Sunday 30 June 2024

ছুঁচোর গায়ের গন্ধ

গোলাপ জলে ধুলেও যাবে না

মালবিকা মিত্র



লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বলেছিলাম, জনগণ এবারের ভোটে কী ভূমিকা নেবে তা সরকার বা বিরোধী পক্ষের নেতারা কেউই বুঝে উঠতে পারেননি। ১৯ এপ্রিল প্রথম দফা নির্বাচনের পর তাদের উভয়ের কাছে স্পষ্ট হয়, কী ঘটতে চলেছে। লিখেছিলাম, জনগণ সরকার পক্ষকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে, সেই সঙ্গে বিরোধী পক্ষকেও হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। এতটুকু আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। বিরোধী জোটকে আরও বজ্রকঠিন ও দৃঢ় হতে হবে। 

অন্যদের কথা কী বলব, আমি নিজেও নির্বাচনে ইউপি, বাংলা, হরিয়ানা, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর ফলাফল দেখে একটু বুঝি আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলাম। আরও আত্মতুষ্ট এই কারণে যে, নরেন্দ্র মোদির মতো একজন একনায়ক আর এখন একনায়ক রইল না, নীতিশকুমার ও চন্দ্রবাবুর উপর নির্ভরশীল হল। সকলেই জানি, এই দুই অবলম্বন যথেষ্ট বিশ্বস্ত নয়। আরও উৎসাহ পেলাম, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ও ইন্দ্রেশ কুমার প্রমুখের সমালোচনামূলক ও উপদেশমূলক মন্তব্যে-- বিনয়ী হতে হবে, সবাইকে নিয়ে চলতে শিখতে হবে, নিজেকে সংঘের উপরে স্থাপন করা যাবে না ইত্যাদি। এক কথায় বলা যায়, তৃতীয় বারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত হল। 

সত্যি বলতে কি, আমি মুহূর্তের জন্য ইতিহাস বিস্তৃত হয়েছিলাম। ইতিহাসে এমন কোনও শাসক দেখানো যাবে না যারা একনায়ক থেকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছেন। একনায়কতন্ত্র সংখ্যা, সাফল্য বা জনাদেশের ওপর নির্ভর করে না। ওটা একটা মানসিকতা। 

একটু ইতিহাসে ফিরে যাই। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট স্থলযুদ্ধে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি জানেন, জলযুদ্ধে ইংল্যান্ডের একাধিপত্য স্বীকৃত। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং ভাই জোসেফকে বলেছিলেন, স্থলযুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব তাকে জলযুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্ব এনে দেবে। ১৮০৬ সালে নেপোলিয়ন'এর ক্ষমতা ছিল মধ্য গগনে। সেই ১৮০৬ সালেই স্পেনে যখন নেপোলিয়ন বিরোধী বিদ্রোহ হয়, সেই বিদ্রোহে ইংল্যান্ড সমর্থন জানিয়ে সৈন্যবাহিনী সহ ওয়েলিংটনকে প্রেরণ করে। নেপোলিয়ন স্পেনের মাটিতে ইংল্যান্ডের উপস্থিতিতে উৎসাহিত হলেন। স্পেনের স্থলভুমিতে তিনি ইংল্যান্ডকে পরাস্ত করার স্বপ্ন দেখলেন। ইংল্যান্ডের অংশগ্রহণ যে স্পেনীয় সমস্যাকে একটা বাড়তি মাত্রা এনে দিয়েছে, তা অবজ্ঞা করলেন। অনিবার্য পরিণতি ভিত্তোরিয়া ও ভিমিয়ার'এর যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে নেপোলিয়নের শোচনীয় পরাজয়। ফলে স্থলযুদ্ধে নেপোলিয়নের শ্রেষ্ঠত্বের অপরাজেয়তার মিথ ভেঙে গেল। কার্যত এরপর থেকেই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট একের পর এক পরাজয়ের সম্মুখীন হলেন। 

ঐতিহাসিকরা বলবেন, স্পেনের মাটিতে ব্রিটিশ সেনাপতি ওয়েলিংটনের উপস্থিতির পর নেপোলিয়ন একটু ধৈর্য দেখাতে পারতেন। পরিস্থিতির সম্যক বিশ্লেষণ করতে পারতেন। কারণ, পরিস্থিতির গভীরতা ছিল ভিন্নতর। কিন্তু নেপোলিয়ন সেটা না করে দ্বিগুণ উৎসাহে ইংল্যান্ডকে স্পেনের মাটিতে পরাস্ত করার উদ্যোগ নিলেন। একনায়ক কখনও আত্মবিশ্লেষণ করে না। একনায়ক নিজে যেটা ঠিক করে সেটাকে একমাত্র সত্য বলে গ্রহণ করে। তাকে পরিবেষ্টিত পারিষদবর্গ সেই সত্যকে চরম সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে, একনায়কের ভেতর মূল্যায়ন, আত্মজিজ্ঞাসা থাকে না। সেই কারণে এরা ভাঙলেও মচকায় না। 

দেখাই যাচ্ছে, একটা সংখ্যালঘু সরকার, যেখানে প্রধান দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই! কিন্তু কে বলবে? গরিষ্ঠতা থাকাকালীন যে সমস্ত প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলি সেই প্রধান দলের অধিকারে ছিল, সংখ্যালঘু হওয়ার পরেও কোনও দফতরই একনায়ক শরিক দলকে দেয়নি। নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এটা কোনও আত্মিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না। সবাইকে নিয়ে চলার বা জোট ধর্মের ইঙ্গিতও নয়। মুখে বলছে বটে এনডিএ'র কথা, কিন্তু বাস্তবে সে নিজের ইচ্ছাতেই চলে। এই যে এত বড় দেশ জোড়া জাতীয় স্তরে পরীক্ষা দুর্নীতি, শত সহস্র কোটি টাকার স্ক্যাম, যথাপুর্বং প্রধানমন্ত্রী মৌন। কোনও বিচলিত বোধ তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। খোদ রাম মন্দিরের ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ছে, সদ্য নির্মিত রামপথে ধ্বস নেমেছে, মালগাড়ি এক্সপ্রেস'এর মাথায় চাপছে; পাশাপাশি, সবে মাত্র মার্চ মাসে ভোটের আগে লোক দেখানো বিমানবন্দর ও সম্প্রসারণের উদ্বোধন করলেন তিনি, জব্বলপুর বিমানবন্দর ও দিল্লিতে মাত্র দু' মাসের মধ্যে সে সব ভেঙেচুরে অস্থির। 

জনসাধারণের দেখানো হলুদ কার্ড সত্ত্বেও এসব হচ্ছে। প্রথমে ইডি দিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নাজেহাল করানো। অতঃপর রাইস এভিনিউ কোর্টে অরবিন্দের জামিন যেই মঞ্জুর হল, সেই জামিনকে হাইকোর্টে আটকে দেওয়া হল; শেষমেশ জামিন মঞ্জুরের সম্ভাবনায় ইডি'কে ছেড়ে সিবিআইকে দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করানো হল। বিরোধী কণ্ঠকে নির্মূল করার নির্লজ্জতম প্রয়াস। অনেকেই ভেবেছিলেন, চন্দ্রবাবু নাইডু স্পিকার পদটা দাবি করেছেন, হয়তো এটা নিয়ে মোদি একটু বেকায়দায় পড়বেন। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম মোদি তার নিজের মনোনীত সেই ওম বিড়লাকেই দ্বিতীয়বারের জন্য স্পিকার করলেন। এমনকি স্পিকার তাঁর ভাষণে বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ শানালেন জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পূর্তি স্মরণ করিয়ে। 'তোর বাপ-ঠাকুর্দা জল ঘোলা করেছিল'-- সেই চেনা পরিচিত বিরোধীদের আক্রমণের রাস্তায় চললেন। অথচ বলা উচিত ছিল, শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ যাতে গণতন্ত্রের প্রধান সৌধ পার্লামেন্টের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় তাঁকে সাহায্য করেন। সে পথে স্পিকার, অর্থাৎ, বকলমে নরেন্দ্র মোদি হাঁটলেন না। ২৪০ আসনে জিতে হাবেভাবে মনে হচ্ছে '৪০০ পার'। 

যদি কেউ ভেবে থাকেন, মোহন ভাগবত বা ইন্দ্রেশ কুমারের উপদেশ ও সুবচনকে নরেন্দ্র মোদি এতটুকু গুরুত্ব দেবেন, তাহলে তা ভুল। লক্ষ করবেন, একই পথে একই লক্ষ্যে তিনি এখনও অবিচল। তাঁর মন্ত্রিসভায় একজনও সংখ্যালঘু ইসলাম ধর্মের মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ, মূলগতভাবে তিনি তার কট্টর হিন্দুত্বের পথ পরিবর্তন করবেন না। আর সেই কারণেই মোহন ভাগবত সহ আরএসএস নেতারাও জানেন, শতবর্ষের প্রাচীন আরএসএস দলের বাড়বাড়ন্ত গত ১০ বছরের মোদি জমানায়। অতএব, তাকে গিলতে না পারলেও উগরে দেওয়া সম্ভব নয়। 

সুতরাং, মোদি সরকার দুর্বল, মোদি সরকারের চৈতন্যের পরিবর্তন বাধ্যত হবে, প্রধানমন্ত্রী ব্যাকফুটে-- এসব ধারণা বিশ্বাস করার অর্থ নিজেদের অসহায় প্রতিপন্ন করা। কারণ, একনায়ক ভাঙবে তবু মচকাবে না। বরং আত্মাহুতি তার কাছে শ্রেয় পন্থা, আত্মসমর্পণ কদাপি নয়। তাই বিরোধী জোট ইন্ডিয়া যেন কখনই এই সরকারের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, এখন মাত্র সময়ের অপেক্ষা, এমন আত্মতুষ্টিতে না ভোগে। 

আগামী রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনগুলি বিরোধী জোটের কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। যে কোনও মূল্যে ঐক্য রক্ষা করে স্বৈরাচারী মোদি সরকারকে রাজ্যে রাজ্যে রুখে দিতে হবে। অন্যথায় মানুষ লোকসভা নির্বাচনে যে মেজাজ ও স্পিরিট দেখালেন তাকে অমর্যাদা করা হবে। তাঁরা হতাশ হবেন। কে না জানে হতাশা থেকেই প্রতিক্রিয়ার শক্তির প্রত্যাবর্তন হয় নবতর শক্তিতে। মনে রাখতে হবে রজনী পাম দত্তের সেই ঐতিহাসিক উক্তিটি-- ফ্যাসিস্ট শৃগাল কখনই শ্রমিক শ্রেণির সিংহবিক্রমকে আঘাত করতে পারেনি; শ্রমিক শ্রেণি যখন সংসদ-সর্বস্ব কমিউনিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ভ্রান্ত রাজনীতির শিকার হয়ে আহত ও হতাশ, তখনই ফ্যাসিস্ট শৃগাল সেই আহত সিংহকে আক্রমণ করেছিল।


Friday 28 June 2024

হকার উচ্ছেদের প্রশ্নই নেই!

