Wednesday 12 June 2024

জনতার হলুদ কার্ড

আগামী লোকসভা নির্বাচন কি নিকটেই?

মালবিকা মিত্র



'আপনারে স্থাপিয়াছো, জগতের দেবতারে নহে।' 

সাধু নরোত্তমের এ হেন কথাকে রাজা 'নাস্তিকের মত কথা কহ' বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের রাজামশাই হলে বলতেন, পাকিস্তানির মতো কথা বলো শুনি; তারপর সোজা পাকিস্তানেই চলে যেতে বলতেন। 

আসলে কবিতার রাজার সঙ্গে আমাদের বর্তমান রাজার বড় পার্থক্য আছে। আমাদের রাজা নিজেই পরমাত্মার অংশ। তিনি পরমাত্মার বাণী বাহক। পুরীর জগন্নাথ প্রভু স্বয়ং আমাদের 'রাজা'র ভক্ত'। আর তাই গল্পটা এখানে একটু ভিন্নতর হল-- রাম মন্দিরের বিগ্রহ খোদ রামলালাই রাজাকে, মানে রাজার দলকে, অযোধ্যা থেকে বিতাড়ন করলেন। এমনকি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যেই রাজশক্তির দর্প চূর্ণ হল। অযোধ্যা তার ইতিহাসকে স্মরণ করালো-- বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির রাজনৈতিক তরজাই এখানে সব নয়। অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে কত না দরগা, মাজার। বড়ি বুয়ার দরগা, ন’গজী কিংবা আড়গড়া মাজার। হিন্দু-মুসলিম দু' পক্ষই সেখানে অসুস্থ সন্তানের আরোগ্য কামনায়, বিয়ের পর প্রার্থনা জানাতে হাজির হন। কোনও মসজিদে খাদিম হিন্দু, কোথাও আবার নিরামিষ রান্না। ফলত, সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার অযোধ্যা রাজশক্তিকেই প্রত্যাখ্যান করল। 

আমাদের রাজা স্বঘোষিত বিশ্বগুরু। ২০১৪ সালের পর বিশ্ববাসী ভারতকে চিনলো, জানলো। এমনকি রিচার্ড অ্যাটেনবরোর 'গান্ধী' ছবির আগে বিশ্ববাসী গান্ধীজীকেও চিনত না। এ হেন পরমাত্মার দূত ১ জুন বিকেলে কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ শিলায় ধ্যান ভঙ্গ করে রাজধানী ফেরার পথে বিমানে বসে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠি তো নয়, যেন বিদায়ী ভাষণ। লিখলেন, ভারতের জাতীয় আন্দোলন সেই কোন যুগ থেকে সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে থেকেছে, সেইসব কথা। সবই আবেগ? না বাবা না, খুব ভেবেচিন্তে হিসেব কষে। রাজামশাই ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি আর সিংহাসনে ফিরবেন না। তাই অনেক কথা বলে ফেলেছেন আবেগ ঘন বক্তৃতার ঢঙে। 

আরও বহু কিছুই বেমানান লাগছে আমাদের কাছে। যে মোদীজী এতদিন তাঁর সমস্ত বাচনে এনডিএ তো ননই, এমনকি বিজেপিও ছিলেন না, সর্বক্ষণ নিজেই নিজেকে 'মোদি' বলে সম্বোধন করে বক্তৃতা দিতেন, সেই ওনার শেষমেশ কী হল? মোদির গ্যারান্টি, এটা মোদি বলছে, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, মোদি এসব অন্যায় সহ্য করবে না, মোদি জেলে ঢোকাবে-- এভাবেই উনি কথা বলতেন। উনি আত্ম'কে হারিয়ে মোদিতে মুগ্ধ। উনি কখনও আমি নন, সর্বদাই মোদি। আর সেই মোদিজী কিনা ভোটের ফল প্রকাশের পর সংসদের সেন্ট্রাল হলে দলীয় সাংসদদের সভায় একবারও মোদি বা বিজেপি'র নাম উচ্চারণ করলেন না! সারাক্ষণ এনডিএ আর এনডিএ  ও এনডিএ বলে গেলেন। জহরলাল নেহেরুর পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড তিনি স্পর্শ করেছেন; আত্মগর্ব ও অহমিকায় তৃপ্ত। কিন্তু দুই বগলে দুটি ক্র্যাচ-- নাইডু ও নীতিশ। রেকর্ড স্পর্শ করেও রেকর্ড কিন্তু অধরাই থেকে গেল। শুধু কি তাই, কেউ কেউ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, নীতিশ-নাইডু, একনাথ আর চিরাগের চার কাঁধে তোলা খাটিয়ায় তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। 

