Friday 6 November 2020

অভূতপূর্ব!

বাইডেন জিতছে কিন্তু টালমাটাল আমেরিকা

সোমনাথ গুহ

 

আমেরিকায় ইলেক্টোরাল ভোটের ওপরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হারজিত নির্ভর করে। ২০১৬'র নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্রাট দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের থেকে ৩০ লক্ষ পপুলার ভোট কম পেয়েছিলেন কিন্তু ৫৪০টা ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে ৩০৪টা পেয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে হোয়াইট হাউস দখল করে নিয়েছিলেন। এই মুহুর্তে জো বাইডেন ২৫৩টা ভোট পেয়ে ম্যাজিক নাম্বারের থেকে মাত্র ১৭ ভোট দূরে। পপুলার ভোটেও তিনি এগিয়ে। এখন অবধি তাঁর ঝুলিতে ৭.৩৬ কোটি ভোট যা ২০০৮ সালে বারাক ওবামার রেকর্ড ভোট প্রাপ্তিকেও (৬.৯৪ কোটি) ছাড়িয়ে গেছে। বাইডেনের জয় আসন্ন। চারটি রাজ্যে এখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে- পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, অ্যারিজোনা এবং নেভাদা। 

পেনসিলভানিয়ার কথা ধরা যাক। এই রাজ্যটির ২০টা ইলেক্টোরাল ভোট আছে। এখানে ট্রাম্প গণনার শুরুতে ৭ লক্ষ ভোটে এগিয়ে ছিলেন যেটা কমতে কমতে শুক্রবার সকালে ৪৮৮৫৪ ভোটে নেমে এসেছে। এখনও প্রায় আড়াই লক্ষ ভোট গোনা বাকি। বিশেষজ্ঞদের হিসাবে বাইডেন বাকি ভোটের ৬২ শতাংশ পেলেই জিতে যাবেন। এই টেলিকাস্টের সময় চার গুচ্ছ ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে বাইডেন যথাক্রমে ৬৬, ৭২, ৭৯, ৮৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, অর্থাৎ, বাকি ভোটে তার প্রাপ্তির হার উত্তরোত্তর বাড়ছে। সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে চমকপ্রদ কিছু না হলে বাইডেন পেনসিলভানিয়া জিতছেন এবং একই সাথে নির্বাচনও জিতছেন এবং চার বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হচ্ছেন। প্রায় একই চিত্র জর্জিয়ায় যেখানে ট্রাম্পের ২ লক্ষের লিড কমে এসে দাঁড়িয়েছে ২৪৯৭। আরও প্রায় ১৫০০০ ভোট গোনা বাকি। এখানেও বাকি ভোট যে হারে জেতা প্রয়োজন বাইডেন তার থেকে বেশি শতাংশ পাচ্ছেন, সুতরাং, এখানে তাঁর জেতা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। জর্জিয়ার ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা ১৬ যা তাকে জয়ের একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে।

মেইল-ভোটিং হচ্ছে এবারে আমেরিকার নির্বাচনে গেমচেঞ্জার। মেইল বা অ্যাবসেন্টি ভোটিং আমাদের পোস্টাল ভোটিংয়ের মতো। যাদের সশরীরে বুথে যাওয়ার অসুবিধা আছে তারা কারণ জানিয়ে এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারেন। অনেক রাজ্যে কোনও কারণ জানানোরও প্রয়োজন নেই, কোনও ব্যক্তি আবেদন করলেই মেইল-ভোটিং করতে পারেন। এছাড়াও পেনসিলভানিয়ার মতো রাজ্যে নির্বাচনের নির্ধারিত দিনের পরে তিন দিন অবধি যা ভোট ডাকে আসবে, তাতে যদি ডাকঘরের স্ট্যাম্পে ইলেকশন ডে’র তারিখ দেওয়া থাকে, তা বৈধ বলে গণ্য হবে। অতিমারির কারণে এবার এই ধরনের ভোটদান অভুতপূর্ব ভাবে বেড়ে গেছে। সংখ্যাটা বলা হচ্ছে অন্তত এক কোটি। এর ফলে ভোটদানের হার এবার আমেরিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ: ৬৭ শতাংশ। 

