Monday 5 October 2020

কৃষ্ণগহ্বরে গণতন্ত্র!

অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে

সোমনাথ গুহ

কখনও একটা শুভ সংকটের অপচয় হতে দেবে না- কথাটি বলেছিলেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল। কবে, কখন, কোথায় এবং কী পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কথাটি বলেছিলেন তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, কিন্তু আমাদের সে নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ, সেটা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়শুভ সংকট’ কথাটি একটি Oxymoron, বিরোধাভাস। সংকট আবার শুভ হয় কী করে! হয় বৈকিশাসক দলের পক্ষে বেশ হয়। কোভিড১৯'এর সংকট দেশের শাসক দলের পক্ষে যে এক অতীব শুভ পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে সেটা নিয়ে কি কোনও সন্দেহ আছে? লকডাউনের পর গত ছয় মাসে কেন্দ্রীয় সরকার কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, তার একটা খতিয়ান প্রস্তুত করা যেতে পারে। এই পদক্ষেপগুলির গুরুত্ব অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী, যা ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। এখানে আমরা কৃষি আইন, শ্রম বিধি এবং জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে কোনও আলোচনায় যাব না, কারণ এগুলি ইতিমধ্যেই বহু চর্চিত। বাকিগুলি মূলত খসড়া, প্রস্তাব, পরিকল্পনার স্তরে আছে, দু-একটি ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নও হয়ে গেছে। প্রতিটিতে সংক্ষিপ্ত মতামত দেব, বিস্তারিত আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব নয়।

·         ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট): বলা হচ্ছে এটি শুধুমাত্র খসড়া। চল্লিশটি শিল্প চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলির পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড় প্রয়োজন হবে না। এর মধ্যে আছে বালি খনন ও উত্তোলন, সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাসায়নিক সার, ২৫ মেগাওয়াট অবধি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ছোট ও মাঝারি সিমেন্ট কারখানা, রংয়ের কারখানা ইত্যাদি। আগে যে কোনও প্রকল্প রূপায়ণের আগে এলাকার বাসিন্দাদের সাথে আলোচনার জন্য ৩০ দিন সময় দেওয়া হত, সেটা এখন হবে ২০ দিন। এর নোটিশ জারি করা হয় হিন্দিতে যা স্থানীয়দের ক্ষেত্রে জানতে বুঝতে প্রবল সমস্যা সৃষ্টি করে, তাই সময় কমে যাওয়ার অর্থ এলাকার বাসিন্দাদের মতামতের গুরুত্বও কমে যাওয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনও কারখানা দূষণ ছড়ালে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ গ্রাহ্য হবে না। সেই কারখানা নিজেরা মন্ত্রককে জানালে তাহলেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে! মন্ত্রকের ছাড় না নিয়ে যদি কোনও প্রকল্প চালু হয়ে যায় তবে তারা পরে অনুমতির জন্য আবেদন করতে পারবে। প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হবে না। আগে ছিল অনুমতি নিয়ে তবেই প্রকল্প শুরু করা যাবে। গত ১১ অগস্ট অবধি ইআইএ-র ওপর মতামত জানানোর সময় নির্ধারিত ছিল এবং জানা যাচ্ছে পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে প্রায় ১৭ লক্ষ মতামত এসেছে যার মধ্যে ২ লক্ষ এই খসড়া নিয়ে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছে। মন্ত্রকের সেক্রেটারি জানিয়েছেন, মতামতগুলি ঘুরেফিরে প্রায় একই এবং নতুন করে আলোচনার কোনও সম্ভাবনা নেই।

·         ৪১টি কয়লা ব্লক নীলামে চড়ানো হল: সরকার বলছে এতে প্রায় আড়াই লক্ষ নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এই ব্লকগুলি ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে অবস্থিত। ১৪টি ব্লক নো-গো-জোন অঞ্চলে, অর্থাৎ বিশুদ্ধ এলাকা যেখানে অরণ্য, জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয় এমন কোনও কিছু করা যাবে না। এর আগে কয়েকবার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু স্থানীয়দের আপত্তির কারণে বাতিল হয়ে গেছে। দুটি ব্লকে ব্যাঘ্র প্রকল্প ও জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। প্রথম তিনটি রাজ্যের প্রত্যেকটিতে ৮০০০-১০০০০ মানুষ উৎখাত হবে। ঝাড়খণ্ডে ৩০-৩২টি গ্রামের মানুষকে অন্যত্র সরে যেতে হবে। শুধু ছত্তিশগড়েই ২৫-৩০ লাখ গাছ ধ্বংস হবে।

