Monday, 14 July 2025

আরও এক মৃত নদী বাঁচানো

মরালী নদীর পুনরুজ্জীবন চাই

বিবর্তন ভট্টাচার্য



মৃত নদী বুড়িগঙ্গা প্রাণ ফিরে পেতেই চাকদহ ব্লকে হৈ হৈ পড়ে গিয়েছে। মৃত নদীতে জোয়ার-ভাঁটা খেলছে দেখে এলাকার মানুষ দারুণ ভাবে উৎসাহিত। হরিণঘাটা ব্লকের প্রাক্তন এমএলএ একদিন আমাকে অনুরোধ করলেন, বুড়িগঙ্গা তো অনেকটা সংস্কার হল, এবার মরালী নিয়ে একটু ভাবুন।  আসলে নদিয়া জেলা হল নদীর জেলা। এই জেলায় প্রধান নদী ছয়টি; যেমন, গঙ্গা, ইছামতী, চূর্ণী,  মাথাভাঙা, জলঙ্গী, অঞ্জনা। এছাড়াও প্রচুর মৃত নদী আছে; এগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, মরালী, যমুনা উল্লেখযোগ্য। তাই শুরু হল পর্যবেক্ষণ।  

চাকদহ ব্লক অঞ্চলে অবলুপ্ত নদীগুলোর মধ্যে মরালী একটি। মরালীর ইতিহাস খুঁজে পাওয়া এতটাই কঠিন আর কোন দশকে এই নদী একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে তা' অনুমান করাও বেশ শক্ত। রেনেল সাহেব কৃত ১৭৬৪ সালের একটি মানচিত্রে মরালী নদীর প্রবাহপথ হিসেবে চাকদহ শহরের দেড় মাইল উত্তরে সামান্য এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি সরু সংকীর্ণ জলরেখা দৃষ্ট হয়। এছাড়া ১৯১৭-২১ সালে সার্ভেকৃত ও ১৯৩১ সালে প্রকাশিত চাকদহ থানার মানচিত্রে ওই গতিপথ বরাবর সর্পাকৃতি একটি জলরেখা হিসেবে চিহ্নিত আছে। তবুও পূর্বদিকে বনগ্রাম থানার মানচিত্রেও ওই গতিপথ অঙ্কিত আছে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে ওই নদীকে মরাইল (MORAIL) বিল নামে অভিহিত করা হয়েছে। বর্তমানে যেমন অঞ্জনা নদীকে সরকার খাল বানিয়েছে, কারণ, খাল-বিল-বাঁওড় বিক্রি করা অত্যন্ত সহজ। তাই নদীকে খাল বানাও।  

মরালী নামের উৎপত্তি কোথা থেকে তা' বলা কঠিন। এমন কত অজানা অখ্যাত নদী স্নেহময় সুধায় পলি দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের কল্যাণ সাধন করে গিয়েছে অথচ তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া ভার। আজও জগৎ সংসারে কত মানুষ নীরবে জগতের হিতসাধন করে থাকেন কিন্তু তাঁদের কথাই বা কজন মনে রাখে? তেমনই এককালের মঙ্গলদায়িনী মরালীও হারিয়ে গিয়েছে ইতিহাসের অতল তলে।

মরাল থেকে মরালী নাম হওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মুরলীগঞ্জ থেকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব দিয়ে ভাগীরথী পর্যন্ত একটি সহজ জলপথ ছিল। সেই জলপথই মরালী। মরালীর যে বৃহত্তর অংশটুকু এখন নদীর আকারে আছে, তার বুকে চড়া পড়ে নদীর প্রবাহ বন্ধ। এই মরালীর ওপর রাজ্য হাইওয়ে এবং বড় বড় ইমারত গড়ে উঠেছে। নদীটি ভাগীরথী থেকে বেরিয়ে যে যমুনাতে গিয়ে মিশেছে, তা' খানিকটা বোঝা গিয়েছিল ২০০০ সালের বন্যার সময়। বর্তমানে তা হেড়ের খাল ও পূর্ব বিষ্ণুপুর হয়ে শ্রীনগর, হিঙনাড়া, বল্লভপুর, বৈরামপুর, বৃদ্ধপাল্লা, পাল্লা, গোপালনগর দিয়ে যমুনাতে মিশেছে। কিন্তু মরালীতে জল সরবরাহকারী ১৭টি বিল-বাঁওড়ের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গাঙ্গরা বিল, ধর্মদহ বিল, নেউলিয়া বিল, সাতশলাকি বিল, ট্যাংরা খাল, মরালী বিল, পারুলিয়া বিল, শ্রীরামপুর খাল, কচুয়া বিল, বড় বিল,  কামডোব বিল, গা বিল, হাতিবাঁধা বিল, চেতলা বিল, চুমুকদহ বিল, মাতলা বিল, ঢাকা বিল-- এগুলো সবই মরালীর জল সরবরাহকারী খাল বিল।

আনুমানিক ১৫ কিমি হেজে ও মজে যাওয়া এই নদীতে কোনও এক সময়‌ কুমীরের বাস ছিল। আর এই মরালী নদীর মৃত্যুর ফলে যমুনা নদীরও মৃত্যু ঘটেছে। যমুনা নদী ভাগীরথী থেকে বিরহীর পাশ দিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক পার হয়ে হরিণঘাটা হয়ে গোবরডাঙা রেল স্টেশনের তলা দিয়ে ইছামতীতে গিয়ে মিশেছে।