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোভিড১৯ পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন। মারির কারণে যে সব নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল নিজের সমর্থকদের সরাসরি প্ররোচনা করেছেন সেগুলো অমান্য করার জন্য। রিপাবলিকানরা তাঁদের নেতাকেই অনুসরণ করেছেন, কোভিডকে গুরুত্ব দেননি এবং বৃহৎ অংশ ৩রা নভেম্বর বুথে গিয়ে সশরীরে ভোট দিয়েছেন। এর বিপরীতে ডেমোক্রেটরা মারিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, যাবতীয় সুরক্ষা বিধি মেনে চলেছেন এবং বাড়ি থেকে ভোট দেওয়াই শ্রেয় মনে করেছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ, ডেমোক্রেট নেতৃবৃন্দ কৌশলগত ভাবে তাঁদের সমর্থকদের কোনও ঝুঁকি না নিয়ে বাড়ি থেকে ভোট দিতে উৎসাহিত করেছেন। তাঁরা জানেন, এর ফলে বেশি সংখ্যক ভোট পড়বে এবং তার অধিকাংশ তাঁদের পক্ষেই যাবে। গণনার সময় বুথের ভোট আগে গোনা হয়েছে এবং ট্রাম্প তরতর করে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু যখন ডাকে আসা ভোটের গণনা শুরু হয়েছে একই গতিতে তাঁর লিড কমে গেছে। ট্রাম্প এটা জানতেন এবং তাই প্রথম থেকেই এই ডাক ভোটের বিরোধিতা করেছেন এতটাই যে উনি ডাক বিভাগের তহবিলের পাওনা টাকা আটকে দিয়েছেন। ওনার যুক্তি হচ্ছে, এতে অনেক ভোট এসে পৌঁছয় না, কারচুপির অনেক সুযোগ থাকে। তাই দেয়াল লিখন পরিষ্কার হয়ে যাবার পরেও তিনি বলছেন ডেমোক্রেটরা নির্বাচন চুরি করে নিয়েছে। আমেরিকার মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। বুক ঠুকে বলছেন বৈধ ভোটে আমিই জিতেছি, এখন যা গোনা হচ্ছে সব অবৈধ ও দেরিতে আসা ভোট, অতএব স্টপ কাউন্টিং। একই আওয়াজ তুলে তাঁর দলবল রাস্তায় নেমে পড়েছে, কিছু জায়গায় ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছে। তিনি আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। পেনসিলভানিয়ার উপরে উল্লেখিত নিয়ম বাতিল করার জন্য তিনি কোর্টে আবেদন করেছিলেন, রাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আর্জি খারিজ করে দিয়েছে। এবার উইসকনসিন, মিশিগান, নেভাদা সহ অন্তত পাঁচটি রাজ্যে পুনর্গণনার জন্য তিনি আদালতে যাচ্ছেন।

মজাটা হচ্ছে পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়াতে ডেমোক্রেটরা মেইল-ভোট বৃদ্ধির কারণে যে সুবিধা পেয়েছেন, রিপাবলিকানরা অ্যারিজোনাতে একই সুবিধা পেয়েছে। এই রাজ্যে বাইডেন গণনার শুরুতে ২ লক্ষ ভোটে এগিয়ে ছিলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেটা কমে দাঁড়ায় ৭০০০০, রাতে ৫৮০০০, শুক্রবার সকালে ৪৬২৫৭। এখনও প্রায় আড়াই লক্ষ ভোট গোনা বাকি। এখানে গণনায় কিন্তু ট্রাম্প উচ্ছ্বসিত, কাউন্টিং বন্ধ করতে বলছেন না। এটাই ট্রাম্প- স্ববিরোধিতায় ভরপুর, বেপরোয়া, খামখেয়ালি, হঠকারি, কথাবার্তায় বেলাগাম, অশালীন, বন্ধু রাষ্ট্রকেও তুচ্ছ কারণে কটু কথা বলতে যার একটুও বাধে না। চিন্তা করুন হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন না দিলে প্রত্যাঘাত করা হবে বলে ভারতকে কী ভাবে হুমকি দিয়েছেন; কিংবা হেলায় ভারতের বাতাস নোংরা বলে দেন, জলবায়ু সংকটের জন্য অন্যান্য দেশের সাথে ভারতকেও একই ভাবে দায়ী করেন। এসবই ‘হাউদি মোদি’, ‘নমস্কার ট্রাম্প’ হওয়া সত্ত্বেও।

