Monday 26 August 2024

মহাঅতীতের চক্রব্যূহভেদ

নির্দ্বিধ গোলাম মুরশিদ

অমৃতা ঘোষাল


(৮ এপ্রিল ১৯৪০ - ২২ অগস্ট ২০২৪)

মহাঅতীতের যন্ত্রণায় ঠিক কতটা বিদ্ধ হন অজর ইতিহাসবেত্তা! ক্ষয়ীভূত সত্য আর প্রপঞ্চময় মিথ্যার আন্দোলনে ইতিহাস-সন্ধানীর চোখে ঝলসে ওঠে ভগ্নস্তূপের আড়ালে থাকা রত্নপুঞ্জ। ইতিহাস-পাথারে দুর্ধর্ষ ডুবুরির মতো এই তথ্য-রত্নরাজি আবিষ্কারের সম্যক ক্ষমতা ছিল ড. গোলাম মুরশিদের। 

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল পূর্ববঙ্গের বরিশালের উজিরপুর এলাকার অন্তর্গত ধামুরা গ্রামে তিনি জীবনের প্রথম আলো দেখেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি তীব্র অনুরাগ অনুভব করেন শৈশব থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর অধ্যাপনাও করেন যথাক্রমে, ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রায় দুই দশক সফল অধ্যাপক হিসাবে কৃতিত্ব অর্জন করে ঐতিহাসিক ডেভিড কফের (১৯৩০-২০২৩) তত্ত্বাবধানে পিএইচডি-র গবেষণা আরম্ভ করেন। বলাই বাহুল্য, সরস্বতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান হয়ে উঠতে তাঁর আর বিশেষ বিলম্ব হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু সমাজ-সংস্কার আন্দোলন-কেন্দ্রিক দুর্দান্ত একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করে বেশ খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন গোলাম মুরশিদ। মেলবোর্নে শিবনারায়ণ রায়ের (২০ জানুয়ারি, ১৯২১ - ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮) অধীনে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণায় তিনি দুই বছর কাটান। ১৯৮৪ থেকে পাকাপাকিভাবেই তিনি লন্ডন নিবাসী। 

ওই বছরই জানুয়ারি মাস থেকে তিনি  ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি)-এর সংবাদ-পাঠক এবং উপস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০০৩ অবধি সফলভাবে থেকেছেন ওই জীবিকায়। তথ্য আদানপ্রদানের অবিরাম স্রোতে তাঁর জীবনের অন্বীক্ষা আরও স্পষ্টতর হতে থাকল। কিছু তথ্য স্মৃতির ভারটুকুই বাড়ায়, আর কিছু উপাত্ত তুলে ধরে রাশিতত্ত্বের আধারে সমাজের প্রকৃত চালচিত্র। ভার ছেঁকে খবরের কেন্দ্রীভূত সারবত্তাকে স্পর্শের ক্ষমতা রাখতেন গোলাম মুরশিদ। ১৯৯১ থেকে লন্ডনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা আর গবেষণার কাজটি সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যান। খ্যাতি অর্জন করেছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের 'স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ'এর গবেষণা সহযোগীরূপেও। 'ভয়েস অফ আমেরিকা'র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর কন্ঠ বারবার ধ্বনিত হয়েছে। সপ্রতিভ সেই কণ্ঠস্বরে ঝলসে উঠেছে আত্মবিশ্বাসের আগুন। চিরপ্রণম্য অগ্নি যখন হৃদয়-যুক্তিতে ভর করে, তখন তার গতিরোধ করে কার সাধ্যি!

অমৃতের সম্ভাব্যতা নিয়ে বড়োসড়ো মাপের তত্ত্ব না সাজালেও সভ্যতার সংকট নিয়ে একটা মাথাব্যথা তিনি অবশ্যই অনুভব করেছিলেন। রোজকার সামাজিক ক্ষেত্রে বিকল্প জীবনদর্শনের পাশাপাশি পর্যালোচনা করেছিলেন বিকল্প সামাজিক হেজেমনি প্রতিষ্ঠার অজস্র তাগিদকে। সে জন্যেই কি ইতিহাসপ্রসূত স্বপ্নকে খুব সহজেই শব্দের দলিলে বন্দী করলেন গোলাম মুরশিদ! বাঙালির অন্তর্জগতে 'কালচারালিজ়ম' শব্দটি এসে প্রবেশ করলে যেন আত্মসচেতনতার প্রশ্নটি আবার টাল খেয়ে যায়! সেই কান্টীয় পুরাতন অথচ চির আধুনিক প্রশ্ন— ‘What is Enlightenment?’ যেন সহসা বিনির্মিত হয়ে গর্জে উঠল! ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরকে আত্মস্থ করে গোলাম মুরশিদ লিখলেন— ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ (২০০৫)। আপেক্ষিক সমাজতত্ত্বের প্রতিভাস থেকে উপকরণগত যুক্তিকে সাজিয়ে নিয়েছিলেন প্রাবন্ধিক গোলাম। বঙ্গের উৎপত্তি, মনস্তত্ত্ব, রুচি-বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতি, স্বপ্ন-প্রত্যাশাকে সংকীর্ণ ফ্রেমের বাইরে ফুটিয়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। নিজস্ব পুনর্গঠিত দর্শনের সাহায্যে ইতিহাসগত ধারাবাহিকতার সূত্রে খুঁজতে চেয়েছেন বাঙালির সার্বিক মুক্তির অজস্র সম্ভাবনা। তবে প্রগতিমুখী মানবতাবাদের কথা এই কালজয়ী গ্রন্থের পর্ব থেকে পর্বান্তরে ধ্বনিত হলেও যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্কতা ঠিক কতখানি নিহিত, সে বিষয়ে সমালোচকরা সংযোগী প্রশ্নও তুলেছেন। যেমন, রিচার্ড এম ইটন রচিত ‘The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760’ (১৯৯৬) গ্রন্থ থেকেই নিজের এই বইয়ের একটা মেটা-ন্যারেটিভ গড়ে তুলেছিলেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু, এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইটিতে ‘এথিক্যাল সোশ্যালিজ়ম’-এর বিস্তার ঘটেছে বেশ অনেকার্থদ্যোতনায়। অনুষঙ্গের প্রস্তর দিয়ে বঙ্গজ ইতিহাসের আবর্তকে অনবদ্য নথি নির্মাণের খাতে বইয়ে দিলেন গোলাম মুরশিদ। ফলত সুকুমার সেনের উত্তরসাধক তথা বাংলা সাহিত্যের তাবড় তাবড় গবেষকরাও ধন্য ধন্য করে উঠলেন।



মধুসূদন দত্ত ও নজরুল ইসলামের জীবনের প্রতি এক প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল তাঁর। বাঙালি কী হারিয়েছে?— এ প্রশ্ন তাঁকে করা হলে তিনি হয়তো নিশ্চিতভাবে এই দুজনেরই উল্লেখ করতেন। রহস্যাবৃত সময়ের উদ্ভাবন আর সংস্কৃতির মিশ্র প্রবাহ – এ দুয়ের মিথষ্ক্রিয়া অনুভব করেছিলেন গোলাম মুরশিদ। তিনি যে শ্রেষ্ঠ মধু-রসিকদেরই একজন ছিলেন তার পরিচয় মেলে ‘আশার ছলনে ভুলি’-র (১৯৯৫) ভূমিকা থেকে। ভার্সাই-এর সরকারি এবং মিউনিসিপ্যাল আর্কাইভস, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রেজ ইন লাইব্রেরি, ব্যর্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি পর্যন্ত তন্নতন্ন করে খুঁজে যে নথিপত্র জোগাড় করেছিলেন, সে কথার উল্লেখ করেছেন স্বয়ং গোলাম মুরশিদই ভূমিকা অংশে। সুখী পারাবতের মতো মধুভক্ত মোটেও ছিলেন না তিনি, তাই সেই অক্ষয় ঐতিহ্যবাহী চরিত্র মধুসূদনের নিজেকে অনিবার্য পালটে-ফেলার ইতিবৃত্তকেই চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। কোনও শুষ্ক স্মৃতিতর্পণ নয়, ‘আশার ছলনে ভুলি’ বাংলা সংস্কৃতির এক অভিনব প্রস্থান। কোনও বিশেষ অনুকল্পের প্রতি এখানে তাঁর বিশ্বস্ততা কিংবা দায়বদ্ধতা প্রতিফলিত হয়নি, বরং সামগ্রিক চেষ্টাই ছিল নির্মোহ দৃষ্টিতে একটা communicative strategy গড়ে তোলা। ভাষাতত্ত্বে যাকে অপ্রত্যক্ষতা ও অস্পষ্টতার কৌশল বলা হয়, তার কিছু কিছু দৃষ্টান্ত অবশ্য মেলে মধুসূদনের জীবন-বীক্ষালব্ধ এই গবেষণাকর্মটিতে। ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল-জীবনী’ (২০১৮) বেশ বিতর্কিত একটি সৃষ্টি যেখানে অ-পরিবর্তনীয় বিদ্রোহী নয়, বরং বহুরূপী হিসেবে নজরুলকে আবিষ্কার করেছেন গোলাম। জীবনীসাহিত্য-সংরূপটি রচনার প্রশ্নে অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে লিটেরারি বায়োগ্রাফিই লেখেন তিনি। বঙ্গদেশের ‘হিউম্যানিস্ট পণ্ডিত’ হিসেবে বিদ্যাসাগরের কৃতিত্বর কাছে যে নির্দ্বিধায় নতজানু হয়েছেন, তার প্রমাণ তাঁরই সম্পাদিত গ্রন্থ ‘বিদ্যাসাগর— সার্ধশত-বর্ষ স্মারকগ্রন্থ’(১৯৭০)।

‘রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া: নারীপ্রগতির একশো বছর’ (১৯৯৩) গ্রন্থে তিনি রাসসুন্দরী দেবী, কৈলাসবাসিনী দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, বিবি তাহেরন নেছা, কৃষ্ণভাবিনী দাস, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ বিদুষী নারীদের প্রতিবাদী স্বর তুলে ধরেছেন। আসলে গোলাম মুরশিদ পাঠককে কোনও তোতা-ইতিহাসের গল্প বলেননি, শুনিয়েছেন সামাজিক বিস্ময়ের ফ্রেমে গুমরে ওঠা সহৃদয়ের কথকতা। উপনিবেশিত সমাজ থেকে আধুনিকোত্তর বঙ্গভূমে বাঙালির যেটুকু স্বকীয় ভাষ্য নির্মিত হয়— তাকেই সমকালীন চেতনার বৃত্তে রূপদানের প্রয়াস করেছেন। তাঁর ‘Reluctant Debutante: Response of Bengali Women to Modernization , 1849-1905’ বইটির অনুবাদ ‘সংকোচের বিহ্বলতা— আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণীর প্রতিক্রিয়া ১৮৪৯-১৯০৫’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য আকাদেমি থেকে। স্ত্রী এলিজাকে উৎসর্গ করা এই বইতে স্ত্রীশিক্ষা ও নারীস্বাধীনতা প্রসঙ্গে বঙ্গসমাজের প্রথা-ঐতিহ্য আর অনুভূতির বিমিশ্র সমাহার পরিলক্ষিত।

‘যখন পলাতক: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ (১৯৯৩) বইটিতে তাঁর ছদ্মনাম হাসান মুরশিদ গ্রহণের সত্যি গল্পটি মেলে। শখে নয়, এই নাম গ্রহণের পিছনে আসল কারণ ছিল শুধুই মুক্তিযুদ্ধ পরিস্থিতিতে পারিবারিক নিরাপত্তা রক্ষা। ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস’ (২০১০) একটি স্ববিরোধকে বুঝে নেওয়ার দলিল। রাষ্ট্রের সীমা ও স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদের সন্দর্ভ , সাংস্কৃতিক শাসন আর জীবনের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র --- ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ আদতে ঠিক কোথায়, সেই উৎসের সন্ধানে তৎপর হয়েছিলেন এই গ্রন্থে। ইতিহাসের দুর্লভ মুহূর্তকে স্মৃতির আলোকায়নে বিচার করে নিয়েছেন— ঠিক  কতটা প্রামাণিক ছিল মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক মুহূর্তগুলো!

