Sunday 8 November 2020

গুরুত্ব কমছে নেতাদের

লাভ জিহাদের মৌলবাদ

শ্রেয়ণ 


উপমহাদেশে ‘লাভ জিহাদ’ কথাটি গত কয়েক বছরে বেশ প্রচলিত হয়ে উঠেছে। যদিও ভারতের সংবিধান এবং আইনব্যবস্থায় কথাটির কোনও বৈধতা নেই। সংসদে এক বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডিও তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে তাকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চেষ্টা কম করছে না হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। অসমের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ঘোষণা করেছেন, ২০২১ সালে বিজেপি আবার বিধানসভায় জিতলে লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই শুরু হবে। লাভ জিহাদির শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। হরিয়ানাতেও আইন আনার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজ। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা কড়া পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছেন। যোগী আদিত্যনাথও পিছিয়ে নেই। হুংকার দিয়েছেন, লাভ জিহাদে অভিযুক্তদের রাম নাম সত্য করে দেওয়া হবে। এমনকি জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রধান রেখা শর্মা সম্প্রতি অভিযোগ করেন, মহারাষ্ট্রে লাভ জিহাদের সংখ্যা বাড়ছে। 

মজার কথা হল, কোরান তো দূরের কথা, মুসলমান ধর্মগুরুদের বক্তব্যেও ‘লাভ জিহাদ’এর কোনও সংজ্ঞা মেলে না। মিলবেই বা কী করে? ইসলাম ধর্মে ‘জিহাদ’ কথাটির তাৎপর্য অনেক গভীর। আল্লাহ্-র পথে সংগ্রামকে বলা হয় জিহাদ। এই সংগ্রাম নিজের ভেতরে এবং বাইরে চলে। অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোও জিহাদের একটি অংশ। যুদ্ধ এবং জিহাদ সমার্থক নয়। নির্বিচারে কিংবা অন্যায়ভাবে মানুষ খুনের ওপর কোরানে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অমুসলমানকে জোর করে মুসলমানে পরিণত করাও ইসলাম সমর্থন করে না। তবে মৌলবাদী সব জায়গাতেই রয়েছে। মুসলমানদের মধ্যেও ধর্মের নামে প্রচুর লোক অধর্মের ব্যবসা চালায়। রক্তে স্নান করেই তাদের তৃপ্তি। হিন্দুধর্মের মধ্যেও তেমন লোক বিরল নয়। তা বলে গোটা সম্প্রদায়কে মৌলবাদী বলে দাগানো যায় কি?

পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ অবশ্য এটাই করে এসেছে। সেই ক্রুসেডের সময়ে ইউরোপে শুরু হয়েছিল ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো। আধুনিক যুগে প্রগতিশীলতার মুখোশ পড়ে সারা বিশ্বে সেই কাজ চলছে। সাম্রাজ্যবাদের গর্ভেই সংঘ পরিবারের জন্ম, তা সবাই জানি। ‘লাভ জিহাদ’, ‘অনুপ্রবেশ জিহাদ’-এর মতো শব্দবন্ধ সংঘীদেরই বানানো। আরএসএস নেতা এমজি বৈদ্য লাভ জিহাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, মুসলমান যুবকেরা যখন হিন্দু মেয়েকে ভালোবাসার টোপ দেখিয়ে বিয়ে করে তাঁকে ধর্মান্তরিত করে, তখন মৌলবিরা খুশি হন৷ কিন্তু বিপরীতটা হলেই তাঁরা ক্ষেপে যান৷

প্রশ্ন হল, উল্টোটা কি হয় না? না হলে, হিন্দু মেয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করলে সংঘীরা তুলকালাম করে কেন? ‘লাভ জিহাদ’-এর অভিযোগ আনে কেন? এমনকি ‘তানিষ্ক’-এর বিজ্ঞাপনকে ঘিরে যে হৈ-হল্লা করলেন খেমচাঁদ শর্মা থেকে কঙ্গনা রানাওয়াত এবং তাঁদের অনুগামীরা, টাটার মতো এত বড় পুঁজিপতি সংস্থা নিজেদের বিজ্ঞাপন সরাতে বাধ্য হল, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অবকাশ থেকেই যায়। 

তবে ‘লাভ জিহাদ’-এর ভীতি অনেক চেষ্টা করেও সংঘীরা উপমহাদেশের বাইরে ছড়াতে পারেনি। পশ্চিমি দুনিয়া ইসলাম বিদ্বেষের আঁতুড়ঘর হলেও ইস্যুটাকে খায়নি সেখানকার মানুষ। উপমহাদেশের শিখ এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কেউ কেউ অবশ্য ফাঁদে পা দিয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতেই কেরলের এক গির্জা থেকে বলা হয়, লাভ জিহাদ একটি বাস্তব সমস্যা। খ্রিস্টান মহিলাদের লোভ দেখিয়ে বিয়ে করে সন্ত্রাসের কাজে লাগাচ্ছে মুসলমান যুবকেরা – এমন অভিযোগ তোলা হয়।

মৌলবাদকে জল-হাওয়া দিয়ে পুষ্ট করছে বিশ্বায়ন। ইতিহাস লক্ষ করলেই দেখা যায়, নয়া-উদারবাদের যুগে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ক্রমশ বাড়ছে। এর সূচনা যদিও হয়েছিল আধুনিক উপনিবেশ বিস্তারের আদিকাল থেকে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং সমকালীন প্রযুক্তি এখন হিংসা নির্মাণ করে। মুসলমানদের কিছু অংশে যেমন মৌলবাদ দ্রুত ছড়াচ্ছে, তেমনি হিন্দু-শিখ-খ্রিস্টানদের মধ্যেও। একটি সম্প্রদায়ের মৌলবাদকে প্রতিরোধ করতে অন্য সম্প্রদায়ে মৌলবাদ বাড়ে – এই বোগাস তত্ত্ব যদি আউড়ে যাই, তাহলে আসল সমস্যাই নজর এড়িয়ে যাবে। 

মধ্যযুগে ইসলামের কোনও কেন্দ্র ছিল না। ভারতের কোনও কোনও সুলতান আরবের খলিফার অনুমোদন নিতেন কেবলই নামে, বাস্তবে নিজেদের মতোই চলতেন। মুঘলরা কোনও খলিফাকেই মানতেন না। পৃথিবীর নানা জায়গায় মুসলমানদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ছিল, তাই নিয়ে আনন্দে ছিলেন তাঁরা। আধুনিক যুগে কিছু পশ্চিমি পণ্ডিত প্রচার করতে লাগলেন, আরবের সংস্কৃতিই বিশুদ্ধ ইসলামের সংস্কৃতি। সেখান থেকেই শুরু হল গণ্ডগোল। হিন্দুধর্মেরও বিশুদ্ধ রূপ খুঁজতে শুরু করেছিলেন প্রাচ্যবাদী ইউরোপীয়রা। বিশুদ্ধতায় ফেরার আহ্বান থেকেই আসে মৌলবাদ এবং বিদ্বেষ। 

ভিন ধর্মে বিয়ে আমাদের উপমহাদেশে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। জোর করে ভালোবাসা আটকানো যায় না। সাধারণ জনগণও তা বোঝেন। সমস্যা হয় মোড়লদের নিয়ে। তবে নতুন যুগ আসছে। গুরুত্ব কমছে নেতাদের। বাড়ছে আম-আদমির সক্রিয়তা। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে তার পূর্বাভাস আমরা দেখলাম। সেরকম চলতে থাকলে মৌলবাদকেও আমরা ক্রমশ পরাজিত করতে পারব।

 

1 comment: