Sunday 12 July 2020

আগামী দিন!

যন্ত্রের দাপটে শ্রমের বৈকুণ্ঠযাত্রা
সোমনাথ গুহ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্যর ‘আশায় বাঁচে চাষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বৃহৎ সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় একটি তাৎপর্যমূলক খবর নজরে এল: একশো তিরিশ বছরের প্রাচীন মোহনবাগান ক্লাবের সাথে মাত্র ছয় বছর আগে গজিয়ে ওঠা অ্যাটলেটিকো দ্য কলকাতা'র সংযুক্তিকরণ। বাংলার সুবিশাল এবং আবেগমথিত ফুটবল ঐতিহ্যের কর্পোরেটিকরণের আগাম পূর্বাভাস পাই বইটির 'বিনোদন ও বিজ্ঞাপন' সংক্রান্ত অধ্যায়ে যেখানে লেখক বলছেন, 'আজ আর এমন কোনও  ক্ষেত্র থাকতে পারে না যেখানে পুঁজি অনুপ্রবেশ করবে না… এটাই তার গতিপথ। ...কারণ, নতুন আবহেই তার মুনাফার উর্ধ্বগতি।' এমনটা নয় যে এটিকে-মোহনবাগানের মালিক সঞ্জীব গোয়েঙ্কা শুধুমাত্র ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু তিনি জানেন  ঐতিহ্যশালী ক্লাবের সাথে সংযুক্তিকরণ এমন এক ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করবে যা তাঁর মুনাফার পথ প্রশস্ত করবে। মুনাফার সন্ধানে পুঁজির এই উদগ্রীব, নাছোড়বান্দা, নিরন্তর যাত্রা যা একটি পণ্যের নির্মাণে শ্রমের অবদান ক্রমশ কমিয়ে আনে, যার ফলে তার প্রায় বৈকুণ্ঠযাত্রা ঘটে এবং যন্ত্রের অবদান ক্রমান্বয়ে দৃষ্টান্তমূলক ভাবে বাড়ে, সেটাই এই বইয়ের মর্মকথা।

শুরুতে ‘লেখকের কথা’তে অনিন্দ্য লিখছেন, তিনি একাডেমিক জগতের লোক নন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকে তাঁদের দোরে ঘুরে ঘুরে তাঁর জীবন ও অর্থনীতির পাঠ। অর্থনীতির বই পড়বার প্রয়োজন হলেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে। মনে হয় এ তো বড় কঠিন, কাঠকাঠ ব্যাপার, মন বিদ্রোহ করে। জারগনে ভারাক্রান্ত সেই সব বইয়ের দুটি পাতা পড়লেই ক্লান্তি আসে। কিন্তু একজন ব্যক্তির শ্রম থেকে নির্মিত পণ্য, সেটির বিনিময়- বাজার-কড়ি-বাজারের ওপর ক্ষমতার দাপট- মুদ্রা-মূল্য-দাম-উদবৃত্ত মুল্য- এক অংশ মুনাফা-আরেক অংশ আবার পুঁজি হিসাবে বিনিয়োগ- পুঁজির এই চক্র যা অন্তহীন ভাবে উদ্বৃত্ত উদগীরণ করছে, তা তিনি অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাবে ছবির মতো চিত্রায়িত করেছেন। বিষয়টি কিন্তু জটিল এবং অনেক লেখক এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করেন এবং পাঠককে বিভ্রান্ত করেন। কিন্তু মূল্যতত্ত্ব সম্পর্কে লেখকের স্বচ্ছ এবং সম্যক উপলব্ধির কারণে তিনি অনায়াস দক্ষতায় পাঠকের কাছে একটি জটিল বিষয়কে সহজ করে তুলে ধরেন এতটাই যে একটা অর্থনীতির বই তরতর করে থ্রিলারের মতো পড়ে ফেলা যায়। 

পুঁজির এই আগ্রাসী, নির্মম যাত্রায় লেখক দেখাচ্ছেন, কীভাবে একটি শিল্পের সূর্যাস্ত হয় এবং শ্রমের অবদান কমিয়ে দিয়ে অধিক যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে নতুন ক্ষেত্রের আবির্ভাব ঘটে যা মুনাফার হারে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি ঘটায়। লেখকের ভাষায়, 'ম্যানুফ্যাকচারিং-এর পুরনো জমানা ছেড়ে পুঁজি এসে ভেড়ে পরিষেবা ক্ষেত্রের তীরে এবং তারপর আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রে যেমন আইসিটি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায়।' পণ্য উৎপাদনে মনুষ্য শ্রম যন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়ায় ১৯৯৯-২০০০'এ Y2K একটা মাইলফলক হিসাবে গণ্য হতে পারে। Y2K সমস্যা সমাধানের জন্য আইটি শিল্পে বিপুল কর্মীবাহিনী নিয়োজিত হয় এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লম্ফন ঘটে। তথ্য এখন হয়ে উঠল অন্যতম পণ্য- ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের যুগে যে পণ্য ছিল বস্তুগত তাই এখন হয়ে উঠল অধরা (Tangible থেকে Intangible)। তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়ক বেয়েই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্ভব।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা! এ এক অনন্য, বিস্ময়কর বিশ্বকর্মা যা অতীতের যাবতীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার শুধু পরিবর্তন নয় এক আমূল রূপান্তর ঘটায়। লেখক এই যুগান্তকারী আগমনের তিনটি উপাদানকে চিহ্নিত করছেন: (১) এক বিশাল ও ক্রমবর্ধমান ডাটাবেস; (২) গণনাশক্তির ক্ষমতার বিস্ফোরণ; (৩) ভেঞ্চার পুঁজির আগমন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত অর্থনীতি পুঁজির বিচরণকে অবাধ, উন্মুক্ত করে দেয়, তাকে আর দেশকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। হাতে একটা স্মার্টফোন থাকলেই সারা বিশ্বকে করায়ত্ত করা যায়। ফেসবুক, টুইটার, গুগল, ইন্সটাগ্রামের জনপ্রিয়তা দুই দশকের মধ্যে বিস্ময়কর ভাবে বৃদ্ধি পায়। অ্যামাজন, সুইগি, জম্যাটো, উবের, আর্বান ক্ল্যাপের সৌজন্যে যাবতীয় পরিষেবা মানুষের হাতের মুঠোয় এসে পড়ে। বিশ্ব হয়ে পড়ে এক 'ভার্চুয়াল লোকালয় বা বিশ্বায়িত গ্রাম'। তথ্যের এক মহাসমুদ্র তৈরি হয় যেখান থেকে মানুষ বেঁচে থাকার যাবতীয় সামগ্রী আহরণ করতে পারে আবার যা তার যাপনের ওপর বেড়ি পড়ায়, নজরদারিতে বন্দি করে। এই বিশাল ডাটাবেস বা তথ্যভাণ্ডার যে সব কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ করে তারা ক্ষমতার লড়াইয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দেয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে এই কর্পোরেটদের সংঘাত ক্রমবর্ধমান যা অনেক সময় অনিবার্য হয়ে পড়ে। 

প্রযুক্তির এই মহাপ্রলয়ের কারণে শ্রমের বাজার হয়ে পড়ে পরিবর্তনশীল, অস্থির, অনিশ্চিত। অনিন্দ্য লিখছেন, 'দশ কি পাঁচ বছর আগে যিনি এক ধরনের আঙ্গিক ও প্রোগ্রামিং-এ দক্ষ ছিলেন তিনি আজ একেবারে পিছিয়ে পড়তে পারেন আজকের নলেজ-ডোমেইন-এ পারদর্শী কোনও শ্রমবাহকের কাছে। তাই চাকরির বাজার আজ অনিশ্চিত।' কিন্তু তিনি বলছেন এমনটা নয় যে কাজ নেই; কাজ আছে কিন্তু চাকরি নেই। গিগ অর্থনীতির উদ্ভব ঘটছে, যাতে 'শ্রম অনেক বেশি কার্যভিত্তিক, চুক্তিবদ্ধ ও স্বল্পমেয়াদি'। এর উদাহরণ হিসাবে তিনি সার্ভেন্ট ইকোনমি বা ভৃত্য পরিষেবার কথা বলছেন যা আমেরিকায় সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়েছে। এছাড়া আছে যন্ত্রযুগের নতুন ধরনের সব কাজ: ম্যানিকিউর, পেডিকিউর, বৃদ্ধদের দেখভাল, শিশুদের যত্ন ইত্যাদি। যন্ত্র দ্বারা শ্রমের প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া এমন পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে যে অধিকাংশ লোক কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এদের জীবিকা নির্বাহ এবং সমাজে অস্থিরতা ঠেকানোর জন্য রাষ্ট্র এদের ব্যাংকের খাতায় কিছু টাকা জমা করবে যা ইদানীংকালে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ (ইউবিআই) তত্ত্ব নামে চর্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশে অনেক রাজ্যে বিভিন্ন খাতে- মিড-ডে-মিল, উজ্জ্বলা যোজনা, কন্যাশ্রী প্রকল্প- এখন যে অনুদান দেওয়া হচ্ছে তা এই ইউবিআই'এর প্রাকপর্ব বলা যেতে পারে।