আর এখানেই হচ্ছে এবারের আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আসল গল্প। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো এতো অননুমেয় এক চরিত্র কোন যাদুবলে এত ভোট পান! তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৬.৯৬ কোটি যা দেশের ইতিহাসে কোনও ‘পরাজিত’ প্রার্থীর রেকর্ড ভোট। ২০১৬'র নির্বাচনে ৬ কোটির আশেপাশে ভোট পেয়ে তিনি বাজিমাত করে দিয়েছিলেন। এবার তার চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছেন। মিডিয়া, প্রায় সব নির্বাচনী সমীক্ষা, এক্সিট পোল তাঁর সম্ভাবনা তো প্রায় উড়িয়ে দিয়েছিল। নির্বাচনের আড়াই দিন পরেও এখনও যে বাইডেন অফিসিয়ালি ম্যাজিক সংখ্যায় পৌঁছতে পারেননি তার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রচুর ব্যালট ডাকে আসার কারণে গণনায় দেরি হওয়া। একই সাথে আরও একটি কারণ, অন্তত সাত-আটটি রাজ্যে ট্রাম্পের নাছোড় লড়াই। অতিমারি তো বাইডেনের পক্ষে শাপে বর হয়েছে, না হলে তিনি হেরেও যেতে পারতেন। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করেছেন। অবৈধ অভিবাসন রোধ করেছেন, এমনকি বৈধ অভিবাসনও সীমিত করে দিয়েছেন। বিপুল সংখ্যক ভোটারদের তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে তাঁদের চাকরি, ব্যবসা, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই অভিবাসন-বিরোধী পলিসি জরুরি। বাইরে থেকে এসে লোকে এখানে টাকা কামাবে আর আমার দেশের মানুষ চাকরি পাবে না, এটা চলতে পারে না। একই কারণে প্যারিসের জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে এসেছেন, টাকা দেওয়া বন্ধ করেছেন; হু'কেও পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ ওই একটাই- এসবে আমেরিকার কোনও লাভ নেই। 'আমি আমেরিকার রক্ষাকর্তা' এটা বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যা বহু মানুষকে স্পষ্টতই প্রভাবিত করেছে।

নানা রকম আইনি জটিলতার কারণে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হতে হয়তো দেরি হবে কিন্তু হতেই পারে নতুন জমানা শুরু হওয়ার পরেও ট্রাম্প ঘরে ফিরে যাবেন না। উনি রাজনীতিতে একইরকম ভাবে সক্রিয় থেকে যাবেন। এমনকি তিনি ২০২৪ সালে আবারও প্রার্থী হতে পারেন। উনি নতুন প্রেসিডেন্টের প্রতিটি পদক্ষেপ অন্তর্ঘাত করার চেষ্টা করবেন। এছাড়া সেনেটে যদি রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় (এই মুহুর্তে ৪৭:৪৭, মোট সদস্য ১০০) তাহলে বাইডেনকে তাঁর নিজস্ব কর্মসূচি চালু করতে প্রভূত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। আগামী চার বছর আমেরিকায় একটা টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।

2 comments:

  1. তথ্য সমৃদ্ধ ভাল লেখা ! বাহ্ !

    ReplyDelete
  2. লেখাটা তথ্য সমৃদ্ধ আর সাবলীল তবে ভালো কিনা জানা নেই! ট্রাম্প খারাপ লোক আর এই মুহূর্তের বন্ধুকে পরও মুহূর্তে হাইড্রোক্লোরোকুইন নিয়ে হুমকি দে আর ট্রাম্প হারলে ভারতে ওনার কাউন্টার পার্ট মোদীর মুখ পুড়বে একথা ভেবে আমাদের বেশ আনন্দও লাগে! লেখাটার মধ্যে কথাটা প্রচ্ছন্ন হলেও ঢুকে আছে। হ্যাঁ অবশ্যই আনন্দ পাই কিন্তু কোথায় যেনো নিজেকে ছাগলের তৃতীয় সন্তান বলেও মনে হয়! এটা ভাববার কোনো কারন ঘটে নি যে বাইডেন জিতলে আকাশ থেকে বোমার বদলে লাল গোলাপের পাপড়ি ঝরে পরবে! প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং লীগ of নেশনস এর মাস্টারমাইন্ড উইড্রো উইলসন ডেমোক্র্যাট, পরমাণু বোমা দিয়ে আক্রমণে পলিসি মেকার রুজভেল্ট ডেমোক্র্যাট, হিরোশিমা নাগাসাকির কান্ডারী ট্রুম্যান ডেমোক্র্যাট, নর্থ কোরিয়া যুদ্ধের কান্ডারী ডেমোক্র্যাট, ভিয়েতনাম যুদ্ধের হোতা বরিস জনসন ডেমোক্র্যাট, ওপেক এবং পশ্চিম এসিয়ার উপর খবদারির কান্ডারী বিল ক্লিনটন ডেমোক্র্যাট , আজকের বাইডেন ও ডেমোক্র্যাট!
    প্রিয় কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর নিল জামা গায়ে লাল জামা গায়ে মনে পড়ছে!
    কোথায় যেনো আমরা বরই অবুঝ!

    ReplyDelete