Sunday 5 July 2020

নতুন আঙ্গিকের দিকে!

দারিদ্র কমছে বৈষম্য বাড়ছে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

সম্প্রতি দক্ষিণ ২৪-পরগণায় দু’ দলের রাজনৈতিক এক সংঘর্ষে জনৈক আক্রান্ত ব্যক্তি টিভি চ্যানেলের সামনে তাঁর ওপর আক্রমণ হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিজ ক্ষতির বহর যা বললেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মধ্য-তিরিশের সে যুবক তাঁর ক্ষতিপূরণের তালিকায় জানালেন, তাঁর মোটরবাইকে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয়েছে, তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়ায় তাঁর নগদ ৩০ হাজার টাকা পুড়ে গেছে, রেফ্রিজারেটার ও টিভি’ও ভেঙ্গেচুরে দিয়েছে। খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে এই যুবক যখন কথাগুলি বলছেন তখন তাঁকে দেখে কখনই ‘অবস্থাপন্ন ঘরের’ কেউ বলে মনে হবে না। কিন্তু তাঁর ঘরে এতসব ছিল, যা অবশ্যই অর্থনীতির বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই পর্যবেক্ষণ থেকে এমনটা মনে করার কারণ নেই যে তাঁর ঘরে এত কিছু ছিল বলে তাঁর ওপর হওয়া আক্রমণের প্রসঙ্গটা হাল্কা হয়ে গেল। আমি আসলে গ্রাম ও শহরে বদলে যাওয়া যাপনের চিত্রগুলিকে ধরার চেষ্টা করছি। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে ‘গরিব গরিব’ বলে যে লিবারেল আর্তনিনাদে সেমিনার, সম্মেলন গরম হয় তার তল পাওয়ার চেষ্টা করছি। অবশ্য কেউ বলতেই পারেন, একজন ব্যক্তি কী হিসেব দিলেন তা দিয়ে গোটা সমাজটাকে চেনা যাচ্ছে কী? না, অবশ্যই না। তাই আমাদের উচিত, কতকগুলো তথ্যের দিকে ফিরে তাকানো। আসলে, ওই ব্যক্তির বয়ানটি আমাকে উস্কে দিল আরও তথ্যের দিকে নজর দিতে।

গরিব সম্পর্কিত সমস্ত কুসংস্কার ত্যাগ করে অন্তত এই কথাটি জোর দিয়ে বলা যাক যে ভারতবর্ষে গত ১৫ বছরে দারিদ্র অনেকটাই কমেছে। গত দশকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত Oxford Poverty and Human Development Initiative (OPHI) দারিদ্র নিরূপণে Multi-Dimensional Poverty Index (MPI) নামক একটি সূচক নির্মাণ করে। তা দিয়ে তারা বিশ্বের ১০৫টি দেশের দারিদ্রের মাপজোখ করেছে। এই সূচকের ভিত্তি হল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাপনের মানের মাত্রার ওপর নির্ভর করে দশটি প্যারামিটারের মধ্যে একটিতেও যদি কোনও ব্যক্তি পিছিয়ে থাকেন তাহলে তিনি দরিদ্র। OPHI’এর মতে, ২০০৫-০৬ সালে ভারতে ৬৩ কোটি মানুষ দরিদ্র ছিলেন যা ২০১৫-১৬ সালে নেমে এসেছে ৩৬ কোটিতে। ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলি হল- বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড ও মধ্যপ্রদেশ। এই চারটি রাজ্যেই ১৯ কোটি দরিদ্র মানুষের বাস যা মোট দরিদ্র মানুষের (৩৬ কোটি) অর্ধেকের বেশি। অর্থাৎ, বাকী রাজ্যগুলিতে দারিদ্রের প্রকোপ অনেক কম। যেমন, একই সময়ে বিহারে মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশই দরিদ্র অথচ কেরালায় তা ১.১ শতাংশ। সে ব্যতিরেকে দারিদ্র এ দেশে যে নিম্নমুখি তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এত দ্রুত তা ঘটল কীভাবে?

বলতে দ্বিধা নেই, ১০০-দিনের কাজের প্রকল্প, স্কুলে মিড-ডে মিল, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের নানারকম কল্যাণমুখি যোজনা, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নানান প্রকল্প- এইসবের মিলিত ফলশ্রুতিতে একটা বদল নিশ্চয়ই এসেছে। তা নিয়ে প্রচুর চুরি-চামারি, অর্থের নয়ছয় হয়েছে, এও সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও গরিব মানুষের একটা অংশের কাছে এই কল্যাণ উদ্যোগগুলো পৌঁছেও গেছে। এর পিছনে কিছু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও আছে। তবে, খেয়াল রাখতে হবে, দারিদ্র কমার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আয়ের বৈষম্য বেড়েছে বিপুল।