সদর দফতরে কামান দাগো?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর কিছুদিন পরেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ডাকেন। সেই বৈঠকে কিছু উষ্মা প্রকাশের পর আবারও ২৪ জুন তিনি আরেকটি এমনতর বৈঠক ডেকে প্রায় রুদ্র মূর্তি ধারণ করে নিজ দল, সরকার, আমলা, পুলিশ কাউকেই রেয়াত না করে কতকগুলি অপ্রত্যাশিত কথা বলেন ও নির্দেশ দেন। প্রকারান্তরে, তিনিই বিরোধীপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং সরকার-বিরোধীরা যে কথাগুলি প্রায়ই বলে থাকেন, সেগুলির অনেকাংশকে তিনিও অবলীলায় মান্যতা দিয়ে প্রশাসনকে দ্রুত বিহিতের নির্দেশ জারি করেন।

নিঃসন্দেহে এ এক অভিনব ঘটনা এবং বিরোধীরা এমত পরিস্থিতিতে ‘কী কর্তব্যম’ বুঝে উঠতে না উঠতেই পরের পর প্রশাসনিক স্তরে নির্দেশানুযায়ী অ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। হাওড়ায় নথিভুক্ত বেআইনি বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হওয়ার পাশাপাশি ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে সরকারি জমি হস্তগত করে ব্যবসা চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি। তারাতলায় সরকারি জমি ও বেহালা ম্যানটনে রাস্তার ওপর যথাক্রমে বিজেপি ও তৃণমূলের পার্টি অফিস বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, সারা রাজ্য জুড়েই রাস্তা ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে ব্যাপক পুলিশি অভিযান শুরু হয়। দেখা যায়, পুলিশ কিছু কিছু জায়গায় বুলডোজার দিয়ে অস্থায়ী দোকান ভেঙে ফুটপাথ ও রাস্তাকে দখলমুক্ত করে। অন্যত্র, হকারি আইন মেনে রাস্তার অংশ দখল না করে ফুটপাথের এক-তৃতীয়াংশে যাতে হকাররা সীমাবদ্ধ থাকেন, তার জন্য পুলিশ মাইকিং ও পুশব্যাক করে। বুলডোজার চালানোর ঘটনা অনভিপ্রেত ছিল এবং তা নিয়ে হকার সংগঠনগুলি সোচ্চার হলে মুখ্যমন্ত্রীও সমস্ত ঘটনাক্রমকে ফের পর্যালোচনার জন্য ২৭ জুন আবার নবান্নে বৈঠক ডাকেন। এবারের বৈঠকে হকার ইউনিয়নের প্রতিনিধিদেরও উপস্থিত থাকতে বলা হয়।

২৭ জুনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, পুলিশ ও নেতারা পয়সা খেয়ে হকার বসাবে তারপর আবার বুলডোজার দিয়ে তাদের উচ্ছেদ করবে, তা চলতে পারে না। তিনি আশ্বাস দেন, কিছু কিছু হকার যারা উচ্ছেদ হয়েছেন তাদের আবারও নিয়ম মেনে বসার অনুমতি দেওয়া হবে। হকার ইউনিয়নগুলির আবেদনে তিনি তাদের ও প্রত্যক হকারকে এক মাস সময় দেন যাতে তারা ফুটপাথে তাদের পসরা নিয়ে আইন মোতাবেক এক-তৃতীয়াংশেই তাদের হকিং’কে সীমাবদ্ধ রাখেন এবং কোনও অবস্থাতেই রাস্তার ওপর নেমে না আসেন। এই বিধি কার্যকর করার জন্য তিনি একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি করে দেন যেখানে হকার ইউনিয়নের প্রতিনিধিদেরও রাখা হয়। এক মাস পর তিনি পুরো বিষয়টা আবার পর্যালোচনা করে দেখবেন কোথাকার জল কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।

ইতিমধ্যে গোদি মিডিয়া ও একশ্রেণির অন্ধ বিরোধীরা অতি উল্লাসে ‘হকারদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে’ বলে বাজারে রোমহর্ষক সব বয়ান ছাড়তে শুরু করেন (অল্প কিছু জায়গায় অবশ্য উচ্ছেদ হয়), যা হকারেরাই বিনা দ্বিধায় বাতিল করে দিয়েছেন। পুলিশের অনাবশ্যক অতি-সক্রিয়তায় কিছু জায়গায় বুলডোজার চালানোর ঘটনাকে হাতিয়ার করে তারা এই রব তুলে সর্বত্র যে অতি-নাটক তৈরি করতে চেয়েছিল তা তেমন কাজে আসেনি। যেখানে যেটুকু বুলডোজার চলেছে তা অন্যায় এবং নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি। ২৭ জুনের বৈঠকে তা পরিষ্কার করে দেওয়া হয় এবং তারপর আর তেমন ঘটনা দেখা যায়নি।

গত তিন-চারদিন তথাকথিত হকার উচ্ছেদের ডামাডোলে ২৪ জুনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর যে রুদ্র রূপ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল এবং তিনি যে সমস্ত সমস্যা ও সে সবের নিদানের কথা পেড়েছিলেন, তা যেন কতকটা চাপা পড়ে যায়! তিনি শুধু হকার সমস্যা বা ফুটপাথ ও রাস্তা দখল নিয়ে কথা বলেননি। আরও ভয়ঙ্কর সব সমস্যার কথা বলেছিলেন যা রাজ্যকে জেরবার করে দিচ্ছে। তিনি বলেছিলেন বালি মাফিয়া, কয়লা মাফিয়া, জমি মাফিয়া, পৌরসভার পরিষেবায় ঘাটতি, নেতা ও পুলিশের তোলা আদায়, বেআইনি নির্মাণ, সরকারি জমি দখল, জনপ্রতিনিধিদের উন্নাসিকতা ও টাকা কামানো, কাটমানি ইত্যাদি ইত্যাদি হরেক সমস্যা নিয়ে, যা জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। মুখ্যমন্ত্রীর দিক থেকে প্রশ্নটা ছিল, জনপ্রকল্পের এত সুবিধা দিয়েও এবং রাজ্যের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানারকম উন্নতি সত্ত্বেও কেন দুর্নীতি ও নেতাগিরি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কালিমা বয়ে বেড়াতে হবে! নিঃসন্দেহে, নিজের সরকার ও দলের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্বেগ, উষ্মা ও প্রতিবাদ, পরিপ্রেক্ষিত ও মতাদর্শগত ভিন্নতা থাকলেও, আমাদের মনে করাতে পারে ১৯৬৬ সালের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের’ সেই অমোঘ রণধ্বনিটি: সদর দফতরে কামান দাগো!  

বলাই বাহুল্য, এবারের লোকসভা নির্বাচন তৃণমূল দলের পক্ষে কঠিন লড়াই ছিল। দুর্নীতির অভিযোগে জেরবার, ইডি-সিবিআই’এর খানা তল্লাসি ও নেতাদের গ্রেফতারি বা নিত্য তলব, আদালতে ক্রমাগত হেনস্থা (ইচ্ছাকৃত) বা হার (আইন মোতাবেক), নেতাদের মাস্তানি (সন্দেশখালি), গোদি মিডিয়ার চিল-চীৎকার— এইসব নানাবিধ সাঁড়াশি আক্রমণের বিরুদ্ধে তৃণমূলের পক্ষে লড়াই দেওয়াটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তবুও তারা আশাতীত ভাবে উতরে গেল বিশেষ দুটি কারণের জন্য- এক) ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি সরকারি জনপ্রকল্পগুলি মানুষের জীবন-জীবিকার পক্ষে ছিল এবং দুই) সরকারের সার্বিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যও মন্দ কিছু ছিল না। নীতি আয়োগ’এর দারিদ্র্য সংক্রান্ত একটি তালিকায় দেখা যাচ্ছে, multi-dimensional poverty সূচকের (২০২৩) নিচে সারা দেশে বসবাসকারী জনসংখ্যার শতকরা ভাগ যেখানে ১১.২৮, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে তা ৮.৬ শতাংশ; উন্নয়নের এত ঢাকঢোল পিটিয়েও গুজরাতে তা ৯.০৩ শতাংশ। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে গুজরাতে দারিদ্র্য বেশি। উপরন্তু, পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি (বা রাজ্যের আয়) বাড়ছে এবং ঋণ ও আয়ের অনুপাত সহনশীল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, যদিও বিপদ একেবারে কেটে গেছে তা বলা যাবে না।