২০০০ সালের প্রবল বন্যার পর এলাকার মানুষ মরালী নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। বুড়িগঙ্গার মতো হেজে যাওয়া নদী যদি প্রাণ ফিরে পায় তবে মরালীতে কেন প্রাণসঞ্চার হবে না? প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর পাড়ে অন্তত ২ লক্ষ মানুষের বসবাস। এখনও প্রচুর মৎস্যজীবী ও কৃষিজীবী মানুষ মরালী নদীর ওপর নির্ভরশীল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রিয় এই মরালী নদী। তিনি এই নদীপথেই সপ্তগ্রাম পর্যন্ত যাতায়াত করতেন। মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস এই নদীর উভয় পার্শ্বস্থ গ্রামগুলোতে। মরালী নদী সংস্কার হলে যমুনার জল বৃদ্ধি পাবে। ফাঁসতলা, খেদাইতলা, সাতশলাকি গ্রামের মানুষ ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মরালী নদীর সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন।

দীর্ঘ দশ বছর নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে চাকদহ বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা এবং দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম'এর উদ্যোগ ও আন্দোলনে বুড়িগঙ্গাতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। এই অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে তাই এবার মরালী নদীর পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা। ২০২৪'এর সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে একাধিকবার সরেজমিন পর্যবেক্ষণে ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মরালী নদীর ছয়টি অবস্থা দেখা গেছে:

১) মহানালা, মসরা ও মথুরাপুর এলাকায় নদী অত্যন্ত সংকীর্ণ অবস্থায় হিউম পাইপ বা কালভার্ট'এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত;

২) ইছাপুর এলাকায় নদীর বুকে বাঁধ দেওয়া হয়েছে;

৩) পারাই গ্রামে নদীতে কোথাও শৈবাল দাম আবার কোথাও কালচে জল;

৪) মথুরাগাছি এলাকায় নদী অন্তঃসলিলা;

৫) সাতসলাকি, খেদাইতলা এলাকায় নদী দিগন্ত বিস্তৃত বিলের মধ্যে হারিয়ে গেছে;

৬) সাতাশী ও নহাটা এলাকার কয়েকটি জায়গায় নদীর খাত দখল হয়ে গেছে।

বস্তুতপক্ষে, মরালী নদী তিনটি ব্লকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত-- চাকদহ, হরিণঘাটা ও বনগ্রাম। ফলে, এই নদীর পুনরুজ্জীবনের জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রামের মানুষের উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন। আমাদের ধারণা, ১০০ দিনের কাজের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এই কাজ সম্ভব। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবিত হবে, মৎস্য চাষের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, মানুষ খেয়েপরে বাঁচবে এবং এলাকার মানুষের অন্যত্র কাজের খোঁজে চলে যাওয়া হ্রাস পাবে।


13 comments:

  1. খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখা। বুড়িগঙ্গা নদীর পুনরজ্জীবনের ইতিহাস জানার ইচ্ছে রইল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই লিঙ্কে দেখতে পারেন:
      https://youtu.be/R6kYzcfaiMc?si=yGYI7QuxkEYAxI78

      Delete
    2. খুব ভালো লাগলো।

      Delete
    3. দীপক মিত্র15 July 2025 at 13:22

      প্রকৃতি রক্ষা ও সভ্যতা
      পুনরুদ্ধারের মহৎ এই কাজে আমরাও আছি।

      Delete
  2. খুবই ভাল লেখা, রাজ্যের মানুষের রাজ্যে ই কাজের ব্যবস্থা থাকলে আর অনত্র এত অপদস্থ আর শঙ্কিত হতে হবেনা, তাছাড়া পরিবেশগত ভাবে ও এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

    ReplyDelete
  3. আমি একজন মৎস্যজীবী, মৌমাছিপালক ও প্রকৃতিপ্রেমী হিসাবে এই মহৎ প্রয়াসে আন্দোলনের সাথী হতে চাই।

    অর্ণব চক্রবর্ত্তী
    বারাসাত, উত্তর চব্বিশ পরগনা
    ৭০০৩৯৯১৩৮৯

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুব ভালো। আপনার সঙ্গে বিবর্তনবাবু যোগাযোগ করে নেবেন।

      Delete
    2. আমার ফোন নম্বর ৯৩৩২২৮৩৩৫৬ কথা বলুন। আমরা রাজি।

      Delete
    3. তথ্য সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন। স্থানীয় মানুষ, জনপ্রতিনিধি ও সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

      Delete
  4. নদী মানে শুধুই জলধারা নয়

    ReplyDelete
  5. Paresh Debnath15 July 2025 at 07:37

    নদী মানে শুধুই প্রবাহিত জলধারা নয়।নদী মানেই একটা গ্রামীণ অর্থনীতির বনিয়াদ।একটা সহনশীল সংস্কৃতির বিকাশও ঘটে এই নদীকে কেন্দ্র করে।তাই নদী বাঁচানোর এই প্রয়াস অত্যন্ত অভিনন্দনযোগ্য।

    ReplyDelete
  6. যার যতটুকু প্রশাসনিক ক্ষমতা আছে তা জলসম্পদ মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া র কাছে পৌঁছে দিন। মিষ্টি জলের আধিক্ষ বৃদ্ধি পাবে বিদ্যাধরী আর ইছামতী তে।

    ReplyDelete
  7. অসাধারণ তথ্যসোমৃদ্ধ প্রতিবেদন, বুড়িগঙ্গা পুনর্জীবনের কাহিনী জানতে পেরে অত্যন্ত খুশী হলাম, মরালি নদীও আপনাদের মত পরিবেশপ্রেমী মানুষের দ্বারা তার আসল চেহারা ফিরে পাক এবং তার দ্বারা ওই নদীর দুই পাড়ের মানুষের উপকার হোক এটাই কাম্য।

    ReplyDelete