Thursday 6 June 2024

সাধু সাবধান!

ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে আপাতত রোখা গেল

সোমনাথ গুহ



ভারতবর্ষের বুকের ওপর যেন একটা ভারী পাথর চাপা দেওয়া ছিল। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর সাথে সাথে সেই চাপ অনেকটাই মুক্ত হল; দীর্ঘ এক দশক পর মানুষ আবার বুক ভরে শ্বাস নিল, বাবাসাহেব আম্বেদকরের সংবিধান আপাতত রক্ষা পেল, একনায়কতন্ত্রের ভীতিপ্রদ করাল ছায়া অপসারিত হল। প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্তের যে মুখাবয়ব দেশের মানুষের চোখের সামনে দুঃস্বপ্নের মতো বিরাজ করত, তা সকালের সংবাদপত্রে হোক বা ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’এ, অথবা কোভিড শংসাপত্রে, তা থেকেও মুক্তি পাওয়া গেল। এই রায় আশ্বাস দিল যে ভারতের গণতন্ত্র হাজারও দুর্বলতা সত্ত্বেও এখনও যে কোনও বিপদকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম। 

প্রথমেই এই নির্বাচনের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে নেওয়া যাক। অয্যোধ্যা, যা ফৈজাবাদ লোকসভার অন্তর্গত, সেখানে বিজেপির পরাজয় বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা সব সময় বরদাস্ত করে না। রাজস্থানের বাঁশওয়াড়া কেন্দ্রে ভারতীয় আদিবাসী পার্টির প্রার্থী তিন লাখের অধিক ভোটে সঙ্ঘী প্রার্থীকে পরাজিত করে এই বার্তাকে আরও জোরালো করেছে। ভেবে দেখুন, ওই কেন্দ্রেই প্রধানমন্ত্রী মোদী সেই চরম বিভাজনকারী মন্তব্য করেছিলেন: কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মহিলাদের মঙ্গলসূত্র ‘অনুপ্রবেশকারী’ কিংবা ‘যাদের অধিক সন্তান আছে’ তাদের দিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, প্রধান সেবককে কেন্দ্র করে যে দুর্বিষহ ‘পারসোনালিটি কাল্ট’ গড়ে উঠেছিল তা ধাক্কা খেয়েছে। বেনারসে এক ধাক্কায় তাঁর জেতার মার্জিন প্রায় সাড়ে তিন লাখ কমে গেছে। বাংলায় তাঁর তথাকথিত ম্যাজিক কাজে দেয়নি, অনেক কেন্দ্রেই তাঁর প্রচার সত্ত্বেও বিজেপি হেরেছে। 

অপরদিকে ৬০০০ কিমি পদযাত্রা এবং সাম্প্রতিক সময়ে নিজের নানা বক্তব্য ও পদক্ষেপ রাহুল গান্ধীকে একজন নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর আগে তিনি ছিলেন একজন অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ, অন্তত তাঁর জনভাবমূর্তি তাই ছিল। মণিপুর, যে রাজ্য গত এক বছর ধরে গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত, সেখানে দুটি কেন্দ্রেই কংগ্রেস জিতেছে। তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, ইনার মণিপুর যা মেইতেই অধ্যুষিত সেই কেন্দ্রও বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। 

সর্বোপরি, ২০১৪ ও ২০১৯ যদি ফেসবুক, টুইটারের ভোটযুদ্ধ হয়, এবারের নির্বাচনে ইউটিউবার'দের জয়জয়কার। ধ্রুব রাঠি, রাবিশ কুমার, অজিত অঞ্জুম, এবং বাংলার কিছু প্রাজ্ঞ সাংবাদিক, ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ মানুষের কাছে গোদি মিডিয়ার এক বিকল্প সংবাদমাধ্যমকে হাজির করেছেন। সরকারি তাঁবেদারদের ‘অল ইজ ওয়েল’ খবরের বিপরীতে মানুষ এই ব্যক্তিদের নাছোড়বান্দা মনোভাবের সৌজন্যে বেকারি, মুল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সন্ধান পেয়েছেন।   