·        ন্যাশানাল ডিজিটাল হেলথ মিশন: সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড যাতে প্রত্যেকের শরীর স্বাস্থ্যের ঠিকুজি কোষ্ঠী লেখা থাকবে। উদ্দেশ্য? যাতে রোগী সহজে সঠিক চিকিৎসক চিহ্নিত করতে পারেন, অ্যাপয়েনমেন্ট ঠিক করতে পারেন, তাঁর পারিশ্রমিক জানতে পারেন, অযথা হাসপাতালে হন্যে হয়ে না ঘুরে বেড়াতে হয়। চিকিৎসকও এক নজরে রোগীর অবস্থা জেনে নিতে পারেন। যেখানে চিকিৎসক, শয্যা, স্বাস্থ্যকর্মী বিপুল ভাবে অপ্রতুল সেখানে কার্ড দিয়ে কী হবে! উদ্দেশ্য হচ্ছে, তথ্যভান্ডার তৈরি করা যাতে মানুষের ওপর নজরদারির পথ আরও সুগম হয়। এটা আরোগ্য সেতু অ্যাপের পরিবর্ধিত রূপ ছাড়া কিছু নয়।

·         এক জাতি এক রেশন কার্ড: গত পয়লা জুলাই থেকে ‘জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন’এর আওতাভুক্ত উপভোক্তারা দেশের যে কোনও রেশন দোকান থেকে পরিষেবা পাবে। রেশন কার্ড আধারের সাথে সংযুক্ত হতে হবে। পরিযায়ী শ্রমিকরা শুধুমাত্র কেন্দ্রের দেওয়া রেশন পাবে, রাজ্যের নয়। এটা ভালো উদ্যোগ। একটাই খটকা আছে; নতুন কৃষি আইনের ফলে যদি অধিকাংশ শস্য কর্পোরেটের গুদামে চলে যায় তাহলে রেশন ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্যের জোগান থাকবে তো?

·        ভারতীয় রেলের বেসরকারিকরণ: ১০৯টি রুটে ১৫১টি বেসরকারি ট্রেন চালু হবে। এই ট্রেনগুলির সমস্ত দায়ভার বেসরকারি কোম্পানির ওপর বর্তাবে। আপাতত পরীক্ষামূলক ভাবে দিল্লি-লক্ষৌ, মুম্বাই-আমেদাবাদ রুটে আইআরসিটিসি-র তত্ত্বাবধানে এই ধরনের কিছু ট্রেন চালু হয়েছে। দিল্লি থেকে এখনকার ভাড়া এসি চেয়ার কারে ১২৮০ টাকা/ এবং এক্সিকিউটিভ চেয়ার কারে ২৪৫০ টাকা/। আগে ভাড়া ছিল ৬৯৯ টাকা/ এবং ১৫৭২ টাকা। এই পরিসংখ্যানটাই যথেষ্ট। বলা হচ্ছে বিমান ভাড়ার থেকে অনেক কম। ভাবটা এমন যেন দেশের সব মানুষ বিমান চড়েই অভ্যস্ত। রেল যদি বেসরকারি হত তাহলে এই মড়কের সময় এত পরিযায়ী শ্রমিককে কি বাড়ি ফেরত পাঠানো যেত? বিদেশ থেকে ভারতীয়দের ফেরত আনতে তো সেই এয়ার ইন্ডিয়ারই সাহায্য নিতে হয়েছে, যে সংস্থাটিকে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলির সুবিধা করে দিতে ছক করে লোকসানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইন্ডিগো বা স্পাইসজেট কি একজনকেও ফেরত আনতে সাহায্য করেছে? একই ভাবে নানা অছিলায় 4G কানেকশনের অনুমতি না দিয়ে BSNL-কেও পঙ্গু করে রাখা হয়েছে।  

·       বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণ: গত বছরের মার্চ মাসে ছয়টি বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের মধ্যে দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। লকডাউন চলাকালীন আরও ছয়টির নাম ঘোষিত হয়েছে। এর মধ্যে তিরুচিরাপল্লির বিমানবন্দর একটি লাভজনক সংস্থা এবং স্বাভাবিক ভাবেই বিমানবন্দরের কর্মচারীরা এবং কেরালা সরকার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের অজুহাত দেখিয়ে একের পর এক বিমানবন্দর আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া এই সরকারের কর্পোরেট-চাটুকারিতার এক নির্লজ্জ উদাহরণ।

·         ১০১টি যুদ্ধাস্ত্র এবং নানা যন্ত্রাংশর আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে: এটি ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এই সামগ্রীগুলি এখন থেকে দেশের অর্ডিন্যান্স কারখানাগুলি তৈরি করবে। কিন্তু এদের নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র নাকি এতই নিম্নমানের যে সেগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে। তাই এই ফ্যাক্টরিগুলির কর্পোরেটিকরণ হচ্ছে; এগুলি এখন শেয়ার বাজারে লিস্টেড কোম্পানি হবে। স্বভাবতই বিভিন্ন ইউনিয়ন এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর।