১৯৯১-৯২ সাল থেকে এ দেশে যদি উদার অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়ে থাকে তাহলে তা ছিল এক পার্টির রাজনৈতিক আধিপত্যেরও অবসান। কেন্দ্রে ও রাজ্যে ধীরে ধীরে কংগ্রেসের একাধিপত্যের যুগ অস্তমিত প্রায়। বহু রাজনৈতিক দলের টানাপোড়েনে কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতার নানান সমীকরণ ও বিন্যাস। ফলে, দলগুলির পক্ষে ক্ষমতায় আরোহন ও অবস্থান ক্রমেই হয়ে দাঁড়াল এক কষ্টসাধ্য প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া। প্রথমে ভাবা গিয়েছিল, উদার অর্থনীতির সূত্রপাতে বৃদ্ধির হার এতটাই সরগরম হবে যে তার থেকেই উন্নয়নের রস চুইয়ে পড়বে নিচের দিকে। গরিব মানুষেরও অবস্থার উন্নতি হবে। কিন্তু পুঁজির নির্মম যাপনে তেমন কোনও অবকাশ নেই। জল-জঙ্গল-জমি দখল করে, উচ্ছেদকে নিয়মে পরিণত করে, এসইজেড বানিয়ে উদার পুঁজির যে অমানবিক যাত্রা, তাতে মূল উদ্দেশ্যই ছিল মুনাফা, আরও উচ্চ হারে মুনাফা। সামান্য হাই-এন্ড কর্মসংস্থানের বিনিময়ে বহু সাধারণ মানুষের উচ্ছেদ হওয়া, তাড়া খাওয়া, বিপন্নতার সামনে তখন আর কোনও পথ নেই। সব থেকে নিপীড়িত ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এলাকাগুলিতে আদিবাসী ও গরিব মানুষেরা শুরু করলেন প্রতিরোধের লড়াই। কোথাও কোথাও তা সশস্ত্র রূপ পেল। সারা দেশ জুড়েই শুরু হল এক অস্থিরতা। পাশাপাশি, নতুন আলোকমালায় সেজে ওঠা নগরগুলির উদ্ভ্রান্ত যাপন। হঠাৎ যেন পুঁজির স্রোত বড় বেগবান। আইটি সেক্টরের উর্ধ্ব আরোহন ও কর্মরতদের বিদেশ পাড়ি মধ্যবিত্ত সমাজের একাংশের মধ্যে নিয়ে এল নতুন যাপন-ঝিলিক। কিন্তু সমাজের এক বড় অংশ হারিয়ে যেতে থাকল উন্নয়নের অকাল বোধনে।

যে ছবিটা উঠে এল- একদিকে রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতায় থাকার বাসনা, অন্যদিকে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল জুড়ে কম বেশি সশস্ত্র প্রতিরোধের লড়াই। এমতাবস্থায় দেশের দরিদ্রতর মানুষের অবস্থা ফেরাতে ও নিজেদের ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করতে একগুচ্ছ সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া ক্ষমতায় আসীন বা আসীন হতে চাওয়া রাজনৈতিক দলগুলির আর কোনও উপায় ছিল না। ইতিমধ্যে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ মুখ থুবড়ে পড়েছে। অতএব, ধীরে ধীরে একবিংশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হল নানান জনমুখি প্রকল্পের ভাবনাচিন্তা। এমএনরেগা, মিড-ডে মিল- এসবের মধ্য দিয়ে শুরু হল গরিব মানুষের কাছে রাষ্ট্রের তরফে কিছু পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস। যাতে কোনওরকমে হলেও এই দুঃস্থ মানুষগুলি বেঁচেবর্তে থাকে। অভুক্ত অবস্থায় থাকলে এরা বন্দুক ধরছে যে! এর পাশাপাশি অবশ্য কিছুকাল পুঁজি টানার প্রয়াসও চলল। তবে তা অচিরেই গুটিয়ে এল। কারণ, পুঁজি আসতে চায় তার নিজ শর্তে, মুনাফা লাভের অঙ্কে। কিন্তু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় তার সমস্ত শর্তকে অতটা আর মান্য করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি, ভার্চুয়াল দুনিয়ার ক্রমউত্থান বহু পুরনো কর্মকৌশলকে অসার করে দিয়েছে। যেমন, খুচরো বাজারে বিদেশি পুঁজির প্রবেশ নিয়ে যে হৈ-হট্টগোল, তার আর কোনও প্রাসঙ্গিকতাই থাকল না, কারণ, ইতিমধ্যেই প্রসার পেতে শুরু করেছে ই-কমার্সের ভুবন যা অচিরেই সমগ্র বিশ্বকে এক বাজারের নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম। ওয়ালমার্ট বিরোধী সংগ্রাম উপায়ন্তরের অক্ষমতায় অ্যামাজনকে নিঃশব্দে মাঠ ছেড়ে দিল। ফলত, সবটা মিলিয়ে, ২০১০-১১ সাল নাগাদ থেকে রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন দলগুলির মধ্যে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি এতটাই সমানে সমানে হয়ে পড়ল যে কল্যাণমুখি অর্থনীতির লাগাম হাতে নেওয়া ছাড়া তখন কোনও দলের কাছে আর কোনও পথ অবশিষ্ট নেই। আশার হলেও, ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের এই সবল দিকটি গড়ে উঠতে অনেকটা সময় লেগেছে। তবে তা এখনও অপূর্ণ, খণ্ড, বিপদাপন্ন।

এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ভারত দারিদ্র মোচনে বেশ কিছুটা এগিয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভার্চুয়াল দুনিয়ার অভিঘাতে গত দশ বছরে অর্থনীতির গতিপথটাই পালটে গেছে আমূল। গিগ অর্থনীতির উত্থানে বহু অস্থায়ী কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং তা আয়ের পথ নানা ভাবে খুলে দিয়েছে। কিন্তু তা কতটা মানবিক, মনুষ্য-উপযোগী সে সব নিয়ে বিতর্কও আছে প্রভূত। সে সব বাদে হঠাৎ করে কোভিড আক্রান্ত পৃথিবী পড়েছে এক মহাচক্রজালে। আমাদের দেশেরও তা থেকে নিস্তার নেই। বহু কাজ, বহু সম্ভাবনা নিঃশব্দে স্তব্ধ হয়ে গেছে। এ এক অস্বাভাবিক ও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। তবে তা অর্থনীতির আঙ্গিকেও আনছে দ্রুত ও সুদূরপ্রসারী বদল। সমগ্র রাজনৈতিক-অর্থনীতির জগতে ভার্চুয়াল দুনিয়া ও ডিজিটাল অর্থনীতির হাতেই লাগাম আরও দৃঢ়বদ্ধ হচ্ছে। নতুন ও অস্থায়ী কাজের যেমন জোগান বাড়বে তেমনই মনুষ্যশ্রমের প্রয়োজনও ক্রমেই ফুরবে। বহু মানুষের হাতে কাজ না থাকাটাই হবে আগামী ভবিতব্য। আর সেইজন্যই সকলের হাতে ‘ন্যূনতম আয়’ পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াসের কথা বারবার নানা মহল থেকে উঠছে। এটুকু বলাই যায়, আমাদের দেশে গরিব মানুষের জন্য আংশিক ন্যূনতম আয়ের একটা বন্দোবস্ত বিভিন্ন ভাবে গত এক-দেড় দশকে সেরেই রাখা হয়েছে। তার কিছু সুফলও পাওয়া গেছে। কিন্তু এ কথাটিও মনে রাখা দরকার, ‘ন্যূনতম আয়’এর পক্ষে যেমন বহু রাজনৈতিক দল সওয়াল করছে, তেমনই কর্পোরেট রাঘববোয়ালরাও করছে। কারণ, দারিদ্র কমলেও আয়ের বৈষম্য এতটাই বেড়ে গেছে যে তা যে কোনও সময়ে সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। আজকের পরিণত ও প্রযুক্তি-লালিত পুঁজি তাই সামাজিক সুরক্ষার পক্ষে।

তাহলে আমরা কি শনৈ শনৈ এক সমাজতান্ত্রিক আঙ্গিকের অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছি? এ কিছুটা বেয়াড়া ও বেঢপ প্রশ্ন। তার উত্তরও কিছুটা সুদূর। তবে বলতে ইচ্ছে করে, শুধু আমরা নই, সমগ্র বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশ তাই এগোচ্ছে। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিবাদের যেমন দ্বন্দ্ব আছে আবার তা দুই দুইয়ের পরিপূরক। একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকেও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বলা যায় আবার একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রও সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে। সাধে কি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন সমাজতান্ত্রিক না পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তা নিয়ে কম বিতণ্ডা হয়েছে? পুঁজির সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষার মেলবন্ধনই সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদী সমাজের মূল আঙ্গিক। এতেই পুঁজি সুরক্ষিত থাকে ও সর্বজনীন হয়ে ওঠে। তবে এতটা সরলও নয় সবটা। এ নিয়ে বিস্তারিত অন্য কোনও লেখায় বলা যাবে।

তবে আজকের সময়ের মূল বৈশিষ্ট্য হল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাত ধরে পুঁজি এক সর্বজনীন রাজনৈতিক-অর্থনীতির পথের হদিশ পেয়েছে। মুনাফার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই তা নির্গত। তবে, এই পথের লাগাম আর রাষ্ট্রনায়কদের হাতে নেই। তা গভীর অ্যালগরিদমের সূত্র ধরে চলমান। তা এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চলেছে। যেখানে পুরনো রাষ্ট্র তার গরিমা ও সাজসরঞ্জাম নিয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। এক নতুন ব্যবস্থার উত্থানের সামনে আমাদের অপলক দৃষ্টি।


3 comments:

  1. Excellent akdom bastober reflection fute utheche ay lekhay

    ReplyDelete
  2. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত আগামী পৃথিবী তে গরীব সাধারণ মানুষ কি উবে যাবে।নাকি ব্যাক্তি মানুষ একাক সত্তা নিয়ে একেকজন উদ্যোগ পতি হবেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে বলেই 'ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম'এর কথা এখন খুব চর্চিত। এর প্রাক পর্যায় নানান প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই আসরে হাজির।

      Delete