গত পঞ্চাশ বছর ধরে যবে থেকে সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেছি সেই সময় থেকেই শুনে আসছি, পুঁজিবাদ মুমূর্ষু, ভেঙে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। হায়, সেই পুঁজিবাদ আজও একের পর এক অভাবনীয় উদ্ভাবন করে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে চলেছে। তার ধ্বংসের বীজ তারই মধ্যে নিহিত আছে- এটা খালি আপ্তবাক্য, বাস্তবে প্রমাণ কিছু পাইনি। পুঁজিবাদের এই চিরন্তনতা সম্পর্কে লেখক একটা মোক্ষম কথা বলেছেন: 'পুঁজিবাদ নিরন্তর ও নিয়ত পুনঃউৎপাদিত হয় আমার, আপনার সকলের কার্যকারণ ও অংশগ্রহণে। আমাদের কেনাবেচা, জীবনাচরণ, বেশি বেশি আয়ের আকাঙ্ক্ষা, সুযোগ-সন্ধান এবং আগ্রাসী ক্রেতামুখি বা বিক্রেতামুখি বোধ ও অনুশীলন পুঁজিবাদকে আমাদের সকলের মধ্যে লালনপালন করে। আমরা এই পুঁজিবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট অথচ তাকেই স্বেচ্ছায় ধারণ ও বহন করি আমাদের দৈনন্দিন নিত্যক্রিয়ায়। গোড়ার সমস্যাটা এখানেই নিহিত।' এই সূত্রায়ন করতে অনিন্দ্য অ্যাডাম স্মিথ থেকে অরবিন্দ অবধি পরিক্রমা করেছেন, আরবের জ্ঞানতাপস ইবন খালদুনকে শ্রমতত্ত্বের জনক হিসাবে অধিষ্ঠিত করেছেন।

তাহলে কি যন্ত্রের দাপটে মানুষের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত? যন্ত্রই কি হয়ে উঠবে বিশ্বের চালিকাশক্তি? যন্ত্র মনুষ্য শ্রমকে প্রায় সর্বত্র প্রতিস্থাপিত করবে, কিন্তু যন্ত্র তো স্থির পুঁজি; পণ্য উৎপাদনে শ্রমের আর যদি কোনও ভূমিকাই না থাকে তাহলে শ্রম ও পুঁজির চিরায়ত দ্বন্দ্ব কী রূপ নেবে? আর কর্মদক্ষতায় যন্ত্র না হয় মানুষের চেয়ে হাজার গুণ শ্রেষ্ঠ, কিন্তু আবেগ, অনুভূতি, প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতা? লেখক সবজান্তা হওয়ার চেষ্টা করেননি, তিনি কোনও নিদান দেননি। তিনি গান্ধী, অরবিন্দ, মার্কস'এর পথ অনুসরণ করে ব্যক্তি মানুষের বিকাশের কথা বলেছেন- সত্যের খোঁজে মানুষের এক নিরন্তর অন্বেষণ যা হয়তো বা সৃষ্টি করবে এক নতুন মানব। 

No comments:

Post a Comment