Sunday 30 June 2024

ছুঁচোর গায়ের গন্ধ

গোলাপ জলে ধুলেও যাবে না

মালবিকা মিত্র



লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বলেছিলাম, জনগণ এবারের ভোটে কী ভূমিকা নেবে তা সরকার বা বিরোধী পক্ষের নেতারা কেউই বুঝে উঠতে পারেননি। ১৯ এপ্রিল প্রথম দফা নির্বাচনের পর তাদের উভয়ের কাছে স্পষ্ট হয়, কী ঘটতে চলেছে। লিখেছিলাম, জনগণ সরকার পক্ষকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে, সেই সঙ্গে বিরোধী পক্ষকেও হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। এতটুকু আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। বিরোধী জোটকে আরও বজ্রকঠিন ও দৃঢ় হতে হবে। 

অন্যদের কথা কী বলব, আমি নিজেও নির্বাচনে ইউপি, বাংলা, হরিয়ানা, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর ফলাফল দেখে একটু বুঝি আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলাম। আরও আত্মতুষ্ট এই কারণে যে, নরেন্দ্র মোদির মতো একজন একনায়ক আর এখন একনায়ক রইল না, নীতিশকুমার ও চন্দ্রবাবুর উপর নির্ভরশীল হল। সকলেই জানি, এই দুই অবলম্বন যথেষ্ট বিশ্বস্ত নয়। আরও উৎসাহ পেলাম, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ও ইন্দ্রেশ কুমার প্রমুখের সমালোচনামূলক ও উপদেশমূলক মন্তব্যে-- বিনয়ী হতে হবে, সবাইকে নিয়ে চলতে শিখতে হবে, নিজেকে সংঘের উপরে স্থাপন করা যাবে না ইত্যাদি। এক কথায় বলা যায়, তৃতীয় বারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত হল। 

সত্যি বলতে কি, আমি মুহূর্তের জন্য ইতিহাস বিস্তৃত হয়েছিলাম। ইতিহাসে এমন কোনও শাসক দেখানো যাবে না যারা একনায়ক থেকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছেন। একনায়কতন্ত্র সংখ্যা, সাফল্য বা জনাদেশের ওপর নির্ভর করে না। ওটা একটা মানসিকতা। 

একটু ইতিহাসে ফিরে যাই। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট স্থলযুদ্ধে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি জানেন, জলযুদ্ধে ইংল্যান্ডের একাধিপত্য স্বীকৃত। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং ভাই জোসেফকে বলেছিলেন, স্থলযুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব তাকে জলযুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্ব এনে দেবে। ১৮০৬ সালে নেপোলিয়ন'এর ক্ষমতা ছিল মধ্য গগনে। সেই ১৮০৬ সালেই স্পেনে যখন নেপোলিয়ন বিরোধী বিদ্রোহ হয়, সেই বিদ্রোহে ইংল্যান্ড সমর্থন জানিয়ে সৈন্যবাহিনী সহ ওয়েলিংটনকে প্রেরণ করে। নেপোলিয়ন স্পেনের মাটিতে ইংল্যান্ডের উপস্থিতিতে উৎসাহিত হলেন। স্পেনের স্থলভুমিতে তিনি ইংল্যান্ডকে পরাস্ত করার স্বপ্ন দেখলেন। ইংল্যান্ডের অংশগ্রহণ যে স্পেনীয় সমস্যাকে একটা বাড়তি মাত্রা এনে দিয়েছে, তা অবজ্ঞা করলেন। অনিবার্য পরিণতি ভিত্তোরিয়া ও ভিমিয়ার'এর যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে নেপোলিয়নের শোচনীয় পরাজয়। ফলে স্থলযুদ্ধে নেপোলিয়নের শ্রেষ্ঠত্বের অপরাজেয়তার মিথ ভেঙে গেল। কার্যত এরপর থেকেই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট একের পর এক পরাজয়ের সম্মুখীন হলেন। 

ঐতিহাসিকরা বলবেন, স্পেনের মাটিতে ব্রিটিশ সেনাপতি ওয়েলিংটনের উপস্থিতির পর নেপোলিয়ন একটু ধৈর্য দেখাতে পারতেন। পরিস্থিতির সম্যক বিশ্লেষণ করতে পারতেন। কারণ, পরিস্থিতির গভীরতা ছিল ভিন্নতর। কিন্তু নেপোলিয়ন সেটা না করে দ্বিগুণ উৎসাহে ইংল্যান্ডকে স্পেনের মাটিতে পরাস্ত করার উদ্যোগ নিলেন। একনায়ক কখনও আত্মবিশ্লেষণ করে না। একনায়ক নিজে যেটা ঠিক করে সেটাকে একমাত্র সত্য বলে গ্রহণ করে। তাকে পরিবেষ্টিত পারিষদবর্গ সেই সত্যকে চরম সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে, একনায়কের ভেতর মূল্যায়ন, আত্মজিজ্ঞাসা থাকে না। সেই কারণে এরা ভাঙলেও মচকায় না। 