·        চাকরিতে বাধ্যতামূলক অবসর: এখন থেকে প্রতি তিন মাস সরকারি কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে। এই লক্ষ্যে যাঁদের তিরিশ বছর চাকরি হয়ে গেছে বা বয়স পঞ্চাশের বেশি, তাঁদের কাজের রেকর্ড খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যারা 'অলস', 'নিষ্কর্মা' তাঁদের অবসর নিতে বাধ্য করা হবে।

·         বিদ্যুৎ শিল্পে সংস্কার: সরকার বলছে আমাদের দেশে কলকারখানায় বিদ্যুতের মাশুলের হার বিশ্বে সর্বোত্তম। তাই cross-subsidy বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ, শিল্পের ওপর অধিক মাশুলের বোঝা চাপিয়ে কৃষি ও গৃহস্থের মাশুল কমিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ বন্ধ করতে হবে। রাজ্য বন্টন সংস্থাগুলিকে বেসরকারি করে লাভজনক করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। বাস্তবটা হচ্ছে, কৃষিতে মান্ডি, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধা কম সংখ্যক কৃষক পায়, যে কারণে আন্দোলন পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় প্রবল আকার ধারণ করেছে, অন্যত্র অতটা নয়যেটা দরকার সেটা হচ্ছে স্থানীয় ফড়ে ও সরকারি আধিকারিদের দাপট কমিয়ে ব্যাপক সংখ্যক কৃষক যাতে এমএসপি পায়, মান্ডির সুবিধা নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। এই কারণে এই ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। একই ভাবে বন্টন সংস্থা এবং সমবায় ব্যাঙ্কগুলি দুর্নীতির আখড়া, সেখানেও সংস্কারের আশু প্রয়োজন। সেটা করার বদলে সরকারের ঝোঁকটাই হচ্ছে সব কিছু কর্পোরেটদের হাতে তুলে দাও তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বেসরকারিকরণ যেন একটা বিশল্যকরণী।     

এছাড়াও ‘বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন’ আরও কঠোর করা হয়েছে, অ্যামনেস্টি যার প্রথম শিকার। এসবিআই-এ ডিসেম্বর মাস থেকে ভিআরএস আসছে, মেয়েদের বিবাহের বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করার প্রস্তাব এসেছে। এই সবই করা হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন মহামারি আইন বলবৎ আছেশতাব্দী-প্রাচীন এই আইন দানবীয় এবং প্রায় আভ্যন্তরীণ এমার্জেন্সি জারির শামিল। এর সুযোগ নিয়ে দিল্লি দাঙ্গা এবং ভিমা কোরেগাঁও কেসে মিথ্যা অভিযোগে অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্ষীয়ান এবং গুরুতর অসুস্থ সমাজকর্মীদের জামিনের আবেদন বারবার নাকচ করা হয়েছে। যে কোনও বিক্ষোভ, প্রতিবাদকে অপরাধমূলক কাজ ও চক্রান্ত হিসাবে গণ্য করা হচ্ছেএত দ্রুত এই সব করা হচ্ছে যে বিরোধী দলগুলি দিশাহারা হয়ে পড়ছে, কোনটা ছেড়ে কোনটার প্রতিবাদ করবে। এর ফলে ভারতীয় গণতন্ত্র নিশ্চিতভাবে একটি কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করছে।  


5 comments:

  1. arjunswapan.sengupta5 October 2020 at 21:29

    আবারও একটা অসাধারণ লেখা! তবে আরও একটু বিস্তারিত হলে ভাল লাগত!

    ReplyDelete
  2. এত স্বল্পপরিসরে এতগুলো বিষয়কে ধরতে গিয়ে কিছুটা না বলা থাকলেও বার্তা পরিষ্কার!ভারতের পুঁজির চরিত্র এবং তার স্তর প্রতিমুহূর্তে বদলাচ্ছে আর তা হচ্ছে সরকারি তত্ত্বাবধানে!সংবিধানে যে সমাজ কল্যাণকর রাষ্ট্রের কথা বলা আছে সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ তা লঙ্ঘন করছে। এগুলো করবার জন্য কভিডের সময়টাকে বেছে নেওয়া সত্যিই লেখার প্রথম লাইন শুভ সংকটক কথাটাকে প্রতিষ্ঠিত করে!

    ReplyDelete
  3. ভাল লেখা। ছোট পরিসরে মূল বিষয়গুলো এসেছে, যথাযথভাবে। সোমনাথকে অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  4. সবই ঠিক আছে, কিন্তু আজকের এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পদক্ষেপগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এবং প্রচার মাধ্যম ও বিচার বিভাগীয় অবস্থান নিয়ে আলোকপাত না করলে পরিস্থিতির ভয়াবহতার উপলব্ধি পুরোপুরি হয় না বলেই মনেহয়।

    ReplyDelete