Sunday 26 July 2020

জীবন যখন 'ফুরায়ে' আসে!

পাথরভাঙার গল্প
অমৃতা ঘোষাল

জীবন শুকিয়ে গেলে করুণা মেলে। আর করুণা শুকিয়ে গেলে উপহাস। মানুষ কিন্তু করুণা কিংবা উপহাস কোনওটারই প্রত্যাশা রাখে না। প্রত্যাশার চূড়ান্তবিন্দুতে থাকে একটু অনুভূতির সন্ধান। আর অনুভূতির সমস্ত উৎসগুলো যখন বন্ধ হতে থাকে তখন মানুষ নিজের প্রকৃত সত্তাই খুঁজে পায় না। সত্তা নেই অর্থাৎ অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ রক্তমাংসও অর্থহীন। সুতরাং, এই দপদপিয়ে চলা প্রাণটাকেও থামিয়ে দিতে হবে। হয় নিজেকে চরম কষ্ট দিয়ে, নয়তো তিলে তিলে একটু একটু করে কষ্ট জমিয়ে। একটু সুখীরা আবার খোঁজেন আরামের মৃত্যু। 'Euthanasia' কয় যাহারে! 

কিছু সত্যি ঘটনা তুলে ধরা যাক। আর আসল নামগুলোকে পাল্টে দেওয়া যাক।

কুমু  কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তার ভাই ছোট, চার বছরের। স্কলারশিপের টাকা থেকে বাবা যে মোবাইলটা কিনে দিয়েছিল ওটা আর অন হচ্ছে না। বাবার কাছে টাকা নেই। পাকা ঘর তুলতে স্কলারশিপের সব টাকা শেষ। বন্ধুরা সবাই রোজ ক্লাস করছে। পাশের বাড়ির রিঙ্কুর মোবাইল থেকে একদিন কলেজের ম্যাডামকে সমস্যাটা জানিয়েছিল। ম্যাডাম 'আমার কিছু করার নেই ' বলে ফোন রেখে দেন। এখন রিঙ্কুর বাড়ি যাওয়া বন্ধ। মাস্ক পরেও যাওয়া যাবে না। একশো দিনের কাজে নাম লেখানো বৌ-পালানো স্বপনের সঙ্গে কুমুর বাবা হঠাৎই তার বিয়ে ঠিক করে ফেলে। কাউকে কোনও কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করল না কুমু। শুধু ওড়না আর সিলিং ফ্যানটাকেই সব চেয়ে ভালো বন্ধু ভাবল।

আজ হৃদির পাঁচ বছরের বিবাহবার্ষিকী। সরকারি স্কুল টিচার হৃদির মাইনে এখনও ঠিকঠাক ঢুকছে। বর সুমনের প্রাইভেট চাকরি। তার মাইনে অর্ধেক করে ঢুকছে। আগে নিজের জন্যে দশ হাজার রেখে পুরোটাই সংসারের জন্যে বরকে দিত। এখন দশ হাজারটুকুও সুমন চাইছে। চাওয়া থেকে মারধোর। বাবা-মাকে ফোন করলে বলে, 'তুমি তো নিজে দেখেই বিয়ে করেছ! এখন আমরা কী করব!' ঠিকই তো! তাহলে হয়তো টাকা দিয়েই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কিন্তু টাকা বেশি দিলেই সুখ কি ভাগ্যে আছে! বিয়ের আগে প্রায় সাত বছর সুমনের সঙ্গে প্রেমপর্বে এসব তো হৃদি কল্পনা করেনি! হৃদি মুখ খুলতে শেখেনি। গত বছর দু' বছরের ছেলে সবুজ ডেঙ্গুতে চিরকালের মতো চলে যাওয়ার পর হৃদি সংসার ছাড়বে ভেবেছিল। হয়ে ওঠেনি। এই সবটুকুই হৃদি ভাবল পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে এসে। একেবারে ছাদের পাঁচিলটাতে দাঁড়িয়ে। বেশিক্ষণ সে আর দাঁড়াবে না, এবার সামনে লাফ দেবে।

