ্যে ভারতের আওতাধীন সামুদ্রিক এলাকায়, যেমন, কেরালা, গুজরাত এবং আন্দামান ও নিকোবরের উপকূলীয় অঞ্চল বরাবর দূরবর্তী গভীর জলভাগ থেকে সামুদ্রিক খনিজ উত্তোলনের জন্য খনন কাজ শুরু করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকী, এই মর্মে টেন্ডারও ডাকা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু উপকূলবাসীর কোনও মতামত গ্রহণ করা হয়নি। উপকূলে বসবাসকারী আমজনতা এই খনন কাজ শুরু করার পক্ষপাতী নয়। তাদের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু সাংবিধানিক অধিকারের বলে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটল। এখানেই বিপদ লুকিয়ে।

তাই, নীল অর্থনীতিতে উপকূলবর্তী রাজ্যগুলিরও সমান হক আছে, সে দাবি এবার সজোরে ওঠা উচিত।