তবুও, রাজ্যে মোটামুটি শক্তপোক্ত একটা অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে এবং সৃজনশীল জনপ্রকল্পগুলির কার্যকারিতা ও জনপ্রসার সত্ত্বেও শহরাঞ্চলে তৃণমূলের ভোট তেমন আশাপ্রদ নয় কেন? এই প্রশ্নটি তৃণমূল নেতৃত্বকে ভাবিয়েছে। প্রথমত, ধর্মান্ধগত কারণে উচ্চবিত্ত ও উচ্চবর্ণের ভদ্দরলোকেদের একটা অংশ এবারে বিজেপি’কে ভোট দেওয়ার কথা ভেবেছিল। তা ব্যতিরেকে, দ্বিতীয়ত, শহরাঞ্চলের আরেকটি বড় অংশ এবারে তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল মূলত দুর্নীতি, নেতাদের দাদাগিরি ও পৌরসভাগুলির নানারকমের ব্যর্থতার কারণে। শিক্ষায় চূড়ান্ত ও ব্যাপ্ত দুর্নীতি এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য শিক্ষকদের দিনের পর দিন রাস্তায় বসে থাকা ও হয়রানি, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তার ওপর বহু স্থানীয় নেতাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া থেকে তাদের ঔদ্ধত্য ও দাদাগিরি সাধারণ মানুষ ভাল ভাবে নেয়নি। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাট, আলো, নিকাশি, পানীয় জল সরবরাহ সহ নানারকম পরিষেবায় ঘাটতি এবং প্রোমোটারদের তাণ্ডব ক্রমেই বেড়ে ওঠায় মানুষের একটা বড় অংশ বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। দুর্নীতি ও জনপরিষেবায় অবহেলা যে পার্টির বিপুল ক্ষতি করছে তা তৃণমূল নেতৃত্ব দেরিতে হলেও বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। আর সেই উপলব্ধি থেকেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজ দল ও সরকারের বিরুদ্ধেই কামান দেগেছেন, যা এক অর্থে হয়তো যথার্থ। তৃণমূলের আরেক নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন-- perform or perish

এখন প্রশ্ন হল, রোগটাকে তো ধরা গেল! ইলাজ হবে কী? এই প্রশ্নের দুটো পরিপ্রেক্ষিত আছে। বলা ভাল, দুটি বিপরীতধর্মী মত প্রবহমান। প্রথমটি হল, তৃণমূল দল ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একবারেই না দল, না মনুষ্য পদবাচ্য বলে গণ্য করা। কট্টর একদল স্বঘোষিত পণ্ডিত, বোদ্ধা ও অত্যন্ত ‘নিপাট’ ভদ্দরলোক ধরনের কিছু মানুষ আছেন যারা এই মতে অন্ধ-বিশ্বাসী এবং মমতা কীভাবে তিন মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রিত্বের কাল সত্যি সত্যিই পূর্ণ করতে চলেছেন, তা ভেবে ভির্মি যান। তারা শয়নে-স্বপনে মমতা-ফোবিয়াতে ত্রস্ত। এরা ক্রমেই সংখ্যালঘু ও অপাংক্তেয়। কিন্তু দ্বিতীয় মতটি নানারকম। মমতা-ভক্ত একদল আছেন, তাদের কথা সরিয়ে রাখলে এই মতের গোত্রে আরেকটি বেশ জোরালো প্রবাহ আছে যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অত্যন্ত শক্তিশালী ও পরিণত রাজনৈতিক নেত্রী বলে গণ্য করেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি এ রাজ্যে শুধু নন, গোটা দেশেই এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির ধারা প্রবর্তন করেছেন। ব্রাত্য বসুর মতো নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লাতিন আমেরিকার বাম ঘরানার নেতৃত্বের সঙ্গে তুলনায় রাখতে চান। আজ ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’এর অনুসরণে দেশের অন্যত্র ‘লাডলি বহিন’, ‘মহালক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ ইত্যাদির চল হয়েছে। অবশ্য, তার মানে এই নয় যে তিনি সমালোচনার উর্ধ্বে। দেখা গেছে, রাজ্যে গণতন্ত্রের প্রশ্নে বা বিরোধী মতামত প্রকাশের প্রতি তাঁর দল ততটা উদার নয়। এতদিন দুর্নীতির প্রশ্নেও তাঁর দল দায়ে না পড়লে নীরব থাকারই পথ নিয়েছিল। আজ হয়তো নির্বাচনের ফলাফলে কিছুটা ধাক্কা খেয়ে তারা নিজেদের সংশোধন করে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সেও ভাল কথা! ভোটের ফলাফল যদি রাজনৈতিক দলগুলিকে সদর্থক করে তুলতে পারে, তার থেকে ভাল জিনিস আর কী হতে পারে!

এখন দেখার, নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রী যে কামান দেগেছেন তার গোলাগুলি সত্যি সত্যিই রাজ্যের অনাচার-অপকর্মকে বিধ্বস্ত করতে পারে কিনা! আশা ও নিরাশা দুইই রইল!          

Monday 17 June 2024

অর্থনীতি চিন্তার অম্লান ধারা

শতবর্ষ ছুঁয়ে

সৌভিক দত্ত


( ১৭ জুন ১৯২৪ - ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০)

কোনও কোনও অর্থনীতির পড়ুয়া বিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী, কেউ বা কলা বিভাগের। কে কোন ডিগ্রি পাবেন তা নির্ভর করে তিনি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করলেন তার ওপর। অর্থাৎ, অর্থনীতি একটি বিজ্ঞান নাকি তার স্থান মানব বিদ্যার অঙ্গনে সেই তর্ক এখন‌ও অমীমাংসীত। তবে অর্থনীতি অধ্যয়ন যত গাণিতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মডেল নির্ভর হচ্ছে তত‌ই বোধহয় পোক্ত হচ্ছে একে বিজ্ঞান বলে মনে করবার প্রবণতা। একটি গাণিতিক মডেলের সাহায্যে নিজের মতকে প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে  কুলীন অর্থনীতিবিদদের একাডেমিক  সমাজে কল্কে পাওয়া কঠিন। এমনকি বিশ্বের সেরা শিরোপা নোবেল পুরস্কারও 'প্রাইজ অন ইকনমিক সায়েন্সেস' বলে দেওয়া হয়। মূলধারার অর্থনীতি চর্চা এখন অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক ও টেকনিক্যাল। কিন্তু শাস্ত্র হিসেবে অর্থনীতি যত নৈর্ব্যক্তিক হচ্ছে, তত্ত্ব, মেথডোলজি, পরিসংখ্যান, রাশি বিজ্ঞানের মডেল, সূচকের পরিমাপ ইত্যাদির ওপর যত জোর পড়ছে,  তত তা বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে! তত‌ই তার কেন্দ্র থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে না তো? এমন একটা শঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুকাল। 

তবে সুখের কথা, এমন কিছু কৃতী ও সার্থক অর্থনীতিবিদ আছেন যাঁদের চিন্তার কেন্দ্রস্থলে ব্যক্তি মানবের স্থান অবিচল থেকেছে। মানুষকে তাঁরা অর্থনীতির পরিভাষায় কেবল ইকনমিক এজেন্ট বা উৎপাদনের উপকরণ ভাবেন না, অর্থনীতির অর্থ যাঁদের কাছে কেবল কতকগুলো অপটিমাইজেশন এক্সারসাইজ নয়। মানুষের কল্যাণ চিন্তা অগ্রাধিকার পেয়েছে, এমন একটা অর্থনীতি চর্চার ঐতিহ্যও আমাদের সামনে রয়েছে। এ দেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও রয়েছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক অম্লান দত্ত ছিলেন অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু, প্রণব বর্ধন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, জঁ দ্রেজ প্রমুখদের অগ্রজপ্রতিম। কথাটি বিশেষ ভাবে স্মরণযোগ্য এইজন্য যে, এই ১৭ জুন ২০২৪ অম্লান দত্ত শতবর্ষ পূর্ণ করলেন। 

১৯২৪'এ তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের কুমিল্লা জেলায় তাঁর জন্ম। স্নাতক স্তরে ভর্তি হ‌ওয়ার প্রাক্কালে তাঁর পিতৃদেব তাঁকে ডেকে জানতে চান সে কোন বিষয় নিয়ে পড়বে, কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা। তরুণ পুত্র তাঁর পিতাকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করেন, তাঁর কি কোনও পরামর্শ আছে? পিতা বলেন, তোমার কিছু লেখা আমার হাতে এসেছে। তা পড়ে আমার মনে হয়েছে তুমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার কথা ভাবতে পারো। তুমিও কি তাই ভাবছ? পুত্র বলেন, না আমি অর্থনীতি নিয়ে পড়ব ভাবছি। স্বভাবতই পিতা মন্তব্য করেন, ও, বিষয় হিসেবে ইংরেজির চেয়ে অর্থনীতি তোমার বেশি পছন্দ? পুত্রের জবাব, একেবারেই না। ইংরেজি সাহিত্য আমি নিজে থেকেই পড়ি। ইতিহাস, দর্শন, বাংলা সাহিত্য, ধর্ম এসব বিষয় আমি নিজের প্রাণের টানেই জেনে নেব। কিন্তু বাধ্য না হলে আমি অর্থনীতির পাঠ্যবই  হয়তো হাতে নেব না। অথচ, অর্থনীতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা না থাকলে এই সমাজ আর এই সময়কে জানাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই আমি অর্থনীতি নিয়েই পড়ব ভেবেছি। 

এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে অম্লান-চিন্তায় অর্থনীতি চর্চার তাগিদটা ঠিক কোথায়। তাই অম্লান দত্তের চিন্তাভাবনা অর্থনীতির চেনা পরিসর অতিক্রম করেছে অনবরত। কারণ, অর্থনীতি চর্চা তাঁর কাছে বৃহত্তর মানব চর্চার একটি উপকরণ মাত্র ছিল। অর্থনীতির থিসিস রচনায় তিনি কখনও তেমন আগ্রহ বোধ করেননি। বরং তাঁর পছন্দের কাজ ছিল অর্থনীতি পড়ানো- যেখানে মানুষে মানুষে সংলাপের মধ্য দিয়ে বিষয়টা অনেক জীবন্ত হয়ে ওঠে। উনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন ওনার শিক্ষক বিনয় সরকারের পড়ানোর ধরন, যিনি ক্লাসে এসে অনেকটা এইরকম বলতেন- অ্যাডাম স্মিথ এই বলেছেন, রিকার্ডো এই বলেছেন, মার্কস এই বলেছেন, বিনয় সরকার এই বলছেন, এবার অম্লান কী বলবি বল; ছাত্রের মধ্যে প্রশ্নমুখর, জিজ্ঞাসু মন জাগিয়ে তোলা যে শিক্ষণ পদ্ধতির অন্যতম লক্ষ্য। আবার অম্লানবাবু যখন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নীচু স্বরে পড়াতেন, গোটা ক্লাসে পিন পতনের শব্দ‌ও শোনা যেত- ছাত্ররা উৎকর্ণ হয়ে থাকতেন একটি শব্দ‌ও যাতে হারিয়ে না যায়। 