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বিদ্যাসাগর বক্তৃতামালার ওপর ভিত্তি করে তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রচর্চা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। ‘রবীন্দ্রনাথের নারী’ প্রবন্ধের শেষে রবীন্দ্র-কথাসাহিত্যের নায়িকাদের বয়স-সীমার যে তালিকাটি সংযোজিত করেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। ‘রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় পরিচয়’ অংশে ‘রবীন্দ্রনাথ অমুসলমান ছিলেন’ শব্দবন্ধটি ধর্মনিরপেক্ষ রবীন্দ্র-অনুরাগীকেও ভাবতে বাধ্য করে।

তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বিধবাবিবাহ, কৌলীন্য-প্রথা, স্ত্রীশিক্ষা, নারীমুক্তি ইত্যাদির সঙ্গে বাংলা নাটকের সম্পর্ক নিরূপণ করে এক পরিবর্তনশীল আকাশকে যেন তুলে ধরেছে এই গবেষণাগ্রন্থ। সগর্বে ঘোষিত হয়েছে – বাংলা নাটকের দুনিয়ায় কোথাও কোনও অর্ধেক আকাশ নেই! বিবর্তনের যাবতীয় অনুপুঙ্খকে আত্মস্থ করেই সম্পাদনা করেছিলেন ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’, যা বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ডায়াস্পোরিক মনন নিয়েই করেছেন শব্দানুসন্ধান, যার সূত্র ধরে নির্মাণ করা যায় সমকালীন বাঙালির সাংস্কৃতিক অবস্থান।

প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য ১৯৮২'তে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার'এ ভূষিত গোলাম মুরশিদ, ২০২১ সালে ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন। কালের যাত্রায় ভাসতে ভাসতে বাঙালি যখন মনে করে, এই তো দিব্যি আছি, তখনই তাঁর সৃজনবিশ্ব মুখর হয়ে ওঠে। আর বাঙালি প্রত্যক্ষ করে, তাদের কথায় ও কাজে অবিশ্বাস্য ফারাক! তখনই প্রয়োজন পড়ে তাঁর লিখনবিশ্বের মুখোমুখি দাঁড়াবার! সমকালীন বৈপরীত্য থেকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক একটি স্মৃতি-কণাকে সঞ্চয়ের সাহস রাখতেন তিনি। 

২২ অগস্ট, ২০২৪, বৃহস্পতিবার, লন্ডনের কুইন্স হাসপাতালে মারা যান ৮৪ বছরের গোলাম মুরশিদ। অমনি বাঙালি সমাজ হারিয়ে ফেলল সহজ কিছু প্রশ্ন, যার উত্তর খোঁজার পথটি চক্রব্যূহভেদের ন্যায় দুরূহ।


Monday 19 August 2024

শিক্ষার অভাবের অজুহাত মিথ্যা

হত্যা বিনা ধর্ষণও অমার্জনীয় অপরাধ 

শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী



আরজিকর ধর্ষণ কাণ্ডের পর এক সপ্তাহের বেশি অতিবাহিত। আপাতভাবে নাগরিক সমাজ তার এ যাবৎকালীন নিরবচ্ছিন্ন মৌনব্রত ভঙ্গ করার প্রমাণ দিয়ে যারপরনাই লড়েছে-লড়ছে, ফলস্বরূপ দেশ ও দেশের গণ্ডির বাইরেও সে যজ্ঞের আহুতির ধূম্র পৌঁছেছে একপ্রকার। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, 'The world is a dangerous place, not because of those who do evil, but because of those who look on and do nothing.'।

তদন্ত আপাতত সিবিআই'এর হাতে, কলকাতা হাইকোর্টের নজরদারিতে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও সুয়ো মটো এই ঘটনা ও বিষয়টিকে নিজের বেঞ্চে এনেছেন; শুনানি ২০ অগস্ট। এই মুহূর্তে তদন্তের ফয়সালা সিবিআইকেই করতে হবে। কেসটিকে গ্রহণ করার পর ৪-৫ দিন কেটেও গেল, কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন কোনও অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে না। এটা কি তদন্তে ব্যর্থতা, নাকি যা ঘটেছে সেই মোতাবেকই তদন্ত এগোচ্ছে?

অতীত ঘাঁটাঘাঁটি করলে আরজিকর হাসপাতালটি সম্পর্কে কিছু তথ্য উঠে আসে যা না চাইলেও বুননে জুড়ে যায় আপনা আপনি। ২০০১ সালে ডাঃ সৌমিত্র বিশ্বাসের দেহাংশ মেলে শহরেরই আরেকটি নামী চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ভ্রমণবাক্স বন্দী হয়ে। ২০০৩'এ ডাঃ অরিজিৎ দত্ত হাতের শিরা কেটে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন, তাঁর রক্তে মিলেছিল মাত্রাতিরিক্ত সিডাটিভ। ২০১৬ সালে অধ্যাপক গৌতম পালকে পাওয়া যায় তাঁরই নিজের বাড়ির মধ্যে গলিত অবস্থায়। ২০২০ সালে ডাঃ পৌলমী সাহা এই হাসপাতালের আপৎকালীন বিভাগের ছ' তলা থেকে লাফ দিয়ে মারা যান। ২০২৩'এ ডাঃ শুভ্রজ্যোতি দাসের মৃতদেহে পাওয়া যায় অতিরিক্ত মাদক। সর্বশেষ ২০২৪'এর অগস্ট মাসে এই হত্যাকাণ্ড। আরজিকর হাসপাতালটির সঙ্গে যুক্ত এই কর্মীদের একটি 'আত্মহত্যা'র ক্ষেত্রেও মৃত্যুপত্র পাওয়া যায়নি এবং চর্চিত মতানুযায়ী উল্লিখিত প্রতিটা মৃত্যুই ঘটে এই সরকারি প্রতিষ্ঠানে হয়ে চলা অসামাজিক কার্যলাপের (কথিত কখনও তা চেতনানাশক ওষুধ চক্র, কখনও তা যৌনচক্র) বিরুদ্ধ স্বর হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে। এবারের মৃত্যুটিও প্রতিবারের মতোই সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। 

লক্ষণীয়, ঘটনার পরম্পরা না বদলালেও ইতিমধ্যে রাজ্যের শাসনভার কিন্তু পরিবর্তিত হয়েছে। অর্থাৎ, এটুকু স্পষ্ট যে, এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তাদেরই কর্মীদের মৃত্যু এ রাজ্য অতীতেও দেখেছে। আর দুর্নীতি যে এই দেশের ভিত্তি তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

বলা যায়, এ মৃত্যু যেন আড়ালে রাখা এক জিজ্ঞাসাপত্র জনগণের সামনে নিয়ে এসেছে। তাদের  জিজ্ঞাস্য: (১) এই সরকারি হাসপাতালটির চিরাচরিত দুর্নীতি ও তাতে যুক্ত উচ্চপদাসীন ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গের কতটা ক্ষমতা? (২) প্রথম ভাষ্যে হাসপাতাল বা পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে 'আত্মহনন' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়ার অপপ্রচেষ্টা কেন? (৩) একজন আপাত ক্ষমতাহীন 'সিভিক ভলান্টিয়ার' কীভাবে সর্বেসর্বা হয়ে উঠতে পারে? (৪) কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা বিশেষত নারী সুরক্ষার এত দুরবস্থা কেন? এবং সর্বোপরি তদন্ত ও সুবিচার প্রসঙ্গে মানুষের আস্থাহীনতা। 

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো'র ২০২১'এর তথ্যানুযায়ী, ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভারতে বিবাহিত নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে ধর্ষণের মোট পরিসংখ্যানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই গার্হস্থ্য বা পারিবারিক ধর্ষণের অন্তর্গত। উল্লেখ্য, মধ্যপ্রদেশের রেওয়া এলাকায় গত ২৪ এপ্রিল নয় বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। দেহ উদ্ধার হয় তার বাড়ির উঠোন থেকে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঘটনার রাতে ওই বালিকা তার দাদার সঙ্গে ঘুমোচ্ছিল। অভিযুক্ত কিশোর, অর্থাৎ, তার ১৩ বছর বয়সী দাদা সেই সময় নীলছবি দেখে সেটির নকল করতে গিয়ে বোনটিকে ধর্ষণ করে। পরে বোনটি বাড়িতে ঘটনা বলে দেওয়ার কথা জানালে, ভয়ে দাদা শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর সে তার মাকে ডেকে সব জানায়। মা এসে দেখে তার মেয়ে তখনও জীবিত। ছেলেকে বাঁচাতে মা নিজেই মেয়ের শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করে।

ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (NFHS) অনুসারে, দেশের বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে যৌন সহিংসতার ৯০ শতাংশেরও বেশি ঘটনা তাদের স্বামীর দ্বারা সংঘটিত হয়। এ ধরনের গার্হস্থ্য ধর্ষণ আইনগতভাবে এখনও 'ধর্ষণ' হিসেবে স্বীকৃত নয়, কারণ ভারতীয় আইন অনুযায়ী বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে গণ্যই করা হয় না! 

তাই কৌতূহলের বশে জানতে ইচ্ছা করে, এরপর? আন্দোলন অব্যাহত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ যে সমাজকে আমরা  আজ দেখছি, তাদের আন্দোলনের মূল ভিত্তি নিয়েই যে বড় সংশয়! দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক তরজার ফাঁকে 'ধর্ষণ'এর মতো 'ছোট ঘটনা' সত্যিই কোথাও যেন গৌণ হয়ে যায় এ রাজ্য বা  দেশে তো বটেই, গোটা পৃথিবীতেই। আমরা কবে উপলব্ধ হব যে হত্যা ব্যতিরেকেও একটি ধর্ষণ এক অমার্জনীয় অপরাধ এবং কখনই তা 'স্বাভাবিক' জৈবিক ক্রিয়া নয়? আর কতটা কাল পেরিয়ে আমরা ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনাকে চরম হিংস্র ও অন্যায় হিসেবে স্বীকার করে তার বিরুদ্ধে সরব হব? চূড়ান্ত নৃশংসতার রূপ না নিলে সে ধর্ষণের ঘটনা প্রতিবাদের বিষয় হিসেবে অযোগ্য - এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্তিই বা কবে ঘটবে? আমরা কি কোনও এক আশ্চর্য মাপকাঠি তৈরি করেছি এই পৈশাচিকতাকে পরিমাপ করতে?  

অজুহাতের পর্দায় নারী কিংবা প্রান্তিক লিঙ্গের বক্ষ কোটি ছোঁওয়া, কখনও গায়ে ঢলে জোর খাটানো, করমর্দনের অছিলায় হাত নিষ্পেষণ, অনাহূত স্পর্শ, আচম্বিতে ঊরুতে চপেটাঘাত বা কুরুচিপূর্ণ বার্তা—এই আচরণগুলোর মধ্যেই সংকীর্ণতার সূত্রপাত। 'আজি এ প্রভাতে রবির কর/ কেমনে পশিল প্রাণের পর' এবং পুরুষ দাঁড়িয়ে পড়ল- পুরুষাঙ্গ দাঁড়িয়ে পড়ল ধর্ষণের স্বার্থে- এমনটা বোধহয় একেবারেই না। প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ শুরু হয় এ সকল 'ছোট ছোট' আপত্তিকর আচরণ থেকেই, যা পরে ভয়ঙ্করের স্পর্ধা দেয়। সিমোন দে বোভোয়ার তাঁর বিখ্যাত এবং বিতর্কিত সৃষ্টি 'The  Second Sex'এ  বলছেন, 'The myth of rape as a sexual act masks its true nature as an act of violence.'।  

আজকের সমাজে সন্তানকে পড়াশোনা নিয়ে বকাঝকা করলেও তার চিত্ত চাঞ্চল্য এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা বলা হয়ে থাকে। অথচ শিশু অবস্থা থেকেই মামা-কাকা-দাদা, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাবার দ্বারাও যে শারীরিক নিগ্রহ ঘটে চলে, তার কথা বলা হয় না এ সমাজে। বিকৃত সমাজে শিশুকে কোলে নেওয়ার অছিলায় তার যৌনাঙ্গ পেষণ কিংবা পুংযৌনাঙ্গে জোর করে হাত দেওয়ানো এসব খুব প্রচলিত অভ্যাস। অতঃপর প্রাকযৌবনে পৌঁছেই আমরা ধীরে ধীরে সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলি, এই আচরণগুলোকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিই, যতক্ষণ না তা কোনও অলীক সীমা অতিক্রম করে। বহু ক্ষেত্রেই আমরা জানি চিনি আমাদের চারপাশের এই শিকারীকুলকে, কিন্তু আমরা তাদের সমাজের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে মেনে নিই, আর সম্ভাব্য নিঠুর পরিণতিগুলোকে উপেক্ষা করি। তাই বারবার সেই একই কথা বলা, সুযোগ-সন্ধানী এ সকল পুরুষ সমমানের অপরাধী, এর মধ্যে লঘু-গুরু খোঁজ এক ধরনের বোকামি অথবা অবেহেলার অলংকরণ।