এবারের এই নির্বাচনী ফল একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। যোগেন্দ্র যাদব, পরকলা প্রভাকর তো অনেক আগেই বুঝেছিলেন এবারের নির্বাচন ছিল সাধারণ মানুষের। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দেশের মহিলা কুস্তিগীরদের প্রতিবাদ যেভাবে দ্রুত গণ চরিত্র নিল, তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে যে দীর্ঘায়ত গণঅভ্যুত্থান, সিএএ-এনআরসি নিয়ে যে ব্যাপক গণজমায়েত, সেগুলো কি কিছুই বার্তা দেয়নি? বিনা প্রস্তুতি ও আগাম সর্তকতা ছাড়াই লকডাউন ঘোষণা, লক্ষ লক্ষ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ ও প্রাণহানি, এসব তো কিছু পূর্বাভাস দিয়েছিল, আমরা শুনতে পাইনি। মনে পড়ছে, 'রক্তকরবী'তে রবীন্দ্রনাথ বিদ্রূপের সুরে বলেছিলেন, ঘোর বর্ষায় প্রেমিক ব্যাঙ তার প্রেমিকাকে সশব্দে চিৎকার করে আহ্বান করে মিলনের আকাঙ্ক্ষায়। দুঃখজনক সত্য হল, প্রেমিকার কানে সেই আহ্বান যথাযথ না পৌঁছলেও ঢোঁড়া সাপের কানে তা বিলক্ষণ পৌঁছয়। দেশের মানুষ ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। সেই ২০১৪ সালের পর থেকে তাঁদের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ তাঁরা প্রকাশ করতে পারেননি। ২০১৯'এর ভোট পুলওয়ামা, বালাকোট আর মোমবাতি মিছিলেই উদ্ধার হয়ে গেল। মানুষের ভেতর জমে থাকা বারুদ প্রকাশ পেল না। বরং তা সুদে মূলে বৃদ্ধি পেল। সেই পুঞ্জীভূত অসন্তোষ ২০২৪'এর নির্বাচনে প্রকাশ পাবে এটা জানাই ছিল । 

কিন্তু বিরোধী নেতারা এটা বুঝলেন না। কর্নাটকের নির্বাচনী সাফল্য প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসকে আত্মতুষ্ট করে তুলল। ফলে, পরবর্তী পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনকে মুখে সেমিফাইনাল বলে ঘোষণা করলেও, বাস্তবে এককভাবে কংগ্রেস লড়াই করল ও কার্যত পর্যুদস্ত হল। নেতারা মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে ব্যর্থ হলেন। রাজ্যে রাজ্যে যথাযথ জোট গঠন হল না। অন্যদিকে মোদি সরকার কর্নাটকের বিপর্যয়ের পর পাঁচটি রাজ্যের ভোটে অতিমাত্রায় সতর্ক হল। ভোটের সাফল্যের ফলে আবার অতিমাত্রায় আত্মতুষ্টিতে ভুগলো এবং ৩৭০ ধারা বাতিল, রাম মন্দির নির্মাণ'এর সুফলেই বৈতরণী পার হবার স্বপ্ন দেখল। শাসক মোদি সরকার তবুও দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিল। প্রথম দফার নির্বাচন ১৯ এপ্রিল সাঙ্গ হবার পরেই ঢোঁড়া সাপের কানে সে বার্তা পৌঁছেছিল। এর ফলে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও দিশাহারা ভাবে মোদি-শাহ এক্স-রে মেশিন দিয়ে সম্পত্তি খুঁজে বের করা, জোড়া মোষের আসন্ন বিপদ, মঙ্গলসূত্র থেকে গো সম্পদ সব মুসলমানরা নিয়ে যাবে, এমন আবোল তাবোল প্রচার শুরু করল যে বোঝাই যাচ্ছিল প্রচারে নিজেদেরই আস্থা নেই। এমনকি নিজেদের পাঁচ ভাইবোনকে ভুলে গিয়ে মোদি বললেন যাদের অনেক বাচ্চাকাচ্চা পয়দা হয়, বলে মুসলমানদের ইঙ্গিত করলেন। নিজেকে পরমাত্মার অংশ বলে নিজেই প্রচার করলেন, সম্বিত পাত্র বললেন জগন্নাথদেব স্বয়ং নাকি মোদিজীর ভক্ত। এই সমস্ত প্রলাপ ও কু-কথায় ভোটের বাজার মুখরিত হল। 

মোদিজীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তিনি বিধ্বস্ত ও আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত পাচ্ছেন। কিন্তু তিনি তো তিনি নন। তিনি হলেন মোদি। আর 'মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়'- এই নিজের তৈরি মিথ্যাকে নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। ফলে, 'না মুমকিন' হওয়া পর্যন্ত এই মিথ বা মিথ্যা চলতে থাকল। অবশেষে এখন সব মিথ ভেঙে এনডিএ জোট সত্য হল। কদিন আগে যদি বিরোধী দলগুলি মানুষের মনোভাবকে অনুভব করতে পারতেন, তাহলে বিজেপি ২৪০ ছুঁতে পারত না। অনেক আগেই থেমে যেত। আমরা রাজনৈতিক নেতারা বহু সময় মানুষের নাড়ির শব্দ শুনতে পাই না। টেবিল-চেয়ারে বসে জোটের অঙ্ক কষি, অফিসে, গৃহে, ঠান্ডা ঘরে সিদ্ধান্ত নিই। টের পাই না মানুষের ইচ্ছা, মানুষের বক্তব্য। মোদিজী, বিজেপি, এমনকি বিরোধীরা কেউ কি ভেবেছিলেন, অযোধ্যা কেন্দ্রে বিজেপির এমন শোচনীয় পরাজয় হবে! 