অম্লান দত্তের ছাত্রদের মধ্যে অনেকের‌ই তখন বামপন্থার দিকে ঝোঁক। সময়টাই তাই। আবার প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থীরা তাঁকে মনে করতেন ধনতন্ত্রের ধ্বজাধারী। কেমব্রিজের বিশিষ্ট মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ মরিস ডবের সঙ্গে তাঁর সে আমলে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিতর্ক সেই ধারণায় পাকা সিলমোহর বসিয়ে দিয়েছিল। অম্লান দত্তের প্রথম প্রকাশিত যে গ্রন্থ 'ফর ডেমোক্রেসি' যা পড়ে আইনস্টাইন, রাসেলের মতো বুদ্ধিজীবীরা চিঠি লিখে স্বতংস্ফূর্ত অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তাও ছিল স্তালিনীয় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের পক্ষে জোরালো সওয়াল। অম্লানবাবু আজীবন সোভিয়েত ব্যবস্থার কঠোর সমালোচক ছিলেন এবং এ ব্যবস্থা দীর্ঘকাল টিকতে পারে না এই মত পোষণ করতেন। অম্লান দত্তের ছাত্র বামপন্থী অর্থনীতিক রতন খাসনবীশ সম্প্রতি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানিয়েছেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার অব্যবহিত পরে অম্লানবাবুর বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে বামপন্থার এই বিপর্যয়ে নিশ্চয়‌ই তিনি খুশি হয়েছেন। তাঁকে অবাক করে দিয়ে অম্লানবাবু বলেন যে না, তিনি হননি। অনেক মানুষের মতো তাঁর মনেও একটি সাম্যবাদী স্বপ্ন সযত্নে লালিত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যবস্থায় সেই স্বপ্নের একটি নিপীড়িত প্রতিমূর্তি (অম্লান দত্ত বোধহয় 'tortured embodiment of that dream' কথাটা ব্যবহার করেছিলেন) দেখে তিনি তার বিরোধিতা করতেন মাত্র।

অর্থাৎ, মুনাফা সর্বাধিকীকরণ সর্বস্ব যে মূলধারার ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চর্চা, তাকেই অম্লান দত্ত একমাত্র সত্য বলে মানেননি। বরং তাঁর মনোযোগ বিকল্পের সন্ধানে বারবার আকৃষ্ট হয়েছে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্মধারার দিকে। প্রথাগত অর্থে অর্থনীতির স্বীকৃত তাত্ত্বিক না হলেও এই দুই মনীষীর মানুষের আত্মশক্তি জাগিয়ে তুলে সামাজিক সহযোগের পথে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রয়াসকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার যোগ্য মনে করেছেন‌। এই বিপুল বিশ্বে সর্বত্র এক মাপে প্রযোজ্য এমন দুনিয়া জোড়া একমাত্রিক মতবাদ গড়ে তোলা কতদূর সঙ্গত এ প্রশ্ন তিনি তুলেছিলেন। এই দিক থেকে তাঁর কাছে শান্তিনিকেতনের চেয়ে শ্রীনিকেতনের মূল্য কম নয়। যেমন তাঁকে উজ্জীবিত করে তুলত রবীন্দ্র প্রেরণায় প্রাণিত পান্নালাল দাশগুপ্ত বা নিরঞ্জন সান্যাল বা অশোক ঘোষের স্বকীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। আশু লক্ষ্যে বা কর্মসূচিতে তাঁরা অভিন্ন নয়, কিন্তু সর্বত্র একটা মিল হচ্ছে, যে কোনও অচল বৃহৎ নীতির দাস না হয়ে স্থানীয় সমস্যায় স্থানীয় মানুষকে সামিল করে স্থানীয় সমাধান খোঁজা। এইসব ছোট ছোট স্থানীয় উদ্যোগ নিয়ে তিনি মনে করতেন সেখানে পরীক্ষার পরিসর ছোট বলে ভুল হলেও তাও হবে ছোট মাপের। আর যদি সফল হয়, তাকে ঘিরে তৈরি হবে অনুরূপ উদ্যোগ। 

ইতিহাস সাক্ষী, কেন্দ্রীয় কোনও গ্র্যান্ড এক্সপেরিমেন্টের বড় বেশি মূল্য চোকাতে হয়। সমাজতন্ত্র সরাসরি কেন্দ্রীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে। আবার ধনতন্ত্র যত‌ই বাজার নির্ভর প্রতিযোগিতার কথা বলুক, দেশে দেশে অভিজ্ঞতা দেখায় যে মুনাফা বৃদ্ধির দৌড়ের একচেটিয়া কারবারের দিকে ঝোঁকটা স্পষ্ট। এটা তাঁর সময়ে রবীন্দ্রনাথ‌ও লক্ষ করেছিলেন যে কেন্দ্রিকতা ও রাষ্ট্র নির্ভরতা অতি বৃদ্ধির ফলে সমাজের নিজস্ব সৃজন শক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে। প্রাচীন সমাজ যখন এত পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েনি তখন, তাঁর ভাষায়, 'দেশের রাজা অন্যমনস্ক হ‌ইলে দেশের জল পাত্র একেবারে রিক্ত হ‌ইয়া যাইত না।' সমাজ রাজাকে শুধু পিটিশন লিখে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে নিজে কূপ খননে প্রবৃত্ত হত। 

কেন্দ্রীকরণের সমস্যা বোঝাতে গিয়ে অম্লানবাবু ব্যবহার করেছেন আমাদের রাজ্যের উদাহরণ। কলকাতা এ রাজ্যের প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র, প্রশাসনিক কেন্দ্র আবার শিক্ষাকেন্দ্রও। এই ত্রহ্যস্পর্শ ভালো হয়নি। এটি অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত। যেমন আমেরিকায় ব্যবসা কেন্দ্র ন্যুইয়র্ক, রাজধানী ওয়াশিংটন, আর শিক্ষাকেন্দ্র ক্যালিফোর্নিয়া সহ নানা স্থানে বিস্তৃত। ফলে, সব রক্ত সেখানে এক স্থানে এসে জমা হয়নি। এমনকি প্রতিবেশী পাকিস্তানেও লাহোর, করাচি, ইসলামাবাদ তিন ধরনের কেন্দ্র। কিন্তু কলকাতা সব কিছুর কেন্দ্র হয়ে ওঠায় এই অতিস্ফীত মহানগরী নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর পরিকাঠামোগত উন্নতি ও রূপসজ্জার জন্য যদি হাজার হাজার কোটি টাকার পরিকল্পনা গ্রহণ করাও হয়, তবু দুটো প্রশ্ন থেকে যায়। 

প্রথমত, সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে যেখানে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার অভাব সেখানে সরকারের সিংহভাগ সম্পদ শুধু রাজধানীর উন্নতিকল্পে ঢালাটা কতদূর সঙ্গত! দ্বিতীয়ত, রাজ্যের অন্যান্য জায়গার সঙ্গে কলকাতার সমস্ত দিক থেকে ব্যবধান আরও বেড়ে গেলে আরও বেশি বেশি সংখ্যক মানুষ গ্রাম ছেড়ে কলকাতা মুখি হয়ে পড়বে। তাই অম্লানবাবুর পরামর্শ, খুব সচেতন ভাবেই কলকাতা ব্যতিরেকে বাংলার অন্যান্য স্থানে শিক্ষা, প্রশাসনের প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হোক। এতে কলকাতাবাসী মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভ্যস্ত ছকে বাঁধা জীবনে কিছু সাময়িক ব্যাঘাত ঘটবে কিন্তু তাঁর মতে সেটাই পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের জন্য সুপথ। তাঁর বক্তব্য, 'কলকাতা উদাহরণ মাত্র। প্রয়োজন পরিকল্পিত বিকেন্দ্রীকরণের। কয়েকটি গ্রামের কেন্দ্রে একটি স্থানীয় বাজার ও ছোট শহর; কয়েকটি ছোট শহরের কেন্দ্রে একটি মাঝারি শহর; এইভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রাম ও শহরের বিন্যাস ও উন্নয়ন সম্ভব। ...কৃষিতে নিযুক্ত মানুষদের একটা বড় অংশকে গ্রামীণ শিল্পে অথবা কৃষির বাইরে অন্য কোনও উৎপাদক কাজে নিয়ে আসতে হবে তা ন‌ইলে গ্রামের আর্থিক সমস্যা ঘুচবে না। কয়েকটি গ্রামের বাইরে যে ছোট শহর সেখানেও সেই শিল্পের সংস্থান হতে পারে। বিকেন্দ্রীকৃত শিল্পায়নের জন্য ব্যাঙ্কের ঋণ নীতি ও পদ্ধতির যেমন পরিবর্তন চাই তেমনি গবেষণার সংগঠনে ও সমস্যার নির্বাচনে নতুন উদ্দেশ্যের প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন। পরিকল্পনার এক একটি বৃত্ত তৈরি হতে পারে কিছু গ্রাম ও বাজার সহ ছোট শহর নিয়ে। এক বৃত্তের সঙ্গে বৃহত্তর বৃত্তের যোগ ঘটিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারি জাতীয় অর্থনীতির দিকে। আর্থিক ও সামাজিক ক্রিয়াকর্মের এইরকম একটা রূপরেখার ইঙ্গিত ছিল গান্ধীর চিন্তা ও রচনায়। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই পল্লীকে ভিত্তি হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁদের আদর্শ সমাজের সংগঠনের চিত্রটি দেশের সামনে তুলে ধরেছিলেন। এর‌ই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এঁরা শিক্ষার‌ও রূপায়ণ করেছিলেন। দেশের সঙ্গে নব মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতা থেকে উত্তরণের পথ এই।'

এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই সুপারিশ আমাদের আধুনিক জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কতদূর সঙ্গতিপূর্ণ? তাই বোধহয় তিনি বলছেন, 'এইখানে এসে যায় একটা জীবনদর্শনের কথা, যা থেকে অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে পরিণামে বিপত্তি ঠেকানো যায় না। আধুনিক অর্থবিজ্ঞানের ভিত্তিতে আছে উপযোগবাদ বা সুখবাদ। উপযোগবাদের প্রধান দুর্বলতা বোধকরি এই যে, সুখ জিনিসটাকে সে খণ্ড খণ্ড করে দেখে। তাতে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সুখের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বড় হয়ে ওঠে, মানুষে মানুষে আনন্দের পরিপূরকতা তেমন স্বীকৃতি পায় না। অবশেষে সমাজের সংহতি বিপন্ন হয়।'

আজ প্রচলিত পথে হেঁটে জলবায়ু পরিবর্তন, আর্থিক অসাম্য, বেকারত্ব ও আঞ্চলিক বৈষম্য প্রসূত গণ পরিযাণ ইত্যাদি সমস্যায় আমাদের গোটা অস্তিত্ব‌ সত্যিই বিপন্ন তখন অর্থনীতি চিন্তার এই বিকল্প ধারাকে একবার পরীক্ষা করে দেখার সময় এসেছে। গঠনমূলক, কল্যাণকর এই ক্ষীণতণু ভাবনার ঐতিহ্য শতবর্ষ পেরিয়ে চির অম্লান হোক।


Wednesday 12 June 2024

জনতার হলুদ কার্ড

আগামী লোকসভা নির্বাচন কি নিকটেই?