ব্যাংকের সুদ সম্ভবত আরও কমবে। এটা ভাবতে ভাবতে মুদিখানার সামনে দাঁড়ালেন ছিয়াত্তর বছরের তপনবাবু। চা নেবেন, বিস্কুট নেবেন, অল্প চাল নেবেন, আর কিছু তার মনেই পড়ছে না। ঘরে ঢুকেই রমাকে বেড প্যান দেওয়া, তারপর কিছু খাইয়ে দেওয়া। গত দু' বছর এরকমই চলছে। কিন্তু সত্যি এবার যদি করোনা হয়, তখন কী করবেন ! চটজলদি সিদ্ধান্ত নিলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে রমা আর নিজের ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে নিলেন অনেকগুলো স্লিপিং পিল। দুপুরে ভাত খেয়ে বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া একাত্তরের রমার বুকে প্রায় বছর কুড়ি পর মাথা রেখে অসীম শান্তিতে ঘুমোলেন তপনবাবু।

পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। কাল সারা রাত কচিটাকে দুধ না খাইয়ে রেখেছে বিন্তি। ওর বুক টনটনিয়ে উঠছে, তবু দেবে না। বৌবাজারের এই গলিতে তাকে এনে তুলেছে বর সাধন। মন্দিরে বিয়ে, তুলতুলে সোহাগ, চুরমুরে দেহ-ব্যবসা। সাধনের অনেক বন্ধু, অনেক মালিক, অনেক প্রতিবেশী। বিন্তি সত্যিই জানে না কচির আসল বাবা কে! সাধন হারামি পালিয়েছে অনেকদিন। তবে খদ্দের আসত ভালোই। নিরোধ নিত। তবু বাচ্চা গজাল। খসাল না। সেদিনও বুক টনটনিয়ে উঠেছিল যে! শালা করোনা আসার আগে ভালোই ইনকাম ছিল। এখন এক কুটোও নেই। বাচ্চাটা আগে না খেয়ে মরুক, তারপর সে বিষ খাবে। তবে বাচ্চাটাকে বিষ দেবে না। কচিটা নিজে থেকেই শুকোবে।

গিটার বাজাতে ভালোবাসে তনুময়। সে যখন স্নানে গিয়েছিল মা গিটারটা ভেঙে ছিঁড়ে রেখে দিয়েছে। সঙ্গত কারণ ছিল। তনুময় সিঙ্গল মাদারের ছেলে। ওর মায়ের কাছে কাল এসেছিল জয়ন্ত আঙ্কল। তনুময়ের জন্যে এনেছিল শার্লক হোমস। মোটা বইটার নিচে ছিল পাতলা চটি বই। ইনসেস্ট চটি। তনুময়ের গা গুলিয়ে উঠেছিল। মায়ের ঘরের বন্ধ দরজা ভেঙে আঙ্কলকে বের করে দিয়েছিল ফ্ল্যাট থেকে। আঙ্কলকে তনুময় বলেছিল, 'ফাকিং বাস্টার্ড, এরপর এলে মাস্ক পরে আসবি।' আজ মা গিটার ভেঙে দিল, তারপর মাস্ক-পরা জয়ন্ত আঙ্কলকে নিয়ে দরজা আটকাল। আর তনুময় বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নতুন ব্লেডটা হাতে তুলে নিল। দৃঢ় প্রত্যয়ে ভরা শ্বাসটা একটু পরেই স্মৃতি হয়ে যাবে।

লকডাউন থাক বা না থাক, করোনা কিন্তু ঘরের অন্ধকার কোণগুলোতে তীব্র আলো ফেলেছে। আমরা বেশিরভাগ মানুষই দেখেছি, আর পিছনোর জায়গা নেই। দেওয়ালে পিঠ একেবারে ঠেকে গ্যাছে। এগোনোও যাচ্ছে না। পা আর মন দুটোই পাথর হয়ে গ্যাছে। এখন প্রশ্ন, পাথর দিয়ে পাথরে আঘাত করলে কি স্থবিরতা ভাঙবে? সত্যি যদি চরিত্রগুলো প্রত্যেকে একে অন্যের মুখোমুখি দাঁড়াত? হৃদি-কুমু-বিন্তি কিংবা তপনবাবু আর তনুময় যদি বন্ধু হত, তবে কি এমনটা হত! তাই বন্ধু হওয়ার সহজাত প্রবৃত্তিটাকে একটু শানিয়ে তুলি। তবেই পাথরের ভেতর থেকে জেগে উঠবে আমি-তুমির মধ্যে লুকিয়ে থাকা জীবনযুদ্ধের এক একজন সংশপ্তক।

No comments:

Post a Comment