সুতরাং, ২০২৪'এর লোকসভা নির্বাচনের জনাদেশ সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে তাই নয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকেও হলুদ কার্ড দেখিয়েছে, সাবধান করেছে। বিরোধীরা কি কিছু শিক্ষা নেবেন? মনে তো হয় না। তা না হলে পশ্চিমবাংলায় দলের শোচনীয় পরাজয়ের পর সিপিআইএম পলিটিব্যুরোর নেতা ও রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম কত অবলীলায় বলতে পারেন, আমাদের দলের কেউ 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' নিয়ে কোনও কটূক্তি করেনি। যারা সারা বছর বলে গেল, ভাতা হল ভিক্ষা, তারাই এখন বলছে আমরা ও কথা বলিনি। একবারও বলার সৎ সাহস দেখালো না, ও কথা বলা আমাদের ভুল হয়েছিল। এআইসিসি এখনও স্বীকার করেনি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া কংগ্রেসকে দুটি আসনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসা উচিত ছিল। আলোচনা করে দুইকে চার করা যেত না এমন নয়। কংগ্রেস আলোচনাই চায়নি, কারণ মহম্মদ সেলিম চায়নি। অনিবার্যভাবেই যা হবার তাই হয়েছে। 

আমি নিজে বিশ্বাস করি, পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরি হওয়া ও তৃণমূল দলের হাতে সিপিএম'এর ক্ষমতাচ্যুতি এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে নিহিত আছে এই তিন দলের অনৈক্যের ক্ষেত্র। ঐক্য সম্ভব নয়, কাম্যও নয়। কিন্তু কংগ্রেস ও সিপিআইএম'কে প্রধান শত্রুর প্রতি বর্শামুখ নির্দিষ্ট করতে হবে ও তৃণমূল প্রধান বিরোধী দল এই ধারণা ছাড়তে হবে। তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানাধিকারীকে আগে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে বাংলার রাজনীতির এক গভীর বিপদ আসন্ন। তৃণমূল সরকারের প্রতি মানুষের যে পরিমাণে মোহমুক্তি ঘটবে ও ঘটছে, তারা বিকল্প হিসেবে সামনে বাম বা কংগ্রেসকে না পেয়ে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী বিজেপিকেই বিকল্প হিসেবে খুঁজে নেবে ও নিচ্ছে। কংগ্রেসকেও পুরনো গৌরবময় অতীতকে ভুলে আঞ্চলিক দলগুলিকে সম্মান করতে শিখতে হবে। আরজেডি, সপা, আপ, তৃণমূল, ডিএমকে, জেএমএম, শিবসেনা, এনসিপি, বহু ধারার বাম ও সবাইকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে। এই নির্বাচনে মানুষ যা বলতে চেয়েছিল তা যথার্থভাবে প্রতিফলিত হবে আগামী লোকসভা নির্বাচনে। কে বলতে পারে সেই নির্বাচন খুব বেশি দেরি নেই।


3 comments:

  1. সত্যিই অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছেন বিষয় গুলো,👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍👍

    ReplyDelete
  2. বিশ্লেষণ যথার্থ, অনেকেই মনে করেন মানুষ ই নাকি ক্ষমতার মূল উৎস। মানুষ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে যত ই লম্ফ লম্ফ করে সব ফল মাটিতে ফেলতে পাড়লেওকুড়াতে পারে না। সে মালিক হতে পারে না।আসল মালিক লাঠি নিয়ে এসে মানুষ গুলো কে তাড়িয়ে ছাড়ে। মালিক সব সময়ই ঘাপটি মেরে বসে থাকে মানুষের লাফালাফি থেমে গেলে আবার নিজের দখল কায়েম করে। কেবলমাত্র গন্তব্যে পৌঁছাতে কিছু সময় বেশী লাগে।

    ReplyDelete
  3. ভালো বিশ্লেষণ। তবে রামমন্দির নির্মাণের পরেও খোদ অযোধ্যায় বিজেপির হার বুঝিয়ে দিল, হিন্দু ফ‍্যাসিবাদ‌এর কথা এক বড় মিথ‍্যাচার। দীর্ঘদিন লালনপালন করা এই মিথ্যা যতো তাড়াতাড়ি বামেরা বুঝতে পারবে ততই ভালো।

    ReplyDelete