মালবিকা মিত্র



'আপনারে স্থাপিয়াছো, জগতের দেবতারে নহে।' 

সাধু নরোত্তমের এ হেন কথাকে রাজা 'নাস্তিকের মত কথা কহ' বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের রাজামশাই হলে বলতেন, পাকিস্তানির মতো কথা বলো শুনি; তারপর সোজা পাকিস্তানেই চলে যেতে বলতেন। 

আসলে কবিতার রাজার সঙ্গে আমাদের বর্তমান রাজার বড় পার্থক্য আছে। আমাদের রাজা নিজেই পরমাত্মার অংশ। তিনি পরমাত্মার বাণী বাহক। পুরীর জগন্নাথ প্রভু স্বয়ং আমাদের 'রাজা'র ভক্ত'। আর তাই গল্পটা এখানে একটু ভিন্নতর হল-- রাম মন্দিরের বিগ্রহ খোদ রামলালাই রাজাকে, মানে রাজার দলকে, অযোধ্যা থেকে বিতাড়ন করলেন। এমনকি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যেই রাজশক্তির দর্প চূর্ণ হল। অযোধ্যা তার ইতিহাসকে স্মরণ করালো-- বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির রাজনৈতিক তরজাই এখানে সব নয়। অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে কত না দরগা, মাজার। বড়ি বুয়ার দরগা, ন’গজী কিংবা আড়গড়া মাজার। হিন্দু-মুসলিম দু' পক্ষই সেখানে অসুস্থ সন্তানের আরোগ্য কামনায়, বিয়ের পর প্রার্থনা জানাতে হাজির হন। কোনও মসজিদে খাদিম হিন্দু, কোথাও আবার নিরামিষ রান্না। ফলত, সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার অযোধ্যা রাজশক্তিকেই প্রত্যাখ্যান করল। 

আমাদের রাজা স্বঘোষিত বিশ্বগুরু। ২০১৪ সালের পর বিশ্ববাসী ভারতকে চিনলো, জানলো। এমনকি রিচার্ড অ্যাটেনবরোর 'গান্ধী' ছবির আগে বিশ্ববাসী গান্ধীজীকেও চিনত না। এ হেন পরমাত্মার দূত ১ জুন বিকেলে কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ শিলায় ধ্যান ভঙ্গ করে রাজধানী ফেরার পথে বিমানে বসে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠি তো নয়, যেন বিদায়ী ভাষণ। লিখলেন, ভারতের জাতীয় আন্দোলন সেই কোন যুগ থেকে সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে থেকেছে, সেইসব কথা। সবই আবেগ? না বাবা না, খুব ভেবেচিন্তে হিসেব কষে। রাজামশাই ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি আর সিংহাসনে ফিরবেন না। তাই অনেক কথা বলে ফেলেছেন আবেগ ঘন বক্তৃতার ঢঙে। 

আরও বহু কিছুই বেমানান লাগছে আমাদের কাছে। যে মোদীজী এতদিন তাঁর সমস্ত বাচনে এনডিএ তো ননই, এমনকি বিজেপিও ছিলেন না, সর্বক্ষণ নিজেই নিজেকে 'মোদি' বলে সম্বোধন করে বক্তৃতা দিতেন, সেই ওনার শেষমেশ কী হল? মোদির গ্যারান্টি, এটা মোদি বলছে, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, মোদি এসব অন্যায় সহ্য করবে না, মোদি জেলে ঢোকাবে-- এভাবেই উনি কথা বলতেন। উনি আত্ম'কে হারিয়ে মোদিতে মুগ্ধ। উনি কখনও আমি নন, সর্বদাই মোদি। আর সেই মোদিজী কিনা ভোটের ফল প্রকাশের পর সংসদের সেন্ট্রাল হলে দলীয় সাংসদদের সভায় একবারও মোদি বা বিজেপি'র নাম উচ্চারণ করলেন না! সারাক্ষণ এনডিএ আর এনডিএ  ও এনডিএ বলে গেলেন। জহরলাল নেহেরুর পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড তিনি স্পর্শ করেছেন; আত্মগর্ব ও অহমিকায় তৃপ্ত। কিন্তু দুই বগলে দুটি ক্র্যাচ-- নাইডু ও নীতিশ। রেকর্ড স্পর্শ করেও রেকর্ড কিন্তু অধরাই থেকে গেল। শুধু কি তাই, কেউ কেউ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, নীতিশ-নাইডু, একনাথ আর চিরাগের চার কাঁধে তোলা খাটিয়ায় তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। 

এবারের এই নির্বাচনী ফল একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। যোগেন্দ্র যাদব, পরকলা প্রভাকর তো অনেক আগেই বুঝেছিলেন এবারের নির্বাচন ছিল সাধারণ মানুষের। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দেশের মহিলা কুস্তিগীরদের প্রতিবাদ যেভাবে দ্রুত গণ চরিত্র নিল, তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে যে দীর্ঘায়ত গণঅভ্যুত্থান, সিএএ-এনআরসি নিয়ে যে ব্যাপক গণজমায়েত, সেগুলো কি কিছুই বার্তা দেয়নি? বিনা প্রস্তুতি ও আগাম সর্তকতা ছাড়াই লকডাউন ঘোষণা, লক্ষ লক্ষ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ ও প্রাণহানি, এসব তো কিছু পূর্বাভাস দিয়েছিল, আমরা শুনতে পাইনি। মনে পড়ছে, 'রক্তকরবী'তে রবীন্দ্রনাথ বিদ্রূপের সুরে বলেছিলেন, ঘোর বর্ষায় প্রেমিক ব্যাঙ তার প্রেমিকাকে সশব্দে চিৎকার করে আহ্বান করে মিলনের আকাঙ্ক্ষায়। দুঃখজনক সত্য হল, প্রেমিকার কানে সেই আহ্বান যথাযথ না পৌঁছলেও ঢোঁড়া সাপের কানে তা বিলক্ষণ পৌঁছয়। দেশের মানুষ ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। সেই ২০১৪ সালের পর থেকে তাঁদের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ তাঁরা প্রকাশ করতে পারেননি। ২০১৯'এর ভোট পুলওয়ামা, বালাকোট আর মোমবাতি মিছিলেই উদ্ধার হয়ে গেল। মানুষের ভেতর জমে থাকা বারুদ প্রকাশ পেল না। বরং তা সুদে মূলে বৃদ্ধি পেল। সেই পুঞ্জীভূত অসন্তোষ ২০২৪'এর নির্বাচনে প্রকাশ পাবে এটা জানাই ছিল । 

কিন্তু বিরোধী নেতারা এটা বুঝলেন না। কর্নাটকের নির্বাচনী সাফল্য প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসকে আত্মতুষ্ট করে তুলল। ফলে, পরবর্তী পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনকে মুখে সেমিফাইনাল বলে ঘোষণা করলেও, বাস্তবে এককভাবে কংগ্রেস লড়াই করল ও কার্যত পর্যুদস্ত হল। নেতারা মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে ব্যর্থ হলেন। রাজ্যে রাজ্যে যথাযথ জোট গঠন হল না। অন্যদিকে মোদি সরকার কর্নাটকের বিপর্যয়ের পর পাঁচটি রাজ্যের ভোটে অতিমাত্রায় সতর্ক হল। ভোটের সাফল্যের ফলে আবার অতিমাত্রায় আত্মতুষ্টিতে ভুগলো এবং ৩৭০ ধারা বাতিল, রাম মন্দির নির্মাণ'এর সুফলেই বৈতরণী পার হবার স্বপ্ন দেখল। শাসক মোদি সরকার তবুও দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিল। প্রথম দফার নির্বাচন ১৯ এপ্রিল সাঙ্গ হবার পরেই ঢোঁড়া সাপের কানে সে বার্তা পৌঁছেছিল। এর ফলে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও দিশাহারা ভাবে মোদি-শাহ এক্স-রে মেশিন দিয়ে সম্পত্তি খুঁজে বের করা, জোড়া মোষের আসন্ন বিপদ, মঙ্গলসূত্র থেকে গো সম্পদ সব মুসলমানরা নিয়ে যাবে, এমন আবোল তাবোল প্রচার শুরু করল যে বোঝাই যাচ্ছিল প্রচারে নিজেদেরই আস্থা নেই। এমনকি নিজেদের পাঁচ ভাইবোনকে ভুলে গিয়ে মোদি বললেন যাদের অনেক বাচ্চাকাচ্চা পয়দা হয়, বলে মুসলমানদের ইঙ্গিত করলেন। নিজেকে পরমাত্মার অংশ বলে নিজেই প্রচার করলেন, সম্বিত পাত্র বললেন জগন্নাথদেব স্বয়ং নাকি মোদিজীর ভক্ত। এই সমস্ত প্রলাপ ও কু-কথায় ভোটের বাজার মুখরিত হল। 

মোদিজীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তিনি বিধ্বস্ত ও আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত পাচ্ছেন। কিন্তু তিনি তো তিনি নন। তিনি হলেন মোদি। আর 'মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়'- এই নিজের তৈরি মিথ্যাকে নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। ফলে, 'না মুমকিন' হওয়া পর্যন্ত এই মিথ বা মিথ্যা চলতে থাকল। অবশেষে এখন সব মিথ ভেঙে এনডিএ জোট সত্য হল। কদিন আগে যদি বিরোধী দলগুলি মানুষের মনোভাবকে অনুভব করতে পারতেন, তাহলে বিজেপি ২৪০ ছুঁতে পারত না। অনেক আগেই থেমে যেত। আমরা রাজনৈতিক নেতারা বহু সময় মানুষের নাড়ির শব্দ শুনতে পাই না। টেবিল-চেয়ারে বসে জোটের অঙ্ক কষি, অফিসে, গৃহে, ঠান্ডা ঘরে সিদ্ধান্ত নিই। টের পাই না মানুষের ইচ্ছা, মানুষের বক্তব্য। মোদিজী, বিজেপি, এমনকি বিরোধীরা কেউ কি ভেবেছিলেন, অযোধ্যা কেন্দ্রে বিজেপির এমন শোচনীয় পরাজয় হবে! 

সুতরাং, ২০২৪'এর লোকসভা নির্বাচনের জনাদেশ সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে তাই নয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকেও হলুদ কার্ড দেখিয়েছে, সাবধান করেছে। বিরোধীরা কি কিছু শিক্ষা নেবেন? মনে তো হয় না। তা না হলে পশ্চিমবাংলায় দলের শোচনীয় পরাজয়ের পর সিপিআইএম পলিটিব্যুরোর নেতা ও রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম কত অবলীলায় বলতে পারেন, আমাদের দলের কেউ 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' নিয়ে কোনও কটূক্তি করেনি। যারা সারা বছর বলে গেল, ভাতা হল ভিক্ষা, তারাই এখন বলছে আমরা ও কথা বলিনি। একবারও বলার সৎ সাহস দেখালো না, ও কথা বলা আমাদের ভুল হয়েছিল। এআইসিসি এখনও স্বীকার করেনি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া কংগ্রেসকে দুটি আসনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসা উচিত ছিল। আলোচনা করে দুইকে চার করা যেত না এমন নয়। কংগ্রেস আলোচনাই চায়নি, কারণ মহম্মদ সেলিম চায়নি। অনিবার্যভাবেই যা হবার তাই হয়েছে। 

আমি নিজে বিশ্বাস করি, পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরি হওয়া ও তৃণমূল দলের হাতে সিপিএম'এর ক্ষমতাচ্যুতি এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে নিহিত আছে এই তিন দলের অনৈক্যের ক্ষেত্র। ঐক্য সম্ভব নয়, কাম্যও নয়। কিন্তু কংগ্রেস ও সিপিআইএম'কে প্রধান শত্রুর প্রতি বর্শামুখ নির্দিষ্ট করতে হবে ও তৃণমূল প্রধান বিরোধী দল এই ধারণা ছাড়তে হবে। তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানাধিকারীকে আগে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে বাংলার রাজনীতির এক গভীর বিপদ আসন্ন। তৃণমূল সরকারের প্রতি মানুষের যে পরিমাণে মোহমুক্তি ঘটবে ও ঘটছে, তারা বিকল্প হিসেবে সামনে বাম বা কংগ্রেসকে না পেয়ে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী বিজেপিকেই বিকল্প হিসেবে খুঁজে নেবে ও নিচ্ছে। কংগ্রেসকেও পুরনো গৌরবময় অতীতকে ভুলে আঞ্চলিক দলগুলিকে সম্মান করতে শিখতে হবে। আরজেডি, সপা, আপ, তৃণমূল, ডিএমকে, জেএমএম, শিবসেনা, এনসিপি, বহু ধারার বাম ও সবাইকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে। এই নির্বাচনে মানুষ যা বলতে চেয়েছিল তা যথার্থভাবে প্রতিফলিত হবে আগামী লোকসভা নির্বাচনে। কে বলতে পারে সেই নির্বাচন খুব বেশি দেরি নেই।


Thursday 6 June 2024

সাধু সাবধান!

ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে আপাতত রোখা গেল

সোমনাথ গুহ



ভারতবর্ষের বুকের ওপর যেন একটা ভারী পাথর চাপা দেওয়া ছিল। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর সাথে সাথে সেই চাপ অনেকটাই মুক্ত হল; দীর্ঘ এক দশক পর মানুষ আবার বুক ভরে শ্বাস নিল, বাবাসাহেব আম্বেদকরের সংবিধান আপাতত রক্ষা পেল, একনায়কতন্ত্রের ভীতিপ্রদ করাল ছায়া অপসারিত হল। প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্তের যে মুখাবয়ব দেশের মানুষের চোখের সামনে দুঃস্বপ্নের মতো বিরাজ করত, তা সকালের সংবাদপত্রে হোক বা ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’এ, অথবা কোভিড শংসাপত্রে, তা থেকেও মুক্তি পাওয়া গেল। এই রায় আশ্বাস দিল যে ভারতের গণতন্ত্র হাজারও দুর্বলতা সত্ত্বেও এখনও যে কোনও বিপদকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম। 

প্রথমেই এই নির্বাচনের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে নেওয়া যাক। অয্যোধ্যা, যা ফৈজাবাদ লোকসভার অন্তর্গত, সেখানে বিজেপির পরাজয় বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা সব সময় বরদাস্ত করে না। রাজস্থানের বাঁশওয়াড়া কেন্দ্রে ভারতীয় আদিবাসী পার্টির প্রার্থী তিন লাখের অধিক ভোটে সঙ্ঘী প্রার্থীকে পরাজিত করে এই বার্তাকে আরও জোরালো করেছে। ভেবে দেখুন, ওই কেন্দ্রেই প্রধানমন্ত্রী মোদী সেই চরম বিভাজনকারী মন্তব্য করেছিলেন: কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মহিলাদের মঙ্গলসূত্র ‘অনুপ্রবেশকারী’ কিংবা ‘যাদের অধিক সন্তান আছে’ তাদের দিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, প্রধান সেবককে কেন্দ্র করে যে দুর্বিষহ ‘পারসোনালিটি কাল্ট’ গড়ে উঠেছিল তা ধাক্কা খেয়েছে। বেনারসে এক ধাক্কায় তাঁর জেতার মার্জিন প্রায় সাড়ে তিন লাখ কমে গেছে। বাংলায় তাঁর তথাকথিত ম্যাজিক কাজে দেয়নি, অনেক কেন্দ্রেই তাঁর প্রচার সত্ত্বেও বিজেপি হেরেছে। 

অপরদিকে ৬০০০ কিমি পদযাত্রা এবং সাম্প্রতিক সময়ে নিজের নানা বক্তব্য ও পদক্ষেপ রাহুল গান্ধীকে একজন নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর আগে তিনি ছিলেন একজন অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ, অন্তত তাঁর জনভাবমূর্তি তাই ছিল। মণিপুর, যে রাজ্য গত এক বছর ধরে গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত, সেখানে দুটি কেন্দ্রেই কংগ্রেস জিতেছে। তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, ইনার মণিপুর যা মেইতেই অধ্যুষিত সেই কেন্দ্রও বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। 

সর্বোপরি, ২০১৪ ও ২০১৯ যদি ফেসবুক, টুইটারের ভোটযুদ্ধ হয়, এবারের নির্বাচনে ইউটিউবার'দের জয়জয়কার। ধ্রুব রাঠি, রাবিশ কুমার, অজিত অঞ্জুম, এবং বাংলার কিছু প্রাজ্ঞ সাংবাদিক, ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ মানুষের কাছে গোদি মিডিয়ার এক বিকল্প সংবাদমাধ্যমকে হাজির করেছেন। সরকারি তাঁবেদারদের ‘অল ইজ ওয়েল’ খবরের বিপরীতে মানুষ এই ব্যক্তিদের নাছোড়বান্দা মনোভাবের সৌজন্যে বেকারি, মুল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সন্ধান পেয়েছেন।   

এর পাশাপাশি একটা আপসোসও রয়ে গেল। মনে হচ্ছে তীরে এসে তরী ডুবল- আর মাত্র ৩৮টা আসন পেলেই তো কেল্লা ফতে হয়ে গিয়েছিল। মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবাংলা, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে আশাতীত ভালো সাফল্যের পরও কেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অধরা রয়ে গেল? কিছু রাজ্যে কংগ্রেস ও সহযোগী দলের ফলাফলের ওপর চোখ রাখা যেতে পারে। মাত্র এক বছর আগে কংগ্রেস ১৩৫ আসন জিতে কর্নাটকে ক্ষমতায় আসে। নিজেদের ইস্তাহারে প্রতিশ্রুত পাঁচটি গ্যারান্টি রূপায়িত করার কারণে আশা করা হয়েছিল যে তারা লোকসভাতেও ভালো ফল করবে। তারা নিজেরাই ২৮টার মধ্যে অন্তত ১৮টা জিতবে আশা করেছিল, কিন্তু জিতেছে মাত্র ৯টা। আসলে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করাই যথেষ্ট নয়, সেটা মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে কিনা নিশ্চিত করতে হয় এবং ভোটবাক্সে তার ফায়দা তোলার জন্য প্রচার করতে হয়। এটা বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস করতে পেরেছে, রাজস্থানে ২০২৩'এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পারেনি, যদিও মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলত রান্নার গ্যাসের দাম ৫০০ টাকা করে দিয়েছিলেন, গিগ শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করেছিলেন যা আর কোনও রাজ্যে আজ অবধি হয়নি। এর কিছুটা সুফল অবশ্য কংগ্রেস লোকসভায় পেয়েছে।