এ প্রসঙ্গে বারংবার আমাদের দেশে প্রকৃত শিক্ষা বা সচেতনতার অভাবের অজুহাত দিয়ে এই কঠিন সত্যকে ঢাকতে যাওয়াও অজ্ঞানতার পরিচয় রাখে। তথাকথিত 'উন্নত' দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এর কোনও ব্যতিক্রম নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়ে। যুক্তরাজ্যে বছরে তার সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার এবং সুইডেনে প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায় প্রায় ৬০টি ধর্ষণের অভিযোগ, যা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। কারণস্বরূপ, যেখানে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহারই মুখ্য সেখানে পশ্চিমা বিশ্বে আধিপত্য ও যৌনতা সংক্রান্ত উদ্ভট কল্পনা প্রভাবশালী বলে মনে করা হয়। প্রাচ্যের কিছু সমাজে ধর্ষণ প্রায়ই সম্মান রক্ষার বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই ধর্ষণের হেতু নিয়ে কথা বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন; ধর্ষক যে কোনও পরিস্থিতিকেই তার অনুকূলে আনতে সচেষ্ট হবে, এই বলা ভালো। বরং ভুলে গেলে চলবে না আমাদেরই মধ্যের সেইসব মানুষদের কথা, যারা ঘটে যাওয়া কোনও ধর্ষণের দৃশ্যচিত্র দেখতে বারবার পর্দায় চোখ রাখে, প্রতিটি ঘৃণ্য খুঁটিনাটি উপভোগ করে পরতে পরতে, এই ঘটনার প্রতি স্তরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ঠোঁটস্থ করেই যেন তারা জনসমাবেশে উচ্চতায় পৌঁছয়। অথচ, অনেক সময়ে তাদের নিজেদেরও হয়তো সংশয় থাকে এসব দৃশ্যচিত্রের সত্যতা নিয়ে; হয়তো এভাবে ঘটনার বিবরণ আত্মস্থ করার ফলে তাদের মননে তা যৌন উত্তেজক হিসেবে কাজ করে। 

শেষ করি অরুন্ধতী রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে: 'Rape is more than a violation of a woman’s body; it is a violation of her soul, a crime that scars her deeply.' (সূত্র: The Ministry of Utmost Happiness)। তাই  ঘরে বাইরে, সংসারে, কর্মক্ষেত্রে নারী নিরাপত্তা বাড়ানো ও অপরাধের সুচারু ও স্বচ্ছ তদন্তভার শাসকগোষ্ঠীর ওপর বর্তালেও, সামগ্রিকভাবে 'মানুষ' হয়ে ওঠার দায় কিন্তু একান্ত মানুষেরই; তাই সে চেতনার হাতেখড়ি হোক এবং 'নারী' হয়ে বাঁচার লড়াইয়ের অন্ত এ গোলকের আগামী প্রজন্ম অন্তত দেখুক।


Saturday 17 August 2024

কিছু বিক্ষিপ্ত কথা...

শতেক শতাব্দী ধরে

নামে শিরে অসম্মানভার

শ্রেয়া ঘোষ



জঘন্যতম, ঘৃণ্য এক অপরাধ সংঘটিত হল কলকাতার আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে গত ৯ অগস্ট। স্বতঃস্ফূর্ত নিন্দা ও প্রতিবাদে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ, সমগ্র ভারত এবং দুনিয়া।

মুখ্যমন্ত্রী ও প্রশাসনের তরফে এই অপরাধের দ্রুত তদন্ত, দোষীদের যথা শীঘ্র কঠোরতম শাস্তি বিধানের ঘোষণা করা হল। ২৪ ঘন্টার মধ্যে এক অপরাধী ধরা পড়ল। আরজিকর ও অন্য সব সরকারি হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তার'রা প্রতিবাদে সামিল হয়ে লাগাতার কর্মবিরতি ঘোষণা করলেন। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তদন্ত প্রক্রিয়া এবং কলকাতা পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে আদালতের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্ত দাবি করেন। পরিবারের তরফ থেকেও সিবিআই তদন্তের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করা হয়। তাঁদের দাবি অনুসারে হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব সিবিআই'এর হাতে যায়। 

১৪ অগস্ট মধ্যরাত্রে অগুন্তি মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদে সামিল হন। সে প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু এই নির্দিষ্ট ঘটনা হলেও দুর্বলের প্রতি সবলের যে কোনও অপরাধ বন্ধের ডাক দেওয়া হয়। স্বাভাবিক ভাবে চিকিৎসকদের এই কর্মবিরতি ও ধর্না বা মধ্যরাতের 'মেয়েরা, রাতের রাস্তা দখল করো' কর্মসূচি রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধে থাকাটাই প্রত্যাশিত ছিল। রাজনৈতিক দলগুলির দৌড়দৌড়ি ও অতি-তৎপরতা সে অসম্ভবকে কি সম্ভব করল?

রাজনৈতিক দলগুলির প্রেক্ষিতে ১৬ অগস্ট অবধি ঘটনাপ্রবাহ এই প্রকার ছিল:

১) SUCI'এর ডাকে ১২ ঘন্টা বাংলা বন্ধ ডাকা হল;

২) দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৪টে অবধি বিজেপি'র রাস্তা রোকো কর্মসূচি ছিল;

৩) ১৬ অগস্ট থেকে আরজিকর হাসপাতালের সামনে বিজেপি'র ধর্না;

৪) বিজেপি মহিলা মোর্চার মোমবাতি মিছিল মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি অবধি;

৫) মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মিছিল ও দোষীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি।

শুভেন্দু অধিকারী বারবার বললেন - 'দফা ১, দাবি ১ - মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ'। নিঃসন্দেহে নতুন এক শ্লোগান। আর এই নতুন শ্লোগান হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কর্মবিরত কিছু চিকিৎসকদের মুখেও। বিরোধী দলনেতা বললেন, ১৪ অগস্ট রাতে হাসপাতালের সামনে বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক ডেকে এনে হামলা চালানো হয়েছে। এই ঘটনাটির প্রেক্ষিতেও তাঁর বক্তব্যে যথারীতি গরুর রচনার মতো খোকাবাবু-পিসি থিয়োরি।

এক সপ্তাহের মধ্যেই মৃতা চিকিৎসক কি ধীরে ধীরে পিছু হটছেন?

১৪ অগস্টের মধ্যরাতে মেয়েদের রাস্তা দখল কর্মসূচি ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল। এক নিরপরাধ মহিলা চিকিৎসকের সরকারি হাসপাতালেই নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদ, ক্রোধ, বেদনা, আবেগে উদ্বেলিত মেয়েদের ঢল নামল রাজপথে; সারা রাজ্য, দেশ ও বিদেশ জুড়ে। কারণ ছাড়াই মহিলাদের সর্বত্র অপমান, প্রতারণা, বিপন্নতার চিরাচরিত ধারা এই একটি ঘটনায় আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠল।

কিন্তু কিছু অদ্ভুত কথাবার্তাও শোনা গেল। শুনলাম যা, সমাবেশ প্রত্যাগত মহিলা বলছেন, 'এত জনসমাগম, এত সমর্থন দেখে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। এত সমর্থন যেন প্রশাসন নির্বাচনের সময়ে মনে রাখে।' দোষীর শাস্তি, মেয়েদের প্রতি অপমানের অবসান, মৃতা চিকিৎসকের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন নয়, তিনি চাইলেন পরের নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফল।

একজন লিখলেন, 'অনুপ্রাণিত ধর্ষণতন্ত্রের অবসান হোক।' শুধু ধর্ষণ  না বলে একটু চালাকির ছোঁয়া লাগিয়ে নিজের মতো খানিক মজা পেলেন তিনি। অপর্ণা সেনের সঙ্গে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ও অন্যায় আচরণ করা হল।

হাজার হাতে হাজার পোস্টার, কিন্তু হাজার মনের অভ্যন্তরে কী উদ্দেশ্য, কে জানে?

মেয়েদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদে, মেয়েদের এই মিছিলেও মেয়েদের প্রতি নিয়ম মতো অশ্লীল ইঙ্গিত করা হল। মেট্রো রেলে রূপান্তরকামী ব্যক্তি চিরাচরিত ভাবে অশ্লীল স্পর্শ ও মন্তব্যের শিকার হলেন।

সংশয় ছিল -

সমাজের সব স্তরের মেয়েরা কি অংশ নিয়েছিলেন? অসংগঠিত ক্ষেত্রে খেটে খাওয়া মেয়েরা, যৌনকর্মী, গৃহ পরিচারিকা, যাঁদের অহরহ দুঃসহ নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তাঁরা? আমার সংশয় নিরসন করে মিছিলে অংশ নেওয়া বন্ধু বললেন, 'হ্যাঁ, অরগানাইজড ভাবে ডাকা হয়েছিল, আর তাছাড়াও ছিল সম্ভবত স্বতঃস্ফূর্তভাবে।'

 এই বিপুল উদ্যোগ যেন দাগ রেখে যেতে পারে সেটাই সর্বান্তঃকরণে চাইছি। একটা মর্মান্তিক ঘটনা যেন স্ফুলিঙ্গ হয়ে দাউদাউ দাবানল ছড়িয়ে দিল। পুড়ে যাক সে আগুনে যত আবর্জনা।

৯ থেকে ১৭ অগস্ট। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। চিকিৎসক ও পরিবারের দাবি অনুসারে তদন্তভার সিবিআই'এর ওপর ন্যস্ত। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং তদন্তের অগ্রগতি তদারক করছেন।

তবুও,

সমস্ত সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকরা কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ ১৭ অগস্ট দেশ জুড়ে সমস্ত হাসপাতালে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। তার মানে সমস্ত দেশের জনসাধারণ অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাবে না? নারী, শিশু, বৃদ্ধ কারও চিকিৎসা হবে না? কাগজে, টিভি'তে ছবি দেখছি, অসুস্থ  স্ত্রীকে কোলে নিয়ে প্রৌঢ় ফিরে যাচ্ছেন, মাথা জোড়া ব্যান্ডেজ-বাঁধা শিশুকে কোলে নিয়ে বাবা ফিরে যাচ্ছেন। মৃত্যুও ঘটে গেছে। আমার পরিচিত এক মহিলার পুত্রবধূর প্রসবের দিন এসে গিয়েছে কাছে, আমাকে বললেন, বাচ্চাটা কি তবে পেটের মধ্যেই মরে যাবে?

মুখ্যমন্ত্রী আবেদন করেছেন, 'দয়া করে, অনুগ্রহ করে, আপনাদের পায়ে ধরে বলছি, মানুষকে পরিষেবা দিন।' আবার তিনিই জানালেন, বহু হাসপাতালে সিনিয়র ডাক্তাররা কাজ করছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশও কাজে আছেন।

আমি ভাবছিলাম কবে সব চিকিৎসকরা কাজ শুরু করবেন? কাল রাতে শুনলাম, আরজিকর কাণ্ডে আন্দোলনরত ডাক্তাররা দাবি করেছেন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সব অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে হবে সিবিআইকে, নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, পুলিশকে ক্ষমা চাইতে হবে ইত্যাদি। দাবি পূরণ না হওয়া অবধি কর্মবিরতি চলবে।

নিরপরাধ অসুস্থ ব্যক্তিকে চিকিৎসা না করে যন্ত্রণা ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যেন প্রতিশোধের মতো।যে কোনও পরিণত মানুষ নিশ্চয়ই বোঝেন, ৪৮ ঘন্টায় প্রমাণ সংগ্রহ করে, দোষীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা অসম্ভব। তথাপি...

এই একটা সপ্তাহ প্রাত্যহিক সব কাজকর্ম, দায়িত্ব সব পালন করে গিয়েছি একেবারে যন্ত্রের মতো। মন থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও এই ঘটনাকে সরাতে পারছি না। নানা প্রশ্ন ক্রমাগত ধাক্কা মারছে মনে।

আজন্মকাল দেখে আসছি সরকারি হাসপাতালে শ'য়ে শ'য়ে বহিরাগত লোকজনের ভীড়। কেন এখানে সুষ্ঠু শৃঙ্খলা থাকে না? অবাঞ্ছিত লোক সর্বদাই যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ যে শৃঙ্খলার দাবি করা হচ্ছে তার জন্য এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে হল কেন?

হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অসহায় মানুষ আর চিকিৎসকরা তারস্বরে মাইক বাজিয়ে সুবিচারের দাবি করছেন। শুধু চিকিৎসকরাই নন, রাজনৈতিক দলগুলিও শব্দসীমা লঙ্ঘন করে মাইক বাজিয়ে সুবিচার চাইছে। অসহায়, অসুস্থ মানুষের প্রতি এতটুকু সংবেদনশীলতা দেখানো যেত না?

এই সাংঘাতিক অপরাধ ঘটার পর আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষকে অপসারণ করা স্বাভাবিক ছিল। অথচ কেন তাঁকে শুধুমাত্র বদলি করা হল তার উত্তরও অলভ্য। প্রশাসনের তরফে এই ঘটনা সদিচ্ছার অভাব সূচিত করে।

অবাক লাগছে, এই সাত দিনের অজস্র কথা আর গুজবে। শোনা যাচ্ছে, হাসপাতালের অভ্যন্তরের অভাবনীয় নোংরামি ও দুর্নীতি নাকি চলে আসছে গত কুড়ি বছর বা তারও বেশি সময় ধরে। আর শুনছি, সবাই নাকি সব জানত। তবে কেন তা প্রকাশ্যে আনা হল না এত বছরেও। এমনকি কারা এই ধর্ষণ ও খুনের মতো ঘটনায় জড়িত সেটাও নাকি সকলেই জানেন। তবু কেন তাঁরা তদন্তকারী সংস্থাকে সে সব জানাচ্ছেন না, তাও বোধগম্য হচ্ছে না।

বিরোধী দলনেতা প্রবল বিক্রমে সিবিআই'কে তদন্তের পদ্ধতি নিয়ে উপদেশ দিচ্ছেন কোন অধিকারে? অভিযুক্তকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে?

২৭ নভেম্বর ১৯৭৩।

He reaches under his shirt, and pulls out the dog chain. She swallows. He magnifies the sound of its rattle as he trails the dog chain on the desk in front of her. Her eyes follow the chain, she swallows again, moves back.... 

One man. Plus a savage twist of one chain. And the thirty seconds for his sperm to release.

Equals one broken woman. With brain damage so irreversible that it does not even register images.

বারবার মনে পড়ছে ১৯৭৩ সালে মুম্বাই'এর KEM হাসপাতালের নার্স অরুণা শনবাগের নির্যাতনের ঘটনা। অপরাধী ছিল হাসপাতালের সুইপার সোহনলাল বাল্মীকি। প্রথমত সেখানে ধর্ষণের ধারাই দেওয়া হয়নি। সামান্য চুরির ধারায় তার সাত বছর জেল হয়। আর অরুণা সেই ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ অবধি সব চেতনা হারিয়ে, অন্ধ হয়ে, পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হলেন। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তাঁকে স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকারটুকুও দেওয়া হল না। কেন?  

পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। সমাধান সূত্র খোঁজার বদলে বিশৃঙ্খলাকেই যেন প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। ঘোলা জলে মাছ ধরতে কোমরে গামছা বেঁধে, খাপলা জাল হাতে নেমে পড়েছে ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতির ময়দানের চেনা মুখগুলো। যেমন বরাবর। 

মৃতা চিকিৎসক কি ধীরে ধীরে পিছু হটছেন?


Tuesday 13 August 2024

আবার হিন্ডেনবার্গ

ব্যক্তিগত দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন

পার্থ হালদার



দু' দিন আগে হিন্ডেনবার্গের আবার আক্রমণ দেখে সত্যিই চমকে উঠেছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, 'শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন সর্বনেশে' লাইনটি। সত্যি বলতে কি, সাধারণ ছোট লগ্নিকারীরা  প্রকৃতই বিভ্রান্ত, কারণ শেয়ার বাজারের মূল ভরসা যে রেগুলেটার (SEBI, সেবি), তার  সর্বোচ্চ প্রধানের বিরুদ্ধে এবারে অভিযোগ। অভিযোগে বলা হয়েছে, সেবি প্রধান মাধবী পুরী বুচ ও তাঁর স্বামী অফ্শোর ফান্ডের মাধ্যমে আদানির কোম্পানিগুলিতে বিনিয়োগ করেছেন এবং অন্যায় ভাবে আদানির শেয়ারগুলির দাম বাড়ানো হয়েছে।

একটা সত্য আমরা সকলেই দেখছি যে, আদানির উপর অতীতে যে আরোপ এসেছে, সেগুলির সেভাবে কোনও তদন্তই হল না। আমরা খালি চোখে যা দেখতে পাচ্ছি, তা কোনও আইনি বৃত্তের মধ্যে কোথাও চোখে পড়ছে না, সেটাই আশ্চর্যের। পুরো বিষয়টা বোঝার জন্য কোনও বিশেষজ্ঞ না হলেও চলবে, কেবল গুগল সার্চ করে গত ৫ বছরে আদানির শেয়ারগুলির উত্থানের গ্রাফ দেখলেই তা বোঝা যাবে। আদানির কোম্পানিগুলি যে যে ক্ষেত্রে ব্যবসা করে, সেই ক্ষেত্রগুলিতে তো আরও অনেক প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিই ব্যবসা করে, সেই কোম্পানিগুলির শেয়ারের দাম কত শতাংশ বেড়েছে একই সময়ে, সেটাই দেখার। 

সেবি'র পক্ষ থেকে এই অভিযোগের বিরুদ্ধে উত্তর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কিছু নাই ঘটে থাকবে তাহলে তো হিন্ডেনবার্গের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তা কিন্তু এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কারণ, কেবলমাত্র শর্ট সেল করার  জন্য (সাধারণ মানুষের অবগতির জন্য জানাই, শেয়ার শুধুমাত্র কিনে তারপরে বেচে লাভ করাই একমাত্র পথ নয়, আগে বিক্রি করে পরে নিচু দামে কিনেও মুনাফা অর্জন করা যায়, যাকে 'শর্ট সেলিং' বলে) তারা যদি এটা করে থাকেন তা হলে তা নিশ্চয় অপরাধ। কিন্তু এর স্বার্থ জড়িয়ে আছে বহু ক্ষুদ্র লগ্নীকারীর ভবিষ্যতের সঙ্গে। তাছাড়া, যেহেতু সাধারণ মানুষের টাকা বিভিন্ন ফান্ডের মাধ্যমে বাজারে লগ্নী হয় ও সেই মানুষগুলোর ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, তাই এই খেলা রোজ রোজ চলতে পারে না। এর থেকে যে ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে এবং হতে পারে তার দায় কাউকে তো নিতেই হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং বাজার নিয়ামক সংস্থার কাছে মানুষের একমাত্র প্রত্যাশা হল স্বচ্ছতা। তাই, সাধারণ মানুষ ও দেশের অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে অবিলম্বে সেবি চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি, যা দেশের বিরোধী দলগুলি করছে, তা প্রকৃতই যুক্তিযুক্ত। 

গল্পের অন্যদিকে যদি হিন্ডেনবার্গ'এর মতো সংস্থা নিয়মিত এই ধরনের কাজ করতে থাকে, আইন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য তদন্তের মাধ্যমে সামনে এনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা তো সরকারের দায়িত্ব। এখন প্রশ্ন হল, সবেতেই এত বিলম্ব কেন? এত অস্বচ্ছতা কেন? কেবলমাত্র বিবৃতিতেই কি সব শেষ? JPC'তে আপত্তি কেন? আর এখানেই মনে হচ্ছে, 'চলতে গিয়ে কেউ যদি চায় এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়ে/ রাজার কাছে খবর ছোটে/  পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে, দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়, একুশ হাতা জল গেলায়'। তাই প্রশ্ন একটাই: স্বচ্ছতা। আপত্তি কোথায়? তাছাড়া যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তার তো নিজেরই সরে দাঁড়ানো উচিত। 

অর্থনীতি একটি দেশের মূল চলিকাশক্তি। যদি সেই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর প্রশ্নচিহ্ন লাগতে শুরু করে, তাহলে দেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এবং অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক মারার কাজ যে শুরু হল, তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। হিন্ডেনবার্গের নিয়মিত এই আক্রমণ যদি সঠিক না হয় তা তো দেশের অর্থনীতির উপরই আক্রমণ। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলির বড় ভুমিকা আছে।  সরকার এবং বিরোধীপক্ষ যৌথ ভাবে তার মোকাবিলা করবে সেটাই স্বাভাবিক; কিন্তু এতে যদি সরকারি মহলের গাত্রদাহ হয় তা সন্দেহের। ১৯৯২ সালে হর্ষদ মেহেতা কেলেঙ্কারির সময় প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ'এর মাধ্যমে সাংসদীয় যৌথ কমিটি তৈরি করেছিলেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাই বর্তমানের এই লুকোচুরি খেলাটি সত্যিই দুর্বোধ্য। সাধারণ মানুষের স্বার্থে এই তদন্ত দীর্ঘায়িত হলে ভারতের অর্থনীতি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতি তা জেনেবুঝে গাফিলতি বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। 

আরেকটা হাস্যকর ব্যাপার যা আজকাল রাস্তাঘাটে চোখে পড়ছে তা হল, এক ধরনের মানুষ যাদের বিন্দুমাত্র শেয়ার বাজারের সাথে যোগ নেই, তারাও সেবি এবং আদানিকে বাঁচাতে বাসে-ট্রামে-রাস্তায় ও চারিদিকে নেমে পড়েছে। এক শ্রেণির সাধারণ মানুষের আদানি ভক্তি চোখে পড়ার মতো। এটা কিছুটা আশ্চর্যের এবং হাস্যকর বলেই মনে হয় । 

যাই হোক, যত দ্রুত এই ঘটনা উন্মোচিত হবে ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা যাবে ততই মঙ্গল। কিন্তু ব্যক্তিগত দুর্নীতি যদি প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন পেতে শুরু করে, তা দুর্ভাগ্যের। অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা যদি বন্ধ হতে থাকে, স্বাভাবিক গণতন্ত্রও যে অবরুদ্ধ হয়, তা বলাই বাহুল্য।


Sunday 11 August 2024

বাংলাদেশ থেকে আহ্বান

তরুণের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ

বিধান চন্দ্র পাল



দেশে, দেশের বাইরে অসংখ্য মানুষ যে বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন সেটা সুস্পষ্ট এবং তা হওয়াটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। সে জন্য সবাইকেই আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দেশের মানুষ, বিদেশের মানুষ, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মানুষ- সবাই আপনারা দেশকে নিয়ে ভাবছেন। কথায় আছে বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। এ ক্ষেত্রে তাই আমি বলতে চাই, দেশের এই পরিস্থিতিতে যারাই দেশকে নিয়ে ভাবছেন, নিয়মিতভাবে খোঁজ-খবর রাখছেন, লিখছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে এই পরিস্থিতিকে নানান উপায়ে বিশ্লেষণ করছেন, এমনকি সমাধানের জন্য অবদান রাখছেন, তারাই আসলে প্রকৃত দেশপ্রেমিক। দেশকে নিয়ে ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের চেতনাবোধ, বাংলাদেশের প্রতি গভীর ও আন্তরিক বন্ধুত্ব এবং মমত্ববোধ ভেতরে না থাকলে এটা কখনও আসে না, কিংবা হয় না। 

দেশে ও দেশের বাইরের মিডিয়া সহ অনেকেই সাম্প্রতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিয়ে নানান মতামত দিচ্ছেন, সমালোচনায় মুখর আছেন। আমি শ্রদ্ধার সাথে সবার মন্তব্য ও বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক ভাবে আমার নিজস্ব কিছু মতামত জানানোর উদ্দেশ্য নিয়ে এই লেখাটি লিখছি।

নতুন প্রজন্ম (যদিও এখনও খুব ভালোভাবে সবাইকে আমার মতো আরও অনেকেরই হয়তো জানার ও বোঝার সুযোগ হয়নি) যেন প্রাণপণ প্রচেষ্টায়, এমনকি অনেকেই বীরের মতো প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গর্ত থেকে বাংলাদেশের সব বয়সী মানুষকে টেনে হিঁচড়ে সাহসের সাথে ওপরে, অর্থাৎ, ডাঙায় তুলে নিয়ে এসেছে। তারপর বেশিরভাগ মানুষই দেখতে পেয়েছে একটি নতুন দেশ- দুর্নীতির আবহ থেকে মুক্তির গন্ধ, পেয়েছে প্রাণ খুলে কথা বলার মতো হিমেল বাতাস এবং তরুণ সমাজ নতুনভাবে ও নতুন পণ নিয়ে দেশকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। 