এর পাশাপাশি একটা আপসোসও রয়ে গেল। মনে হচ্ছে তীরে এসে তরী ডুবল- আর মাত্র ৩৮টা আসন পেলেই তো কেল্লা ফতে হয়ে গিয়েছিল। মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবাংলা, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে আশাতীত ভালো সাফল্যের পরও কেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অধরা রয়ে গেল? কিছু রাজ্যে কংগ্রেস ও সহযোগী দলের ফলাফলের ওপর চোখ রাখা যেতে পারে। মাত্র এক বছর আগে কংগ্রেস ১৩৫ আসন জিতে কর্নাটকে ক্ষমতায় আসে। নিজেদের ইস্তাহারে প্রতিশ্রুত পাঁচটি গ্যারান্টি রূপায়িত করার কারণে আশা করা হয়েছিল যে তারা লোকসভাতেও ভালো ফল করবে। তারা নিজেরাই ২৮টার মধ্যে অন্তত ১৮টা জিতবে আশা করেছিল, কিন্তু জিতেছে মাত্র ৯টা। আসলে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করাই যথেষ্ট নয়, সেটা মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে কিনা নিশ্চিত করতে হয় এবং ভোটবাক্সে তার ফায়দা তোলার জন্য প্রচার করতে হয়। এটা বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস করতে পেরেছে, রাজস্থানে ২০২৩'এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পারেনি, যদিও মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলত রান্নার গ্যাসের দাম ৫০০ টাকা করে দিয়েছিলেন, গিগ শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করেছিলেন যা আর কোনও রাজ্যে আজ অবধি হয়নি। এর কিছুটা সুফল অবশ্য কংগ্রেস লোকসভায় পেয়েছে।

বিহারে আসন বন্টনের বৈষম্যের কারণে ইন্ডিয়া জোটের ফল আশানুরূপ হয়নি। আরজেডি ২৩টার মধ্যে মাত্র চারটে আসনে জিতেছে। তাদের নিজেদের কোটা থেকে তারা 'বিকাশশীল ইনসান পার্টি'কে তিনটে আসন ছেড়ে দিয়েছিল, যার একটাতেও তারা জিততে পারেনি। এর বিপরীতে ‘মালে’ (সিপিআইএমএল, লিবারেশন) তিনটে আসনে লড়ে দুটিতে জয়লাভ করেছে। তাদের অবশ্যই আরও বেশি আসন প্রাপ্য ছিল। সাধারণ মানুষের থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা তুলে তাঁরা নির্বাচনে লড়েছেন যা এক বিরল নিদর্শন স্থাপন করেছে। 

হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, দিল্লিতে কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ার ফলাফল শোচনীয়। দিল্লিতে আপ ও কংগ্রেসের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের তিক্ততার কারণে নিচু তলায় কর্মীদের মধ্যে কোনও বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি যা আসন জেতার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়েছে। হিমাচলে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস একটি আসনও জিততে পারেনি, যা সত্যিই বিস্ময়কর। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস বিজেপির বি টিমে পরিণত হয়েছে। বর্ষীয়ান নেতা কমলনাথ নামে মাত্র কংগ্রেস, গান্ধী পরিবারের সঙ্গে পুরনো সম্পর্কের কারণে তিনি এখনও দলে টিকে আছেন। এঁদের মতো নেতা যতদিন দলে থাকবেন ততদিন ওই রাজ্যে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এছাড়া গুজরাত, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেস মাত্র একটি করে আসন জিতেছে। বলাই বাহুল্য, ইন্ডিয়া জোটকে ক্ষমতায় আসতে হলে কংগ্রেসকে অন্তত ২০০'র কাছাকাছি আসন পেতে হত। তাই কংগ্রেস যেমন ফ্যাসিবাদকে সাময়িক ভাবে ঠেকিয়ে রাখার কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার, তেমনই ম্যাজিক অঙ্কে না পৌঁছনোর সিংহভাগ দায়ও তাদের।        

বিগত ১৭তম লোকসভায় দেশের সংবিধানের বিভিন্ন ধারা বারবার লঙ্ঘন করা হয়েছে। সাড়ে তিনশোর বেশি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সংবিধানের বিভিন্ন ধারাকে হেলায় পদদলিত করেছে; যেমন এটা প্রথম লোকসভা যেখানে সংবিধানের ধারা ৯৩ লঙ্ঘন করে কোনও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়নি। এই বিষয়ে সীমিত শক্তির কংগ্রেস দলের প্রতিবাদ তারা উপেক্ষা করেছে। তারা প্রায় বিনা আলোচনায় একের পর এক আইন প্রণয়ন করেছে যা দেশের সাতাত্তর বছরের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। মাত্র ১৬ শতাংশ বিল আলোচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে, যা ১৫তম লোকসভায় ছিল ৭১ শতাংশ, ১৬তম লোকসভায় ছিল ২৫ শতাংশ। লক্ষণীয়, ২০১৪ থেকে আলোচনার অবকাশ প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় কোনও আলোচনা-বিতর্ক ছাড়াই তিনটি শ্রম বিল, ডিজিটাল ডেটা প্রোটেকশন বিল, ন্যায় সংহিতা বিল ইত্যাদি আইনে পরিণত করা হয়েছে। 