দেখাই যাচ্ছে, একটা সংখ্যালঘু সরকার, যেখানে প্রধান দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই! কিন্তু কে বলবে? গরিষ্ঠতা থাকাকালীন যে সমস্ত প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলি সেই প্রধান দলের অধিকারে ছিল, সংখ্যালঘু হওয়ার পরেও কোনও দফতরই একনায়ক শরিক দলকে দেয়নি। নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এটা কোনও আত্মিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না। সবাইকে নিয়ে চলার বা জোট ধর্মের ইঙ্গিতও নয়। মুখে বলছে বটে এনডিএ'র কথা, কিন্তু বাস্তবে সে নিজের ইচ্ছাতেই চলে। এই যে এত বড় দেশ জোড়া জাতীয় স্তরে পরীক্ষা দুর্নীতি, শত সহস্র কোটি টাকার স্ক্যাম, যথাপুর্বং প্রধানমন্ত্রী মৌন। কোনও বিচলিত বোধ তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। খোদ রাম মন্দিরের ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ছে, সদ্য নির্মিত রামপথে ধ্বস নেমেছে, মালগাড়ি এক্সপ্রেস'এর মাথায় চাপছে; পাশাপাশি, সবে মাত্র মার্চ মাসে ভোটের আগে লোক দেখানো বিমানবন্দর ও সম্প্রসারণের উদ্বোধন করলেন তিনি, জব্বলপুর বিমানবন্দর ও দিল্লিতে মাত্র দু' মাসের মধ্যে সে সব ভেঙেচুরে অস্থির। 

জনসাধারণের দেখানো হলুদ কার্ড সত্ত্বেও এসব হচ্ছে। প্রথমে ইডি দিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নাজেহাল করানো। অতঃপর রাইস এভিনিউ কোর্টে অরবিন্দের জামিন যেই মঞ্জুর হল, সেই জামিনকে হাইকোর্টে আটকে দেওয়া হল; শেষমেশ জামিন মঞ্জুরের সম্ভাবনায় ইডি'কে ছেড়ে সিবিআইকে দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করানো হল। বিরোধী কণ্ঠকে নির্মূল করার নির্লজ্জতম প্রয়াস। অনেকেই ভেবেছিলেন, চন্দ্রবাবু নাইডু স্পিকার পদটা দাবি করেছেন, হয়তো এটা নিয়ে মোদি একটু বেকায়দায় পড়বেন। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম মোদি তার নিজের মনোনীত সেই ওম বিড়লাকেই দ্বিতীয়বারের জন্য স্পিকার করলেন। এমনকি স্পিকার তাঁর ভাষণে বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ শানালেন জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পূর্তি স্মরণ করিয়ে। 'তোর বাপ-ঠাকুর্দা জল ঘোলা করেছিল'-- সেই চেনা পরিচিত বিরোধীদের আক্রমণের রাস্তায় চললেন। অথচ বলা উচিত ছিল, শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ যাতে গণতন্ত্রের প্রধান সৌধ পার্লামেন্টের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় তাঁকে সাহায্য করেন। সে পথে স্পিকার, অর্থাৎ, বকলমে নরেন্দ্র মোদি হাঁটলেন না। ২৪০ আসনে জিতে হাবেভাবে মনে হচ্ছে '৪০০ পার'। 

যদি কেউ ভেবে থাকেন, মোহন ভাগবত বা ইন্দ্রেশ কুমারের উপদেশ ও সুবচনকে নরেন্দ্র মোদি এতটুকু গুরুত্ব দেবেন, তাহলে তা ভুল। লক্ষ করবেন, একই পথে একই লক্ষ্যে তিনি এখনও অবিচল। তাঁর মন্ত্রিসভায় একজনও সংখ্যালঘু ইসলাম ধর্মের মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ, মূলগতভাবে তিনি তার কট্টর হিন্দুত্বের পথ পরিবর্তন করবেন না। আর সেই কারণেই মোহন ভাগবত সহ আরএসএস নেতারাও জানেন, শতবর্ষের প্রাচীন আরএসএস দলের বাড়বাড়ন্ত গত ১০ বছরের মোদি জমানায়। অতএব, তাকে গিলতে না পারলেও উগরে দেওয়া সম্ভব নয়। 

সুতরাং, মোদি সরকার দুর্বল, মোদি সরকারের চৈতন্যের পরিবর্তন বাধ্যত হবে, প্রধানমন্ত্রী ব্যাকফুটে-- এসব ধারণা বিশ্বাস করার অর্থ নিজেদের অসহায় প্রতিপন্ন করা। কারণ, একনায়ক ভাঙবে তবু মচকাবে না। বরং আত্মাহুতি তার কাছে শ্রেয় পন্থা, আত্মসমর্পণ কদাপি নয়। তাই বিরোধী জোট ইন্ডিয়া যেন কখনই এই সরকারের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, এখন মাত্র সময়ের অপেক্ষা, এমন আত্মতুষ্টিতে না ভোগে। 

আগামী রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনগুলি বিরোধী জোটের কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। যে কোনও মূল্যে ঐক্য রক্ষা করে স্বৈরাচারী মোদি সরকারকে রাজ্যে রাজ্যে রুখে দিতে হবে। অন্যথায় মানুষ লোকসভা নির্বাচনে যে মেজাজ ও স্পিরিট দেখালেন তাকে অমর্যাদা করা হবে। তাঁরা হতাশ হবেন। কে না জানে হতাশা থেকেই প্রতিক্রিয়ার শক্তির প্রত্যাবর্তন হয় নবতর শক্তিতে। মনে রাখতে হবে রজনী পাম দত্তের সেই ঐতিহাসিক উক্তিটি-- ফ্যাসিস্ট শৃগাল কখনই শ্রমিক শ্রেণির সিংহবিক্রমকে আঘাত করতে পারেনি; শ্রমিক শ্রেণি যখন সংসদ-সর্বস্ব কমিউনিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ভ্রান্ত রাজনীতির শিকার হয়ে আহত ও হতাশ, তখনই ফ্যাসিস্ট শৃগাল সেই আহত সিংহকে আক্রমণ করেছিল।


1 comment:

  1. ভালো বিশ্লষণ ও মতামত।
    বিরোধী ঐক্য রক্ষা ও বিকশিত হবে না আরো দুর্বল হবে? মোদি দ্বতীয়টা চায়। বিরোধীদের অগ্নি পরীক্ষা।

    ReplyDelete