এটাই আসলে কি প্রকৃত স্বাধীনতা- তা নিয়ে প্রশ্ন ও শঙ্কা অনেকের মধ্যেই এখন আসতে শুরু করেছে। কারণ, এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, দীর্ঘদিন হল সমাজবদ্ধ হয়ে ওঠার পরিবর্তে আমরা কেবল ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্রমেই দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। ফলে, একদিকে আমরা দেখলাম তরুণ সমাজ এবং সবার অংশগ্রহণে মুক্তি ও বিজয় যখনই অর্জিত হল, ঠিক তারপর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক আক্রোশে আক্রান্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, সাধারণ মানুষ এবং বিশেষভাবে নির্দিষ্ট সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ওপর নির্বিচারে আক্রমণ, নির্যাতন, গণহত্যা, চুরি-ডাকাতি, ধর্মীয় উপাসনালয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য সমূহ ভেঙে ফেলা, জমি দখল ও লুঠপাট সহ আরও অনেক উল্টো অপ্রত্যাশিত চিত্র অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে একের পর এক ঘটে গেল, যা ভীষণ লজ্জা ও নিন্দার। এগুলো ঘৃণিত ও জঘন্য এবং কুৎসিত মন-মানসিকতারই পরিচয়, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। 

আসলে জাতির ইতিহাস ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এত বড় পট পরিবর্তন ঘটে যাবে, সেটা কেউ এ দেশের মানুষ কল্পনাও করেনি। আমি বলব, এটা কেমন যেন হঠাৎ করেই হয়ে গেছে বা ঘটে গেছে। তবে এটা নানান কারণেই আজ হোক বা কাল, বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের জনগণের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।      

যাই হোক, ডাঙায় তোলার পর স্বাভাবিকভাবেই সেখানে অনেকের গায়েই এখনও কাদা-মাটি-নোংরা লেগে আছে, যা মুছতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হবে। অনেককে তুলতে গিয়ে আহত হবার মাধ্যমে যে দাগ বা ক্ষত তৈরি হল, তা হয়তো অনেককেই সারাটা জীবনের জন্য বয়ে বেড়াতে হবে। ওপরে ওঠার পরে প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদার জিনিসপত্রগুলো সবাই হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে খুঁজে না পাবার কারণে কাড়াকাড়ি-মারামারি, খামচা-খামচি কিংবা তারও থেকে ভয়ানক ও লোমহর্ষক কর্মযজ্ঞ যা ভয়াবহ ও জঘন্য রূপ ধারণ করতে পারে, তা কখনই কারও কাম্য হতে পারে না। এত কিছুর পরও বলব, মানুষ আসলে অতিষ্ঠ হয়ে আছে, তারা অচিরেই শান্তি চায়, সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচার পরিবেশ নিশ্চিত হোক সেটা চায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকুক সেটা চায়। তাই, সাধারণ মানুষ সহ সবাই নতুন প্রজন্মের বিজয়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা রেখে সম্মানের সাথে সাম্প্রতিক সকল সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। 

এ মুহূর্তে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার সবার মনেই আশা জাগাচ্ছে, যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন সদস্যের নির্বাচন নিয়ে জনমনে ও  মিডিয়ায় অনেক প্রশ্ন এবং সমালোচনা রয়েছে। সেটাও হয়তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও এখন সবার মনেই আশা জাগাচ্ছে বিশেষভাবে একটি বিষয়-- অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হলেন একজন বিশ্বনন্দিত নোবেল জয়ী শান্তির দূত। ফলে, সেদিকেই আশায় বুক বেঁধে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিতের স্বপ্ন নিয়ে তরুণ সমাজ, দেশবাসী ও সারা বিশ্বই এখন অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে, থাকবে এবং সে জন্য প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করে যাবে। 

দেশ জুড়ে যত দ্রুত সম্ভব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নিশ্চিন্তে বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরা ও কথা বলতে পারবে, সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের বেঁচে থাকার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হবে, ব্যবসা-বাণিজ্য সহ সার্বিকভাবে পুরো অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরে আসবে, দ্রব্যমূল্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছবে, রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, শিক্ষা পদ্ধতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ আবার সচল হবে, কোথাও আর কোনও বৈষম্য থাকবে না, তখনই এক শান্তিপূর্ণ ও সুস্থির বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। পাশাপাশি, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও পদ্ধতি সহ সকল ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সকল সংস্কারের প্রক্রিয়াও অচিরেই শুরু হোক, সেটাই সবার আকাঙ্ক্ষা। 

হঠাৎ করেই জাতির ইতিহাস ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই বড় ধরনের পট পরিবর্তনে প্রায় পুরো ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনাই এখন স্বাভাবিকভাবে ভেঙে পড়েছে। সেগুলোকে এখন পুনরুজ্জীবিত করে তোলার প্রচেষ্টা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, যদিও সেটা খুব সহজ কাজ নয়। ফলে, প্রশ্ন তোলার, সমালোচনা করার খোরাক হয়তো চারপাশে অনেকই খুঁজে বের করা সম্ভব। কিন্তু এখন সমালোচনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত না করে, সংস্কারের জন্য ও দেশকে স্থিতিশীল করে তোলার যে নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, সেটাকেই সাংবিধানিক নিয়ম অনুসরণ করে Doctrine of Necessity মেনে সুস্থ পথে পরিচালিত করা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই। তাই, সেখানেই সবাইকে উৎসাহ দিতে অনুরোধ, বিনীত আবেদন ও উদাত্ত আহ্বান জানাবো। আর এ জন্য নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে সময়ও দিতে হবে; দেশে, দেশের বাইরে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-দেশ সবাইকেই বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করাটাও জরুরি হবে বলে আমি মনে করি ও সেটা আন্তরিকভাবে প্রত্যাশাও করি। তাহলে দেশে অচিরেই শান্তি ফিরে আসতে পারে কিংবা সেদিকে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হতে পারে। 

মনে রাখতে হবে, এই প্রজন্ম কখনও ভাষা আন্দোলন দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, এমনকি নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানও দেখেনি। তাদেরকেই বলা হচ্ছে Gen-Z - যাদের জন্মগ্রহণ ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের বেড়ে ওঠার সময়কালে কিংবা জন্মের পরে যে শাসককে দেশ শাসন করতে দেখেছে তারা, তা নিয়েই মন্তব্য, ভালো-মন্দ বিচার, ক্ষোভ, দাবি এমনকি উচ্ছৃঙ্খলতা পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারে, যা অন্য কাউকে নিয়ে হয়তো অতটা তারা পারবে না, সঙ্গতভাবে করবেও না।  

ফলে, আমাদের এগিয়ে যেতে হলে অবশ্যম্ভাবীভাবে তরুণ সমাজের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে, তাদের কথা আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে, তাদের সব ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে, ধর্ম ও অর্থের মাধ্যমে তারা যাতে নোংরাভাবে ব্যবহৃত না হতে পারে বা কেউ যাতে তাদেরকে ব্যবহারের সুযোগ আর কখনও না পায়, সেদিকে সচেতনভাবে খেয়াল রাখতে হবে, তারা যাতে পরিবেশ বিনষ্টকারী কাজে সম্পৃক্ত না হয় সে জন্য তাদের মধ্যে পরিবেশগত ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা চেতনা বাড়াতে হবে; তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ দিতে হবে, মূল্যবোধ সমুন্নত ও পরিবেশবান্ধব মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এ জন্য তাদের প্রশংসা করার পাশাপাশি সঠিক পথে গাইড করাটাও অত্যন্ত জরুরি হবে। তবে সেটা একপাক্ষিক হলে চলবে না, কারণ, তাদের কাছ থেকেও অন্যদের শেখার অনেক কিছুই আছে। এই ধরনের সুস্থ একটি চর্চার আবহ অচিরেই তৈরি করা সম্ভব, না হলে কিংবা এই প্রক্রিয়া কোনওভাবে আবার বাধাপ্রাপ্ত হলে এর পরিণাম পুরো জাতির জন্য আরও ভয়াবহ হতেই বাধ্য। 

মনে রাখতে হবে, সময়ের পরিক্রমায় অনেকদিন ধরে সংবিধান সহ মৌলিক বিষয় সমূহে পরিবর্তন, বিভিন্ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, শিক্ষা ব্যবস্থা সহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতার ধরনে পরিবর্তন হয়ে এসেছে বাংলাদেশে। ফলে, দেশের মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে কিংবা অভ্যন্তরে দুর্নীতিবাজ, মৌলবাদী, ফ্যাসিবাদী কিংবা ধর্মীয়, জঙ্গি গোষ্ঠীর কিংবা উগ্র ও সন্ত্রাসবাদের যে উত্থান, তা একদিনে হয়নি। অতএব, হঠাৎ করেই একে অস্বীকার করাটা কিংবা সেখানে পরিবর্তন আনাটা এখন খুব কঠিন একটি পর্যায়ে চলে গেছে। কিন্তু ইতিবাচকভাবে এ ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনাটা অসম্ভব কিছু নয় বলেই আমি বিশ্বাস করি। 

পরিশেষে বলব, তরুণ সমাজ দায়িত্ব নিয়ে জাতির জীবনে যে পরিবর্তন এনে দিয়েছে, তা আমূল ও অসাধারণ এক পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত বহন করে। তাই এই পরিবর্তনকে সবাই মিলে আমাদের কাজে লাগাতে হবে, ইতিবাচকতার দিকে নিয়ে যেতে হবে। অনেক খারাপ খবরের ভীড়ে চারপাশে দেখছি, তারুণ্যের মনে জেগে ওঠার এক নতুন উদ্যম শুরু হয়েছে, এই উদ্যমে নানান বয়সী মানুষরাও আবার তারুণ্যের শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠছে, তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে রাত জেগে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব পালন করছে, তারা রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ভূমিকা পালন করছে, চুরি হওয়া সামগ্রী সমূহ উদ্ধার করে সেগুলো ফেরত দিচ্ছে। এ ধরনের অনেক ঘটনা নিঃসন্দেহে আমাদের মনে সত্যিই আশা জাগায়। একইসাথে এটাও প্রমাণ করে যে, অনেক বিশৃঙ্খলতার মাঝেও তারুণ্যের শক্তিই দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে।  

আমরা আর কোনও অসঙ্গতি চাই না, বৈষম্য, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক বিদ্বেষ আর হতে দিতে চাই না। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিষচক্রে ও গর্তে আমরা আর নিজেদেরকে ডোবাতে চাই না। যে উঠে দাঁড়ানোর যাত্রা আমরা নতুন করে শুরু করেছি, সেটা ক্রমেই বিকশিত হয়ে উঠুক- কারণ আমার মতো অগণ্য মানুষ এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, সেই উঠে দাঁড়ানোর মাঝেই রয়েছে প্রকৃত স্বাধীনতার উপলব্ধি, দেশের ও সবার শান্তি আর সমৃদ্ধি। সবার সুস্থ ও বলিষ্ঠ অংশগ্রহণে দেশ সেদিকেই এগিয়ে যাক এবং যাবেই, সেটাই আমার আপনার সবারই আকাঙ্ক্ষা হোক!


Saturday 10 August 2024

দুনিয়া কাঁপানো কুড়ি দিন (২)

এবারে চূড়ান্ত লড়াই ও তারপর...