বিহারে আসন বন্টনের বৈষম্যের কারণে ইন্ডিয়া জোটের ফল আশানুরূপ হয়নি। আরজেডি ২৩টার মধ্যে মাত্র চারটে আসনে জিতেছে। তাদের নিজেদের কোটা থেকে তারা 'বিকাশশীল ইনসান পার্টি'কে তিনটে আসন ছেড়ে দিয়েছিল, যার একটাতেও তারা জিততে পারেনি। এর বিপরীতে ‘মালে’ (সিপিআইএমএল, লিবারেশন) তিনটে আসনে লড়ে দুটিতে জয়লাভ করেছে। তাদের অবশ্যই আরও বেশি আসন প্রাপ্য ছিল। সাধারণ মানুষের থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা তুলে তাঁরা নির্বাচনে লড়েছেন যা এক বিরল নিদর্শন স্থাপন করেছে। 

হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, দিল্লিতে কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ার ফলাফল শোচনীয়। দিল্লিতে আপ ও কংগ্রেসের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের তিক্ততার কারণে নিচু তলায় কর্মীদের মধ্যে কোনও বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি যা আসন জেতার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়েছে। হিমাচলে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস একটি আসনও জিততে পারেনি, যা সত্যিই বিস্ময়কর। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস বিজেপির বি টিমে পরিণত হয়েছে। বর্ষীয়ান নেতা কমলনাথ নামে মাত্র কংগ্রেস, গান্ধী পরিবারের সঙ্গে পুরনো সম্পর্কের কারণে তিনি এখনও দলে টিকে আছেন। এঁদের মতো নেতা যতদিন দলে থাকবেন ততদিন ওই রাজ্যে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এছাড়া গুজরাত, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেস মাত্র একটি করে আসন জিতেছে। বলাই বাহুল্য, ইন্ডিয়া জোটকে ক্ষমতায় আসতে হলে কংগ্রেসকে অন্তত ২০০'র কাছাকাছি আসন পেতে হত। তাই কংগ্রেস যেমন ফ্যাসিবাদকে সাময়িক ভাবে ঠেকিয়ে রাখার কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার, তেমনই ম্যাজিক অঙ্কে না পৌঁছনোর সিংহভাগ দায়ও তাদের।        

বিগত ১৭তম লোকসভায় দেশের সংবিধানের বিভিন্ন ধারা বারবার লঙ্ঘন করা হয়েছে। সাড়ে তিনশোর বেশি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সংবিধানের বিভিন্ন ধারাকে হেলায় পদদলিত করেছে; যেমন এটা প্রথম লোকসভা যেখানে সংবিধানের ধারা ৯৩ লঙ্ঘন করে কোনও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়নি। এই বিষয়ে সীমিত শক্তির কংগ্রেস দলের প্রতিবাদ তারা উপেক্ষা করেছে। তারা প্রায় বিনা আলোচনায় একের পর এক আইন প্রণয়ন করেছে যা দেশের সাতাত্তর বছরের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। মাত্র ১৬ শতাংশ বিল আলোচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে, যা ১৫তম লোকসভায় ছিল ৭১ শতাংশ, ১৬তম লোকসভায় ছিল ২৫ শতাংশ। লক্ষণীয়, ২০১৪ থেকে আলোচনার অবকাশ প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় কোনও আলোচনা-বিতর্ক ছাড়াই তিনটি শ্রম বিল, ডিজিটাল ডেটা প্রোটেকশন বিল, ন্যায় সংহিতা বিল ইত্যাদি আইনে পরিণত করা হয়েছে। 

এসবেরই থেকে সাময়িক মুক্তি। ‘সাময়িক’, ‘আপাতত’ শব্দগুলো ব্যবহার করতে হচ্ছে, কারণ, ১৮তম লোকসভার চরিত্র বহুমাত্রিক এবং তাই কিছুটা টলমল। মানুষের কাছে যেটা স্বস্তির সেটা হল টিডিপি, জনতা দল (ইউ) ইত্যাদির চাপে থাকার কারণে বিজেপি তাদের ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের প্রকল্প রূপায়ণ করতে পারবে না, মুসলিম নিপীড়ন, বুলডোজার অভিযান বন্ধ রাখতে হবে। এই দুটি দল রাজনীতির ময়দানে বিশুদ্ধ হাওয়া মোরগ হিসাবে পরিচিত, কখন যে কী করবে একবিংশ শতাব্দীর নব্য অবতারও বুঝে উঠতে পারবেন না। ইতিমধ্যেই তারা সওদা করা শুরু করে দিয়েছে-- ক্যাবিনেট মন্ত্রী চাই, স্পিকার চাই, রাজ্যের জন্য স্পেশ্যাল প্যাকেজ চাই! নানা দাবির কারণে বিজেপি নেতৃত্বের চুল খাড়া হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিধানসভা হোক বা লোকসভা, উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজনীতি করতে অভ্যস্ত। তিনি গরিষ্ঠতাকে নির্মম ভাবে ব্যবহার ও নানা ছলচাতুরি করে সহযোগী এবং বিরোধী উভয়কেই চমকে ধমকে দমিয়ে রাখতে অভ্যস্ত। তিনি অটল বিহারি বাজপেয়ী নন যিনি ১৯৯৯ সালে ১৮২টা আসন নিয়েও পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন। এছাড়া দলের মধ্যেই তাঁর যে প্রশ্নাতীত আধিপত্য ছিল সেটা আর নেই, বিশেষ করে আরএসএস'এর নিরঙ্কুশ সমর্থন তাঁকে আবার নতুন করে অর্জন করতে হবে। তিনি বর্তমানে মেরুকরণের রাজনীতি বর্জন করবেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, সিএএ-এনআরসি, সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার বিভিন্ন আইন মুলতুবি রাখবেন, ইডি-সিবিআই'এর রাশ টেনে ধরবেন। 

কিন্তু তিনি সব সময় সুযোগ খুঁজবেন কী করে ২৪০ সংখ্যাটাকে ২৭২ করা যায়। এটাই হবে তাঁর পাখির চোখ। আর কে না জানে, এই খেলায় তিনি ও তাঁর ছায়াসঙ্গী অসম্ভব পটু। শুধু মহারাষ্ট্রের দিকে চোখ ফেরালেই সেটা বোঝা যায় যেখানে তারা শরদ পাওয়ার আর উদ্ধব থ্যাকারের মতো পোড়খাওয়া  রাজনীতিবিদদের দলকেও টুকরো করে দিয়েছেন। এছাড়া তাঁদের হাতে আছে বিপুল অর্থভাণ্ডার, দেশের প্রধান দুই কর্পোরেট সংস্থার অকুন্ঠ সমর্থন। আপাতত বিজেপি নেতৃত্ব শ্বেতশুভ্র পায়রার রূপ নিলেও এটা নিশ্চিত যে তারা শুরু থেকেই তলায় তলায় ইন্ডিয়া জোটের বড় দলগুলিতে ভাঙ্গন ধরিয়ে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করবে। সুতরাং, ইন্ডিয়া জোট এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে অতি সতর্ক থাকতে হবে। সাধু সাবধান!


Wednesday 5 June 2024

অউর এক ধাক্কা

এক নতুন সম্ভাবনার দিকে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

ভারতবর্ষ সম্পর্কে উৎসুক রম্যা রল্যাঁ’কে রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘ভারতকে জানতে হলে বিবেকানন্দকে জানুন।’ কারণ, উনবিংশ ও বিংশ শতকে যে দুজন ব্যক্তিত্ব কার্যত পায়ে হেঁটে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষকে চষে বেড়িয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। অন্যজন মহাত্মা গান্ধী। এই বিশাল ভূখণ্ডে কত শত মত, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কুসংস্কার, অন্ধতা, প্রজ্ঞা ও মানবিকতার যে বিবিধ যাপনধারা নানাবিধ ভাষা, ধর্ম ও জাতির সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে বহমান, তা এই দুজনই মর্মে মর্মে প্রত্যক্ষত উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন। তাই আমরা বলি, ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।’

সেই দেশকে কি ‘এক দেশ এক ধর্ম এক জাতি এক ভাষা’র দাপট দিয়ে রুদ্ধ করা যায়? একটা সময়ের পর এই প্রশ্ন উঠেছিল। সর্বত্র। যে রামমন্দিরের রণহুঙ্কারে এক বিশাল অংশের সহনাগরিকের রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছিল, সেই মন্দির এলাকাতেই পর্যুদস্ত হয়েছে ‘এক দেশ এক ধর্মের’ উন্মত্ত মানসিকতা। ফৈজাবাদ লোকসভা কেন্দ্র, যার অন্তর্গত অযোধ্যা ও রামমন্দির, সেখানে পরাজিত হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী। এই হল ভারতবর্ষ। যাঁরা রামকে আরাধ্য দেবতা মনে করেন, তাঁরাও রামের নামে মাস্তানিকে মেনে নিতে পারেন না। এই হল ভারতবর্ষ। হিন্দুত্বের স্বঘোষিত আইকন নরেন্দ্র মোদির নিজের কেন্দ্রে (বারাণসী) গতবারের নির্বাচনে তাঁর জয়ের ব্যবধান ৪ লক্ষ থেকে এবারে নেমে এসেছে ১.৫ লক্ষে। এই হল ভারতবর্ষ। যাঁরা মনেপ্রাণে হিন্দু, প্রবল ভাবে ধর্মবিশ্বাসী, তাঁদেরও অধিকাংশজন চান না ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার নামে অন্য ধর্মমতে বিশ্বাসীদের ওপর তরবারির কোপ পড়ুক। এই হল ভারতবর্ষ। স্বামী বিবেকানন্দ ও মহাত্মা গান্ধী এই ভারতবর্ষকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে জনতা রায় দিয়েছে ভারতবর্ষের বিবিধতা ও বৈচিত্র্যের পক্ষে, ক্রমশ অসহ্য ও নির্মম হয়ে ওঠা এককেন্দ্রিকতার বিপক্ষে। কিন্তু এই রায় সর্বত্র সমান হয়নি। তার কারণও আছে। মানুষের বিচারবুদ্ধি অসীম। তারা একত্রে ভারসাম্য নির্মাণ করতে জানে। তারা শাসক ও বিরোধী, দু’ পক্ষেরই তুল্যমূল্য বিচারে পারদর্শী। কিন্তু কীভাবে করে, কেউ বলতে পারবে না। অতীতে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করে রেহাই পাননি। আবার তার বিপ্রতীপে প্রতিষ্ঠিত জনতা পার্টির সরকারও দু’-আড়াই বছরের বেশি টেকেনি। পরের নির্বাচনে আবারও ইন্দিরা গান্ধী প্রত্যাবর্তন করেন। তাই, নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল এই নির্বাচনে জোর ধাক্কা খেলেও একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। নতুন সরকার গঠনেও তেমন আঙ্কিক গোলযোগ নেই। কিন্তু সেই সরকারের স্থায়িত্ব ও দাপট কতটা হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। বারাণসীতে যথেচ্ছ পুজোপাঠ দিয়ে, নিজেকে পরমাত্মার সরাসরি প্রেরিত দূত হিসেবে চিহ্নিত করে ও নির্বাচনের দিন কন্যাকুমারীতে বিশাল ক্যামেরা সেটিং’এর সামনে ধ্যানের ফটো-শ্যুটিং করেও, দেখা যাচ্ছে, তিনি পরমাত্মার আকাঙ্ক্ষিত ‘আশীর্বাদ’ ও জনগণের কাম্য ভোট, কোনওটাই পাননি।