এসবেরই থেকে সাময়িক মুক্তি। ‘সাময়িক’, ‘আপাতত’ শব্দগুলো ব্যবহার করতে হচ্ছে, কারণ, ১৮তম লোকসভার চরিত্র বহুমাত্রিক এবং তাই কিছুটা টলমল। মানুষের কাছে যেটা স্বস্তির সেটা হল টিডিপি, জনতা দল (ইউ) ইত্যাদির চাপে থাকার কারণে বিজেপি তাদের ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের প্রকল্প রূপায়ণ করতে পারবে না, মুসলিম নিপীড়ন, বুলডোজার অভিযান বন্ধ রাখতে হবে। এই দুটি দল রাজনীতির ময়দানে বিশুদ্ধ হাওয়া মোরগ হিসাবে পরিচিত, কখন যে কী করবে একবিংশ শতাব্দীর নব্য অবতারও বুঝে উঠতে পারবেন না। ইতিমধ্যেই তারা সওদা করা শুরু করে দিয়েছে-- ক্যাবিনেট মন্ত্রী চাই, স্পিকার চাই, রাজ্যের জন্য স্পেশ্যাল প্যাকেজ চাই! নানা দাবির কারণে বিজেপি নেতৃত্বের চুল খাড়া হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিধানসভা হোক বা লোকসভা, উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজনীতি করতে অভ্যস্ত। তিনি গরিষ্ঠতাকে নির্মম ভাবে ব্যবহার ও নানা ছলচাতুরি করে সহযোগী এবং বিরোধী উভয়কেই চমকে ধমকে দমিয়ে রাখতে অভ্যস্ত। তিনি অটল বিহারি বাজপেয়ী নন যিনি ১৯৯৯ সালে ১৮২টা আসন নিয়েও পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন। এছাড়া দলের মধ্যেই তাঁর যে প্রশ্নাতীত আধিপত্য ছিল সেটা আর নেই, বিশেষ করে আরএসএস'এর নিরঙ্কুশ সমর্থন তাঁকে আবার নতুন করে অর্জন করতে হবে। তিনি বর্তমানে মেরুকরণের রাজনীতি বর্জন করবেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, সিএএ-এনআরসি, সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার বিভিন্ন আইন মুলতুবি রাখবেন, ইডি-সিবিআই'এর রাশ টেনে ধরবেন। 

কিন্তু তিনি সব সময় সুযোগ খুঁজবেন কী করে ২৪০ সংখ্যাটাকে ২৭২ করা যায়। এটাই হবে তাঁর পাখির চোখ। আর কে না জানে, এই খেলায় তিনি ও তাঁর ছায়াসঙ্গী অসম্ভব পটু। শুধু মহারাষ্ট্রের দিকে চোখ ফেরালেই সেটা বোঝা যায় যেখানে তারা শরদ পাওয়ার আর উদ্ধব থ্যাকারের মতো পোড়খাওয়া  রাজনীতিবিদদের দলকেও টুকরো করে দিয়েছেন। এছাড়া তাঁদের হাতে আছে বিপুল অর্থভাণ্ডার, দেশের প্রধান দুই কর্পোরেট সংস্থার অকুন্ঠ সমর্থন। আপাতত বিজেপি নেতৃত্ব শ্বেতশুভ্র পায়রার রূপ নিলেও এটা নিশ্চিত যে তারা শুরু থেকেই তলায় তলায় ইন্ডিয়া জোটের বড় দলগুলিতে ভাঙ্গন ধরিয়ে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করবে। সুতরাং, ইন্ডিয়া জোট এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে অতি সতর্ক থাকতে হবে। সাধু সাবধান!


1 comment:

  1. নির্বাচন পরবর্তী সম্ভাবনাগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

    ReplyDelete