শাহেদ শুভো


দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র-নাগরিক ৩ অগস্ট শহীদ মিনারে সমবেত হন। বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তরুণরা শহীদ মিনার জড়ো হতে থাকেন। এ সময় তাদের সঙ্গে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতে দেখা যায় বয়স্ক নাগরিকদেরও। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শহীদ মিনারে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্যে এক দফা দাবি ঘোষণা করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম-- 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে।

অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেন আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ--

১) কেউ কোনও ধরনের ট্যাক্স বা খাজনা দেবেন না;

২) বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল সহ কোনও ধরনের বিল পরিশোধ করবেন না;

৩) সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও কল-কারখানা বন্ধ থাকবে। আপনারা কেউ অফিসে যাবেন না, মাস শেষে বেতন তুলবেন;

৪) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ থাকবে;

৫) প্রবাসীরা ব্যাঙ্কিং চ্যানেলে কোনও ধরনের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন না;

৬) সব সরকারি সভা, সেমিনার, আয়োজন বর্জন করবেন;

৭) বন্দরের কর্মীরা কাজে যোগ দেবেন না। কোনও ধরনের পণ্য খালাস করবেন না;

৮) দেশের কোনও কল-কারখানা চলবে না, গার্মেন্টস কর্মী ভাইবোনেরা কাজে যাবেন না;

৯) গণ পরিবহন বন্ধ থাকবে, শ্রমিকরা কেউ কাজে যাবেন না;

১০) জরুরি ব্যক্তিগত লেনদেনের জন্য প্রতি সপ্তাহের রোববার ব্যাংক খোলা থাকবে;

১১) পুলিশ সদস্যরা রুটিন ডিউটি ব্যতীত কোনও ধরনের প্রোটোকল ডিউটি, রায়ট ডিউটি ও প্রটেস্ট ডিউটিতে যাবেন না। শুধু থানা পুলিশ নিয়মিত থানার রুটিন ওয়ার্ক করবে;

১২) দেশ থেকে যেন একটি টাকাও পাচার না হয়, সব অফশোর ট্রানজেকশন বন্ধ থাকবে;

১৩) বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যতীত অন্যান্য বাহিনী ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ডিউটি পালন করবে না। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যারাক ও কোস্টাল এলাকায় থাকবে;

১৪) আমলারা সচিবালয়ে যাবেন না, ডিসি বা উপজেলা কর্মকর্তারা নিজ নিজ কার্যালয়ে যাবেন না;

১৫) বিলাস দ্রব্যের দোকান, শো-রুম, বিপনি-বিতান, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে। তবে হাসপাতাল, ফার্মেসি, জরুরি পরিবহন সেবা, যেমন, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহন, অ্যাম্বুলেন্স সেবা, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহন, জরুরি ইন্টারনেট সেবা, জরুরি ত্রাণ সহায়তা এবং এই খাতে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহন সেবা চালু থাকবে।

এছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানপাট বেলা ১১ থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। 

যদিও ১ দফা দাবি অগস্ট মাসে ঘোষিত হয়, কিন্তু ছাত্ররা ঘোষণা করে জুলাই এখনও বহমান, শেখ হাসিনার পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই বহমান, তাই এই লেখায় ৪ আগস্টের বদলে লেখা হল ৩৪ জুলাই। 

অসহযোগ আন্দোলন ঘিরে এদিন অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে ৯৮ জন সাধারণ মানুষ ও পুলিশ নিহত হয়। লক্ষ্মীপুরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় এক কলেজ ছাত্র। আহত হয় অর্ধশতাধিক মানুষ। বেলা ১১টার দিকে জেলা শহরের উত্তর তেমুহনী থেকে ঝুমুর পর্যন্ত এলাকায় এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দুপুর ১২টার দিক থেকে সরকারের নির্দেশে মোবাইল অপারেটররা দেশ জুড়ে ফোর-জি নেটওয়ার্ক সেবা বন্ধ রাখে। ৫ অগস্ট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বেলা ২টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়।

সারা দেশের মধ্যে সংঘর্ষে সিরাজগঞ্জে পুলিশের ১৩ সদস্য সহ ২২ জন, রাজধানীতে ১১, ফেনীতে ৮, লক্ষ্মীপুরে ৮, নরসিংদীতে ৬, সিলেটে ৫, কিশোরগঞ্জে ৫, বগুড়ায় ৫, মাগুরায় ৪, রংপুরে ৪, পাবনায় ৩, মুন্সিগঞ্জে ৩, কুমিল্লায় পুলিশের সদস্য সহ ৩, শেরপুরে ৩, জয়পুরহাটে ২, ভোলায় ১, হবিগঞ্জে ১, ঢাকার কেরানিগঞ্জে ১, সাভারে ১, বরিশালে ১, কক্সবাজারে ১, গাজীপুরের শ্রীপুরে ১ জন নিহত হন। পুলিশের সদর দফতর থেকে এক বার্তায় জানানো হয়, ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক আন্দোলন ঘিরে ৪ অগস্ট দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২৭টি থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, রেঞ্জ অফিসে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় তিন শতাধিক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

ত্রিমুখি সংঘর্ষে প্রথম দিনেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে নীলফামারী। ভাঙচুর করা হয়েছে নীলফামারী-২ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূরের বাড়ি। এতে আহত হয় অন্তত ১২ জন। অসহযোগ আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতা এড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তিন দিনের (৫, ৬ ও ৭ অগস্ট) সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। বলা হয়, সাধারণ ছুটিকালীন সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, আধা- স্বায়ত্বশাসিত এবং বেসরকারি অফিসগুলো বন্ধ থাকবে। তবে জরুরি পরিষেবা যেমন বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, অন্যান্য জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস ও বন্দরগুলোর কার্যক্রম, পরিচ্ছন্নতা, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ডাকসেবা এবং এই সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত যানবাহন ও কর্মীরা এই ছুটির আওতার বাইরে থাকবেন। এছাড়া ঢাকা সহ সব বিভাগীয় সদর, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, শিল্পাঞ্চল, জেলা ও উপজেলা সদরের জন্য সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের পৃথক তিনটি বিজ্ঞপ্তিতে এদিন জানানো হয় সান্ধ্য আইন (কারফিউ) চলাকালে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারিক কার্যক্রম ও সব দফতর ও শাখা বন্ধ থাকবে। তবে প্রধান বিচারপতি জরুরি বিষয়ে প্রয়োজন সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। একই সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে ৫ অগস্ট থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগ ও দেশের সব অধস্তন আদালত বা ট্রাইব্যুনালের বিচারিক ও দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।

সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে অবিলম্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব- ‘রূপান্তরের রূপরেখা’- দেয় 'বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক'। প্রস্তাব অনুসারে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করবে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচির তারিখ ৬ অগস্টের পরিবর্তে ৫ অগস্ট সোমবার পালনের ঘোষণা দেয়। এতে সারা দেশ থেকে আন্দোলনকারীদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়। 

৩৫ জুলাইয়ের আগের রাত থেকেই সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে যেতে শুরু করে। লক্ষ থেকে কোটি ছাত্র–জনতা রাস্তায় নেমে এসে শহীদ মিনারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে; অন্যদিকে ঢাকার প্রায় ১১টা পয়েণ্টে অবস্থান নেয় ছাত্র–জনতা। পুলিশ, বিজিবি তার আগের রাত থেকেই নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করেছে। তারা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল, আর পারছিল না জনতার সাথে প্রতিরোধে। আওয়ামী লীগ সারা দেশে প্রতিহতের ঘোষণা দেয় কিন্তু শুধুমাত্র ঢাকায় মিরপুর ১০'এ আওয়ামী লীগের কর্মীরা অবস্থান নেয়। সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়, তারা জনগণের বিরুদ্ধে গুলি চালাতে অস্বীকার করে। সবখানেই আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করা শুরু হয়। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্য ভাষণের ঘোষণা দেন, ছাত্র–জনতার কাছে সময় চান। এরপর জানা যায়, শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা পালিয়ে গেছেন। হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। 

সেনাকুঞ্জে সেনাপ্রধান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে এই আশু পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের  সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে ছাত্ররা চায়, যেহেতু এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে তারা, তাদের পছন্দের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হতে হবে। তারা ডঃ মহঃ ইউনুসের নাম প্রস্তাব করে। বঙ্গভবনে ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি। এর আগে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করেন। সর্বসম্মতিতে ডঃ ইউনুসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। এই লেখা যখন লিখছি তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত প্রথিতযশা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সহিত আন্দোলনে যুক্ত দুইজন গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ক সহ ১৭ জনকে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মনোনয়ন করা হয়েছে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার এবং ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটনের জন্য যে রাষ্ট্র মেরামতের কর্মসূচি জারি করা হয়েছিল, এইভাবেই তার সূচনা হল।

বাংলাদেশের এই জুলাই বিপ্লবের ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিজয়ের নেতৃত্বে ছিল Gen-Z। বিখ্যাত এক গণমাধ্যম বাংলাদেশের এই আন্দোলনকে 'Gen-Z  মুভমেন্ট' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এই বিপ্লব একটা সামাজিক সমস্যা থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। আওয়ামী লীগের মতো একটা জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার তীব্র বাসনায় কীভাবে একটা হাইব্রিড ফ্যাসিস্ট রেজিমে পরিণত হয়ে  জনবিছিন্ন হয়ে যায়, তা আমরা দেখলাম। এই ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক পুরনো বয়ান ভেঙে দিয়েছে, এই আন্দোলন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আস্তিক-নাস্তিক সহ সকল রাজনৈতিক মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করেছে। যদিও এই আন্দোলন কখনই কোন বিশেষ রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ করেনি, আবার দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের মতো বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক ট্রাডিশনাল দলগুলো এই তরুণদের মন বুঝতে ব্যর্থ, তাই মাঠের রাজনীতিতে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক চিন্তার জন্ম নেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক গঠনগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই আন্দোলনকে ছাত্র-জনতার বিপ্লব বলা হলেও অন্যান্য দেশের বিপ্লবী সরকারের মতো তা গঠিত হয়নি। এখনও বর্তমান সংবিধান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আলোকেই তা নির্বাচিত। যেহেতু রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি এবং ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলি নিয়ে বিরূপতা আছে, তাই তার প্রভাবে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দীর্ঘমেয়াদী হলে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার কতটুকু শক্তিশালী হবে, না একটা বি-রাজনীতিকরণের আড়ালে সমাজের সুবিধাবাদী শ্রেণি আরও শক্তিশালী হবে, সে প্রশ্ন থেকে গেছে! 

কিন্তু ছাত্ররা সজাগ ও সক্রিয় রয়েছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে গণ অভ্যুত্থানে বাসাবো, খিলগাঁও, মান্ডা, মুগদা, কদমতলা, মাদারটেক, রাজারবাগ, সবুজবাগ, নন্দীপাড়া, মায়াকানন, আহমদবাদ এলাকার যে সব সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনগণ অংশ নিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে ৯ অগস্ট বিকালে বাসাবো বালুর মাঠে একটি ‘গণ অভ্যুত্থানকারী সাধারণ ছাত্র-জনতার অধিবেশন’ আয়োজন করা হয়। অধিবেশনে বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীরা কেমন ধরনের নতুন বাংলাদেশ চায় সেটি তুলে ধরে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বক্তব্য রাখেন আন্দোলনে শহীদ আশিকুল ইসলামের (১৬) বাবা রিকশাচালক ফরিদুল ইসলাম। এই অধিবেশন থেকে এলাকার সর্বজনের স্বার্থে গণ অভ্যুত্থানকারী সাধারণ শিক্ষার্থী জনতার পক্ষ থেকে ১০টি করণীয় দেওয়া হয়। করণীয়গুলো হল:

১) এলাকায় পুলিশ সহ কোনও গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি চলবে না। করলে সেটি সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা হবে;

২) এলাকায় ভিন্ন ধর্ম বা জাতির উপর কোনও হামলা চলবে না; 

৩) নারীদের উপর কোনও যৌন নির্যাতন, হয়রানি করা হবে না;

৪) এলাকায় কোনও সন্ত্রাস, লুটপাট কিংবা অস্ত্রের মহড়া চলবে না;

৫) কথা বলার জন্য কারও ওপর হামলা বা কাউকে হয়রানি, গ্রেফতার করা যাবে না। প্রত্যেকের কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে;

৬) জোর করে বা ভয় দেখিয়ে কাউকে কোনও মিছিল সমাবেশে নেওয়া যাবে না;

৭) ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার, হয়রানি, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন চলবে না;

৮) এলাকার রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরের চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে;

৯) কারও আত্মমর্যাদায় আঘাত করা চলবে না;

১০) কোনও স্থাপনা বা ভাস্কর্য ভাঙা চলবে না।

তারপরও বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য এই মুহূর্তে রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়োজন এই কারণে যে, আর কোনওদিন কোনও সরকার যাতে সংবিধান পরিবর্তন করে ফ্যাসিস্ট না হয়ে যায়। এই দেশের প্রতিটা মানুষ যাতে কোনও পরিচয় বা অর্থনৈতিক কারণে বৈষম্যের শিকার না হয়, যেন এক ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস শুধু হতাহত মানুষের ইতিহাস হিসেবে নয়, মানুষের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকুক। 