অতএব, এবারের নির্বাচনের ফলাফল কতকগুলি জোরালো বার্তা দিতে চাইছে। তার গোটা পাঁচেক’কে না হয় খানিক বোঝার চেষ্টা করা যাক:

বার্তা এক: মৌলবাদী ও ঘৃণার রাজনীতি এ দেশে অচল। শাসন ও শোষণের জন্য শাসকেরা মানুষের মধ্যে বিভাজনের বীজ ছড়িয়ে নিজেদের অকুন্ঠ শাসনকে বজায় রাখতে চায়। ধর্মের বিভাজন এ ক্ষেত্রে একেবারে মোক্ষম। আমরা জানি, সমাজের সর্বস্তরে আপস ও দ্বন্দ্ব, অন্য কথায়, সহাবস্থান ও ঠোকাঠুকি, দুইই কতকটা সমভাবে বহমান। কিন্তু ঠোকাঠুকিটাকে যদি কেউ হাতিয়ার করে এবং তৎপ্রসূত রেষারেষি ও হিংসার রাজনীতিকে প্রধান অক্ষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে ও রাখতে চায়, তাহলে তার ভয়ঙ্কর ফলাফল কী হতে পারে আমরা গত কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ করেছি। একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি নিয়মিত বিষোদগার, তা ব্যতিরেকে খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক, ব্যক্তিগত জীবন, নারীদের চলাচল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এইসব নিয়ে যদি ফতোয়া দেওয়া হতে থাকে এবং তা না মানলে তার ভয়ঙ্কর পরিণতির আশঙ্কা থাকে, স্বভাবতই এই মৌলবাদী ও ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষ এবারের নির্বাচনে অঞ্চল-বিশেষে ইতিবাচক রায় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উপরন্তু, অন্যান্য সন্ত্রাসের (যেমন, রাজনৈতিক, জাতপাত ভিত্তিক, গোষ্ঠী ভিত্তিক) বিরুদ্ধেও সতর্কবার্তা এই রায়ে নিহিত আছে। তা একেক রাজ্যে একেকরকম ফল দেখে অনুমান করা যাচ্ছে।

বার্তা দুই: ইদানীং জনকল্যাণের রাজনীতি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মূল এজেন্ডায় চলে এলেও এবং তা নিয়ে শত শত প্রকল্প চালু হলেও কোনও সরকার যে শুধুমাত্র সেগুলির ওপর নির্ভর করেই জনতার ইতিবাচক রায় লাগাতার আদায় করে নিতে পারবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যায় যথাক্রমে জগন রেড্ডি ও নবীন পট্টনায়েক সরকারের পতন তাহলে হত না। এই দুই সরকারই তাদের মেয়াদকালে যথেষ্ট জনকল্যাণ প্রকল্পের কাজ করেছে কিন্তু তবুও নির্বাচনে হেরেছে মূলত দুটি কারণে: ১) অন্ধ্রে বেহিসেবি টাকা খরচের ফলে সরকারি কোষাগারে সংকট ও ২) উড়িষ্যায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও ‘উন্নয়নের’ নামে বিভিন্ন এলাকায় গরিব মানুষের উপর স্টিমরোলার চালানো ও তাদের উচ্ছেদ। ফলে, এই লোকসভা নির্বাচন যদিচ কেন্দ্রে ফ্যাসিবাদী সরকার গঠনের সম্ভাবনাকে নির্মূল করার ভোট, তথাপি স্থানীয় সরকারের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা ব্যর্থতার বিরুদ্ধে রায় দেওয়ারও কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এই বহুমাত্রিক জটিলতাকে সবসময়েই মাথায় রাখতে হবে।

বার্তা তিন: উত্তরপ্রদেশে যোগী রাজের যে মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়, যার অন্যতম উপাদান ‘বুলডোজার রাজ’- তার বিরুদ্ধে প্রবল বিতৃষ্ণায় মানুষ বিরুদ্ধপক্ষকে (ইন্ডিয়া জোট) ঢেলে ভোট দিয়েছে। কার্যত, রাজ্যওয়ারি ফলাফলের বিচারে বিজেপি সেখানে পরাজিত। কারণ, সমগ্র উত্তরপ্রদেশ জুড়েই নারী নিরাপত্তার অভাব, সংখ্যালঘু মানুষের আতঙ্কে দিন কাটানো, বুলডোজারের ভয়ে গরিব মানুষের দৈনিক ত্রাস, ব্রিজভূষণ ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের সন্ত্রাস ইত্যাদি বিবিধ কারণে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। পরন্তু, সেখানে বিরোধীরা কার্যত একটি পাকাপোক্ত জোটও গড়ে তুলতে পেরেছিল। এই ধরনের জোট গড়ে উঠলে বিজেপি যে খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে পারে তার আরও একবার প্রমাণ পাওয়া গেল।

বার্তা চার: এবারে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত ইউটিউব চ্যানেলের সঞ্চালক ও বিশ্লেষকেরা এক মিডিয়া বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। লাখে লাখে মানুষ টিভি চ্যানেল ও খবরের কাগজ থেকে মুখ ফিরিয়ে ইউটিউব ও নানা বিকল্প ডিজিটাল মিডিয়ার দিকে মনোনিবেশ করেছে যেখানে সংবাদ ও ঘটনাক্রম বিশ্লেষণের এক যুগান্তকারী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এই প্রবণতা বেশ কিছু বছর ধরেই সংহত হচ্ছিল কিন্তু এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে তা যেন বিস্ফোরণের রূপ নিল। রাভিস কুমার, সাক্ষী মালিক, অজিত অঞ্জুম, আকাশ ব্যানার্জি, ভগৎরাম, বং নিউজ, এনকে ডিজিটাল, এনটিটি ইত্যাদিদের ইউটিউব চ্যানেলগুলি যেন আগুনের মতো গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। আর তারই মাঝে হাইড্রোজেন বোমার মতো আছড়ে পড়ল ধ্রুব রাঠি’র ‘মোদি ডিক্টেটর’ শীর্ষক ইউটিউব প্রতিবেদনটি। কোটি কোটি লোকের কাছে মোদিরাজের আসল চেহারা উন্মোচিত হল। মোবাইল থেকে মোবাইলে কোটি কোটি মানুষের কাছে বাহিত হল সে চেহারা। মহল্লায় মহল্লায় স্ক্রিন খাটিয়ে ধ্রুব রাঠি’র প্রতিবেদন হাজার হাজার মানুষকে দেখানো হল। হিন্দি বলয় জুড়ে তা এক তীব্র অভিঘাত তৈরি করল। এরপর আরও আরও এইরকম ইউটিউব ভিডিও দেশ জুড়ে মশাল জ্বাললো। এই প্রবল জনোচ্ছ্বাসের কাছে ভেসে গেল একনায়কের সব ক্ষমতা ও দম্ভ। জনতার এই ‘মিডিয়া ক্ষমতা’ নিঃসন্দেহে এক নতুন রাজনৈতিক যুগের প্রবর্তন। বার্তা হল, এই ধারা আরও শক্তিশালী হয়ে এক উন্নত রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ করবে।

বার্তা পাঁচ: নির্বাচনের ফলাফল বিজেপিকে প্রবল ধাক্কায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সংখ্যা থেকে অনেকটা নিচে নামিয়ে দিল বটে কিন্তু তাদের জোট এনডিকে’এ সামান্য বেশি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিল। এরকমটাই যেন হওয়ার ছিল। এক প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী, মেগালোম্যানিয়াক স্বৈরাচারীকে যখন শাসন চালানোর জন্য নির্ভর করতে হবে ছোট ছোট দলগুলির মতামতের উপরে, তখনই তাঁর আসল যন্ত্রণাপর্ব শুরু হবে। তিনি প্রতিদিন দগ্ধ হবেন, চাপের কাছে অহরহ মাথা নিচু করবেন, তবুও ক্ষমতা ছাড়তে পারবেন না; আশায় থাকবেন, এই বুঝি পরমাত্মা তাঁকে সুযোগ করে দেবেন একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের বনিয়াদ যে বড্ড শক্ত, আর দেশের মানুষগুলোও সাত সেয়ানার এক সেয়ানা; তাঁরা যথার্থই জানেন, কখন ঢিল দিতে হয় আর কখন টান। এই টানাপোড়েনেই সম্ভবত বিশ্বগুরুর বয়সও বাড়তে থাকবে, সঙ্গে ক্লান্তি আর তীব্র হবে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা। সেই হাল তিনি ধৈর্যচ্যুতিতে ছাড়বেন নাকি শেষবিন্দু অবধি যুঝে, তা আপাতত দেখার।

অন্তত এটুকু আশ্বস্ত হওয়া গেছে, সাধারণ মানুষের ওপর যে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্টিমরোলার চলছিল, ব্যক্তিগত জীবনের পছন্দ-অপছন্দ ও যাপনরীতির ওপর হুমকির বাতাবরণ তৈরি হচ্ছিল, মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থাকাল বিরাজ করছিল, তার হয়তো কিছুটা বিরতি হবে। কারণ, শাহেনশাহ এখন আর একা সবকিছু করতে পারবেন না। তাঁর হাত-পা বাঁধা। তাঁর দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।