প্রথম পর্বের লিঙ্ক:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2024/08/blog-post_9.html


Friday 9 August 2024

দুনিয়া কাঁপানো কুড়ি দিন (১)

'স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি'

শাহেদ শুভো


প্রথম পর্ব

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিনির্মাণের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪'এর ছাত্র-জনতা বিপ্লব এক অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর জিন্নাহ'র উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে প্রথম যে প্রতিবাদের স্বর উঠেছিল-- শুরু হয়েছিল ৫২'এর ভাষা আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ৬৯'এর গণ-অভ্যুত্থান-- তা থেকেই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দেশের ছাত্ররা জনতার সাথে হাতে হাত মিলিয়েই পরিবর্তন এনেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ যখন পথ হারিয়েছে ছাত্র সমাজ পথ দেখিয়েছে এই দেশের মানুষদের। তাই বাংলাদেশের জনগণের কাছে ছাত্ররা সবসময় সত্য আর ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। 

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের দুঃশাসনে গুম, খুন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের নানা ধরনের বাহিনীর তৈরি করা নির্যাতন সেল, যেখানে বিরুদ্ধ মতের মানুষকে জঙ্গি সাজিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নানারকম নিপীড়নমুলক আইন, যেমন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ইত্যাদির তাণ্ডবে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অথচ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে মূল ভূমিকা রেখেছিল; এই দেশের সাধারণ নিপীড়িত মানুষের হাতেই আওয়ামী লীগের জন্ম। কিন্তু, এই রাজনৈতিক দলটাই তার মিত্র আমলাতন্ত্র এবং অলিগার্ক  ব্যবসায়ীদের স্বার্থে দেশব্যাপী এমন এক আধিপত্যকামী রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করে, যেখানে বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে গণ শৌচাগারগুলিকে পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়াটাই ছিল অন্যতম কর্মকাণ্ড। 

'কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন'-- এই শ্লোগান ছিল তাদের মূলমন্ত্র। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধংস করে দেওয়া, সংবিধানে সর্বজন গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল-- এইসব কাজের জন্য দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে ছিল উন্নয়ন তত্ত্বের নামে 'কুইক রেন্টাল'এর মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ খাত কর্পোরেটের হাতে দিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের নামে প্রায় দশ গুন ব্যয় দেখানো। অহেতুক বড় প্রকল্পের নামে বিদেশি ঋণ (চীনের মতো রাষ্ট্রের কাছে প্রচুর  ঋণ), উন্নয়ন কাঠামোর মধ্যে প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষকে অস্বীকার করা, দলের ব্যবসায়ী অলিগার্কদের বিদেশে অর্থ পাচার, এইসব বিষয় নিয়ে বিদেশের বিখ্যাত মিডিয়াগুলো সরব থাকলেও বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত গণমাধ্যম ছিল নিশ্চুপ। কারণ, ওইসব গণমাধ্যম ছিল আওয়ামী লীগের ওই অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। সমাজের কতিপয় সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ ছাড়া বাংলাদেশের গোটা জনগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তাই, কোটা সংস্কার আন্দোলন গোটা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের সৃষ্টি করা সকল বঞ্চিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এই আন্দোলন তাই ২০১৮ সালের নিছক কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পরিবর্তিত হয় ।

এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছিল, ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন আবার নতুনভাবে আলোচনায় ফিরে আসা। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। ঐ পরিপত্রের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সকল কোটা বাতিল করা হয়েছিল। শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের 'রাজাকারের নাতি-পুতি' হিসেবে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে, 'তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার' এবং 'চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার' স্লোগান দেয়। এর পরের দিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। 

আওয়ামী লীগের রাজনীতির সবচেয়ে ঘৃণ্য দিক ছিল কোনও বিষয়ে বিক্ষুব্ধ মানুষকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়া, যেমন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, রাজাকার, জামাত–শিবির, বিএনপি মৌলবাদী চক্র, নাশকতা ইত্যাদি। এই জন্য সকল শ্রেণির রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়াও নানারকম সামাজিক আন্দোলনেও মানুষ সম্পৃক্ত হতে ভয় পেত! আর সাথে তো তাদের নিজস্ব দলীয় বাহিনী আর প্রশাসনের নারকীয় অত্যাচার ছিলই। যার জন্য ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, ২০১৮ জুলাই থেকে অগস্টের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, যে আন্দোলন ছিল স্কুল-কলেজের ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত, সেখানেও  দমন-নিপীড়ন চালানো হয়েছিল। এই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকেও আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত দমনের দৃষ্টিতে দেখেছিল। তাই, দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের উপর রড, লাঠি, হকি স্টিক, রামদা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। একই সাথে পুলিশও লাঠি, রাবার বুলেট দিয়ে হামলা করে। প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরাও তাদের দিকে ইটের টুকরা ছোড়ে ও উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো পুরো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।  

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা ছিল তিন দফা দাবি নিয়ে --

     সরকারি চাকরিতে কার্যকর বর্তমান কোটা পদ্ধতি বাতিল;

     অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ন্যায্য হারে কোটা প্রদান;

     কোটার সর্বোচ্চ সীমা ৫ শতাংশে নামিয়ে সংসদে নতুন আইন পাশ করা। 

প্রথম থেকেই  অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের মতোই এই আন্দোলনের চরিত্র খুব নিরীহ ছিল। কিন্তু যেহেতু শেখ হাসিনা সরকার যে কোনও আন্দোলনকেই ভয় পেত, তাই নানারকম কৌশল অবলম্বন করে আন্দোলনকে মাঠেই দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ২৪'এর জুলাই থেকে অগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সরকার তার বাহিনীকে দিয়ে এমন এক নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে যা বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাসে সকল নির্মমতা ও বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিশু, সাধারণ মানুষ, কত যে নিহত ও আহত হয়েছেন হাসিনা সরকারের রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর দলীয় ক্যাডারদের হাতে তার হিসেব নেই। স্বাধীন বাংলাদেশ এক জেনোসাইড দেখল তার দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গঠিত বাহিনীর হাতে। এখন পর্যন্ত হতাহতের পরিমাণ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, গ্রেফতার অগণিত। হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়েছে, এমনকি জাতিসংঘপ্রাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে নিরস্ত্র মানুষের উপর। ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট করে গণ গ্রেফতার চালানো, এলাকাগুলোতে ব্লক রেইড, বাসায় বাসায় ছাত্র আছে কিনা খুঁজতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের নিয়ে পুলিশ-বিজেবি'র অভিযান, যেন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের ছাত্রসমাজকে। বাংলাদেশ কখনও দেখেনি, আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্র লীগ, শ্রমিক লীগ, যুব লীগের ক্যাডার বাহিনী, যারা কিনা হেলমেট বাহিনী হিসেবে এই দেশে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত, তাদের সাথে মিলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দেশের নিরস্ত্র ছাত্র–জনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আর সহ্য করতে পারেনি, তারা ছাত্রদের পাশে এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র লীগকে প্রতিহত করে, তখন অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এই সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়; তারা হল ভ্যাকেট করানোর জন্য পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ইতিহাসের বরবর্তম হামলা চালায়, যে শিক্ষার্থীরা তাদের সন্তান সমতুল্য। সরকারি বাহিনীর নিপীড়নের সাথে আন্দোলনে যুক্ত হওয়া শিক্ষার্থী আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যারা কিনা বাংলাদেশের একটা এলিট সোসাইটিকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং কথিত আছে তারা রাজনীতি এবং সমাজ বিমুখ, তারাও এই নিপীড়ন না মেনে নিতে পেরে সংগঠিত হয়। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বিচারে গুলি চালায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী। এর মধ্যে হাসিনা সরকারের গেস্টাপো বাহিনীর অন্যতম কুচক্রী কর্মকর্তা ডি বি হারুন আন্দোলনরত  শিক্ষার্থীদের অন্যতম সমন্বয়কদের আটক করে নিয়ে আসে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ছিলেন। আন্দোলনের চাপ তীব্র হওয়ায় ডিবি তাদের গ্রেফতার করতে অস্বীকার করে। 'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্ক' নামক সংগঠনের প্রতিনিধিরা ডিবি কার্যালয়ে উপস্থিত নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কদের অবস্থা জানতে যায়, কিন্তু ডিবি কার্যালয় জানায়, গ্রেফতার নয়, তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে হেফাজতে রাখা হয়েছে। বাইরে থাকা অন্য সমন্বয়করা আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখে, আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে চলে; তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোকে সক্রিয় ভাবে মাঠের আন্দোলনে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের নির্যাতনে আক্রান্ত প্রবাসী অনেক মানবাধিকার কর্মী, আন্তর্জাতিক সাংবাদিক এই আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করেছে। 

বাহিরে থাকা সমন্বয়করা অনলাইনে ৯ দফা দাবির ভিত্তিতে আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ করে-- 

১) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে;

২) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার এবং সন্ত্রাসী কর্তৃক ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেশে ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে পদত্যাগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শহীদ শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের 'ড্রাগ এডিক্ট' বলে কুরুচিপূর্ণ ও মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে এবং আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতকে পদত্যাগ করতে হবে;

৩) ঢাকা সহ যত জায়গায় ছাত্র-নাগরিক শহিদ হয়েছে সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে;

৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ক্যাম্পাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা হয়েছে, প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টরদের পদত্যাগ করতে হবে;

৫) যে পুলিশ-বিজিবি-রাব ও সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করেছে, ছাত্র লীগ-যুব লীগ সহ যে সব সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছে এবং যে সব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদেরকে নিরস্ত্র ছাত্র-নাগরিকদের ওপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে, তাদেরকে আটক করে হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে;

৬) দেশব্যাপী যে সকল ছাত্র-নাগরিক শহীদ এবং আহত হয়েছে তাদের পরিবারকে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে;

৭) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র লীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠন সহ সব দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দ্রুততম সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছাত্র সংসদ কার্যকর করতে হবে;

৮) অবিলম্বে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলগুলো খুলে দিতে হবে। কারফিউ তুলে নিয়ে সারা দেশের সমস্ত ক্যাম্পাসে মোতায়েনকৃত পুলিশ, রাব, বিজিবি, সোয়াট এবং আর্মি তুলে নিতে হবে;

৯) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কোনও ধরনের হয়রানি করা হবে না এই মর্মে অঙ্গীকার করতে হবে। ইতোমধ্যে গণ গ্রেফতার ও পুলিশি হয়রানির শিকার সমন্বয়কবৃন্দ ও ছাত্র-নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে ও সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। 

এর সাথে ছাত্ররা আরও কর্মসূচি দেয়। যেহেতু ঘোষিত কর্মসূচির দিন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ১৫ অগস্ট হত্যা দিবস, তাই আওয়ামী লিগ গোটা অগস্ট মাস জুড়ে শোক কর্মসূচি পালন করত এবং বিরোধী মত সহ অনেক সময় কোনও সাধারণ সংগঠন বা সাংস্কৃতিক সংগঠনকে কোনও প্রকার অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হত না। কিন্তু ছাত্ররা জাতীয় শোক দিবসকে প্রত্যাখান করে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয়। সাথে সাথে দেশকে স্থিতিশীল করতে নয় দফা দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানায়। অভূতপুর্ব ঘটনা ঘটে-- বাংলাদেশ সহ বাইরের বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মেটার প্রোফাইল লাল রঙের আকার ধারণ করে, দ্রোহের মন্ত্রে গোটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ একদিকে, বিপরীতে আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তরা। পরবর্তীতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজ এই নয় দফা দাবিতে ৩ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল করে ও ৪ আগস্ট থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষেরা ভয় কাটিয়ে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে থাকে। বেশ কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী হাইকোর্টে রিট পিটিশন করে আইনশৃঙ্খলার নামে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালানোর বিষয়ে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে। হাইকোর্ট শুনানি না করলেও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে অবজারভেশন দেয় ডিবি অফিসে বন্দী ছাত্রনেতাদের বিষয়ে। মানবাধিকার সুজনের সিনিয়র সিটিজনরা ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেন ডিবি অফিস থেকে সমন্বয়কদের ছেড়ে  দেওয়ার জন্য, সরকার সকল শ্রেণির মানুষের চাপে কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ে, ডিবি হারুনকে বদলি করা হয় ও ছাত্র নেতাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সরকারের বিরুদ্ধে চাপ শুরু হয়, জাতিসংঘের কড়া বিবৃতি, জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানের বিবৃতি, যুক্তরাষ্ট্র স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ইউরোপিয় ইউনিয়ন সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। দিশেহারা হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকার। এই গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে হাসিনাশাহী সহ তাঁর গেস্টাপো প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

ক্রমশ...

দ্বিতীয় ও শেষ পর্বের লিঙ্ক:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2024/08/blog-post_10.html


Friday 2 August 2024

যমালয়ে রেল দফতর!

'কোন ল্যাজে মারি তায়'

মালবিকা মিত্র



সবাই জানত, সংখ্যালঘু সরকার জোট সরকার, ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলায় না। বাজেট তো যেন শরিকি বাজেট। মন্ত্রিসভা, স্পিকার, স্পেশাল প্যাকেজ, এসব নিয়েই বুঝি টানাটানি শুরু হবে। বাঙালরা বলে আড়াই হাতি গামছা আব্রু ঢাকে তো ইজ্জত ঢাকে না। কিন্তু সরকার বেশ স্বস্তিতেই মন্ত্রিসভা করল, স্পিকার করল, বাজেটও করল, হাবেভাবেও যেন 'চারশো পার সরকার'। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, উপরওয়ালার মার দুনিয়ার বার। যখন যা দেয় ছপ্পড় ভরকে দেয়-- আশীর্বাদও, অভিশাপও। 

কথাটা কেন উঠল বলি। নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন শুরু হল নিট-ইউজি পরীক্ষা দুর্নীতি দিয়ে। এই সরকারের যাত্রার একেবারে গোড়ায় গলদ। আরেকটু ঠিক শব্দ চয়ন করলে বলতে হয় 'বিসমিল্লাহ গলদ'। কিন্তু  কথায় বলে, কুকুরের পেটে নাকি ঘি সয় না, তাই বিসমিল্লাহ শব্দটা সবার কানে ঠিকঠাক ধরা পড়ে না। অতএব, ওই শব্দটা বাদ রাখলাম । শুধু তো নিট-ইউজি নয়, এক্সিট পোলকে কেন্দ্র করে শেয়ার বাজারের উত্থান-পতন এবং স্বয়ং মোদীজী ও অমিত শাহজীর শেয়ার নিয়ে দেশের জনগণকে পরামর্শ দান। সে এক বিরাট স্ক্যাম। অর্থাৎ, একটা নয়, দু' দুটো ঘোটালা নিয়ে এ সরকারের যাত্রা শুরু। তারপর এই সরকারের বয়স সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু হল একের পর এক রেল দুর্ঘটনার সিরিজ। লোকে বলছে, দফতরটাই 'রেল দুর্ঘটনা দফতর' হয়ে গেছে। কেউ বলছে সিরিয়াল কিলার। 

অশ্বিনী বৈষ্ণবের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। এখানে ওখানে নতুন গাড়ির উদ্বোধন আছে, মোদিজীর স্তুতি করা আছে নিয়মিতভাবে। সংসদে বন্দেভারত, বুলেট ট্রেন, আরও অতিরিক্ত গতির গল্প শোনাচ্ছেন। কিন্তু মানুষের চরম দুর্গতি সম্পর্কে মন্ত্রী অবশ্য বলেছেন 'ছোটখাটো কিছু ঘটনা' নিয়ে বিরোধীরা অহেতুক জলঘোলা করছেন। বেশ গলার জোরেই সংসদে কথাটা বলেছেন। আর তার সঙ্গে নিজেই জলটা ঘোলা করার জন্য বলেছেন, ১২ লক্ষ রেল কর্মচারী অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। তাদের কোথায় হাততালি দেবেন, থালি বাজাবেন, তা না, নিন্দা করছেন। প্রতিদিন দু' কোটি মানুষ রেলযাত্রা করে, সেই যাত্রীদের কথা ভাবুন, তাদেরকে এভাবে দুর্ঘটনার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত করবেন না। কী অসাধারণ যুক্তির বিন্যাস!! 

বিরোধীরা তো ঠিক এই কথাটাই বলছেন যে, প্রতিদিন দু' কোটি মানুষের রেলযাত্রাকে সুরক্ষিত করুন। তাদের ও তাদের পরিবারবর্গের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটানো বন্ধ করুন। বিরোধীরা এই কথাই বলছেন যে, রেল কর্মচারীদের অসহায় অবস্থা। যাত্রী সুরক্ষা, নিরাপত্তার বন্দোবস্তগুলো নেই। অথচ, তাঁরাই মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভের সামনে পড়ছেন। লক্ষ লক্ষ শূন্য পদ। এক একজনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত ডিউটি দিতে হচ্ছে। এর ফলে মানসিক ভাবে রেল কর্মীরা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছেন। একজন রেলের ড্রাইভারকে বলেছিলাম, প্রায়ই আপনাদের গাড়ি স্টেশন ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে যায়। তারপর সেই গাড়িকে আবার পিছিয়ে আনতে হয়। এরকম হলে তো বড় দুর্ঘটনা এড়াতে পারবেন না। সেই ড্রাইভার উত্তরে বলেছিলেন, আমাদের পরপর কিছু নিয়ম আছে-- কখন ফার্স্ট ব্রেক টিপবেন, কখন সেকেন্ড ব্রেক এবং কখন ফাইনাল ব্রেক। এখন ধরুন, ফাইনাল ব্রেকটা যখন দিলাম সেটা কাজ করল না, তখন আমাকে আল্টিমেট যে ব্রেক, এয়ার ব্রেক দিতে হবে। সেটা দিতে গেলে মাঝে দু-এক সেকেন্ডের সময় লাগবে। সেই সময়ে ট্রেনটা তো গতিশীল, কিছুটা এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ, একটা ব্রেক কাজ না করা এবং নিশ্চিত ব্রেকের সাহায্য নেওয়া-- এই দুইয়ের মাঝে যে সময়, সেই সময়ে গাড়িটা বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়। এটা প্ল্যাটফর্মে গাড়ি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে যেমন সমস্যা, একইরকম কোনও বিপদের সম্মুখীন হয়েও ঘটতে পারে, অর্থাৎ, গাড়ি দাঁড়ালো না। তখন ব্রেকটা কাজ করল না। 

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন ব্রেক কাজ করে না। ড্রাইভার বলেছিলেন, চাকার সঙ্গে ব্রেকের ঘর্ষণ এবং এই ঘর্ষণজনিত ক্ষয়কে নিয়মিত চেক করতে হয়। ব্রেক পাল্টাতে হয়। লক্ষ করলেই দেখা যায়, ব্রেক আর চাকার ঘর্ষণে অনেক আগুনের ফুলকি ছুটতে থাকে। এটা যদি অনেকদিন ধরে হয় তাহলে তো ব্রেক আর চাকার মধ্যে সমন্বয় ঘটবে না। এ জন্যই গাড়ির নিয়মিত চেকআপ প্রয়োজন। গাড়িগুলোকে দুটি বা তিনটি ট্রিপের পর বিশ্রাম দিতে হয়। কিন্তু সে কাজটা হয় না। কারণ, তার জন্য চাই অনেক বেশি সংখ্যক কোচ। তবেই তো কোচগুলি বিশ্রাম পাবে। এতে নিরাপত্তা আছে, কিন্তু লোক-দেখানো নাম কেনা চটকদারি নেই। চটকদারি আছে নিত্যনতুন আরও দ্রুতগতি আরও আধুনিক মডেল গাড়ি কেনায়। দ্রুতগতির গাড়ি কেনা মানে বিদেশ থেকে নতুন মডেলের কোচ আনা। সরকারি ক্রয় মানেই তো ভিন্নতর গল্প। তার ওপর এই দ্রুত গতির গাড়ি চালাতে গেলে তার যাত্রাপথটাকে সবসময়ই ক্লিয়ার ও বাধাহীন রাখতে হবে। ফলে, কোনও গাড়িকে কোথাও সরিয়ে বন্দেভারতকে আগে জায়গা দিতে হবে। কর্তার গাড়ি যাবার জন্য যেমন অন্যান্য সব গাড়িকে রেড সিগন্যাল দেওয়া হয় রাস্তায়, অনেকটা সেই রকম। এভাবেই রেল যাত্রায় সমস্যার পাহাড়। কেবলই আধুনিক প্রযুক্তির আমদানি, দু' বছর আগের চালু করা কলাকৌশল বাতিল করা। নিত্যদিন শুনতে পাই গাড়ির সিগন্যাল, পয়েন্ট, এসব আধুনিক করার জন্য কত কত গাড়ি বাতিল করা হয়। অবশ্যই দুরন্ত বা বন্দেভারত বাতিল হয় না, বাতিল হয় সাধারণের ব্যবহার্য ট্রেন। 

রেলমন্ত্রী অশ্বিনী কত সহজে বলতে পারলেন 'ছোটখাটো কিছু ঘটনা'। তাঁর মন্ত্রীত্বের ৬-৭ সপ্তাহে চারটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এগুলি তাঁর কাছে 'ছোটখাটো ঘটনা'। আসলে সমস্যা হল, রেলমন্ত্রী তো আর রেলে চাপেন না, তিনি বিমানে যাতায়াত করেন। এখানেই যত গোলমাল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান না। শিক্ষামন্ত্রীর পরিবার সরকারি স্কুল-কলেজে পাঠ নেয় না। শুধু তো মন্ত্রীরা নন, সেপাই, সান্ত্রী, আমলা কেউ এগুলির ভোক্তা নন। এগুলোর ভোক্তারা হলেন, বেলা বারোটার বাজারে পোকায় কাটা বেগুন আর পচা আলু যারা কিনতে যান বা সে সামর্থ্যও যাদের নেই, তাঁরা। অতএব, বলাই বাহুল্য, এগুলো খুবই 'ছোটখাটো কিছু ঘটনা'। 

রেলমন্ত্রী বললেন, আগের সরকার দুর্ঘটনা প্রতিরোধ বা যাত্রী সুরক্ষায় কোনও ব্যবস্থা করেনি। আসলে, নিরন্তর মোদি বন্দনা ও মোদী ভজনা করে অশ্বিনী বৈষ্ণব ভুলেই গেছেন নিজেকে। আগের সরকারের রেলমন্ত্রীও যে ছিলেন তিনিই! বিগত ১০ বছর ধরে সরকারে বিজেপি, বরং এ বছর এনডিএ। অশ্বিনী বৈষ্ণব ঠিক কী বলতে চাইছেন? দোষটা এনডিএ সরকারের নয়, দোষটা পূর্ববর্তী বিজেপি বা মোদি সরকারের? 

অতি সম্প্রতি প্রবল বর্ষণে দিল্লিতে ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত সংসদ ভবনের ছাদ থেকে সেন্ট্রাল লবিতে জল চুঁইয়ে পড়েছে। জাত বানিয়া যাকে বলে আর কি! কোথাও পয়সা খাওয়া ছাড়ে না। মন্দিরেও খায় সংসদ ভবনেও খায়। 'না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা'। এ সরকারের তৃতীয় দফায় একেই সরকার খোঁড়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলছে, তায় একদিকে নতুন নির্মাণ থেকে জল চুঁয়ে পড়ে, অন্যদিকে শিক্ষা দফতরের স্ক্যাম, রেল দুর্ঘটনা দফতর সৃষ্ট লাগাতার আতঙ্ক, এগজিট পোল স্ক্যাম-- সবে মিলে এ যাত্রা বড়ই কঠিন ও সঙ্গীন। 

এই সমস্যার মধ্যেই বিরাজ করছে আমাদের হুকোমুখো হ্যাংলা। যার মুখে কোনও হাসি নাই। নাই তার কারণ, একটার পর একটা সংকট ও উভয় সংকট তার সামনে এখন সটান হাজির। 'আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি...'। অথবা,

'বসে যদি ডাইনে,  লেখে মোর আইনে—

           এই ল্যাজে মাছি মারি ত্রস্ত;

বামে যদি বসে তাও,        নহি আমি পিছপাও,

           এই ল্যাজে আছে তার অস্ত্র।

যদি দেখি কোনো পাজি বসে ঠিক মাঝামাঝি

           কি যে করি ভেবে নাহি পাই রে—

ভেবে দেখি একি দায়        কোন্ ল্যাজে মারি তায়

            দুটি বৈ ল্যাজ মোর নাই রে।'